Connect with us

বাংলাদেশ

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার

Published

on

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার

বাংলাদেশ; এক সুবিশাল ব-দ্বীপ। শতাব্দীর পর শতাব্দী উজানে থেকে ভেসে আসা পলিমাটির আস্তরণে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই দেশ। যুগে যুগে রাজনৈতিক পট ও বিদেশী শাসকের পরিবর্তন অনুসারে এদেশের সংস্কৃতির ধারাও নতুন মোড় নিয়েছে; সাথে পরিবর্তন ঘটেছে এর অভ্যন্তরীণ রূপ ও অভিব্যক্তির। নানান সমঝোতা ও মিথষ্ক্রিয়ার কৌশলে টিকে থেকে প্রবাহিত হওয়া বাঙ্গালি সংস্কৃতির বিকাশের যে গতিপথ তা সত্যিই লক্ষ্যনীয়।বাঙ্গালি সংস্কৃতির এই অভাবনীয় গতিধারায় অনেক উপাদান এখনোও পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। তার মধ্যে মনোহরী ও কৌতূহলউদ্দীপক হিসেবে ধরা দিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র যদি তুলে ধরা যায় তাহলে সেটি হবে অবাক করে দেবার মতো।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার

বাংলাদেশে প্রায় ২,৫০০ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এখন পর্যন্ত ৪৫২ টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম, লালবাগের কেল্লা, শঙ্খনিধি রাজঘর, পানাম সিটি, শালবন বিহার, ময়নামতি, মহেস্থানগর, মেঘালিথিক মনুমেন্টস, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, কান্তনগর মন্দির, ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং সর্বশেষ নিদর্শন নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর, যা কিনা দ্বিতীয় নগর সভ্যতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই সকল স্থানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন হাতিয়ার, রক্ষাকবচ, পুঁতি, মৃৎপাত্র, সিলমোহর, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য, পোড়ামাটির শিল্প, শঙ্খ, বিভিন্ন ধাতব ও কাঠের শিল্পকর্ম- প্রতিটি নিদর্শনেই ফুটে উঠে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক অনিন্দ্য ঐতিহ্যের ছাপ।

সুপ্রাচীনকাল থেকে মৃৎপাত্র-নির্মাণ এক বিশেষ শিল্পকর্ম হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। প্রাচীন বাংলার ঘরে ঘরে দৈনন্দিন তৈজসপত্র হিসেবে এর ব্যবহার ছিলো। আর বর্তমানে একে মূলত শখের বস্তু হিসেবে আমরা ঘরে রাখি। নবোপলীয় স্থায়ী বসতির যুগে এর সূত্রপাত ঘটে। মানব-সভ্যতার সূচনার এক অন্যতম মাইলফলক বলা হয় এই মৃৎপাত্রকে।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
মহেস্থানগড়, ছবি :সংগৃহীত

মহেস্থানগড়,  উয়ারী-বটেশ্বর, শালবন বিহার, পাহাড়পুর, তমলুক, পাণ্ডুরাজার ঢিবি, গোবিন্দ ভিটা, ভাসুবিহার, রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ি, মঙ্গলকোট প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিছু দুষ্পাপ্য মৃৎপাত্র যার মধ্যে আছে- নবযুক্ত মৃৎপাত্র, উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, কালো প্রলেপযুক্ত মৃৎপাত্র, রুলেটেড মৃৎপাত্র ইত্যাদি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারাবাহিতা ও শিল্পকর্মের ইতিহাসে মৃৎপাত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

হয়তো বাংলাদেশের নদীমাতৃক বৈশিষ্ট্য এবং পলিমাটির অফুরান সম্ভারের জন্যই প্রায় প্রতিটি প্রত্নস্থলে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দেখা মেলেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের দিক থেকে এরপর বলা যায় স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যশিল্পের কথা। ঐতিহাসিকযুগে বাংলা স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে যে কতটা সমৃদ্ধ ছিলো তা বর্তমানে সংরক্ষিত মসজিদ-মন্দিরগুলো দেখলেই বোঝা যায়।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির ,ছবি : সংগৃহীত

প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে প্রাচীন স্থাপত্যের অধিকাংশই ধর্মীয় স্থাপত্য- স্তূপ, মসজিদ, মন্দির, বিহার ইত্যাদি। উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে লালমাটির দেয়ালে তৈরী স্থাপত্যগুলো ঐতিহ্যবাহী এবং এতে প্রযুক্তিগত উন্নতিরও চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য ঐতিহ্যের ইতিহাসে- জৈন মন্দির, সত্যপির ভিটা, ভোজবিহার, শালবন বিহার, রাজা হরিশচন্দ্রের প্রাসাদ, নিবেদন মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, কান্তজী মন্দির ইত্যাদি অন্যতম। 

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
প্রাচীন বাংলার ভাষ্কর্য শিল্প , ছবি : সংগৃহীত

ভাষ্কর্য শিল্পের কথা বললে বলা যায় যে, বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার বছরব্যাপী বিকশিত ভাষ্কর্য শিল্পের আদি-পর্বের পোড়ামাটির নিদর্শনগুলো কোনো না কোনো মন্দির বা বিহারেরই অংশ ছিল। বেশিরভাগ ভাষ্কর্যই ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক তথ্য বা ধ্যান-ধারনায় সংযোজিত শিল্পীর স্বাধীন সত্তাকে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বরেন্দ্র এলাকা থেকে সর্বাধিক ভাষ্কর্যের নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। গজলক্ষী, পার্বতী, সূর্য, মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বর, বুদ্ধ ইত্যাদি ভাষ্কর্য শিল্প এদের মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
বাংলার পোড়ামাটির শিল্প, ছবি :সংগৃহীত জতক

এই উপমহাদেশে মানব-সভ্যতার প্রাচীনতম শিল্পগুলোর মধ্যে আরেকটি শিল্পের প্রাণবন্ত অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়; যার নাম পোড়ামাটির শিল্প। বাংলাদেশের অসংখ্য প্রত্নস্থল  ও স্থাপত্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পোড়ামাটির নিদর্শন পাওয়া গেছে। বাংলায় মৃৎপাত্র এবং পোড়ামাটির শিল্পের প্রসারের কারন প্রায় একই- কাদামাটির সহজলভ্যতা। এই উপমহাদেশে সেই নব্যপ্রস্তরযুগ থেকেই পোড়ামাটির শিল্প পরিলক্ষিত হয়। বাংলার যে সকল প্রত্নস্থলে পোড়ামাটির শিল্পের প্রাচীন নিদর্শনগুলো পাওয়া গেছে তার মধ্যে – বানগড়, মহেস্থানগড়, তমলুক, মঙ্গলকোট, চন্দ্রকেতুগড় এবং উয়ারী-বটেশ্বর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
কান্তজির মন্দিরের পোড়ামাটির ফলক, ছবি : সংগৃহীত

এসব স্থানে পাওয়া গেছে নৃত্য ভঙ্গিমায় কবন্ধ পুরুষ ভাষ্কর্য, ক্ষুদ্রাকৃতি প্রাণী, মনুষ্য নিদর্শন, পোড়ামাটির মস্তক এবং কালাতীত ধরনের নারী ভাষ্কর্য। এই সকল পোড়ামাটির শিল্পগুলোর মধ্যে এক উচ্চমানের নান্দনিক সৌন্দর্য রয়েছে। উপমহাদেশের পোড়ামাটির শিল্প  বাহ্যিক সৌন্দর্য সৃষ্টিতে নতুন চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। বলা যায় আভিজাত্যের এক নান্দনিক ছাপ বয়ে এনেছিল। অথচ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং নির্মাতাদের অবহেলার ফলাফল হিসেবে বাংলার গর্বিত ঐতিহ্য পোড়ামাটির শিল্প বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হয়েছিল। বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী জিনিস হলো লিপিতাত্ত্বিক নিদর্শন ও সিলমোহর।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
ব্রাক্ষ্মীলিপি, ছবি :সংগৃহীত

প্রাচীনকালে হাতির দাঁতের ফলক, গিরিপাত্র, কাঠস্তম্ভ, পোড়ামাটি বা কাদামাটি, কচ্ছপের খোল, শঙ্খ, ছোটবড় পাথর বা ধাতব ফলকে প্রশস্তিমূলক নানা শ্লোক উৎকীর্ণ করা হতো। ব্রাক্ষ্মীলিপির নিদর্শনের নাম আমরা সবাই হয়তো শুনেছি যেটি কিনা বাংলার প্রত্নস্থল মহেস্থানগড়ে পাওয়া গিয়েছে। মহেস্থানগড় উৎখননে ব্রাক্ষ্মী অক্ষরে একটি মৃৎ সিলের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যেটি কিনা আদি- ঐতিহাসিক গুপ্তপূর্বকালের বলে ধারনা করা হয়।

বাংলায় যে লিপিগুলোর নিদর্শন পাওয়া গেছে তার মধ্যে গুপ্ত যুগের  তাম্রশাসনের প্রাধান্য রয়েছে এবং গুপ্ত শৈলির প্রভাব ব্যাপক। গুনাইঘর তাম্রশাসন  বাংলার প্রথম রাজসিক ভূমি-দানপত্র। প্রাচীনকালের এইসব তাম্রশাসনে গুপ্ত ঐতিহ্যের প্রতিফলন লক্ষনীয় এছাড়াও নিবিড়ভাবে স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের সমাজ চিত্রের পরিবর্তন লক্ষনীয়।

এই সকল নিদর্শন পারতই আমাদের ঐতিহ্যকে করেছে বহুগুনে সমৃদ্ধ। এছাড়াও প্রাচীনকালে মানুষ বৈরী প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে যে সকল উদ্ভোদনী প্রক্রিয়ায় যানবাহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা করতো তাকেও বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে লিপ্ত করা যায়। পানিপথে যাতায়াতের জন্য বজরা, পাতেলা, পাসওয়ার; স্থলপথে গরু, ঘোড়া, মহিষের গাড়ি, হাতির যান এবং সুপ্রাচীনকাল থেকেই অন্যতম প্রধান বাহন পালকি-  প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অনন্য আবেগীয় নিদর্শন।

এরপর সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে মানুষ প্রস্তর নির্ভর জীবন-যাপন অতিক্রম করে  তামা, লোহা ও ব্রোঞ্চের ব্যবহার আবিষ্কার করে। এইসময় থেকে ধাতব উপকরণের কার্যকারিতা ও ব্যবহার, তৈরী কারুশিল্প সভ্যতার ইতিহাসে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে। তামা, লোহা ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে নিত্য-ব্যবহার্য বস্তু থেকে শুরু করে বিলাস সামগ্রী, অলংকার ইত্যাদি তৈরী করা হতো।

বাংলাদেশ: প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার
প্রিাচীন বাংলার ডোকরা শিল্প , ছবি :সংগৃহীত

ধাতব উপকরণে তৈরী কারুশিল্প শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বর্তমানে প্রাত্যহিক জীবনধারায় মানুষের সাথে এক অতি সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এছাড়াও প্রাচীনকাল থেকে বাংলার মানুষের কাছে সৌকর্য, আভিজাত্য ও নান্দনিকতার অভিব্যক্তি  হিসেবে শুভ্র শঙ্খ, চিত্রকলা, পটচিত্র ধারা, কাঠ খোদাই বা ছাপাই ছবি ইত্যাদি এক একটি অপ্রতিম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পারতপক্ষে বলা যায়, এই নিদর্শনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার প্রাচীন বানিজ্য, প্রযুক্তি, সৌন্দর্যবোধ, আবেগ, অনুভূতি, সৃজনশীলতা ও বিশ্বাস। এই সকল নিদর্শনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ যেন সত্যিই প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অমেয় আধার বৈশিষ্ট্যে পূর্ণতা লাভ করেছে।

নুসরাত জাহানশিক্ষার্থী

– ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ৪র্থ বর্ষ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

বিংশশতকের নব্বয়ের দশকে জন্ম হয়েছিলো যমুনা নদীর শহর টাঙ্গাইলে এবং স্থায়ী ঠিকানা ভৈরব নদীর শহর যশোরে। জলের ধারে জন্ম, জলেই স্থায়িত্ব; এদিক থেকে বলা যায় জলের জাতক। বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহর ঘুরে প্রবাহের মত বেরে ওঠা। । ছোট গল্প-সাহিত্য বোঝার পর থেকেই কথাসাহিত্য এবং সংগ্রামী মূলক লেখা পড়ার প্রতি ঝোকটা বেশি । জীবনের প্রতিটি ছোট ছোট মূহূর্ত নিয়েই সাজানো যায় কবিতা। আবার একগুচ্ছ ছোটবড় মূহূর্ত আর কল্পনা মিলিয়ে রূপ নেয় উপন্যাস। এইবোধ থেকেই হাতে কলম ধরা। ভীষণ কল্পনাপ্রবণ জীবন, বাস্তবের পাশাপাশি কল্পনায় প্রিয় মানুষদের সাথে কথোপকথনে সময় কাটাতে পছন্দ বেশি। বাতাসে কবিতার ঘ্রাণে কবিতাপ্রেমী হয়ে সময়ের সাথে কল্পনা এবং বাস্তবের মাঝামাঝি অনুভূতি নিয়েই আপনমনে জন্ম নিয়েছে কবিতার বুননশিল্প। প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কবিতাগ্রন্থ "একজন পাণ্ডুলিপি বলছি"। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে পড়াশুনা, লেখালেখির নেশা ধমনীর শিরা ও উপশিরায়। প্রকৃতিপ্রেম ও কবিতার মিশেলেই একজন সাদামাটা মানুষ।

বাংলাদেশ

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

Published

on

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

 

পূর্বের অবস্থা যা ই হোক না কেন এটার বর্তমান অবস্থা যে খুব সোচনীয় তা আমরা আঁচ করতে পারছি খুব ভালো ভাবে এই আলোচনার মাধ্যমে। আবার আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে চিনি শিল্পের এই মন্দাবস্থা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জনসাধারণের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যদিও এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী মূলত শিল্পের সাথে জড়িত নীতিনির্ধারকরা।

আমরা জেনেছি যে বাংলাদেশে সরকারী ১৫ ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২ টি চিনিকল রয়েছে, এবং ৫ টি চিনি পরোশোধনাগার রয়েছে। এই শিল্পের সাথে ১২.৫ লক্ষ পরিবারের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আখ চাষ এবং চিনি আহরণের হার খুবই কম। দেশে প্রতি একরে আখ উৎপাদন হয় মাত্র ১৫ মেট্রিক টন যা হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ৭০ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার চিনি আহরিত হয় মাত্র ৭.৪ % যা অস্ট্রেলিয়া ১৫.৭ % পর্যন্ত হয়ে থাকে।

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

চিনিশিল্প

চিনি শিল্পে ধস মোটামুটি শুরু হয়েছে ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে। অথচ ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে কিন্তু বাংলাদেশে মোট আখ উৎপাদিত হয়েছিলো ২০ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন হয়েছিলো ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬২ মেট্রিকটন। যা প্রায় ৮.৭৭ %। কিন্তু ২০০০-০১ মৌসুমে সেটা কমে হয় ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬ মেট্রিকটন এবং চিনি আহরিত হয় ৯৮ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। যা কমে হয় ৭.১১ %।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তন,তুলনামূলক কম সূর্যালোক ঘণ্টা, আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষু জাতের অভাব, অপরিপক্ক আখ মাড়াই, পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কমতে থাকে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন।

২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন হটাৎ এমন খাপছাড়া কেন হয়ে যাওয়ার পেছনে যে কয়েকটি কারণ মূখ্যভাবে দায়ী তা হলো ‘ চাষীরা আখ বিক্রির টাকা সময় মতো না পাওয়া, আখের বদলে অন্য ফসল চাষে তুলনামূলক বেশী লাভ, চিনি মিল গুলোর কাছে চাষীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আটকে থাকা, পাওয়ার ক্রাশারের আগমন, এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল আচরণ না করা।

চিনি উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে রয়েছে মানসন্মত আখের অভাব, মাটি ও আবর্জনা যুক্ত আখ মিলে সরবরাহ, ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি আখ মাড়াই করে রস ড্রেনে ফেলা, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্লাটফর্মে ও মাঠে আখ শুকানো, আখ থেকে রস ঠিকমত বের না করা, সর্বপরি দক্ষ জনবলের অভাবে চিনি আহরণে ব্যাপক গড়মিল তৈরি হচ্ছে।

শুধু চিনি উৎপাদনেই লোকশান হচ্ছে না। অদক্ষ জনবল, পরিকল্পনার অভাব, নিম্নমানের আখ চাষ, ক্রয় বিক্রয়ে দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় খরচ, ব্যায়ের খাত বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অনিয়ম যেন বাসা বেঁধে বসেছে চিনিকলগুলিতে।ফলে কিছু কিছু কর্মকর্তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও চিনিকলগুলির এবং শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

চিনি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানিকারী পণ্য হতে পারে এবং কতগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করতে পারে, যেমনঃ কারখানাগুলির আধুনিকীকরণ, পূর্ণমাত্রায় আখ উৎপাদন, সহজশর্তে আখচাষীদের ঋণ প্রদান, রিফাইনারিগুলিকে পূর্ণমাত্রায় চিনি উৎপাদনের জন্য অনুমতি প্রদান, আখ চাষে ও চিনি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার, অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ, মিল কর্মচারীদের অপকর্ম থেকে বিরত রাখা এবং চিনিকলগুলি থেকে উৎপাদিত উপজাত পণ্যের (by-products) সঠিক ও ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা।

লিখেছেনঃ
মারুফুজ্জামান
৪৬ তম আবর্তন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

বাংলাদেশ

জাতির জনকের শাসনকালঃ দেশনীতি ও বিদেশনীতি

Published

on

Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahman
আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে দেখেছি, যিনি জ্ঞানে ও নেতৃত্বে হিমালয় সম” -বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এই বাণী ই জাতির জনক সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতে কৌতূহলী করে তোলবে যেকোনো মুজিবপ্রেমী ব্যাক্তি কে। বঙ্গবন্ধু সোনার  বাংলা  গরে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পান নি, কিন্তু সদ্যস্বাধীন দেশটি নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতেই আজকে আমাদের এই দেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রিয় নেতা পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার কাঠামো প্রবর্তন করেন। আজকের এই দিনে স্বল্পসময়ে জাতির জনকের গৃহীত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক  বিভিন্ন পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র নীতি সহ সংক্ষেপে তাঁর  শাসন কাল আলোকপাত করা হলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রিয় এই নেতা খুব অল্প সময়েই আলোচিত উঠেন তাঁর বন্ধুত্বপূর্ন আচরণ,বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী  সিদ্ধান্ত দক্ষতার মাধ্যমে। এই স্বল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, ওআাইসি সহ ১২৬ দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নেতার সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছিলেন। তাছাড়াও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বেসামরিক  মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ, অবাঙালিদের রেখে যাওয়া শিল্প কারখানায় দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা,স্বীকৃতি ও সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের ক্রোধের ফল সরূপ সৃষ্ট  ভয়াবহতা অনুধাবন, পাকিস্তানের শাসন,নির্যাতনের বিরুদ্ধ আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে। সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রিয় বাংলা কে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হবে হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাইতো তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সাথে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব স্থাপন করেন বিপরীত দিকে তাঁর  গৃহীত কৌশলপূর্ণ নীতির কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী চায়না আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী হয়ে উঠেছে।মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার বিরোধী ভূমিকা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ১ অক্টোবর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড  আর ফোর্ডের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে মিটিং করেন।১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ আন্দোলন এর শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে ন্যামের সদস্য রাষ্ট্রদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক কৌশল সফল হয়। ফলে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের মাধ্যমে প্রিয় দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে নিজস্ব স্থান তৈরি করে নেয়।এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু যা সারা বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in United Nations নব্যস্বাধীন দেশ বিধায় তখনো রাষ্ট্রের সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিলো নানাবিধ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান। অভ্যন্তরে ছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের মিত্রদের বিচারের দাবী অন্যদিকে দেশের স্বীকৃতি অর্জনে পাকিস্তানের মিত্র দেশগুলোর বিরোধিতা। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবী মনোভাব জাগ্রত করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতা অর্জনের ১ বছরের মধ্যে ই আওয়ামী লীগের ছাত্র সমাজের একাংশ গড়ে তোলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)। দ্বিধা বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি গুলো দেশে এনজিও এর মাধ্যমে সহযোগিতা  কার্যক্রম চালু রাখে যা পরবর্তী তে দেশে প্রধান শক্তি হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের ওপর ছিল দেশ পুনর্গঠনের সামগ্রিক চাপ কিন্তু কাজের ফলাফল ছিল ধীর।  এই সময়ে অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ ওঠে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রবল হয়ে উঠে যা উগ্রপন্থী যুব নেতৃত্ব  ও মধপ্যন্থী মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ে।এ পরিস্থিতিতে সরকার পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তি দান করে ও আওয়ামীপন্থী বিশ্বাসীদের নিয়ে উগ্র পন্থীদের দমনে রক্ষী বাহিনী গঠন করে। নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র থেকে আমরা জানি,প্রতিটি ক্রিয়ার ই সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে,তেমন জাতির জনকের শাসন কালেরও আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে, তাই বলে একটি রাষ্ট্রের জন্ম যার হাত ধরে তাঁর পরিবারের এমন নৃশংস হত্যাকান্ড কখনো গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman family photo 15 august দেশগঠনে অকৃত্রিম প্রচেষ্টা কারী এই রাষ্টনায়কই কতিপয় সেনাবাহিনীর অফিসারের রোষের কবলে পড়ে প্রিয় পুত্র শেখ রাসেল,২ পুত্রবধূ, সকল বিপদে সাহস প্রদানকারী স্ত্রী সহ পরিবারের আরো সদস্য নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। প্রিয় বাংলার শোষিত জনগণের কল্যাণে আত্ননিয়োগকারী রাষ্ট্র নায়ক,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ তম মৃত্যুবার্ষিক,তাঁর প্রতি জানাই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

বাংলাদেশ

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী

Published

on

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
১.লেখার শুরুতে একটা হাসির গল্প বলে নিতে চাই। করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও চালু রাখতে হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এক ব্যাংক কর্মকর্তা আর গ্রাহকের কথোপকথন হচ্ছে। গ্রাহকটি ব্যাংকে মোটামুটি অংকের টাকা তুলতে এসেছেন। কর্মকর্তাটি গ্রাহককে প্রশ্ন করলেন সবকিছু বন্ধের মধ্যে তিনি কেন টাকাগুলো তুলছেন? গ্রাহক জানালেন, লকডাউনে বাসায় বসে থাকতে গিয়ে বিরক্ত তিনি। বাইরের পরিবেশ দেখতে আর বিরক্তি কাটাতে ব্যাংকে চলে এসেছেন । হাতে চেক বই দেখে রাস্তায় পুলিশও তাকে কিছু বলেন নি। কর্মকর্তাটি গ্রাহকের এমন বক্তব্যে হতবাক হয়ে গেলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে টাকাগুলো গুনে নিয়ে দ্রুত সেই লোকটিকে বাড়ি চলে যেতে বললেন কর্মকর্তাটি।লোকটি আরো অবাক করে দিয়ে তাকে জানালেন, গোনার দরকার নেই। টাকাগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই কাল এসে জমা দিয়ে যাবেন তিনি। ব্যাংকগুলো খোলা রাখায় লকডাউনের বিরক্তি কাটাতে সুবিধা হয়েছে তার। ব্যাংকেও আসা হয় বাইরের পরিস্থিতিও নিজ চোখে দেখা যায়! এই গল্পটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমার নজরে আসে। সারাদেশের কার্যত লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক খুলে রাখায় ক্ষুব্ধ ব্যাংকিং খাতে কাজ করা মানুষেরা। তাদেরই একজন গল্পটি ছড়িয়ে দিয়েছে৷ আর তাঁর কল্যাণেই এমন নিদারুণ হাস্যরসের গল্পটি জানতে পেলাম। আশা করছি গল্পটি মিথ্যা হবে। বৈশ্বিক বিপর্যয়ের এই সময়টাতে কোনো মানুষ গল্পের গ্রাহকের মতো কাজ করবে না বলে বিশ্বাস করতে চাই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আরেকটা ভিডিও দেখে এই জাতিকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। একজন পুলিশ সদস্য একা একা মাইকিং করে এই করোনা বিপর্যয়ের সময়টাতে সবাইকে ঘরে থাকার আহবান জানাচ্ছেন। আশেপাশের সবাই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সে কেনো হাতে লাঠি নিয়ে আসে নি! লাঠি না নিয়ে কেন সে মানুষকে বোঝাতে আসলো সেটা অনেকের মনে দুঃখ দিয়েছে। আসলেই কি আমরা এমন জাতি যাদের পিঠে লাঠির আঘাত না পড়লে নিজেদের ভালোটুকু বুঝবো না?
জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী

২.

আমি যে মুহুর্তে এই লেখাটা লিখছি তখন সারাবিশ্বে করোনায় মারা গেছেন এক লক্ষ মানুষ। পুরো পৃথিবীটাই এক প্রকার ঘরে বন্দী অবস্থায় আছে। এই অবস্থায় সবাই মিলে ঘরে থাকার ফলে প্রকৃতির ওপর প্রভাব পড়েছে অসাধারণ। বাতাসে দূষণ কমে গেছে, আশপাশ পরিষ্কার হয়েছে। দীর্ঘদিন পর অনেকটা দূর থেকে নাকি হিমালয় দেখা যাচ্ছে, কক্সবাজারে ডলফিন ফিরে এসেছে। নেটিজেনরা ( ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অংশ হওয়া মানুষদের এই শব্দ দিয়ে অভিহিত করা হয়) মজা করে বলছে, প্রকৃতির এত কিছু ফিরে আসার মধ্যে মানুষের জীবনে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক/প্রমিকারাও হয়তো ফিরে আসবে! তবে জীবনে পুরনো প্রেমিক/প্রেমিকারা ফিরে না আসলেও সমাজের পুরনো একদল মানুষ কিন্তু ঠিকই ফিরে এসেছে। তারা হচ্ছেন ত্রাণের চাল চোর সম্প্রদায়। এই মুহুর্তে দেশের মোট করোনা শনাক্ত মানুষের চেয়ে সরকারি ত্রাণের চাল চুরি করা মানুষের সংখ্যা বেশি। সারাবিশ্ব যেখানে মৃত্যুভয়ে থমকে গেছে সেখানে আমাদের চাল চোরেরা পুরনো প্রতাপে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার বাংলাদেশে৷ কোভিন ১৯ শনাক্ত মানুষের চেয়ে নিশ্চিত ভাবে এই রোগে মৃতের সংখ্যার তারতম্য খুব বেশি নয়৷ এমন একটা ভয়ানক সময়ে দাঁড়িয়ে এইসব চাল চোরদের জন্য আমার কেন জানি মায়া হয়! স্রষ্টা না করুক করোনা ভাইরাসেই যদি চাল চোরেরা মারা যায় তবে চুরিকরা এসব চালগুলোর জন্য তাদের আফসোস হবে। মৃত্যুর পরেও তাদের আফসোসের কথা ভেবেই আমার খারাপ লাগছে।

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
৩.

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও আমার বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করলো। সেই ভিডিওতে দেখলাম এক ইউপি সদস্য করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ নিতে আসা কিছু বেরোজগার মহিলার ওপর চোটপাট করছে। তাঁর চোটপাট এবং হুংকারের কারণটা জেনে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আহারহীন মানুষদের তিনি জোর গলায় শাসাচ্ছেন এবং ত্রাণ দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। কারণ ত্রাণ সহযোগিতা তিনি তাদেরকেই করবেন যারা নাকি তার নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী! ভিডিওটা দেখে মর্মাহত হলাম। মনে মনে বিশ্বাস করতে চাইলাম আমার দেখাটা যেন ভুল হয়। করোনা ভাইরাস কোন দল চেনে না। সে চেনে মানব দেহ। তাঁর সংস্পর্শে যে শরীরটা আসবে তাকেই সে আক্রমণ করবে৷ করোনার আক্রমণ থেকে যদি নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয় তবে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে৷ কিন্তু ঘরে খাবার না দিয়ে তো আপনি তাদের ঘরে রাখতে পারবেন না। কারণ কষ্টকর সত্য হচ্ছে এই যে পেটের ক্ষুধা করোনা ভয় মানে না। সারাবিশ্বকে থামিয়ে দিলেও করোনা মানুষের পেটের ক্ষুধা থামাতে পারে নি। আর সেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রথমে বাইরে বের হবে আয়হীন মানুষ, তারপর বের হবে নিম্ন আয়ের মানুষ, তারপর স্বল্প আয়ের। এভাবে করে ঘরে যাদের খাবার কিছুই থাকবে না তারা সবাই রাস্তায় বের হয়ে যাবে৷ আর বাস্তবতা হচ্ছে এই করোনা আক্রমণ থেকে নিজে বাঁচতে হলে অন্যদের নিয়েও বাঁচতে হবে। কারণ এই ভাইরাসটি কেবলমাত্র তখনই থামবে যখন সংক্রমণের জন্য একটি মানবদেহও আর সে খুঁজে পাবে না। আর মানবদেহগুলোকে যদি ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে হয় তবে সেগুলোর পেটের ক্ষুধার সংস্থান করাও আবশ্যক। মানুষদের খাবারের দুঃশ্চিন্তা নির্মুল করে বাইরের সমাজ থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সেই চিন্তা দূর করার পদক্ষেপে যদি অতিউৎসাহী এসব ইউপি সদস্যদের উপস্থিতি বেশি হয়ে দাঁড়ায় তখন কিন্তু গন্ডগোল।যারা কিনা মনে করে গণমানুষের মতামত নিয়ে তারা নিজেদের সরকার বাহাদুর নাম রেখেছে। সেই বাহাদুরকে কিন্তু এইসব চ্যালাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বাহাদুরি দেখাতে হবে। বাহাদুরি দেখাতে হবে চাল চোরদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রেও। নয়তো দলকানা ইউপি সদস্য আর চাল চোর চেয়ারম্যানরা মিলে জনগণ নামক বস্তুটিকে খেপিয়ে তুলবে।শুনেছি ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর আইয়ুব খানের শাসন’ দুটোই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বস্তু ছিল। বাঙালী খেপে গিয়ে কিন্তু আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলো।

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
৪.

পৃথিবীব্যাপী করোনাক্রান্ত লাখ খানেক মৃত্যুর মধ্যে চিকিৎসা সেবায় জড়িত অনেকেও কিন্তু মারা গেছেন৷ করোনা বিপর্যয়কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ধরে প্রতিটি দেশের মৃত চিকিৎসা পেশার মানুষদেরকে দেওয়া হচ্ছে শহীদের খেতাব। কারণ সবাই জেনে গেছে এই যুদ্ধে সেনাপতি – সৈনিক যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়ে বিরোধী শিবিরে গুলি চালানো কেউ নয়। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে দিনরাত মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া লোকগুলোই এই যুদ্ধে আমাদের বড় শক্তি। এদেশে প্রথমেই যখন করোনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো তখনই আক্রান্ত হওয়া শুরু করলো একে একে ডাক্তারেরা। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের চিকিৎসা সেবায় বিশেষ জায়গা দখল করে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সাংবাদিকতার সূত্রে আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো এই সময়ে কেমন সেবা দিচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। যে ভয়াবহ তথ্য জানতে পারলাম সেটা উল্লেখ করতে চাচ্ছি। করোনায় শুরুতেই ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এদিকটায় এসেছিলেন৷ লকডাউনের শুরু হলে কিছু কিছু সরকারি হাসপাতাল সহ অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক গুলোয় রোগী দেখা সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়টাতে অধিকাংশ অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে। মৌসুম পরিবর্তনের কারণে রোগীদের বেশিরভাগই ছিল সর্দি-জ্বর, কাশি- গলাব্যথা সহ করোনার অন্যান্য উপসর্গ সমৃদ্ধ। এ পর্যন্ত ঘটনা সাধারণ চোখে এক প্রকার ঠিকই ছিল। কিন্তু ভয়াবহ কথাটা জানা গেলো এরপরে। আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই লেখাটার সময় পর্যন্ত কোনো ধরনের জীবাণুরোধী ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) পান নি। সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় তারা রোগী দেখেছেন। এমন চিত্র আমি মনে করি সারাদেশের। সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বড় চিকিৎসক সবাইকেই একটু বেশি নিরাপত্তায় রাখতে হবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। যদিও তাদের কিছু অংশের কার্যক্রম নিয়ে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবুও এটা ভুলবাবর কোন জো নেই যে স্রষ্টার পর আমাদের এই বিপদে রক্ষাকর্তা তারাই।বেঁচে থাকলে চিকিৎসকদের কাজের সমালোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সময়ে অন্তত তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেই। নিজেদের প্রয়োজনে তাদের সাহস যোগাই। হয়তো চিকিৎসা অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যখাতের খারাপ দশা, স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোভাব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তবে যেটাই হোক এর মধ্যেই বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হবে। নিজে বাদে অন্য সবার দোষ ধরে আমাদের সময়টা কেটে যেতে পারে কিন্তু বাঁচতে হলে এসবের মধ্যেই লড়াই করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত বিশ্বে করোনা প্রতিরোধক কোনো যথার্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার না হয় ততদিন যারই দোষ ধরি না কেন মৃত্যুর মিছিল থামাবার কোনো উপায় নেই। এই বাস্তবতা বাংলাদেশ কিংবা আমেরিকা সব জায়গাতেই এক। তাই ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ আদর্শই ধারণ করতে হবে। নিজে যথাসম্ভব সঙ্গ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। যত খারাপই লাগুক সরকারি নির্দেশনা মানতে হবে, মানাতে হবে৷নিজেদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে ‘এই শহরে আর কেউ বেঁচে নেই’ – এমন বাক্য আমরা কেউই শুনতে চাই না।

লেখক: শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত