বিশ্বের মানচিত্রে জন্মলাভের ৪৮ বছর পেরিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রহর গুণছে। পাকিস্তানের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় লাভের পরে নানাসময়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, একনায়কতান্ত্রিক সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে।
প্রতিটি সরকারেরই কর্মকান্ড আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে; কিন্তু এটি অনস্বীকার্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ পন্থায় দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগানোর চেষ্টা করেছে। তবুও দেশের সচেতন নাগরিকদের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, স্বাধীনতা লাভের পরে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটেছে কি না? টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দলটি বর্তমানে ক্ষমতায়, তাই চায়ের দোকান থেকে শুরু করে টেলিভিশন-টকশো, সভা-সেমিনার, রাজনীতির মাঠসহ সর্বত্রই এ নিয়ে বিষদ আলোচনা-সমালোচনা পরিলক্ষিত করা যায়।
লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্র হওয়ায় দেশের মানুষ বা রাজনীতিবিদদের মতে এবং আমার মতে উন্নয়নের সংজ্ঞা একটু ভিন্নতর হবে এবং এটিই স্বাভাবিক। সাধারণ অর্থে মানুষের উপকারে আসবে বা মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন কিছুকেই আমরা ভেবে থাকি এটিই উন্নয়ন। এ ধারণা অমূলকও নয়। তবে উন্নয়নের প্রকৃত সংজ্ঞা একটু ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন দুই প্রকার। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান। দৃশ্যমান উন্নয়ন যেটি সাধারণত সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন: বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চিকিৎসা, সেবা, কৃষিখাতসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ায়। আবার পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন অর্থ্যাৎ মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রভৃতিও একটি দেশের উন্নয়নের সূচক।
অদৃশ্যমান উন্নয়ন চোখে দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায় এবং এর সুফলও ভোগ করা যায়। অদৃশ্যমান উন্নয়নের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সামাজিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সরকারি আমলা-কর্মচারী থেকে সর্বস্তরের নাগরিকদের নৈতিকতার মানদন্ড প্রভৃতি। ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রমাণিত যে, দৃশ্যমান উন্নয়ন ও অদৃশ্যমান উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটি পূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। আমাদের দেশে উন্নয়নের অবস্থা যেন ঠিক তেমন। দূষিত রাজনীতি এবং দূর্নীতির করাল গ্রাসে আমরা আজও কাক্সিক্ষত প্রকৃত উন্নয়নে পৌঁছতে পেরেছি কি না সেটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

ছবি : সংগৃহীত
আমাদের দেশের উন্নয়নের চিত্র নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক গল্প প্রচলিত। একটি গ্রামে ছোট ব্রিজ নির্মাণে অর্থ মন্ত্রাণালয় থেকে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী নিজের জন্য বকশিস হিসেবে ৫ লাখ রেখে বাকি টাকা প্রেরণ করেন স্থানীয় দপ্তরে। স্থানীয় সাংসদের বকশিস স্বরূপ চলে যায় আরো ৩ লাখ টাকা। ১২ লাখ টাকা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে দিলে সেখান থেকেও স্থানীয় নেতা, বিভিন্ন ছাত্রনেতার জন্য কিছু বকশিস রাখতে হয়। সব কিছু বাদ দিয়ে নির্মাণকারী ৫ লাখ টাকার কাজ করেন। এভাবেই আমাদের দেশে বকশিসের উন্নয়ন হয়ে আসছে। এমন উন্নয়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে নিজেদের যুক্তি পেশ করে থাকেন। কেউ বলেন যেখানে কিছুই ছিল না, সেখানে কাজ হচ্ছে এটিই ভালো। এটিই উন্নয়ন। আরেক শ্রেনী বলেন, কাজ হলেও তো কাঙ্ক্ষিত মানের কাজ হয়নি। অবশ্য এটি নির্ভর করবে একান্ত দৃষ্টিভঙ্গির উপরে।
তবে একথা সত্য যে, আমাদের দেশের বড় বড় প্রকল্পে বড় বড় দূর্নীতি একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কোনোটি পত্রিকায় এসেছে, কখনবা দৃষ্টির অন্তরালেই হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার আমাদের হতবাক করেছে। একটি শঙ্কা অমূলক নয় যে, এ রকম কতই না স্থাপনায় এমনটি করা হয়েছে যা সময়ই বলে দিবে।

ছবি: সংগৃহীত
অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে দেশে মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৯০৯ ডলার যা গত অর্থবছরে ছিল ১৭৫১ ডলার। কিন্তু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাস্তবিক অর্থেই কি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে? শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে কি আমূল কোনো পরিবর্তন হয়েছে? অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা প্রায়ই আশঙ্কা করে বলে থাকেন, দেশ যেন একটি পুঁজিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। যার যত সম্পদ তা বেড়ে দ্বিগুণে রূপ নিচ্ছে এবং নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনের মানের তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
এসব তো গেল দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রসঙ্গ। তর্ক-বিতর্ক থাকলেও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে আমরা কমবেশি উন্নয়ন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে অদৃশ্যমান উন্নয়নে আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। রাজনৈতিক সহিংসতা, নেতাদের বাগযুদ্ধ, দূর্নীতি, সন্ত্রাসসহ নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা আজও উন্নয়ন করতে পারিনি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন হলেও দেশে বিরাট আকারে নিরাপদ খাদ্য সঙ্কট রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সেবা পেতে নাগরিকদের হয়রানি যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারি চাকুরি পেতে গোপন আর্থিক লেনদেন মামুলি বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, বিরোধী শক্তিকে দমন করাকেই প্রধান কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছে। উন্নয়ন ও সমস্যার সমাধানকে তৃতীয় বিষয়ে রূপান্তরিত করে সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্যের মূলভাব যেন বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকার সময় কি কি অপকর্ম করেছে শুধু সেগুলোই উল্লেখ করা। অপরপক্ষে বিরোধী দলও সরকারের প্রতিটি কর্মকান্ডের বিরোধীতা করাকেই প্রধান কর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য যেন ক্ষমতার গদি দখল করা।
আবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা নায্য দাবীতে কোনো আন্দোলন করলে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের বাধার মুখে পড়তে হবে এটিই যেন এদেশের রীতিতে রূপ নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠীর হাতে রক্তাক্ত হয়েছে আরেক সহপাঠী। বুক খালি হয়েছে শতশত বাবা মায়ের। ছাত্রশিবিরের হাতে নিহত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক, ছাত্র মৈত্রীর নেতা জামিল আক্তার রতনসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী। তেমনই ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছে শিবিরের বিভিন্ন নেতা-কর্মী; শিবির সন্দেহে নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। ছাত্রদলসহ অন্যান্য বামসংগঠনগুলোও এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের কল্যানে কাজ করার থেকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই বছরের অনেকটা সময় পার করে দেয় আমাদের দেশের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আবার দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণনাশের কথা উল্লেখ নাই বা করলাম। এজন্য মাঝে মাঝেই আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। পত্রিকার পাতা খুললেই সড়ক দুর্ঘটনা, খুন, গুম, ধর্ষণের খবর ভেসে উঠে।

ছবি :সংগৃহীত
এখানেই শেষ নয়। বাগযুদ্ধ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আলেম সমাজের মাঝে। ওয়াজ মাহফিলে একটা বিরাট অংশ জুড়েই থাকে একে অপরের প্রতি কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি। বিভিন্ন মাহফিলে আবার বক্তারা সরকার ও নারী বিদ্বেষী বিভিন্ন উসকানীমূলক কথা বলে জনগণকে উত্তেজিত করে তোলে। অথচ এসব ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ধর্মের পথে আনয়ন করা। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে সাধারণ জনগণ যতটা না উপকৃত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সামাজিক বিভাজন।
প্রচলিত নষ্ট রাজনীতির জন্য আমাদের দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হানাহানির জন্য অকালে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য মেধাবীর প্রাণ। কেবলমাত্র কাগজে উন্নয়নের মাধ্যমে জাতিগত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং নৈতিকতা ও সহনশীলতা গুণের উন্নয়নের সংমিশ্রণের মাধ্যমেই আসবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। দেশ এগিয়ে যাবে, বিনির্মাণ হবে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।