যাঁর কর্ম ও অবদান সারা বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি আদায় করেছে, যাঁর ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে, যাঁর প্রতি বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক ও মনীষী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন,যিনি আমাদের জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত, বিবিসি জরিপে যিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন, যিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দেশের স্বাধীনতার জন্য, তাঁর জন্মশতবর্ষ পালন করবো আমরা এবছর। সারাজীবন শোষিতর পক্ষে রাজনীতি করে যাওয়া এ মানুষটি আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রধান অগ্রনায়ক। তাই তাঁর প্রতি দেশবাসীর ছিল অগাধ প্রত্যাশা। কিন্তু ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় হারাতে হয়।মানুষটি বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময়ের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। সারাজীবন দেশের জন্য বিলিয়ে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ছায়া আমরা দেখতে পাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কর্মযজ্ঞে। আমাদের আশা বাড়ে, বাড়ে প্রত্যাশাও। দেশের অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের প্রত্যাশী আমি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের কাছে একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আরেকটু বেশি মনোযোগ প্রত্যাশা করি।বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে প্রত্যাশা করি আমাদের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যেন হয় আরো টেকসই।

সামাজিক সুরক্ষা খাতে এশিয়ার কোন দেশ কেমন খরচ করে সেটার ওপর গতবছর একটি প্রতিবেদন করেছিলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।সেখানে দেখা গেছে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ২১তম।এশিয়ার ২৫টি দেশের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ‘দ্য সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন্ডিকেটর ফর এশিয়া: অ্যাসেসিং প্রোগ্রেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ (১.২%) পরিমাণ অর্থ সামাজিক সুরক্ষায় খরচ করে বাংলাদেশ। তালিকার শীর্ষে থাকা জাপান খরচ করে জিডিপির ২১ শতাংশের বেশি।

ছবি : সংগৃহীত

সর্বশেষ তথ্যমতে দেশে এখন ৭৪ লাখ লোক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পান। এই কর্মসূচির আওতায় সরকার বিধবা ভাতা, দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি দিয়ে থাকে। এগুলোর সঙ্গে আছে প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র সহায়তা কার্যক্রম। এছাড়া স্টেট রিলিফ, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিডি), কাজের বিনিময়ে টাকাসহ (কাবিটা) বিভিন্ন কর্মসূচিও আছে। তবে বাংলাদেশের সব নাগরিক পায়, এমন কোনো সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেই।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জিডিপির ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ (২.৫৮%)। এই হিসাবের মধ্যে আছে সরকারি পেনশনভোগীদের জন্য বরাদ্দ করা টাকাও। সরকারি চাকরির পর অবসরভোগীদের প্রায় শতভাগই দারিদ্র্যসীমার ওপরে বাস করেন। তাই পেনশন বাবদ খরচ বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ জিডিপির ২ শতাংশের(২%) মতো হয়।পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী জিডিপির অনুপাতে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। যেমন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশে (২.৩%)উন্নীত করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

ছবি : কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।

বর্তমান সামাজিক সুরক্ষার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রতিবন্ধী। এই জনগোষ্ঠীর জন্য অসাধারণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য ইতোমধ্যে এই সরকার প্রতিবন্ধী বান্ধব খেতাব অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সারাবিশ্বে নামকরা একজন অটিজম বিশেষজ্ঞ। তাই বর্তমান সরকার প্রধানের কাছে দেশের প্রতিবন্ধী সমাজ একটু বেশিই তাকিয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রটিতে আরেকটু কাজ করা গেলে দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে সরকারের নামও উজ্জ্বল হবে।কারণ বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবন্ধী বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও কর্ম সংস্থানে অন্তর্ভুক্ত না করায় বাংলাদেশের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় ব্যাহত হচ্ছে। যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশের (১.৭%) সমান। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও  কর্ম সংস্থানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সবার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাতে হবে । এছাড়া সরকারের উচিত দক্ষজনশক্তি হিসেবে প্রতিবন্ধীদের তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণ, তাদের কর্মে প্রবেশগম্যতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যাপারে আরো পদক্ষেপ নেওয়া। এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য, গতবছরের সরকারি হিসেব মতে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর সাত শতাংশ (৭%) মানুষ কোনো না কোনোভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধীতার সঙ্গে লড়াই করছে। এই হিসেবের মানুষদের অনেকে উচ্চ শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম। শুধুমাত্র নিষ্ঠুর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা তাদের কর্মে প্রবেশে এক ধরনের অদৃশ্য বাঁধার সৃষ্টি করে রেখেছি। তাঁরা হয়তো কঠিন সংগ্রাম করে নিজেদের প্রতিবন্ধীতা জয় করতে পেরেছে। শুধু পারেনি আমাদের ধ্যান – ধারণায় পরিবর্তন আনতে। যার ফলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর নিয়োগে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর আইনত অধিকার থাকলেও তারা প্রবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ছবি : সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ (এনএসডিসি) দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট ২৩টি মন্ত্রণালয় ও ৩৭টি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করছে। যা সত্যিই প্রতিবন্ধী বান্ধব কিন্তু যথেষ্ট নয়।দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতজন প্রতিবন্ধী শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার তথ্য নেই। তাদের সংখ্যা জানা থাকলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সহজ হতো। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এক শতাংশ (১%) ও ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে ১০ শতাংশ (১০%) প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নেওয়ার কথা থাকলেও তা পূরণ করা হয় না। যার ফলে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী কর্মে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না। আমরা উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই উল্টো চিত্র। সেখানে সরকারি কর্মে নিযুক্তিতে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে আনার সব রকমের প্রচেষ্টা থাকে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সরকারি চাকরিগুলোয় ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা বিশেষভাবে সংরক্ষিত থাকে। যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশগম্যতা পায় না।

তবে আশার কথা হচ্ছে, পর্যাপ্ত না হলেও বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রতিবছর খরচ বাড়ছে। গত ১০ বছরে সামাজিক সুরক্ষায় সরকার খরচ বাড়িয়েছে প্রায় তিন গুণ। প্রতিবছরই সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানো হয়েছে। গত অর্থবছরে ১৬ ধরনের কর্মসূচিতে ২৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। ১০ বছর আগে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।মুজিববর্ষে আমরা প্রত্যাশায় থাকবো অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হবে। এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। এখনো জিডিপির ২ শতাংশের (২%) কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি অন্তত ৩-৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী দারিদ্র্য নির্মূল করতে হলে এসব দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে নজর দিতেই হবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে সরকার প্রধান হবার পরপরই সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় নিয়েছিলেন।মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রচলনের সাথে সাথে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের জন্য নিয়েছিলেন বিশেষ পদক্ষেপ। তাই এটা ধারণা করা যায় সামাজিক সুরক্ষার গুরুত্ব তিনি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে একটু বেশি সুযোগ দিয়ে সামনে না আনতে পারলে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল থাকবে না।সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হেটেই স্বপ্নের সোনার বাংলা জাতিকে উপহার দেওয়া হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীতে সমাজের এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া হোক।

লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।