Connect with us

বাংলাদেশ

আমরা শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো না

Published

on

আমরা শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো না
১.
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন করোনার ব্যাপারে তাদের আর কিছু করার নেই। মহামারী নিয়ন্ত্রণে সকল প্রচেষ্টাই তাদের করা শেষ। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামছে না। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাকেই শ্রেয় মনে হচ্ছে ইতালির সরকারের কাছে। এদিকে ফেসবুকের একটি পোস্টে দেখলাম চায়না নাকি তথ্য লুকিয়েছে৷ একজন টুইটারে পোস্ট করেছেন তাঁর শহরে ৮০ লক্ষ লোক টেলিফোন সংযোগের তালিকা থেকে উধাও হয়ে গেছে। তার ধারণা এরা সকলে করোনায় মারা গেছে কিন্তু সরকার এই খবর প্রকাশ করে নি। ইতালি কিংবা চায়না দুজায়গার এই দুটি খবর আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেয়েছি।এগুলোর সত্যতা আছে কিনা জানি না, আশা করছি নেই। তবে আমার সাধারণ চোখ বলে এমন কাজ করা ছাড়া ঐ দেশগুলোর আর করারও বা কি ছিলো? বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশ ইতালি। করোনা আক্রমণে প্রথম মৃত্যু থেকে সর্বশেষ মৃত্যুর মাঝখানে তাদের কেটে গেছে ৫০ দিন। নিয়ন্ত্রণে তো আনতে পারেই নি বরং প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। দিনে হাজারের কাছাকাছি মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর আকাশে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার থাকতে পারে? চায়নার একটি শহরেই যদি ৮০ লাখ মৃত্যুর মতো অবস্থা সৃষ্টি হয় তবে সেদেশের প্রধান যদি আমি নিজেও থাকতাম তবুও চেষ্টা করতাম যেন এ খবর ছড়িয়ে না পড়ে। এর পিছনে যৌক্তিক কারণও আছে। দেশের সরকার প্রধান হিসেবে আমাকে দেখতে হতো যতই মহামারী হোক না কেন সামাজিক শৃঙ্খলা যেন ভেঙে না পড়ে। শহরজুড়ে অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে যদি ৮০ লাখ লোকের মৃত্যুর খবর আমি প্রকাশ করি। যেখানে দাবি করছি আমি বিশ্ব অর্থনীতির ২য় শক্তিশালী দেশ।যে যার মতো ইয়া নফসি ইয়া নফসি করে নিজে বাঁচার চেষ্টা করবে। ডাক্তার, নার্স কাউকে পাওয়া যাবে না চিকিৎসার জন্য, শহরের আইন ঠিক রাখা যাবে না পুলিশের অভাবে, প্রশাসন পরিচালনা বাধাগ্রস্থ হবে কারণ হর্তাকর্তারা যে যার মতো সেকেন্ড হোম – থার্ড হোমে পালিয়ে যাবে। তাই যতই খারাপ অবস্থা হোক আমাকে চেষ্টা করতে হবে এটা দেখাতে যে, সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। শুধু একটু ধৈর্য ধরুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। চায়না আর ইতালিকে এখানে টেনে আনলাম মনোযোগ তৈরি করতে। কারণ আসল কথা আমি এখনো বলি নি। আসল কথাটা হচ্ছে আমার কথা, আমাদের কথা, এই দেশের কথা। সব জল্পনা কল্পনা পিছনে ফেলে করোনা আমাদের কাছেও চলে এসেছে। করোনায় প্রমাণিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩। আর অপ্রমাণিত কত? আমি এখানে প্রমাণিত-অপ্রমাণিত বলতে বুঝাচ্ছি টেস্টিং কিট দ্বারা পরীক্ষিত মৃত্যু আর অপরীক্ষিত মৃত্যুকে। এখানে একটা জোকস মনে পড়ে গেলো,এক দেশের ‘ক’ নামক প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর দেশে করোনা কাউকে মারতে পারে নি। অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘খ’ ওই ঘোষণার প্রতুত্তরে জানালেন আরে গরীব তোর দেশে তো করোনা টেস্টের কিটসই নেই। বরঞ্চ আমায় দেখ, আমার দেশে করোনায় কেউ মারা যায় নি। ‘খ’ এর কথা শুনে সে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী বললেন, সহমত ভাই ;আমরাই পেরেছি। সব করোনা টেস্টিং কিটস এখনো অব্যবহৃত, কেউ চাইলেও দেইনি। জোকসটা এখানে এই মুহূর্তে বলার পিছনে একটা কারণ আছে৷ করোনা টেস্টিং কিট ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে ৩ জন করোনায় মারা গেছে৷ কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাস করে তাদের কাছে টেস্টিং কিট পৌছাবো না আমরা সেটা জানি। তাই করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে এতদিনে সেসব জায়গার যারা শুধুমাত্র গায়ে জ্বর আছে ভেবে মারা গেছেন তাদের ব্যাপারে কি ভাবনা থেকে যায় না? থাকে কি?
আমরা শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো না
২.
ইতালি কিংবা চায়না দুটি দেশই চিকিৎসা ব্যবস্থায় বাংলাদেশের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি আধুনিক। তাদের যতটুকু খবর গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে আমরা পেয়েছি তাই আঁতকে ওঠার মতো। সেইসব দেশ থেকে করোনা ভাইরাস দেহে নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকে আমাদের এখানে চলে এসেছে৷ তাদের সঙ্গে সামাজিক সংস্পর্শ শুধু নেই খাওয়া -দাওয়া, ওঠা-বসা থেকে শুরু করে বিয়ে – বাসররাত পর্যন্ত করে ফেলেছি৷ দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম যে মহিলা করোনা ভাইরাসে মারা গেছেন তিনি মাত্র চার ঘন্টা সময়ে পুরো দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন৷ করোনা সনাক্ত হবার পর চিকিৎসা নেবার সময়টির মধ্যে তিনি নাকি দুঘন্টা চার্চের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আর দুঘন্টা কাটিয়েছিলেন ছেলে বন্ধুর সাথে মধ্যাহ্নভোজে। ব্যাস এতেই ওই দেশের অবস্থা ১২টা৷ আর আমাদের এখানে নাকি আমেরিকা প্রবাসী ২জন করোনা আক্রান্ত মানুষ বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, দহরম – মহরম করেছেন। ঐ দুজনার সঙ্গে শারীরিক সংস্পর্শে আসা প্রচুর লোক সেই অঞ্চলের উপনির্বাচনের ভোট উৎসবে অংশ নিয়েছেন। একবার ঠান্ডা মাথায় বুঝতে পারছেন অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? করোনা ভাইরাসকে এতটা বিপদজনক হিসেবে ধরা হচ্ছে এর মৃত্যু হারের জন্য নয়। এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতার জন্য। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণ হাঁচি-কাশি কিংবা স্পর্শের মাধ্যমেও কয়েকজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। করোনায় মৃত্যুর হার অন্য অনেক সংক্রামক রোগের চেয়ে কম। গুগল বলছে স্বাভাবিক মৃত্যু হার বর্তমানে ২.০৭ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ওপর এই ২.০৭ শতাংশ যদি প্রয়োগ করি তখন ফলাফল আসে কিন্তু ৪৬ লক্ষ ২০ হাজার! সংখ্যাটা বুঝতে পারছেন তো? প্রায় অর্ধকোটি। গুগলে আরেকটা জিনিস জানতে পারলাম। ইতালিতে নাকি করোনা আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুহার আজ পর্যন্ত ৪৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আমি চিকিৎসক নই তবে করোনার এই সময়টিতে চিকিৎসকদের বিভিন্ন পরামর্শ প্রতিনিয়ত জানার এবং শোনার চেষ্টা করছি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ৮০ বছরের বেশি বয়সী যারা আগে থেকেই রোগে আক্রান্ত, তারা এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। ৮০ বছরের ঊর্ধ্বের বয়সীরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ১৫ শতাংশ। ৫০ এর নিচের যারা করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর হার মাত্র ০ দশমিক ২ থেকে ০ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ৫০ ঊর্ধ্বদের মৃত্যুর হার একটু বেশি। ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের প্রাণহানির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর এই হার ৩ দশমিক ৬ এবং ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ। অন্যদিকে করোনায় ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের প্রায় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশই মারা যাচ্ছেন।এছাড়া যারা আগে থেকে গুরুতর রোগে ভুগছেন তাদের তুলনায় হালকা অসুস্থ মানুষের মৃত্যুর হারে বেশ পার্থক্য রয়েছে। যারা হৃদরোগে ভুগছেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশই মারা যাচ্ছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের মৃত্যুর হার ৭ দশমিক ৩, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বিশেষ করে অ্যাজমা এবং দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভোগা মানুষের মৃত্যুর হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ৬ এবং ক্যান্সার রোগীদের মৃত্যুর হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

আমরা শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো না

৩.

করোনার এই সময়টাতে প্রায়ই আমার আরণ্যক বসুর একটি কবিতার কথা মনে পড়ে। কি সুন্দর তিনি লিখে গেছেন -“পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক আমরা তখন প্রেমে পড়বো, এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব।
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন,
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন।
মনে থাকবে? ” কতটা তীব্র আবেগ তাই না বলুন? এই জন্মে প্রিয়তম মানুষটাকে এক অজানা বিচ্ছেদের কারণে হারাতে হলো। আর সেই হারানোর সময়টাতেই বসু বাবু যেন চেয়ে বসলেন পরের জন্মে কাছাকাছি থাকার প্রতিজ্ঞা। ইদানীং কবিতাটা পড়ছি আর ভাবছি বসু বাবুর বিচ্ছেদের এই অজানা কারণটা বোধহয় করোনা ভাইরাস। কবিতাটা বারবার পড়ছি আর ভাবছি এমন কোনো মহামারিতে প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদের কথা ভেবেই হয়তো তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন। খুব নিরাশ লাগে নিজের কাছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো নিরুপায় হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হঠাৎই কিছু সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে চোখের সামনে পড়ে। আশাবাদী হয়ে উঠি, তীব্র বেঁচে থাকার ইচ্ছে জেগে ওঠে৷ বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছোট্ট একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনা চারেক শিক্ষার্থী সেখানকার উপাচার্য আর বিভাগীয় প্রধানের সহায়তায় বিনামূল্যে বিতরণের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করেছে। তাও আবার নিজেদের জন্য নয়। সেখানকার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত মানুষদের জন্য। আমরা সবাই জানি করোনার চিকিৎসা প্রদান করতে আমাদের চিকিৎসকেরা নিজেরা কতটা ভয়ংকর স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী নেই আমাদের হাসপাতাল গুলোতে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধের যুদ্ধে এই চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই প্রধান সেনাপতির ভুমিকা পালন করবে। তাদের জন্য শিক্ষার্থীদের সামান্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির খবর কেনো জানি আমার বেঁচে থাকাকে আনন্দ দেয়। যখন ভাবি, ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মতো করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে আমরাও কি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো? তখন খবর আসে এক বাড়িওয়ালা এই সময়ে তাঁর ভাড়াটিয়াদের এ মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। খবর আসে আমার গরীব দেশের খুব শক্তিশালী না হওয়া সরকার তাঁর জনগণের কথা ভেবে বিদ্যুৎ – গ্যাসের বিল দুমাস পরে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর আসে একজন গার্মেন্টসের মালিক হাজার হাজার চিকিৎসকের জন্য করোনা ভাইরাসে চিকিৎসা দেবার মতো নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী পোশাক তৈরি করে দিচ্ছে। এসব খবরে লজ্জা পাই আরণ্যক বসুর কবিতাটির কথা মনে করে। ভাবি এদেশের সাধারণ মানুষ,সাধারণ শিক্ষার্থী, সাধারণ নারী, ইতালির তুলনায় সাধারণ সরকার যখন এতভাবে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন শুধু ঘরে বসে থেকে আমি কি এই যুদ্ধের সৈনিক হতে পারবো না! পরের জন্মে প্রেমিকার সঙ্গে ষোলো বছরেই প্রেম করার অনিশ্চিত হিসাব তৈরি করার চেয়ে এজন্মে হিসাব চুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা ভালো। হ্যাঁ, শুধু ঘরে বসেই যেকেউ পৃথিবী ব্যাপী শুরু হওয়া এই করোনা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রচন্ড ছোঁয়াচে এই সংক্রামক ভাইরাসটি ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের মাধ্যমে। তাই সমস্ত সামাজিক সম্মিলন ও ব্যক্তি সংস্পর্শ এড়িয়ে বাড়িতে থাকাই করোনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত অবদান। জরুরি প্রয়োজনে যদি বাইরে যেতেই হয় তবে মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লভস পড়তে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা বাড়িতে শুয়ে বসে পৃথিবীর এতবড় বিপর্যয় ঠেকিয়ে দেবার মতো সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়৷ এর সঙ্গে শুধু একটু নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কষ্ট করতে হবে। বাইরে থেকে এসে এবং দিনের মধ্যে কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন। অন্যকারো জন্য নয়, অন্তত নিজের জন্য হলেও বেঁচে থাকুন। সচেতন হোন, সময় বড্ড অল্প৷ করোনা ভাইরাসের কাছে হেরে গিয়ে আমরা শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো না। এই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে বিজয়ী বেশে আমরা আকাশে তাকাবো, পূর্ণিমার রাতে প্রিয় মানুষটাকে সঙ্গে নিয়ে তারা গুনবো। প্রেমিকার সঙ্গে দূরত্বটা এ জন্মেই ঘুচিয়ে দেবো।

লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

বাংলাদেশ

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

Published

on

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

 

পূর্বের অবস্থা যা ই হোক না কেন এটার বর্তমান অবস্থা যে খুব সোচনীয় তা আমরা আঁচ করতে পারছি খুব ভালো ভাবে এই আলোচনার মাধ্যমে। আবার আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে চিনি শিল্পের এই মন্দাবস্থা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জনসাধারণের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যদিও এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী মূলত শিল্পের সাথে জড়িত নীতিনির্ধারকরা।

আমরা জেনেছি যে বাংলাদেশে সরকারী ১৫ ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২ টি চিনিকল রয়েছে, এবং ৫ টি চিনি পরোশোধনাগার রয়েছে। এই শিল্পের সাথে ১২.৫ লক্ষ পরিবারের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আখ চাষ এবং চিনি আহরণের হার খুবই কম। দেশে প্রতি একরে আখ উৎপাদন হয় মাত্র ১৫ মেট্রিক টন যা হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ৭০ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার চিনি আহরিত হয় মাত্র ৭.৪ % যা অস্ট্রেলিয়া ১৫.৭ % পর্যন্ত হয়ে থাকে।

দেশীয় চিনিশিল্পের পথিতযশা অবস্থা

চিনিশিল্প

চিনি শিল্পে ধস মোটামুটি শুরু হয়েছে ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে। অথচ ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে কিন্তু বাংলাদেশে মোট আখ উৎপাদিত হয়েছিলো ২০ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন হয়েছিলো ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬২ মেট্রিকটন। যা প্রায় ৮.৭৭ %। কিন্তু ২০০০-০১ মৌসুমে সেটা কমে হয় ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬ মেট্রিকটন এবং চিনি আহরিত হয় ৯৮ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। যা কমে হয় ৭.১১ %।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তন,তুলনামূলক কম সূর্যালোক ঘণ্টা, আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষু জাতের অভাব, অপরিপক্ক আখ মাড়াই, পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কমতে থাকে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন।

২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন হটাৎ এমন খাপছাড়া কেন হয়ে যাওয়ার পেছনে যে কয়েকটি কারণ মূখ্যভাবে দায়ী তা হলো ‘ চাষীরা আখ বিক্রির টাকা সময় মতো না পাওয়া, আখের বদলে অন্য ফসল চাষে তুলনামূলক বেশী লাভ, চিনি মিল গুলোর কাছে চাষীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আটকে থাকা, পাওয়ার ক্রাশারের আগমন, এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল আচরণ না করা।

চিনি উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে রয়েছে মানসন্মত আখের অভাব, মাটি ও আবর্জনা যুক্ত আখ মিলে সরবরাহ, ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি আখ মাড়াই করে রস ড্রেনে ফেলা, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্লাটফর্মে ও মাঠে আখ শুকানো, আখ থেকে রস ঠিকমত বের না করা, সর্বপরি দক্ষ জনবলের অভাবে চিনি আহরণে ব্যাপক গড়মিল তৈরি হচ্ছে।

শুধু চিনি উৎপাদনেই লোকশান হচ্ছে না। অদক্ষ জনবল, পরিকল্পনার অভাব, নিম্নমানের আখ চাষ, ক্রয় বিক্রয়ে দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় খরচ, ব্যায়ের খাত বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অনিয়ম যেন বাসা বেঁধে বসেছে চিনিকলগুলিতে।ফলে কিছু কিছু কর্মকর্তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও চিনিকলগুলির এবং শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

চিনি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানিকারী পণ্য হতে পারে এবং কতগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করতে পারে, যেমনঃ কারখানাগুলির আধুনিকীকরণ, পূর্ণমাত্রায় আখ উৎপাদন, সহজশর্তে আখচাষীদের ঋণ প্রদান, রিফাইনারিগুলিকে পূর্ণমাত্রায় চিনি উৎপাদনের জন্য অনুমতি প্রদান, আখ চাষে ও চিনি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার, অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ, মিল কর্মচারীদের অপকর্ম থেকে বিরত রাখা এবং চিনিকলগুলি থেকে উৎপাদিত উপজাত পণ্যের (by-products) সঠিক ও ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা।

লিখেছেনঃ
মারুফুজ্জামান
৪৬ তম আবর্তন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

বাংলাদেশ

জাতির জনকের শাসনকালঃ দেশনীতি ও বিদেশনীতি

Published

on

Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahman
আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে দেখেছি, যিনি জ্ঞানে ও নেতৃত্বে হিমালয় সম” -বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এই বাণী ই জাতির জনক সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতে কৌতূহলী করে তোলবে যেকোনো মুজিবপ্রেমী ব্যাক্তি কে। বঙ্গবন্ধু সোনার  বাংলা  গরে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পান নি, কিন্তু সদ্যস্বাধীন দেশটি নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতেই আজকে আমাদের এই দেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রিয় নেতা পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার কাঠামো প্রবর্তন করেন। আজকের এই দিনে স্বল্পসময়ে জাতির জনকের গৃহীত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক  বিভিন্ন পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র নীতি সহ সংক্ষেপে তাঁর  শাসন কাল আলোকপাত করা হলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রিয় এই নেতা খুব অল্প সময়েই আলোচিত উঠেন তাঁর বন্ধুত্বপূর্ন আচরণ,বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী  সিদ্ধান্ত দক্ষতার মাধ্যমে। এই স্বল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, ওআাইসি সহ ১২৬ দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নেতার সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছিলেন। তাছাড়াও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বেসামরিক  মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ, অবাঙালিদের রেখে যাওয়া শিল্প কারখানায় দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা,স্বীকৃতি ও সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের ক্রোধের ফল সরূপ সৃষ্ট  ভয়াবহতা অনুধাবন, পাকিস্তানের শাসন,নির্যাতনের বিরুদ্ধ আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে। সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রিয় বাংলা কে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হবে হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাইতো তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সাথে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব স্থাপন করেন বিপরীত দিকে তাঁর  গৃহীত কৌশলপূর্ণ নীতির কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী চায়না আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী হয়ে উঠেছে।মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার বিরোধী ভূমিকা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ১ অক্টোবর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড  আর ফোর্ডের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে মিটিং করেন।১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ আন্দোলন এর শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে ন্যামের সদস্য রাষ্ট্রদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক কৌশল সফল হয়। ফলে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের মাধ্যমে প্রিয় দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে নিজস্ব স্থান তৈরি করে নেয়।এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু যা সারা বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in United Nations নব্যস্বাধীন দেশ বিধায় তখনো রাষ্ট্রের সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিলো নানাবিধ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান। অভ্যন্তরে ছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের মিত্রদের বিচারের দাবী অন্যদিকে দেশের স্বীকৃতি অর্জনে পাকিস্তানের মিত্র দেশগুলোর বিরোধিতা। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবী মনোভাব জাগ্রত করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতা অর্জনের ১ বছরের মধ্যে ই আওয়ামী লীগের ছাত্র সমাজের একাংশ গড়ে তোলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)। দ্বিধা বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি গুলো দেশে এনজিও এর মাধ্যমে সহযোগিতা  কার্যক্রম চালু রাখে যা পরবর্তী তে দেশে প্রধান শক্তি হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের ওপর ছিল দেশ পুনর্গঠনের সামগ্রিক চাপ কিন্তু কাজের ফলাফল ছিল ধীর।  এই সময়ে অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ ওঠে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রবল হয়ে উঠে যা উগ্রপন্থী যুব নেতৃত্ব  ও মধপ্যন্থী মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ে।এ পরিস্থিতিতে সরকার পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তি দান করে ও আওয়ামীপন্থী বিশ্বাসীদের নিয়ে উগ্র পন্থীদের দমনে রক্ষী বাহিনী গঠন করে। নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র থেকে আমরা জানি,প্রতিটি ক্রিয়ার ই সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে,তেমন জাতির জনকের শাসন কালেরও আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে, তাই বলে একটি রাষ্ট্রের জন্ম যার হাত ধরে তাঁর পরিবারের এমন নৃশংস হত্যাকান্ড কখনো গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman family photo 15 august দেশগঠনে অকৃত্রিম প্রচেষ্টা কারী এই রাষ্টনায়কই কতিপয় সেনাবাহিনীর অফিসারের রোষের কবলে পড়ে প্রিয় পুত্র শেখ রাসেল,২ পুত্রবধূ, সকল বিপদে সাহস প্রদানকারী স্ত্রী সহ পরিবারের আরো সদস্য নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। প্রিয় বাংলার শোষিত জনগণের কল্যাণে আত্ননিয়োগকারী রাষ্ট্র নায়ক,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ তম মৃত্যুবার্ষিক,তাঁর প্রতি জানাই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

বাংলাদেশ

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী

Published

on

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
১.লেখার শুরুতে একটা হাসির গল্প বলে নিতে চাই। করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও চালু রাখতে হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এক ব্যাংক কর্মকর্তা আর গ্রাহকের কথোপকথন হচ্ছে। গ্রাহকটি ব্যাংকে মোটামুটি অংকের টাকা তুলতে এসেছেন। কর্মকর্তাটি গ্রাহককে প্রশ্ন করলেন সবকিছু বন্ধের মধ্যে তিনি কেন টাকাগুলো তুলছেন? গ্রাহক জানালেন, লকডাউনে বাসায় বসে থাকতে গিয়ে বিরক্ত তিনি। বাইরের পরিবেশ দেখতে আর বিরক্তি কাটাতে ব্যাংকে চলে এসেছেন । হাতে চেক বই দেখে রাস্তায় পুলিশও তাকে কিছু বলেন নি। কর্মকর্তাটি গ্রাহকের এমন বক্তব্যে হতবাক হয়ে গেলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে টাকাগুলো গুনে নিয়ে দ্রুত সেই লোকটিকে বাড়ি চলে যেতে বললেন কর্মকর্তাটি।লোকটি আরো অবাক করে দিয়ে তাকে জানালেন, গোনার দরকার নেই। টাকাগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই কাল এসে জমা দিয়ে যাবেন তিনি। ব্যাংকগুলো খোলা রাখায় লকডাউনের বিরক্তি কাটাতে সুবিধা হয়েছে তার। ব্যাংকেও আসা হয় বাইরের পরিস্থিতিও নিজ চোখে দেখা যায়! এই গল্পটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমার নজরে আসে। সারাদেশের কার্যত লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক খুলে রাখায় ক্ষুব্ধ ব্যাংকিং খাতে কাজ করা মানুষেরা। তাদেরই একজন গল্পটি ছড়িয়ে দিয়েছে৷ আর তাঁর কল্যাণেই এমন নিদারুণ হাস্যরসের গল্পটি জানতে পেলাম। আশা করছি গল্পটি মিথ্যা হবে। বৈশ্বিক বিপর্যয়ের এই সময়টাতে কোনো মানুষ গল্পের গ্রাহকের মতো কাজ করবে না বলে বিশ্বাস করতে চাই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আরেকটা ভিডিও দেখে এই জাতিকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। একজন পুলিশ সদস্য একা একা মাইকিং করে এই করোনা বিপর্যয়ের সময়টাতে সবাইকে ঘরে থাকার আহবান জানাচ্ছেন। আশেপাশের সবাই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সে কেনো হাতে লাঠি নিয়ে আসে নি! লাঠি না নিয়ে কেন সে মানুষকে বোঝাতে আসলো সেটা অনেকের মনে দুঃখ দিয়েছে। আসলেই কি আমরা এমন জাতি যাদের পিঠে লাঠির আঘাত না পড়লে নিজেদের ভালোটুকু বুঝবো না?
জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী

২.

আমি যে মুহুর্তে এই লেখাটা লিখছি তখন সারাবিশ্বে করোনায় মারা গেছেন এক লক্ষ মানুষ। পুরো পৃথিবীটাই এক প্রকার ঘরে বন্দী অবস্থায় আছে। এই অবস্থায় সবাই মিলে ঘরে থাকার ফলে প্রকৃতির ওপর প্রভাব পড়েছে অসাধারণ। বাতাসে দূষণ কমে গেছে, আশপাশ পরিষ্কার হয়েছে। দীর্ঘদিন পর অনেকটা দূর থেকে নাকি হিমালয় দেখা যাচ্ছে, কক্সবাজারে ডলফিন ফিরে এসেছে। নেটিজেনরা ( ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অংশ হওয়া মানুষদের এই শব্দ দিয়ে অভিহিত করা হয়) মজা করে বলছে, প্রকৃতির এত কিছু ফিরে আসার মধ্যে মানুষের জীবনে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক/প্রমিকারাও হয়তো ফিরে আসবে! তবে জীবনে পুরনো প্রেমিক/প্রেমিকারা ফিরে না আসলেও সমাজের পুরনো একদল মানুষ কিন্তু ঠিকই ফিরে এসেছে। তারা হচ্ছেন ত্রাণের চাল চোর সম্প্রদায়। এই মুহুর্তে দেশের মোট করোনা শনাক্ত মানুষের চেয়ে সরকারি ত্রাণের চাল চুরি করা মানুষের সংখ্যা বেশি। সারাবিশ্ব যেখানে মৃত্যুভয়ে থমকে গেছে সেখানে আমাদের চাল চোরেরা পুরনো প্রতাপে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার বাংলাদেশে৷ কোভিন ১৯ শনাক্ত মানুষের চেয়ে নিশ্চিত ভাবে এই রোগে মৃতের সংখ্যার তারতম্য খুব বেশি নয়৷ এমন একটা ভয়ানক সময়ে দাঁড়িয়ে এইসব চাল চোরদের জন্য আমার কেন জানি মায়া হয়! স্রষ্টা না করুক করোনা ভাইরাসেই যদি চাল চোরেরা মারা যায় তবে চুরিকরা এসব চালগুলোর জন্য তাদের আফসোস হবে। মৃত্যুর পরেও তাদের আফসোসের কথা ভেবেই আমার খারাপ লাগছে।

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
৩.

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও আমার বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করলো। সেই ভিডিওতে দেখলাম এক ইউপি সদস্য করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ নিতে আসা কিছু বেরোজগার মহিলার ওপর চোটপাট করছে। তাঁর চোটপাট এবং হুংকারের কারণটা জেনে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আহারহীন মানুষদের তিনি জোর গলায় শাসাচ্ছেন এবং ত্রাণ দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। কারণ ত্রাণ সহযোগিতা তিনি তাদেরকেই করবেন যারা নাকি তার নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী! ভিডিওটা দেখে মর্মাহত হলাম। মনে মনে বিশ্বাস করতে চাইলাম আমার দেখাটা যেন ভুল হয়। করোনা ভাইরাস কোন দল চেনে না। সে চেনে মানব দেহ। তাঁর সংস্পর্শে যে শরীরটা আসবে তাকেই সে আক্রমণ করবে৷ করোনার আক্রমণ থেকে যদি নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয় তবে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে৷ কিন্তু ঘরে খাবার না দিয়ে তো আপনি তাদের ঘরে রাখতে পারবেন না। কারণ কষ্টকর সত্য হচ্ছে এই যে পেটের ক্ষুধা করোনা ভয় মানে না। সারাবিশ্বকে থামিয়ে দিলেও করোনা মানুষের পেটের ক্ষুধা থামাতে পারে নি। আর সেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রথমে বাইরে বের হবে আয়হীন মানুষ, তারপর বের হবে নিম্ন আয়ের মানুষ, তারপর স্বল্প আয়ের। এভাবে করে ঘরে যাদের খাবার কিছুই থাকবে না তারা সবাই রাস্তায় বের হয়ে যাবে৷ আর বাস্তবতা হচ্ছে এই করোনা আক্রমণ থেকে নিজে বাঁচতে হলে অন্যদের নিয়েও বাঁচতে হবে। কারণ এই ভাইরাসটি কেবলমাত্র তখনই থামবে যখন সংক্রমণের জন্য একটি মানবদেহও আর সে খুঁজে পাবে না। আর মানবদেহগুলোকে যদি ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে হয় তবে সেগুলোর পেটের ক্ষুধার সংস্থান করাও আবশ্যক। মানুষদের খাবারের দুঃশ্চিন্তা নির্মুল করে বাইরের সমাজ থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সেই চিন্তা দূর করার পদক্ষেপে যদি অতিউৎসাহী এসব ইউপি সদস্যদের উপস্থিতি বেশি হয়ে দাঁড়ায় তখন কিন্তু গন্ডগোল।যারা কিনা মনে করে গণমানুষের মতামত নিয়ে তারা নিজেদের সরকার বাহাদুর নাম রেখেছে। সেই বাহাদুরকে কিন্তু এইসব চ্যালাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বাহাদুরি দেখাতে হবে। বাহাদুরি দেখাতে হবে চাল চোরদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রেও। নয়তো দলকানা ইউপি সদস্য আর চাল চোর চেয়ারম্যানরা মিলে জনগণ নামক বস্তুটিকে খেপিয়ে তুলবে।শুনেছি ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর আইয়ুব খানের শাসন’ দুটোই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বস্তু ছিল। বাঙালী খেপে গিয়ে কিন্তু আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলো।

জ্ঞানহীন এক জাতির করোনা কাহিনী
৪.

পৃথিবীব্যাপী করোনাক্রান্ত লাখ খানেক মৃত্যুর মধ্যে চিকিৎসা সেবায় জড়িত অনেকেও কিন্তু মারা গেছেন৷ করোনা বিপর্যয়কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ধরে প্রতিটি দেশের মৃত চিকিৎসা পেশার মানুষদেরকে দেওয়া হচ্ছে শহীদের খেতাব। কারণ সবাই জেনে গেছে এই যুদ্ধে সেনাপতি – সৈনিক যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়ে বিরোধী শিবিরে গুলি চালানো কেউ নয়। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে দিনরাত মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া লোকগুলোই এই যুদ্ধে আমাদের বড় শক্তি। এদেশে প্রথমেই যখন করোনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো তখনই আক্রান্ত হওয়া শুরু করলো একে একে ডাক্তারেরা। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের চিকিৎসা সেবায় বিশেষ জায়গা দখল করে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সাংবাদিকতার সূত্রে আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো এই সময়ে কেমন সেবা দিচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। যে ভয়াবহ তথ্য জানতে পারলাম সেটা উল্লেখ করতে চাচ্ছি। করোনায় শুরুতেই ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এদিকটায় এসেছিলেন৷ লকডাউনের শুরু হলে কিছু কিছু সরকারি হাসপাতাল সহ অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক গুলোয় রোগী দেখা সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়টাতে অধিকাংশ অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে। মৌসুম পরিবর্তনের কারণে রোগীদের বেশিরভাগই ছিল সর্দি-জ্বর, কাশি- গলাব্যথা সহ করোনার অন্যান্য উপসর্গ সমৃদ্ধ। এ পর্যন্ত ঘটনা সাধারণ চোখে এক প্রকার ঠিকই ছিল। কিন্তু ভয়াবহ কথাটা জানা গেলো এরপরে। আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই লেখাটার সময় পর্যন্ত কোনো ধরনের জীবাণুরোধী ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) পান নি। সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় তারা রোগী দেখেছেন। এমন চিত্র আমি মনে করি সারাদেশের। সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বড় চিকিৎসক সবাইকেই একটু বেশি নিরাপত্তায় রাখতে হবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। যদিও তাদের কিছু অংশের কার্যক্রম নিয়ে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবুও এটা ভুলবাবর কোন জো নেই যে স্রষ্টার পর আমাদের এই বিপদে রক্ষাকর্তা তারাই।বেঁচে থাকলে চিকিৎসকদের কাজের সমালোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সময়ে অন্তত তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেই। নিজেদের প্রয়োজনে তাদের সাহস যোগাই। হয়তো চিকিৎসা অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যখাতের খারাপ দশা, স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোভাব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তবে যেটাই হোক এর মধ্যেই বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হবে। নিজে বাদে অন্য সবার দোষ ধরে আমাদের সময়টা কেটে যেতে পারে কিন্তু বাঁচতে হলে এসবের মধ্যেই লড়াই করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত বিশ্বে করোনা প্রতিরোধক কোনো যথার্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার না হয় ততদিন যারই দোষ ধরি না কেন মৃত্যুর মিছিল থামাবার কোনো উপায় নেই। এই বাস্তবতা বাংলাদেশ কিংবা আমেরিকা সব জায়গাতেই এক। তাই ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ আদর্শই ধারণ করতে হবে। নিজে যথাসম্ভব সঙ্গ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। যত খারাপই লাগুক সরকারি নির্দেশনা মানতে হবে, মানাতে হবে৷নিজেদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে ‘এই শহরে আর কেউ বেঁচে নেই’ – এমন বাক্য আমরা কেউই শুনতে চাই না।

লেখক: শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত