বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণসহ নানা কারণে আলোচিত এ ব্যক্তিকে আমার কাছে ‘ভাগ্যবান রাজনৈতিক ব্যক্তি’ বলেই মনে হয়। চিন্তা করে দেখুন, এযাবৎকালে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের মধ্য থেকে একমাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। স্বাধীনতার পরপরই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে হত্যা করে ধ্বংসের রাজনীতি শুরু করে। একই বছরের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, কামারুজ্জামানের মতো জাতির সূর্য সন্তানদের কথিত জেলহত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকেও মিলিটারি ক্যুর মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলার রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। এ ধরনের নজির সম্প্রতি মিসরেও তৈরি হয়েছে। মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি আদালতের এজলাসেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। স্বৈরাচার আবদুল ফাত্তাহ সিসি এতে কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না, বরং মুরসির পরিবার ও তার ছেলেদের নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে। মুরসির দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতাকর্মীদের হত্যা, হয়রানি, দেশান্তর করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশে অতীত এবং বর্তমানে বড় দলের প্রতিষ্ঠাতারা জেলহত্যা, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্রে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ সময়ে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন।
তিনিও অন্যদের মতো জেলেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন কি না, তা বলা যায় না। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, খুন বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কমে গেছে। যখন রাজনৈতিক টর্চারিং ফ্যাশন হয়ে পড়েছে, তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সুন্দর-স্বাভাবিক মৃত্যুতে এরশাদকে ‘ভাগ্যবান’ বলাই যায়। অনেকে বলবেন, এরশাদ যদি পল্টিবাজি রাজনীতি না করতেন এবং ক্ষমতার কাছাকাছি না থাকতেন, ম্যানেজের রাজনীতি না করতেন, তাহলে তাকেও এ ধরনের ভাগ্যবরণ করতে হতো। বিষয়টিতে আমিও একমত। কারণ এরশাদের পতনের পর তিনি যতটা না আবারও ক্ষমতারোহণের চেষ্টা করছেন তার চেয়ে বেশি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য রাজনীতি করেছেন।
প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতা দখল, দেশ পরিচালনা, রাজনৈতিক কারসাজির কারণে স্বৈরাচারী তকমা নিয়ে বেঁচে ছিলেন দীর্ঘদিন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম বলি হন জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দীপালি সাহা। এছাড়াও নূর হোসেন, মঞ্জু ও ডা. মিলন শহীদ হওয়ার ঘটনা সবার জানা। পাশাপাশি প্রবীণদের বলতে শুনেছি, এরশাদ সামরিক শাসনের কড়াকড়ির সঙ্গে নরম জবানের একটা সুন্দর সমন্বয় সাধন করতে পারতেন। মানুষকে বোকা বানানোর ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তার শাসনামলে কিছু প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা অস্বীকার করা যায় না। লোকপ্রশাসন পড়তে হলে অবশ্যই তখনকার উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, জেলা-উপজেলাভিত্তিক ৩ স্তরবিশিষ্ট বিকেন্দ্রীকরণমূলক প্রশাসন প্রবর্তন, ৪৬০ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা, গ্রাম সরকার পদ্ধতি বিলোপ, হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রসারণ, প্রতি জেলায় মুন্সেফ কোর্ট তৈরির অবদান স্বীকার করতে হবে। নারী নির্যাতনের জন্য কঠোর শাস্তি, জাতীয় প্রেস কমিশন গঠন, আর্থিক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, কৃষক ও কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, জাতীয় ঈদগাহ নির্মাণ, জাতীয় তিন নেতার মাজারের নির্মাণকাজসহ ভূমিহীনদের জমি প্রদান ও গুচ্ছগ্রাম করে পল্লী গ্রামের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা ছিল তার। এছাড়াও তার শাসনামলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করে একটা বড় জনসংখ্যাকে খুশি রেখেছেন।
সর্বশেষ এরশাদ মসনদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে। তারপর অবৈধ শাসন ও দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন তিনি। কিন্তু আবারও এ আওয়ামী লীগ-বিএনপি তাকে প্রয়োজনে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দুই নেত্রী এরশাদের কাছে হাজির হয়ে জোট করতে অনুনয়-বিনয় করেন। তাদের সমর্থন দানের জন্য আবারও রাষ্ট্রপতি বানানোর প্রলোভনও দেখানো হয়েছে বারবার। তারপর থেকে ক্ষমতা ও রাজনীতির ক্রীড়নক হয়ে ছিলেন তিনি। সম্ভবত তিনিই সমকালীন সময়ের অন্যতম সেনাশাসক, যিনি স্বৈরাচারের অপবাদ নিয়ে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসতে পেরেছেন। অন্যান্য বড় দলের ক্ষমতায় যাওয়ার ট্রামকার্ড হতে পেরেছেন। এ ধরনের রাজনৈতিক পুনর্বাসন ও প্রত্যাবর্তন শুধু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বেই সম্ভব।
এখনও তার দল সিস্টেম্যাটিক বিরোধী দলে আছে। শত দুর্নাম সত্ত্বেও আঞ্চলিক রাজনীতি তথা রংপুরে তিনি আমরণ জনপ্রিয় ছিলেন। রংপুরের মানুষ সংবাদ সম্মেলন করে তার মরদেহ সেখানে দাফনের দাবি করে। তবে এরশাদশূন্য বর্তমান জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব ও দাপট কতদিন টিকে থাকবে? নাকি আবার নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে ভাঙন বা বিভাজন তৈরি হবে, তা দেখার বিষয়। সেই আশির দশক থেকে আজও সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত এরশাদের ভালো-খারাপ ইতিহাস মূল্যায়ন করবে।
তবে একটা বিষয় বলতে হয়, এরশাদ ক্ষমতা থাকা অবস্থায় যে স্বৈরাচারী নীতি অবলম্বন করেছেন কিংবা ভালো কিছু কাজ করছেন, সেটা তরুণ প্রজন্ম দেখেনি! শুনেছে আর প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু ৯০ সালের পরে এরশাদ যখন আবারও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হলেন, তখন থেকেও যদি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতেন, জনগণের পক্ষে লড়াই করে দেখাতে পারতেন, তাহলে ৯০-পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম আরও বেশি দিন তাকে মনেরাখত!
লেখক: ওমর ফারুখ জাবেদ
মূল প্রবন্ধ : আলোকিত বাংলাদেশ