এই শহরে মৃত্যুর মিছিল চলছে, আর প্রতিনিয়ত সেই মিছিলে যোগ হচ্ছে এক একটি তরতাজা প্রাণ। শহর জুড়ে চলছে ডেঙ্গু মহামারী, ডেঙ্গু আতঙ্ক, ঝরে যাচ্ছে এক একটি প্রাণ।অসহায় পিতা এক সন্তানের দাফন শেষে হাসপাতলে ছুটছে আরেক সন্তানকে বাঁচানোর জন্য, সদ্যভূমিষ্ট সন্তানের মুখ না দেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে আরেক পিতা, এক গর্ভবতী মা সন্তান জন্মদানের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ পড়ুয়া তরুণীটি লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে।হ্যা চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল,নিয়ন্ত্রণহীন ডেঙ্গু পরিস্থিতি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শতশত মানুষ যেমন হাসপাতলে ভর্তি হচ্ছে তেমনি কারো কারো ভাগ্যে নেমে আসছে চরম পরিণতি,ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। আহা, এই মৃত্যু যেন অনিবার্য। শিশু- কিশোর, তরুণ-তরুণী,যুবক-যুবতী,সবোর্পরি আবালবৃদ্ধবনিতা কেউই যেন তার রাহুগ্রাস মুক্ত নয়।
ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্খিতি এখন শহর ছাড়িয়ে চলে গেছে গ্রামেও। দেশের ৬৪ টি জেলায় শুরু হয়েছে ডেঙ্গু মহামারী। গতকাল রোববার দেওয়া সরকারি তথ্য মতে ২৪ ঘন্টায় ১ হাজার ৮৭০ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চলতি মাসের তিন দিনে গড়ে দৈনিক রোগী ভর্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৫ জন। প্রথমআলোর হিসাব মতে এখন পর্যন্ত মোট ৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মেয়র, মেয়র সাইদ খোকন ছবি : সময়ের পরিবর্তন
শহর জুড়ে,দেশজুড়ে যখন ডেঙ্গু মহামরী রূপ নিয়েছে তখন আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বহীন কর্মকান্ড ও লাগামহীন কথাবার্তায় দেশ বাসী বিস্মিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সিটি করপোরেশনের মেয়র, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, কথিত সুশীল সমাজের কথাবার্তা ও কর্মকান্ডে রীতিমত বিরক্ত ও হতাশ দেশবাসী। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় তো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ও মৃতের সঠিক পরিসংখ্যানকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।এমনকি তিনি সরকরি পরিসংখ্যানকেও অবজ্ঞা করেছেন। এডিস মশার বংশ বিস্তারকে রোহিঙ্গাদের বংশ বিস্তারের সাথে তুলনা দিয়ে রীতিমত হাস্য রসের জন্ম দিয়েছেন। শুধু হাস্যরসের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত হননি মন্ত্রী, তিনিতো ঝটিকা সফরের মাধ্যমে সপরিবারে মালেশিয়া বেড়িয়ে এসে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রনের মন্ত্র শিখে এসছেন বলে মনে হয়। আর দেশে এসেই বলেছেন “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে প্যানিকড হওয়ার কিছু নেয়। (বাংলাট্রিবিউন)।
আর মেয়র সাহেবদের কথাই বা কি বলব তারা তো আর ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে আপনার বাসায় গিয়ে মশারী টাঙ্গিয়ে দিয়ে আসবে না। আপনি নিজ দায়িত্বেই মশারি টাঙিয়ে ঘুমালে ডেঙ্গু থেকে বেঁচে যেতে পারেন। আর হঠাৎ যদি বিকট শব্দে আপনার ঘুম ভাঙ্গে তাহলে ভয় পাবেন না চারিদিকে ধোয়ায় অন্ধাকার হলে কামান কিংবা গোলাগুলির আক্রমণ না ভেবে মশা মারা ফকার মেশিন ভেবে মনটাকে হালকা করে নিয়েন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতিপয় সুশীলদের ডেঙ্গু মোকাবেলা পদ্ধতির ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি।
দেশের সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বা সুবিধাভোগী মানুষ যারা,তারা দেশের সংকটে কালে সবচেয়ে কাযকরী ভূমিকা পালন করবে এটাই আমাদের কাম্য। অতীতে তাদের সেই ভূমিকার কারণে আমার অনেক সংকটকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। ডেঙ্গু প্রকোপ ও ডেঙ্গু ভয়াবহতা মোকাবেলায় একদল সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অভিনব কৌশল দেখে দেশবাসীর রীতিমত চক্ষু চড়ক গাছ। প্রচারসর্বস্ব এই মানুষগুলো ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবেলা করতে রীতিমত পিচঢালা রাজপথ ঝাড়ু দিতে নেমে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সেই ঝাড়ুর দৃশ্যতো ভাইরাল যা দেখে রীতিমত ক্ষেপে গেছে জনসাধারণ।
নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বহীনতা, প্রচারসর্বস্বতা যখন চরমে তখন দেশব্যাপী ডেঙ্গু মহামরী আকার ধারণ করেছে।ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার পিছনি বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমতো বলা যেতে পারে আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ধারণার বাইরে ছিল পরিস্থিত এত দূর গড়াবে। দুই সিটিকরপোরেশন, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রথমে পরিস্থিতি হালকাভাবে নিয়েছে যার কারণে ক্রমশই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলছেন, এই বিষয়ে তারা আগেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে সাবধান করেছিলেন। মার্চ মাসে জরিপ করেই তারা সিটিকরপোরশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই জরিপের ফলাফল ঘোষণা করেন যেখানে বর্তমান পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়া এবং মহামারী আকার ধারণ করার পিছনে অন্যতম কারণ আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন । শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্বের অধ্যাপক মিজানুর রহমান ও মশক বিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার বলছেন দীর্ঘ সময় ধরে বর্ষা ও গরমের অস্তিত্ব এডিস মশার ক্রমাগত বংশ বিস্তারে সহায়তা করেছে। ধাপে ধাপে বর্ষা ও গরম এডিস মশার বংশবিস্তার সহায়ক কেননা তাদের প্রজনন কাল দীর্ঘ হয়ে থাকে। ক্রমই বংশ বিস্তার করা এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কোন কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশের নেই। সিটি করপোরেশন শুধু সাধারণ কিউলেক্স মশাকে তার্গেট করে।
এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ তথা এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।মশক বিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার এবং কীটতত্বের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলছেন দীর্ঘদিন যখন কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তখন তার কার্যকারিতা হারায়। আইসিডিডিআরবি বলছে সিটি করপোরেশনের মশা মারা পারমিথ্রিন ঠিক মত কাজ করে না। মশার ক্ষেত্রে কিলিং এজেন্ট যে পারমিথ্রিন সেই পারমিথ্রিন ঠিক মত কাজ না করলে মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে কীভাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ডেঙ্গুর প্রকোপ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণের বাইরে চলে
যাওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ হলো সিটি করপোরশনের যথেষ্ট কারিগরি সক্ষমতা না থাকা, কর্মকর্তাদের
একে অপরের দোষারোপের প্রবণতা এবং ডেঙ্গু প্রকোপ শুরু হলে তৎপর হওয়া।
সিটি
কর্পোরেশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
২০০০
সালের পর এই বছরই ডেঙ্গুর সবচাইতে বড় প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর পর থেকে
প্রতিবছরই এটি কিছুটা দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর ধরে
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সময়কাল দীর্ঘ হচ্ছে।
কিন্তু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনগুলো সময়মত পদক্ষেপ নেয়নি বলে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। কীটনাশক ক্রয় ও ব্যবহারে দুর্নীতির অভিযোগ এমনকি তাদের কারিগরি সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুধু সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন নয় বরং যখন কীটনাশক ক্রয়ে দুর্নীতি , কীটনাশ কার্যকরক না হওয়ার মত বিষয় সামনে আসে তখন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের পরস্পরের দোষারোপ চক্র আমরা দেখেছি।
জরিপের মাধ্যমে পূর্বেই বর্তমান অবস্থার সর্তকতা প্রদান স্বত্বেও গুরুত্ব না দেওয়া এবং ডেঙ্গু প্রকোপ শুরু হলে তৎপর হলেও পরিস্থিতি আসলে দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতলে গেলেও অনেক সময় সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না, ডেঙ্গুর পরীক্ষার যথেষ্ঠ সুবিধা নেই হাসপাতালগুলোতে। এর মধ্যে আবার নামকরা সরকারী হাসপাতালগুলো যেন মুনাফা অর্জনের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে ডেঙ্গু মহামারীকেই। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুর প্রকোপ চলতে পারে।
বর্তমান সময়ের এই ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্ব সহকারে সকলের কাজ করার কোন বিকল্প নেই । আমারা নাগরিকরাও দায়িত্ববোধ থেকে এড়িয়ে যেতে পারি না,ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে গুরুত্ব না দিয়ে পরবর্তীতে দূর্ঘটনা ঘটুক এমন পরিস্থিতি যাতে না সৃষ্টি হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, দায়িত্ববোধ এবং কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আসুক ডেঙ্গু মহামারি আর মৃত্যুর মিছিলে যেন যোগ না হয় আর একটিও তাজা প্রাণ সেই প্রত্যাশাই রইল।
তথ্যসূত্র :
প্রথম আলো
বাংলাট্রিবিউন
বিবিসি বাংলা
বণিকবার্তা
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
পূর্বের অবস্থা যা ই হোক না কেন এটার বর্তমান অবস্থা যে খুব সোচনীয় তা আমরা আঁচ করতে পারছি খুব ভালো ভাবে এই আলোচনার মাধ্যমে। আবার আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে চিনি শিল্পের এই মন্দাবস্থা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জনসাধারণের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যদিও এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী মূলত শিল্পের সাথে জড়িত নীতিনির্ধারকরা।
আমরা জেনেছি যে বাংলাদেশে সরকারী ১৫ ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২ টি চিনিকল রয়েছে, এবং ৫ টি চিনি পরোশোধনাগার রয়েছে। এই শিল্পের সাথে ১২.৫ লক্ষ পরিবারের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আখ চাষ এবং চিনি আহরণের হার খুবই কম। দেশে প্রতি একরে আখ উৎপাদন হয় মাত্র ১৫ মেট্রিক টন যা হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ৭০ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার চিনি আহরিত হয় মাত্র ৭.৪ % যা অস্ট্রেলিয়া ১৫.৭ % পর্যন্ত হয়ে থাকে।
চিনিশিল্প
চিনি শিল্পে ধস মোটামুটি শুরু হয়েছে ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে। অথচ ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে কিন্তু বাংলাদেশে মোট আখ উৎপাদিত হয়েছিলো ২০ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন হয়েছিলো ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬২ মেট্রিকটন। যা প্রায় ৮.৭৭ %। কিন্তু ২০০০-০১ মৌসুমে সেটা কমে হয় ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬ মেট্রিকটন এবং চিনি আহরিত হয় ৯৮ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। যা কমে হয় ৭.১১ %।
মূলত জলবায়ু পরিবর্তন,তুলনামূলক কম সূর্যালোক ঘণ্টা, আগাম আখ চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস, নিচু জমিতে আখ চাষ, উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত ইক্ষু জাতের অভাব, অপরিপক্ক আখ মাড়াই, পুরাতন যন্ত্রপাতি ও মিলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কমতে থাকে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন।
২০১০ সাল পরবর্তী সময়ে চিনি আহরণ হার ও মোট চিনি উৎপাদন হটাৎ এমন খাপছাড়া কেন হয়ে যাওয়ার পেছনে যে কয়েকটি কারণ মূখ্যভাবে দায়ী তা হলো ‘ চাষীরা আখ বিক্রির টাকা সময় মতো না পাওয়া, আখের বদলে অন্য ফসল চাষে তুলনামূলক বেশী লাভ, চিনি মিল গুলোর কাছে চাষীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আটকে থাকা, পাওয়ার ক্রাশারের আগমন, এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল আচরণ না করা।
চিনি উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে রয়েছে মানসন্মত আখের অভাব, মাটি ও আবর্জনা যুক্ত আখ মিলে সরবরাহ, ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি আখ মাড়াই করে রস ড্রেনে ফেলা, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্লাটফর্মে ও মাঠে আখ শুকানো, আখ থেকে রস ঠিকমত বের না করা, সর্বপরি দক্ষ জনবলের অভাবে চিনি আহরণে ব্যাপক গড়মিল তৈরি হচ্ছে।
শুধু চিনি উৎপাদনেই লোকশান হচ্ছে না। অদক্ষ জনবল, পরিকল্পনার অভাব, নিম্নমানের আখ চাষ, ক্রয় বিক্রয়ে দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় খরচ, ব্যায়ের খাত বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অনিয়ম যেন বাসা বেঁধে বসেছে চিনিকলগুলিতে।ফলে কিছু কিছু কর্মকর্তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও চিনিকলগুলির এবং শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
চিনি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানিকারী পণ্য হতে পারে এবং কতগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করতে পারে, যেমনঃ কারখানাগুলির আধুনিকীকরণ, পূর্ণমাত্রায় আখ উৎপাদন, সহজশর্তে আখচাষীদের ঋণ প্রদান, রিফাইনারিগুলিকে পূর্ণমাত্রায় চিনি উৎপাদনের জন্য অনুমতি প্রদান, আখ চাষে ও চিনি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার, অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ, মিল কর্মচারীদের অপকর্ম থেকে বিরত রাখা এবং চিনিকলগুলি থেকে উৎপাদিত উপজাত পণ্যের (by-products) সঠিক ও ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
লিখেছেনঃ
মারুফুজ্জামান
৪৬ তম আবর্তন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
“আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে দেখেছি, যিনি জ্ঞানে ও নেতৃত্বে হিমালয় সম” -বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এই বাণী ই জাতির জনক সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতে কৌতূহলী করে তোলবে যেকোনো মুজিবপ্রেমী ব্যাক্তি কে।
বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গরে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পান নি, কিন্তু সদ্যস্বাধীন দেশটি নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতেই আজকে আমাদের এই দেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রিয় নেতা পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার কাঠামো প্রবর্তন করেন।
আজকের এই দিনে স্বল্পসময়ে জাতির জনকের গৃহীত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র নীতি সহ সংক্ষেপে তাঁর শাসন কাল আলোকপাত করা হলো।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রিয় এই নেতা খুব অল্প সময়েই আলোচিত উঠেন তাঁর বন্ধুত্বপূর্ন আচরণ,বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দক্ষতার মাধ্যমে। এই স্বল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, ওআাইসি সহ ১২৬ দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নেতার সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছিলেন। তাছাড়াও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ, অবাঙালিদের রেখে যাওয়া শিল্প কারখানায় দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা,স্বীকৃতি ও সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের ক্রোধের ফল সরূপ সৃষ্ট ভয়াবহতা অনুধাবন, পাকিস্তানের শাসন,নির্যাতনের বিরুদ্ধ আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে। সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রিয় বাংলা কে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হবে হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাইতো তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সাথে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব স্থাপন করেন বিপরীত দিকে তাঁর গৃহীত কৌশলপূর্ণ নীতির কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী চায়না আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী হয়ে উঠেছে।মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার বিরোধী ভূমিকা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ১ অক্টোবর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর ফোর্ডের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে মিটিং করেন।১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ আন্দোলন এর শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে ন্যামের সদস্য রাষ্ট্রদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক কৌশল সফল হয়। ফলে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের মাধ্যমে প্রিয় দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে নিজস্ব স্থান তৈরি করে নেয়।এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু যা সারা বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
নব্যস্বাধীন দেশ বিধায় তখনো রাষ্ট্রের সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিলো নানাবিধ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান। অভ্যন্তরে ছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের মিত্রদের বিচারের দাবী অন্যদিকে দেশের স্বীকৃতি অর্জনে পাকিস্তানের মিত্র দেশগুলোর বিরোধিতা। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লবী মনোভাব জাগ্রত করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতা অর্জনের ১ বছরের মধ্যে ই আওয়ামী লীগের ছাত্র সমাজের একাংশ গড়ে তোলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)। দ্বিধা বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি গুলো দেশে এনজিও এর মাধ্যমে সহযোগিতা কার্যক্রম চালু রাখে যা পরবর্তী তে দেশে প্রধান শক্তি হয়ে উঠে।
আওয়ামী লীগের ওপর ছিল দেশ পুনর্গঠনের সামগ্রিক চাপ কিন্তু কাজের ফলাফল ছিল ধীর। এই সময়ে অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ ওঠে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রবল হয়ে উঠে যা উগ্রপন্থী যুব নেতৃত্ব ও মধপ্যন্থী মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ে।এ পরিস্থিতিতে সরকার পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তি দান করে ও আওয়ামীপন্থী বিশ্বাসীদের নিয়ে উগ্র পন্থীদের দমনে রক্ষী বাহিনী গঠন করে।
নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র থেকে আমরা জানি,প্রতিটি ক্রিয়ার ই সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে,তেমন জাতির জনকের শাসন কালেরও আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে, তাই বলে একটি রাষ্ট্রের জন্ম যার হাত ধরে তাঁর পরিবারের এমন নৃশংস হত্যাকান্ড কখনো গ্রহনযোগ্য হতে পারে না।
দেশগঠনে অকৃত্রিম প্রচেষ্টা কারী এই রাষ্টনায়কই কতিপয় সেনাবাহিনীর অফিসারের রোষের কবলে পড়ে প্রিয় পুত্র শেখ রাসেল,২ পুত্রবধূ, সকল বিপদে সাহস প্রদানকারী স্ত্রী সহ পরিবারের আরো সদস্য নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। প্রিয় বাংলার শোষিত জনগণের কল্যাণে আত্ননিয়োগকারী রাষ্ট্র নায়ক,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ তম মৃত্যুবার্ষিক,তাঁর প্রতি জানাই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
১.লেখার শুরুতে একটা হাসির গল্প বলে নিতে চাই। করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও চালু রাখতে হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এক ব্যাংক কর্মকর্তা আর গ্রাহকের কথোপকথন হচ্ছে। গ্রাহকটি ব্যাংকে মোটামুটি অংকের টাকা তুলতে এসেছেন। কর্মকর্তাটি গ্রাহককে প্রশ্ন করলেন সবকিছু বন্ধের মধ্যে তিনি কেন টাকাগুলো তুলছেন? গ্রাহক জানালেন, লকডাউনে বাসায় বসে থাকতে গিয়ে বিরক্ত তিনি। বাইরের পরিবেশ দেখতে আর বিরক্তি কাটাতে ব্যাংকে চলে এসেছেন । হাতে চেক বই দেখে রাস্তায় পুলিশও তাকে কিছু বলেন নি। কর্মকর্তাটি গ্রাহকের এমন বক্তব্যে হতবাক হয়ে গেলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে টাকাগুলো গুনে নিয়ে দ্রুত সেই লোকটিকে বাড়ি চলে যেতে বললেন কর্মকর্তাটি।লোকটি আরো অবাক করে দিয়ে তাকে জানালেন, গোনার দরকার নেই। টাকাগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই কাল এসে জমা দিয়ে যাবেন তিনি। ব্যাংকগুলো খোলা রাখায় লকডাউনের বিরক্তি কাটাতে সুবিধা হয়েছে তার। ব্যাংকেও আসা হয় বাইরের পরিস্থিতিও নিজ চোখে দেখা যায়! এই গল্পটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমার নজরে আসে। সারাদেশের কার্যত লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক খুলে রাখায় ক্ষুব্ধ ব্যাংকিং খাতে কাজ করা মানুষেরা। তাদেরই একজন গল্পটি ছড়িয়ে দিয়েছে৷ আর তাঁর কল্যাণেই এমন নিদারুণ হাস্যরসের গল্পটি জানতে পেলাম। আশা করছি গল্পটি মিথ্যা হবে। বৈশ্বিক বিপর্যয়ের এই সময়টাতে কোনো মানুষ গল্পের গ্রাহকের মতো কাজ করবে না বলে বিশ্বাস করতে চাই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আরেকটা ভিডিও দেখে এই জাতিকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। একজন পুলিশ সদস্য একা একা মাইকিং করে এই করোনা বিপর্যয়ের সময়টাতে সবাইকে ঘরে থাকার আহবান জানাচ্ছেন। আশেপাশের সবাই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সে কেনো হাতে লাঠি নিয়ে আসে নি! লাঠি না নিয়ে কেন সে মানুষকে বোঝাতে আসলো সেটা অনেকের মনে দুঃখ দিয়েছে। আসলেই কি আমরা এমন জাতি যাদের পিঠে লাঠির আঘাত না পড়লে নিজেদের ভালোটুকু বুঝবো না?
২.
আমি যে মুহুর্তে এই লেখাটা লিখছি তখন সারাবিশ্বে করোনায় মারা গেছেন এক লক্ষ মানুষ। পুরো পৃথিবীটাই এক প্রকার ঘরে বন্দী অবস্থায় আছে। এই অবস্থায় সবাই মিলে ঘরে থাকার ফলে প্রকৃতির ওপর প্রভাব পড়েছে অসাধারণ। বাতাসে দূষণ কমে গেছে, আশপাশ পরিষ্কার হয়েছে। দীর্ঘদিন পর অনেকটা দূর থেকে নাকি হিমালয় দেখা যাচ্ছে, কক্সবাজারে ডলফিন ফিরে এসেছে। নেটিজেনরা ( ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অংশ হওয়া মানুষদের এই শব্দ দিয়ে অভিহিত করা হয়) মজা করে বলছে, প্রকৃতির এত কিছু ফিরে আসার মধ্যে মানুষের জীবনে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক/প্রমিকারাও হয়তো ফিরে আসবে! তবে জীবনে পুরনো প্রেমিক/প্রেমিকারা ফিরে না আসলেও সমাজের পুরনো একদল মানুষ কিন্তু ঠিকই ফিরে এসেছে। তারা হচ্ছেন ত্রাণের চাল চোর সম্প্রদায়। এই মুহুর্তে দেশের মোট করোনা শনাক্ত মানুষের চেয়ে সরকারি ত্রাণের চাল চুরি করা মানুষের সংখ্যা বেশি। সারাবিশ্ব যেখানে মৃত্যুভয়ে থমকে গেছে সেখানে আমাদের চাল চোরেরা পুরনো প্রতাপে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার বাংলাদেশে৷ কোভিন ১৯ শনাক্ত মানুষের চেয়ে নিশ্চিত ভাবে এই রোগে মৃতের সংখ্যার তারতম্য খুব বেশি নয়৷ এমন একটা ভয়ানক সময়ে দাঁড়িয়ে এইসব চাল চোরদের জন্য আমার কেন জানি মায়া হয়! স্রষ্টা না করুক করোনা ভাইরাসেই যদি চাল চোরেরা মারা যায় তবে চুরিকরা এসব চালগুলোর জন্য তাদের আফসোস হবে। মৃত্যুর পরেও তাদের আফসোসের কথা ভেবেই আমার খারাপ লাগছে।
৩.
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও আমার বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করলো। সেই ভিডিওতে দেখলাম এক ইউপি সদস্য করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ নিতে আসা কিছু বেরোজগার মহিলার ওপর চোটপাট করছে। তাঁর চোটপাট এবং হুংকারের কারণটা জেনে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আহারহীন মানুষদের তিনি জোর গলায় শাসাচ্ছেন এবং ত্রাণ দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। কারণ ত্রাণ সহযোগিতা তিনি তাদেরকেই করবেন যারা নাকি তার নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী! ভিডিওটা দেখে মর্মাহত হলাম। মনে মনে বিশ্বাস করতে চাইলাম আমার দেখাটা যেন ভুল হয়। করোনা ভাইরাস কোন দল চেনে না। সে চেনে মানব দেহ। তাঁর সংস্পর্শে যে শরীরটা আসবে তাকেই সে আক্রমণ করবে৷ করোনার আক্রমণ থেকে যদি নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয় তবে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে৷ কিন্তু ঘরে খাবার না দিয়ে তো আপনি তাদের ঘরে রাখতে পারবেন না। কারণ কষ্টকর সত্য হচ্ছে এই যে পেটের ক্ষুধা করোনা ভয় মানে না। সারাবিশ্বকে থামিয়ে দিলেও করোনা মানুষের পেটের ক্ষুধা থামাতে পারে নি। আর সেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রথমে বাইরে বের হবে আয়হীন মানুষ, তারপর বের হবে নিম্ন আয়ের মানুষ, তারপর স্বল্প আয়ের। এভাবে করে ঘরে যাদের খাবার কিছুই থাকবে না তারা সবাই রাস্তায় বের হয়ে যাবে৷ আর বাস্তবতা হচ্ছে এই করোনা আক্রমণ থেকে নিজে বাঁচতে হলে অন্যদের নিয়েও বাঁচতে হবে। কারণ এই ভাইরাসটি কেবলমাত্র তখনই থামবে যখন সংক্রমণের জন্য একটি মানবদেহও আর সে খুঁজে পাবে না। আর মানবদেহগুলোকে যদি ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে হয় তবে সেগুলোর পেটের ক্ষুধার সংস্থান করাও আবশ্যক। মানুষদের খাবারের দুঃশ্চিন্তা নির্মুল করে বাইরের সমাজ থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সেই চিন্তা দূর করার পদক্ষেপে যদি অতিউৎসাহী এসব ইউপি সদস্যদের উপস্থিতি বেশি হয়ে দাঁড়ায় তখন কিন্তু গন্ডগোল।যারা কিনা মনে করে গণমানুষের মতামত নিয়ে তারা নিজেদের সরকার বাহাদুর নাম রেখেছে। সেই বাহাদুরকে কিন্তু এইসব চ্যালাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বাহাদুরি দেখাতে হবে। বাহাদুরি দেখাতে হবে চাল চোরদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রেও। নয়তো দলকানা ইউপি সদস্য আর চাল চোর চেয়ারম্যানরা মিলে জনগণ নামক বস্তুটিকে খেপিয়ে তুলবে।শুনেছি ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর আইয়ুব খানের শাসন’ দুটোই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বস্তু ছিল। বাঙালী খেপে গিয়ে কিন্তু আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলো।
৪.
পৃথিবীব্যাপী করোনাক্রান্ত লাখ খানেক মৃত্যুর মধ্যে চিকিৎসা সেবায় জড়িত অনেকেও কিন্তু মারা গেছেন৷ করোনা বিপর্যয়কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ধরে প্রতিটি দেশের মৃত চিকিৎসা পেশার মানুষদেরকে দেওয়া হচ্ছে শহীদের খেতাব। কারণ সবাই জেনে গেছে এই যুদ্ধে সেনাপতি – সৈনিক যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়ে বিরোধী শিবিরে গুলি চালানো কেউ নয়। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে দিনরাত মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া লোকগুলোই এই যুদ্ধে আমাদের বড় শক্তি। এদেশে প্রথমেই যখন করোনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো তখনই আক্রান্ত হওয়া শুরু করলো একে একে ডাক্তারেরা। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের চিকিৎসা সেবায় বিশেষ জায়গা দখল করে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সাংবাদিকতার সূত্রে আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো এই সময়ে কেমন সেবা দিচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। যে ভয়াবহ তথ্য জানতে পারলাম সেটা উল্লেখ করতে চাচ্ছি। করোনায় শুরুতেই ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এদিকটায় এসেছিলেন৷ লকডাউনের শুরু হলে কিছু কিছু সরকারি হাসপাতাল সহ অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক গুলোয় রোগী দেখা সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়টাতে অধিকাংশ অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে। মৌসুম পরিবর্তনের কারণে রোগীদের বেশিরভাগই ছিল সর্দি-জ্বর, কাশি- গলাব্যথা সহ করোনার অন্যান্য উপসর্গ সমৃদ্ধ। এ পর্যন্ত ঘটনা সাধারণ চোখে এক প্রকার ঠিকই ছিল। কিন্তু ভয়াবহ কথাটা জানা গেলো এরপরে। আমার জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই লেখাটার সময় পর্যন্ত কোনো ধরনের জীবাণুরোধী ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) পান নি। সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় তারা রোগী দেখেছেন। এমন চিত্র আমি মনে করি সারাদেশের। সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বড় চিকিৎসক সবাইকেই একটু বেশি নিরাপত্তায় রাখতে হবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। যদিও তাদের কিছু অংশের কার্যক্রম নিয়ে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবুও এটা ভুলবাবর কোন জো নেই যে স্রষ্টার পর আমাদের এই বিপদে রক্ষাকর্তা তারাই।বেঁচে থাকলে চিকিৎসকদের কাজের সমালোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সময়ে অন্তত তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেই। নিজেদের প্রয়োজনে তাদের সাহস যোগাই। হয়তো চিকিৎসা অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যখাতের খারাপ দশা, স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোভাব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তবে যেটাই হোক এর মধ্যেই বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হবে। নিজে বাদে অন্য সবার দোষ ধরে আমাদের সময়টা কেটে যেতে পারে কিন্তু বাঁচতে হলে এসবের মধ্যেই লড়াই করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত বিশ্বে করোনা প্রতিরোধক কোনো যথার্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার না হয় ততদিন যারই দোষ ধরি না কেন মৃত্যুর মিছিল থামাবার কোনো উপায় নেই। এই বাস্তবতা বাংলাদেশ কিংবা আমেরিকা সব জায়গাতেই এক। তাই ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ আদর্শই ধারণ করতে হবে। নিজে যথাসম্ভব সঙ্গ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। যত খারাপই লাগুক সরকারি নির্দেশনা মানতে হবে, মানাতে হবে৷নিজেদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে ‘এই শহরে আর কেউ বেঁচে নেই’ – এমন বাক্য আমরা কেউই শুনতে চাই না।
লেখক: শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।