Connect with us

ফিচার

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

Published

on

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

 

” উত্তুরে হাওয়ার পসরা জোগায় নেমে এলো মায়াবী শীত
কুয়েলিকা মন বারতা পাঠালে ঝরাপাতা ধরে বীণ
থির থির ভোরে মেঘের মত কুয়াশারা মেলে ডানা
আলতো রোদে বালিকার মন হেসে হয় আটখানা।”

শীতের উত্তুরে হাওয়ায় কবিমন হয়ে উঠে চঞ্চল। স্বভাবতই প্রকৃতির সাথে মানবমনের রয়েছে এক নিগূঢ় যোগসূত্র। আর এই যোগসূত্র শীতঋতুতে জেনো আরো প্রবল হয়ে উঠে। শিশির ভেজা প্রকৃতি, কুয়াশাচ্ছন্ন ঘাসের পাতার সূর্যালোকিত হয়ে হীরকের মত ঝলমলানী, বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হলুদ সরষেফুল, পত্রশূণ্য গাছ-গাছালি জেনো প্রতিটি বাঙ্গালির মনেই দাগকাটে একটু বৈচিত্রপূর্ণভাবে। ঠিক একইভাবে বহিরাঙ্গিক সকল রূপ নিয়ে প্রসন্নতা- বিষণ্ণতার আলপনা আঁকতে বৈচিত্রময়তার সর্বোচ্চ সমাহার নিয়ে শীতের আগমন ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। যদিও আমরা বলে থাকি প্রকৃত শীতের ছোঁয়া পেতে গ্রামের কোনো বিকল্প নেই কিন্তু বিচিত্রময় প্রকৃতি ও পরিবেশের অভয়ারণ্য সাতশো একরের এই ক্যাম্পাসে শীতের আগমন কোনোভাবেই গ্রাম থেকে আলাদা নয়। কিছু কিছু দিক থেকে বরংচ আরো বেশিই সমৃদ্ধ। শহরের মধ্যে গ্রাম্য ছোঁয়ায় শীতের আমেজে জেগে উঠে এই ক্যাম্পাস। নৈসর্গিক সবুজের সমারোহে ঘেরা এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে শীত আসে তার গতানুগতিক চিরচেনা রুপের বাইরেও আরো আলাদা কিছু মুগ্ধতা নিয়ে। শীত যেনো তার বর্ণিল রূপের এক অনবদ্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে। গোধূলির সোনালী সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই মাঝারী কুয়াশার চাদড়ে আঁকড়ে ধরা প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যায় শীত এসে গেছে। হিমেল হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন ধরানো এক ঝাঁঝালো মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে শীত আসে এইখানে।

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ মীর রাসেল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত মানেই জমকালো পরিবেশ, শীত মানেই সকাল সন্ধ্যা অতিথি পাখির ঝাঁঝালো কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধকর কিচিরমিচির, শীত মানেই সন্ধ্যা রাতে খোলা মাঠে দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশার মাঝে আগুল জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের গানের আসর আর আড্ডা, মোড়ে মোড়ে ধোয়া ওঠা পিঠার টং এর দোকান কিংবা লাল শাপলার ভিড় ঠেলে অতিথি পাখিদের জলকেলির দৃশ্য। এই অতিথি পাখিগুলোর জন্যই জাহাঙ্গীরনগরের শীত হয়ে উঠে জমকালো। কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীত আসার শুরু থেকেই গুটি গুটি পাখনা মেলে ক্যাম্পাসের প্রতিটি লেকেই সমাগম ঘটতে থাকে এই অতিথিদের। সাইবেরিয়ার তীব্র শীত থেকে বাঁচতে প্রতিবছর বাংলাদেশের খুউব অল্পকিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এই অতিথি পাখিদের দল।

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ আসাদুজ্জামান আসাদ

তাদের মধ্যে বিরাট একটি অংশ জায়গা করে নেয় জাহাঙ্গীরনগরের লেকগুলোতে। ক্যাম্পাসের লেকগুলোও যেনো শীতের শুরুতেই লাল শাপলা ফুটিয়ে তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে। এ জেনো মনকে শীতল করে দেওয়ার মতো এক দৃশ্য। শীতের সকালে বা বিকেলে ধোয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে এদের জলকেলি, লাল শাপলার ভেতর দিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে ভাসতে থাকা, দল বেধে মুক্ত আকাশে ঘূর্ণির মতো উড়াউড়ি জেনো যেকোনো মুসাফিরবে মনকে শান্ত করার জন্য যথেষ্ট।

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ অপু

উপযুক্ত পরিবেশ এবং নিরাপদ আশ্রয়ে এসব অতিথি পাখি শীতের কয়েকটা মাস জেনো নির্ভয়েই কাটিয়ে দেয় এই অভয়ারণ্যে। এদের কলকাকলিতে যাদুর মতো কেটে যায় আমাদেরও শীত। এই অতিথিরা যে শুধু আমাদের মনকেই ভুলিয়ে রাখে, শুধু তাইনা; এদেরকে দেখার জন্য প্রতিবছর এইসময়ে ক্যম্পাসে ভীড় জমে প্রচুর পর্যটকের। তাদের মধ্যে বিদেশী পর্যটকও লক্ষণীয়। সময় আর শীতের তীব্রতায় দিন দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে চলেছে অতিথি পাখির সংখ্যা। এদেরকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানাতে এবং সাথে সাথে অতিথি পাখি সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় পাখিমেলার। সে জেনো এক উৎসবমুখর পরিবেশ!মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ রাতুল হাসান

পাখিদের পাশাপাশি এদের ঘিরে মিশে থাকে আরেক মহোনীয় আকর্ষণ। ছোটোবড়ো মিলিয়ে এই ক্যাম্পাসে প্রায় দশটির মতো লেক রয়েছে। শীতের শুরু থেকেই এই লেকগুলোতে ফুটতে থাকে শাপলা আর কচুরিপানা। শীতের সকালে কুয়াশার জাল যখন লেকগুলোর উপরে বিছিয়ে থাকে তখন কুয়াশার মাঝে শাপলা আর কচুরিপানা দেখে মনে হয় জেনো তাকিয়ে আছে শত শত রঙবেরঙ এর হাওয়া মিঠাই। ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে প্রায় তিনরঙ্গের শাপলা ফুটতে দেখা যায়: সাদা, লাল এবং বেগুনি। বেগুনি শাপলা একটি দূর্লভ প্রজাতির শাপলা হলেও শুধুমাত্র ক্যম্পাসের লাইব্রেরী সংলগ্ন ছোট্ট একটি জলাশয়ে এটির দেখা মেলে। বেগুনি শাপলার আছে তীব্র আবেগ এবং মহোনীয় শক্তি। এ শক্তি তার সংস্পর্শে না গিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এই পরিবেশে জেনো পঙ্কতিমালা না মিললেও কবি নজরুলের একগুচ্ছ কবিতার চরণ মনে পড়ে-

“কেতকী-কদম-যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থৈ থৈ করে শ্যামল শোভার নবনী॥
শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনী-গীতি গাহিয়া।
অঘ্রাণে মাগো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনী॥”

অতিথি পাখি, শাপলা বনের সাথে সাথে ক্যাম্পাসের আরেকটি জিনিস জানান দেয় শীতের। সেটি হলো শিউলি ফুলের শীতল মিষ্টি গন্ধ। মেয়েদের প্রীতিলতা হল এবং ফজিলাতুন্নেছা হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় সাদা আর কমলার মিশ্রনে তৈরী এক শুভ্র কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও শিশিরস্নাত লাল-হলুদ কলাবতী, ডালিয়া, গাজর, সারি সারি গাধাফুল তাদের পাপড়িতে জেনো শীত মাখিয়ে নিয়ে আসে।

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ সংগৃহীত

জাবিতে শীতকাল মানেই হলো উৎসবের ধুম। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন: জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, চিরকুট, ধ্বনি, গীতনাট, জুডো, জাডস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর টানা দুই মাস সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ক্যাম্পাসবাসীকে শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়। ছোটোবড়ো কয়েক ডজন উৎসবের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষনীয় হয়ে থাকে হিমউৎসব। তিনদিনব্যাপী এই উৎসব তুলে নিয়ে গ্রামবাংলার পুরাতন কিছু সংস্কৃতি যেমন: সাপখেলা, লাঠিখেলা, পুতুলনাট্য ইত্যাদি। হারিয়ে যাওয়া এসব সংস্কৃতির ছোঁয়ায় পুরাতন ঐতিহ্যগুলো জেনো তরতাজা হয়ে উঠে। আর এরজন্য ক্যাম্পাসসহ আশেপাশের এলাকার মানুষও জেনো একটি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। জাবিতে শীতের আরেকটি বড় আকর ।

মোহনীয় শীতের আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ছবিঃ সংগৃহীত

আকর্ষণ হলো ক্যাম্পাসের পিঠার দোকানগুলো। শীতের পিঠা-পুলির আয়োজনেও পিছিয়ে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিঠার দোকানগুলো। দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত এসব দোকানে চলে শীতের নানা রকম পিঠা তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, পরিবহন চত্বর, বঙ্গবন্ধু হল চত্বর, ক্যাফেটেরিয়া, মীর মশাররফ হোসেন হল, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হলের মাঝখানের স্বপ্ন চত্বরসহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠে ছোট ছোট পিঠার দোকান। পিঠার জন্য বিশেষ ভাবে সারাক্ষণ এসব দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। ধোয়া ওঠা গরম গরম এই পিঠা হাতে নিয়ে জেনো মাসে পর মাস বাড়িতে না যেতে পারা, মা-খালাদের হাতের শীতের পিঠা খাওয়ার আফসোস কিছুটা হলেও কমে এইখানকার শিক্ষার্থীদের। শুধু চলমান শিক্ষার্থী নয়, এই পিঠার টানে ছুটে আসেন সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকার আশপাশের অঞ্চলের বহু মানুষজন। পিঠা যেমন শীতের বিকেলের আকর্ষণ, তেমনিভাবে শীতের সকালের আকর্ষণ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে খেজুররস। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে মাটির কলস ভরে ফেরি করে বিক্রি করতে আসে খেজুররস। বাংলাদেশের প্রথম সাড়ির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে; শহরের মাঝে গ্রামের এমন ছোঁয়া পেয়ে গেলে আর কিইবা লাগে!

বটতলার খাবারের দোকানগুলোতেও জেনো শীত নামে। বটতলার বাহারী খাবারের তালিকায়ও স্থান করে নেয় শীতের শাক-সবজিগুলো যেমন: ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, বরবটি, টমেটো ,লাউ, শিম, সরিষা, পালং ইত্যাদি। জাহাঙ্গীরনগরে বেড়াতে এসে বটতলার খাবার মুখে না দিয়ে চলে যান এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

কুয়াশাঘেরা রূপের মাধূরী নিয়ে শীত আসে এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। কনকনে ঠান্ডায় যখন বাইরে বের হওয়ার জো নেই তখনো শীতের সৌন্দর্যের মধুরিমা উপলব্ধি করতে বাইরে বের হয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। শীতের সকালের সবটুকু সৌন্দর্য আর মাধুর্য যেনো ইশ্বর ঢেলে দিয়েছেন এই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে। প্রকৃতি যেনো তার রূপটি উজাড় করে দিয়েছে এর বুকে। সত্যিই, শীত তার বর্ণিল রূপের এক অনবদ্য মুগ্ধতার ডানা মেলে ধরে এই সাতশো একরে।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

বিংশশতকের নব্বয়ের দশকে জন্ম হয়েছিলো যমুনা নদীর শহর টাঙ্গাইলে এবং স্থায়ী ঠিকানা ভৈরব নদীর শহর যশোরে। জলের ধারে জন্ম, জলেই স্থায়িত্ব; এদিক থেকে বলা যায় জলের জাতক। বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহর ঘুরে প্রবাহের মত বেরে ওঠা। । ছোট গল্প-সাহিত্য বোঝার পর থেকেই কথাসাহিত্য এবং সংগ্রামী মূলক লেখা পড়ার প্রতি ঝোকটা বেশি । জীবনের প্রতিটি ছোট ছোট মূহূর্ত নিয়েই সাজানো যায় কবিতা। আবার একগুচ্ছ ছোটবড় মূহূর্ত আর কল্পনা মিলিয়ে রূপ নেয় উপন্যাস। এইবোধ থেকেই হাতে কলম ধরা। ভীষণ কল্পনাপ্রবণ জীবন, বাস্তবের পাশাপাশি কল্পনায় প্রিয় মানুষদের সাথে কথোপকথনে সময় কাটাতে পছন্দ বেশি। বাতাসে কবিতার ঘ্রাণে কবিতাপ্রেমী হয়ে সময়ের সাথে কল্পনা এবং বাস্তবের মাঝামাঝি অনুভূতি নিয়েই আপনমনে জন্ম নিয়েছে কবিতার বুননশিল্প। প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কবিতাগ্রন্থ "একজন পাণ্ডুলিপি বলছি"। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে পড়াশুনা, লেখালেখির নেশা ধমনীর শিরা ও উপশিরায়। প্রকৃতিপ্রেম ও কবিতার মিশেলেই একজন সাদামাটা মানুষ।

সর্বাধিক পঠিত