ইতিহাস
৩ নভেম্বর এবং জাতীয় চার নেতার “বঙ্গবন্ধু’র সহযোদ্ধা ” হয়ে উঠার দিনগুলো

Published
4 years agoon

বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। সেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় বাঙালির স্বপ্ন ছিল নিজ জাতি সত্তা বজায় রেখে একটি সুন্দর মুক্ত জীবন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কৌশলে এবং কূটচক্রে বাঙালির জাতিসত্তাকে বিনষ্ট করার চক্রান্ত শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি প্রথম এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে গ্রহণ করে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা।
বঙ্গবন্ধু সেই সময়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ছয় দফা আন্দোলন থেকে, ঊনসত্তরের গণজোয়ার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ এরই ফলাফল।এই পথ চলার শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সহযোদ্ধা ছিলেন জাতীয় চার নেতা। বঙ্গবন্ধুর ধ্যান, ধারণা পরিকল্পনা এবং নীতিমালা সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অবগত। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাদের পক্ষে নেতৃত্বদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বজন নন্দিত।
১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল,তৎকালীন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা বর্তমান মুজিবনগরে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। নবগঠিত এই সরকারের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান,যাদের সময়োপযোগী কৌশল,বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমাদের স্বপ্ন, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন খুব স্বল্প সময়েই বাস্তব রুপলাভ করেছে।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার যমোদল দামপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে এমএ (ইতিহাস) এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভাষা আন্দোলনকালে গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কর বিভাগে অফিসার পদ লাভ করেন। ১৯৫১ সালে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ময়মনসিংহে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে সমাসীন ছিলেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ৬-দফা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবসহ বহুসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। সেই সঙ্কটময় সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং এর অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে (জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৬৯) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনের লক্ষ্যে রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারের সাথে বিরোধী দলগুলোর গোলটেবিল বৈঠকে (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১০-১৩ মার্চ, ১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি গণপরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে (১৯ মার্চ, ১৯৭১) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সঙ্গী। ২৫ মার্চ (১৯৭১) শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ।তিনি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালে তার জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৮ সালে আইএ এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে কারাবন্দি অবস্থায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। রাজনীতিক ও আইনজীবী তাজউদ্দীন আহমদ পবিত্র কোরানে হাফেজও ছিলেন।ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন।
১৯৪৩ সাল থেকে তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ সরকারের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে তিনি এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের (১৯৪৯) অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেফতার হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি ৯২-ক ধারায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৯ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেন।
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরে এপ্রিলে তিনি গ্রেফতার হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (১৯৬৫) সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬-দফা আন্দোলনের সময় দেশরক্ষা আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে তিনি দলের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহূত গোলটেবিল বৈঠকে (১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মুজিবনগর সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী।তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের ‘কুড়িপাড়া’ গ্রামে ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
এরপর ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৪৫ সালে এখান থেকেই অর্থনীতিতে এমএ এবং ল’ পাস করেন। এলএলবিতে প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।আলীগড় থেকে দেশে ফেরার পর তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সাথে। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এই নবীন আত্মসচেতন ব্যক্তি।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিলেন পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি। ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং পিএলজির ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিত হতে থাকেন।
১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন এবং দলের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মনসুর আলী। আবদুল্লাহ আল মাহমুদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এরপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়।
১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন।

চার জাতীয় নেতার অন্য একজন হচ্ছেন আবুল হাসনাত মোঃ কামরুজ্জামান।
পড়াশোনার শুরু রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজসেবক আব্দুস সামাদ ছিলেন তার পড়াশোনার প্রেরণার উৎস
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তার এক ফুপা। তিনি রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে যাওয়ার সময় কামারুজ্জামান হেনাকেও সঙ্গে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য যান কলকাতা এবং বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাস করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ শেষ করে তিনি চলে এসেছিলেন নিজ শহর রাজশাহীতে। চলতে থাকে রাজনীতি। পুনরায় ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে স্নাতক ছেলেটি এবার পড়াশোনা শুরু করেন আইন নিয়ে। রাজশাহী কলেজ যে বছর আইন বিভাগ খোলে, সে বছর প্রথম ব্যাচেই অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে, তিনি এখান থেকেই লাভ করেন বিএল ডিগ্রি। শুরু করেন আইন পেশা। প্রসার লাভ করেন আইন পেশায়।তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক হন ১৯৪২ সালে। বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯৪৩-৪৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৬ সালে কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
১৯৬২ ও ১৯৬৬ সালে পরপর দু’বার এএইচএম কামারুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬-দফার সময় তিনি ৬-দফা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কুচক্রী মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত সরকার জাতীয় চার নেতাকে কাছে টানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু তারা জাতির পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
মোশতাক তাদের প্রথমে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত এবং তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের প্ররোচনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় ৩ নভেম্বর এই চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম হত্যার ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব। কারাগারে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারনা করেছিলেন যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের কৌশল আগে থেকেই গ্রহন করা হয়েছিল।
হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি সে চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবেনা।খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে হবে এমন ধারনা সঠিক ছিলনা বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।কিন্তু তারপরেও সে ধারনার ভিত্তিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় চারজন নেতাদের হত্যা করা হয় বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় গুলোর মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ‘জেল হত্যা’দিবস অন্যতম, এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সহযোদ্ধা, পরম বিশস্ত বন্ধু, সর্বোপরি বাংলার জাতীয় চার নেতা কে হারিয়েছি, যাদের অভাব অপূরণীয়, আজ এই জেল হত্যা দিবসে প্রিয় নেতাদের স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালবাসায়।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

সিরাজুল খানের সাথে এদেশের অধিকাংশ নবীন পাঠকের পরিচয় ঘটে মহিউদ্দিন আহমদের” জাসদের উত্থান পতন,অস্থির সময়ের রাজনীতির ” বইটির মাধ্যমে।এতো বিশাল পরিমাপের একজন রাজনীতিবিদ সংগঠক কিন্তু আমাদের দেশীয় ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে অন্তত আমার চোখে খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়নি।পাঠকের সাথে আরেকটু ভালো করে পরিচয় ঘটে “আমি সিরাজুল আলম খান বলছি” বইটির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে নামক রাষ্ট্রটির বিস্ময়কর উত্থান হলাে একটি জনগােষ্ঠীর জেগে ওঠার মহাকাব্য। এর প্রতিটি পরতে আছে যুগ যুগ ধরে মানুষের সংঘবদ্ধ সংগ্রাম।সেই যুথবদ্ধ প্রয়াসে রয়েছে অনেক কারিগর, অনেক বীর। সিরাজুল আলম খান তেমনই একজন,একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যিনি শ্রম-ঘাম-মেধা দিয়ে বাংলাদেশের উত্থানপর্বে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।গড়ে তুলেছিলেন নিজের সংগঠনিক মেধা দিয়ে বিশাল কর্মী বাহিনীর এক সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্ক।
বঙ্গবন্ধুর এই যে উত্থান বা এদেশের মানুষের কাছে তাঁকে পৌঁছানো সেটার অন্যতম কারিগর ছিলেন সিরাজুল আলম খান,যার সাংগঠনিক মেধা আর সক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু গুণমুগ্ধ হয়ে তাকে সুপারম্যান আখ্যা দিয়েছিলেন।বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যার ছিল আরেকটি নিজস্ব একটি বলয় যেটাকে পরবর্তীতে ইতিহাস নিউক্লিয়াস নামে আবিস্কার করেছে। নিউক্লিয়াস, মুজিব বাহিনী, জাসদ কিংবা পঁচাত্তরের নভেম্বরের অভ্যুত্থান,বিপ্লব কিংবা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সবগুলোর সাথেই ছিল তাঁর একান্ত নিবিড় যোগাযোগ। কিন্তু জনসম্মুখে খুব কমই আসতেন কাজ করতেন পিছনে থেকে।আর এই কারনেই হয়তো পাওয়ার পলিটিক্সে কখনোই প্রবেশ করেননি।
যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনি ছিলেন তাঁর খুব কাছের বন্ধু,দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের সুক্ষ্ম বিরোধ ছিল,বিরোধ ছিল চলার পথটিও নিয়েও তবে সেসব বিরোধ ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনোই চিড় ধরেনি।
সিরাজুল আলম খানের নায়ক বা গুরু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মুজিবে মােহমুগ্ধ ছিলেন তিনি। একসময় তিনি বিদ্রোহ করলেন।ভাঙ্গন ধরলো গুরু শিষ্যের সম্পর্কে তাই বলে সিরাজুল আলম খানের জন্য বঙ্গভবন বা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দরজা কখনোই বন্ধ ছিল না,সর্বদা খোলাই ছিল।
সর্বহারা গ্রুপের সিরাজ সিকদারকে যখন ক্রসফায়ারে দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধু আপন শিষ্য সিরাজুল আলম খানকে বললেন,” তুই দেশ ত্যাগ কর”।গুরুর আদেশ মেনেই দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেন।স্বাধীনতা পূর্ব এবং উত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুর পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠক হিসেবে সিরাজুল আলম খানের নাম বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না কিন্তু রাজনীতির সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করতে পারা কিংবা স্থিরতার বড্ড অভাব বা অনীহার কারনে ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ বসাতে আসেননি।অনেকটা সমরেশ বাবুর কালবেলা- কালপুরুষের অনিমেষের মতন। সঙ্গীদের চোখে তিনি হলেন প্রতিনায়ক। তৈরি হলাে তাঁর কাল্ট। অর্থশাস্ত্রে মার্জিনাল ভ্যালু বা প্রান্তিক উপযােগিতার তত্ত্ব আছে। কালের পরিক্রমায় সঙ্গীরা একে একে তাঁকে ত্যাগ করায় তার প্রান্তিকমূল্যমান ঠেকে শূন্যের কোঠায়।
যার হাত ধরে এদেশে অসংখ্য অসংখ্য নেতৃত্ব, নেতা,মন্ত্রী, এমপি সৃষ্টি হয়েছে,যার সান্নিধ্যে থাকা অসংখ্য লোক দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশকে সেবা দিয়েছে সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ লোকটি এখন ‘রেচিড অব পলিটিকস’—রিক্ত, পরিত্যক্ত।এটা যতটানা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তারচেয়ে বেশি নিজের খাম খেয়ালিপূর্ণ মনোভাবের কারনে।
তাঁর হাত ধরেই উঠে এসছিল আজকের হাসানুল হক ইনুর মতন অসংখ্য জাদেরেল রাজনীতিবিদরা।হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতন একদা তাঁকে ঘিরে যারা বিপ্লবের মন্ত্র জপেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ এখন দলীয় রাজনীতি থেকে অবসরে। বাকিরা নানান শিবিরে বিভক্ত। একদা স্বপ্নবাজ অ্যাংগ্রি ইয়াংম্যানরা’ এখন ইতিহাসের জাবর কাটেন।
তবে তাঁর সমালোচনাও করে থাকেন কেউ কেউ,হাজার হাজার স্বপ্নবাজ তরুনকে স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে বিপদগামী করেছেন,একটা সময়ে তাদেরকে ত্যাগও করেছেন।স্বাধীনতার পরবর্তীতে যে কয়েকটি ঘটনা দেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছিল সেটার অন্যতম হল ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এম মনসুর আলীর সরকারী বাসভবন ঘেরাওর ঘটনা।রহস্যময় উক্ত ঘটনায় ৫০ জন জাসদ কর্মী সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন যদিও সরকারি হিসেবে আরো কম।সেই ঘটনার পরেই জাসদ আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকতে পারেনি বরং আন্ডারগ্রাউন্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।১৭ তারিখের এই ঘটনাটি নাহলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস ভিন্নতর হতে পারতো।কিন্তু হয়নি কিংবা যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হয়েছে।
ইতিহাসের এই নায়ক কিংবা প্রতিনায়ক নিজের শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন এইভাবে-
“আমার মৃত্যুর পর কোনো শােকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নােয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।”
মহিউদ্দিন আহমদেকে ধন্যবাদ ইতিহাসের জীবন্ত এই কিংবদন্তিকে আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য। রহস্যময় এই মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
ইতিহাস
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বিভিন্ন ফ্যাক্ট ও একটি আলোচনা

Published
3 years agoon
September 7, 2020
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট এক মর্মান্তিক ঘটনায় স্বপরিবারে নিহত হন।
তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বাংলাদেশতো বটেই সারা বিশ্বের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এতো বড় একটা ঘটনা নিয়ে যতটা নিরপেক্ষ আলোচনা বা লেখালিখি হওয়ার দরকার ছিল ঠিক ততটা হয়নি,যেটুকুইবা হয়েছে তার অধিকাংশ ই অনিরপেক্ষ কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।
বাংলাদেশে এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে কয়েকটি পুস্তক নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে অন্যতম হল অধ্যাপক আবু সাইয়িদের – ‘ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস্‘
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ঘটনাবলী থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা,বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের কথা,৭২-৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা করেছেন।
তবে নিঃসন্দেহে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর স্ব পরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি।
বইটিতে লেখক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন,যেমন-
ক.গণবাহিনী
অধ্যাপক আবু সাযিদ নিজের বইয়ের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে-
,”অন্য এক তথ্য হতে জানা যায়, শেখকে হত্যা করার পরামর্শ দেয় গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ। অভ্যুত্থান এক সঙ্গে যৌথভাবে ঘটানোর কথা ছিল কিন্তু মোশতাক চক্র পূর্বেই ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে”।
অধ্যাপক সাহেব যে সূত্রের কথা বলেছেন সেটা হল আলোচিত বই-
WHO KILLED MUJIB,IBID,PAGE 38।
খ.মোশতাকগং-
১৯৭৪ সালের শেষের দিকে খন্দকার মোশতাক আফগানিস্তান ও ইরান সফরে যান। ইরানে তিনি চীনা নেতাদের সাথে বৈঠক করেন এবং সেই সফরেই জেদ্দায় পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সাথে ও বৈঠক করেন।
(ঐ- পৃষ্ঠা -৮৬)
গ.সেনাবাহিনীরএকাংশ-
বঙ্গবন্ধু হত্যার নেতৃত্বদানকারী ফারুক রশীদরা ১৯৭৩ সালের শেষ থেকেই নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে।
তারই ধারাবাহিকতায় ঘাতকরা ১৯৭৪ সালের শেষ থেকেই নিজেদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
ঘাতকদের ৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চূড়ান্ত আঘাত হানার দু’টি নির্ধারিত সময়সূচী ছিল কিন্তু নানা কারনে সেসব বাস্তবায়ন করা যায়নি। সর্বশেষ ৭৫ সালের ১২ ও ১৫ ই আগষ্টের মধ্যবর্তী সময়কে বেছে নেওয়া হয় এবং সেনাবাহিনীর সে অংশটি সফলও হয়।
(ঐ- ৮০ও৮১ নং পৃষ্ঠা)
ঘ. সি আই এ সহ নানা মহল তৎপর ছিল-
দেশকে অস্থিতিশীল করা ও সশস্ত্র লড়াই সংগঠিত করতে জাসদ নেতৃত্ব সি আই এ এর লোক বলে কথিত জনৈক পিটার কাস্টারের নিকট হতে ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করে।
(ঐ- পৃষ্ঠা -৫৯)
ঙ-আওয়ামীলীগে উপদলীয় কোন্দল –
১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনেরপরে পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল চরমভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে যা – প্রকারান্তে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ন করে।
( ঐ- পৃষ্ঠা ৬২)
চ- মনি- তোফায়েল গ্রুপের বিরোধ
কেন্দ্রে মনি- তোফায়েল উপদলীয় কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু রাশিয়ায় থাকাকালীন ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে( তোফায়েল আহমেদ সমর্থিত শফিউল আলম প্রধান কর্তৃক) সূর্যসেন হলের ৭ জন ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাণ্ড।এই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এম মুনসুর আলী বলেছেন,” এই পরিকল্পিত ছাত্র হত্যা ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।যার লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের উৎখাত।
(ঐ- পৃষ্ঠা -৬২)
এমনকি শেখ ফজলুল হক মনি তোফায়েল আহমেদকে বিদেশী গুপ্তচর হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
( সূত্র- কনফিডেনসিয়াল ডায়েরি,বিক্রমাদিত্য,পৃষ্ঠা -৭)
ছ-আওয়ামীলীগ নেতাদের বিশেষ বাহিনী, লাল বাহিনীর জনগণের উপর অত্যাচার-
১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখের লড়াই নামক পত্রিকার ১ম সংখ্যার উপশিরোনাম ছিল এরূপ- “কোরবান আলীর ঘাতক বাহিনী” ‘ মুজিবরের নয়া মন্ত্রীসভার তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী তার এলাকায় একটা ঘাতক বাহিনী তৈরি করেছে।এলাকার দাগী আসামী,খুনী চোর ডাকাতদের দিয়ে গঠন করা হয়েছে এই বাহিনী। শুধু কোরবান আলী নয়, ঢাকার গাজী গোলাম মোস্তফা থেকে শুরু করে বরিশালের হাসানাত পর্যন্ত সমস্ত আওয়ামী ও যুবলীগারদের নিজস্ব বাহিনী আছে’।
এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন-
” একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে,জেলায় জেলায় ক্ষমতাসীন চিহ্নিত আওয়ামিলীগ নেতাদের বিশেষ বিশেষ বাহিনী, লাল বাহিনী জনগনের উপর অত্যাচার চালিয়েছে।তাদের সন্ত্রাসে জনগণ প্রতিবাদহীন আক্রোশে হয়েছে নির্বাক নিশ্চুপ।”
(ঐ- পৃষ্ঠা -৬২)
এগুলো ছাড়াও রক্ষী বাহিনী, ভারতের সাথে চুক্তি,দুর্ভিক্ষ, সেনাবাহীনির সাথে দূরত্ব, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ নানা বিষয় বঙ্গবন্ধুর হত্যারকাণ্ডে ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করেছে।
কিছু একটা ঘটবে সে সস্পর্কে অনেকেই জ্ঞাত থাকা
বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন ধীরে ধীরে অজনপ্রিয়তার দিকে চালিত হচ্ছিলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছিলো তখন “কিছু একটা ঘটবে” এমন বিষয়টি সম্পর্কে অনেকেই জ্ঞাত ছিলেন।
তবে ” কিছু একটা ঘটা” যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সে সম্পর্কে বোধকরি কেউই ভাবতে পারেন নি।
খন্দকার মোস্তাক বাদে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরেরা সে বিষয়ে কে কতটুকু জ্ঞাত ছিলেন সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
ক- জনাব কামরুজ্জামান সাহেবের জ্ঞাত থাকা-
ফেক্টস এণ্ড ডকুমেণ্টস ভইয়ের লেখক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সাহেব নিজের বইয়ের ২৮৩ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা ও পরবর্তীকালের খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য জনাব অধ্যাপক ইউসুফ আলীর একটি সাক্ষাতকার ছাপিয়েছেন।
সেখানে অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন যে –
“হেনা ভাই(মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান)আমাকে জানান বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে হেনা ভাইয়ের তিন নম্বর রোডের( ধানমণ্ডির) বাসায় ডালিম তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।ডালিম তাঁকে ডেকেছে।হেনা ভাই নামেননি।হেনা ভাই বললেন, ডালিম আমার সাথে আগেও যোগাযোগ করেছিল এবং প্রস্তাবও নিয়ে এসছিলো।তাই জানতাম,সে কি কথা বলতে এসেছিল।তাই দরজা খুলিনি।
হেনা ভাই আমাকে বললেন,”ডালিমরা জানিয়েছিল এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে।বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে তা বলেনি তবে তাকে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং আবার হেনা ভাইয়ের নেতৃত্বে পাওয়ার( ক্ষমতা) নেওয়া হবে।হেনা ভাই আমাকে বললেন,আমি তাতে তখন রাজি হয়নি।১৪ আগষ্ট তারিখে তাই নীচে নামিনি।ডালিম পরে গালাগালি করে চলে যায়”।
খ- জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের জ্ঞাত থাকা-
একই সাক্ষাতকারের শেষের দিকে ইউসুফ আলী সাহেব বলেন যে,আগষ্টের ১৩ বা ১৪ তারিখে তিনি তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেলহত্যার অন্যতম শহীদ জনাব সৈয়দ নজরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে সেখানে তাঁকে ভীষণ রাগান্বিত অবস্থায় দেখতে পান।
উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু সবাইকে তুমি করে সম্বোধন করলেও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন।
ইউসুফ সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলেন স্যার কী হয়েছে জবাবে সৈয়দ সাহেব জানালেন-
” আমার কাছে লোক আসছিলো আমার কাছে পাওয়ার নেবার প্রস্তাব নিয়ে আসছিলো “
( ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস, পৃষ্ঠা -২৮৬)
” আমি ( ইউসুফ সাহেব) বললাম, ৩২ নাম্বার যান সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। দেখেন কী করতে পারেন”।
” সৈয়দ সাহেব বললেন, না তিনি(বঙ্গবন্ধু) যখন সব কথা খুলে বলতে চাননা,তখন আর কী করবো”।
“তখন আমি বললাম, আজকে যাবেন? তিনি বললেন না। তারপর ঠিক হলো পরদিন উনি যাবেন। সে সুযোগ আর হয় নাই”
গ- সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্বের অবগত থাকা-
৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্টের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর১৯শে আগষ্ট সেনা প্রধান ঢাকাসেনাসদরে
একটি কনফারেন্স ডাকেন।সেখানে ফারুক রশীদ উপস্থিত হয়ে ( কথিত) অভ্যুত্থান সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করেন।রশীদ নিজেদের কর্মের ব্যাখ্যায় একটা পর্যায়ে বলে উঠেন,” সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র অফিসার এই অভ্যুত্থানের কথা আগে থেকেই জানতেন, এসনকি ঢাকা বিগ্রেড কমাণ্ডারও।”
রশিদ দাবি করলেন যে,প্রত্যেকের সঙ্গে তাদের আলাদা আলাদা সমঝোতা হয়েছে পূর্বেই।তখন উপস্থিত সিনিয়র কোন অফিসারই এর প্রতিবাদ করেননি।একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি কেউ।
উল্লেখ্য সে বৈঠকে সেনা প্রধান শফিউল্লাহ সাহেব,উপ সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান সাহেব এবং সিজিএস বিগ্রেডিয়ার জনাব খালেদ মোশাররফ সহ সিনিয়র অফিসারবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু ঢাকা পতাদিক ব্রিগেডের আধিনায়ক কর্ণেল সাফায়েত জামিল রশিদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে বলে উঠেন
” You are all liars,mutineers and deserters, you are all murders.Tell your Moshtaque that he is an unsurper and a conssipirator.
He is not my president. In my first opportunity I shall dislodge him and you all will be tried for your crimes”.
( ঐ- পৃষ্ঠা -৩১৪)
বইয়ের ৮১ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে ঘাতকরা ১৯৭৪ সালের শেষ থেকেই নিজেদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বা গ্রেফতার করার পর ক্ষমতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর একাংশ (যারা এই কর্মটি সাধন করেছে) বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও তৎকালীন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জান, উপরাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ বিভিন্ন জনের কাছে গিয়েছিল। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরেরাও বিষয়টি জানতেন কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাঁরা কেউই বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টি অবহিত করেননি কিংবা করার সুযোগ পাননি কিংবা অবহিত করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেননি।
বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনায় এসব বিষয়ে তেমন উল্লেখ থাকেনা বললেই চলে বরং একটি স্রোতেই মর্মান্তিক এই ইতিহাসকে প্রবাহিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত করা হচ্ছে।
এতে করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি কেবল রাজনীতিক ফায়দা হাসিলেরই মাধ্যমই হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সবকিছু জনা সম্পর্কে প্রজন্মকে দূরে সড়ানো হচ্ছে।
আমরা চাই বিশদ আকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হউক।নির্দিষ্ট কোন দৃষ্টিকোণ কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের আলোচনা না হউক।বঙ্গবন্ধুর বিশালতাকে কুক্ষিগত করে না রাখার জন্য এসব আলোচনা অত্যন্ত জরুরী। বঙ্গবন্ধু কোনো দলীয় সম্পদ নয় বরং তিনি সবার। তিনি বাংলাদেশের। তাঁর সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করাই হচ্ছে তাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা আর সম্মান দেখানো।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করবেন ততই জাতির জন্য মঙ্গল জনক হবে।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টাে ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার অপরিনামদর্শী কর্মকান্ডের ফলাফল সেই সাথে পিছন থেকে ভারতের ছুরি চালানোর বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।বাংলাদেশীদের প্রতি করা বৈষম্যের বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেছেন। আবদুল্লাহ খান নিয়াজি নিজের “দ্যা বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” বইতেও পাকিস্তান ভাঙ্গার পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের দায় দেখেছেন। তিনি বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন সমস্যাটা ছিল রাজনৈতিক সুতরাং সমাধানটা রাজনৈতিকভাবেই হওয়া দরকার ছিল।রাজনৈতিক সমস্যাবলী সামরিকভাবে কখনোই টেকসই সমাধান আনতে পারে না। নিযাজি বা পারভেজ মোশাররফ কিংবা পাকিস্তানের সাধারণ জনগন সবাই ই একটা বিষয়ে একমত যে,পাকিস্তান ভাঙ্গার পিছনে ভারত ব্যাপক ইন্ধন যুগিয়েছে। মুনতাসীর মামুনের “পাকিস্তানি জেনারেলের মনোভাব “বইটিতেও এমন বক্তব্যই দেখতে পাই। ভারতকে পিছন থেকে ছুরি চালানোর সুযোগটি পশ্চিম পাকিস্তারের মাথামোটা রাজনীতিবিদরাই করে দিযেছে।নিয়াজী কিংবা পারভেজ মোশাররফ তাঁরা কেউই এটাকে সামরিক বিপর্যয় হিসেবে মানতে নারাজ তারা বরং এটাকে রাজনৈতিক বিপর্য়য় হিসেবেই উল্লেখ করতে আগ্রহী। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের পাকিস্তানিদের পরাজয়ের বিষয়টি তৎকালীন সেনা সদস্যদের আজও ব্যথিত করে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য,সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদেরই দোষারোপ করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করবো শুধু দোষারোপ ই নয় তাদের এই জুলুম অত্যাচার আর নিপিড়নের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের নিকট ক্ষমা চাইবেন তাহলেই তাদের প্রকৃত অনুভব আর অনুভূতির বিষয়টি প্রকাশ পাবে।সেনা প্রধান হওয়া
১৯৯৮ সালের ৭ ই অক্টোবর সন্ধ্যায় হুট করেই পারভেজ মোশাররফকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ ডেকে পাঠান।তখনই তিনি জানতে পারেন যে জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামতকে অবসরে পাঠিয়ে তাঁকে সেনা প্রধান করা হয়েছে।কয়েকদিন আগে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী একক কর্তৃত্ববলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। ভারত থেকে বাস্তুভিটা হারিয়ে এক মোহাজির পাকিস্তানের সেনা প্রধান হওয়াটা এক আশ্চর্যের বিষয় ই বটে।কোন অভিজাত পরিবারের না হওয়া ও এই মোহাজির পরিচিতির কারনেই নওয়াজ শরীফ হয়তো ভেবেছিলেন তাকে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই পরিচালিত করতে পারবেন।কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই নেওয়াজ শরীফের করা সে ধারণাটি ভুল প্রমানিত হয়। প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছোটখাটো সমস্যা বা বিরোধ দেখা দিলেও কারগিল যুদ্ধ ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের সৈন্য সমর্পনের ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে সেটা প্রকট আকার ধারণ করে।কারগিল যুদ্ধ ও যুদ্ধ সম্পর্কিত অভিযোগ

সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্র প্রধান
সেনাপতি পারভেজ মোশাররফ রাষ্ট্রীয় এক সফরে কলম্বো ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানে ফেরার পথে বিমান যখন আকাশে তখনই জানতে পারেন যে তাঁর পাকিস্তানে ফেরত আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।কন্ট্রোল রুম থেকে তাঁর বিমানের পাইলটকে পাকিস্তান আর দুবাই ছাড়া পৃথিবীর যেকোন দেশে বিমান অবতরন করতে বলা হয়। সন্ধ্যার এই ফ্লাইটিতে তিনি ছাড়াও আরো ১৯৮ জন বেসামরিক যাত্রী ছিল। বিমান যখন মাঝ আকাশে তখনই তাঁকে সেনা প্রধান থেকে অবহ্যতির ঘোষণা দিয়ে নতুন সেনা প্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউদ্দিন বাটের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পারভেজ মোশাররফের অনুগত সৈনিক আর অফিসাররা তাদের সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে এমন অবিচার মেনে নেয়নি। তারা দ্রুতই করাচী বিমান বন্দর সহ প্রধানমন্ত্রীর ভবন,রাষ্ট্রপতির ভবন,রেডিও টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং নওয়াজ শরীফকে উৎখাত করে পারভেজ মোশাররফ কে ক্ষমতার মসনদে বসায়। ক্ষমতাচ্যুত নেওয়াজ শরীফের অনুরোধে তাকে নিজ পরিবার সহ সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয়। আর এভাবেই নাটকীয় ভাবে দেশভাগের রিফিউজি এক শিশু ৫২ বছর পরে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হন।যেভাবে আমেরিকার দোসর ও আলকায়দা বিরোধী অবস্থান নেওয়া
৯/১১ যখন আমেরিকায় ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা হলো তখন পারভেজ মোশাররফ করাচীতে কায়েদা আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমাধি সংলগ্ন বাগান পরিদর্শন করছিলেন।হটাৎ করে তাঁর সামরিক সচিব আমেরিকার টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী হামলার তথ্য দিলেন। পরেরদিন সকালে তিনি গভর্নর হাউজে একটা মিটিং এ ছিলেন তখন সামরিক সচিব এসে পারভেজ মোশাররফ কে জানালো আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেটস জেনারেল কলিন পাওয়েল ফোনে রয়েছেন,তিনি পারভেজ মোশাররফের সাথে কথা বলতে চান।কলিন পাওয়েলের দিক থেকে এতোটাই তাড়াহুড়ো ছিল যে মিটিং শেষ করা পর্যন্ত তার অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না,মিটিং রেখেই পারভেজ মোশাররফ ফোনটি রিসিভ করেন।জেনারেল কলিন পাওয়েল কোন রাখঢাক না রেখে সরাসরিই বলে দিলেন,”তোমরা হয় আমাদের সাথে থাকবা নাহয় আমাদের বিরুদ্ধে”।মানে আমেরিকার সাথে না থাকার অর্থ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা ধরা নেওয়া হবে। পরেরদিন ফোনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড আর্মিটেজের সাথে যোগাযোগ হয়।তিনিও পারভেজ মোশাররফ কে জানায়, “তোমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তোমরা আমেরিকার সাথে থাকবা নাকি সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ,যদি সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকো তাহলে বোমা হামলায় প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকো”।পারভেজ মোশাররফ এটাকে সর্বকালের সেরা কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কথা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অব্যহত এমন হুমকীর পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারভেজ মোশাররফ যে বিষয়গুলো ভাবলেন সেটি হল- ★ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি যা আমেরিকার তুলনায় নগন্য। ★পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা যা মার্কিন আক্রমনে টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। ★পাকিস্তানের সামজিক বহুমাত্রিকতা রয়েছে যা যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। তাছাড়া জাতীয় বিষয়ের দিক থেকে তিনি যে বিষয়গুলো ভেবেছেন সেসব হল- ★পাকিস্তান মার্কিনীদের সহায়তা না করলে বৈরি রাষ্ট্র ভারত সহায়তা করবে এবং ইতোমধ্যে মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতীয় ঘাঁটি ব্যবহারের প্রস্তাবও দিয়ে দিয়েছে,ভারত হয়তো এই সুযোগে আমেরিকার সহায়তায় কাস্মীরকে বাগিয়ে নিবে। ★ একটি মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের পরমানু অস্ত্র নিয়েও আমেরিকা নতুন কোন টালবাহানা শুরু করতে পারে। ★ গত ৫০ বছরে তিল তিল করে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। ★তাছাড়া তালেবানদের জন্য পাকিস্তান কেন আত্মত্যাগ করবে? আত্মত্যাগ করার মতন তালেবান পাকিস্তানের জন্য এমন কী করেছে? এসব কিছু ভেবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পারভেজ মোশাররফ তালেবান বিরোধী মার্কিন জোটে শরীক হন।পরমাণু অস্ত্র ও আবদুল কাদির খানকে গৃহবন্দী
১৯৭৪ সালে ভারত সর্বপ্রথম পরমানু বোমা পরিক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়।এর ব্যাখ্যায় ভারত বলে যে এটা হলো শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণ।সারা বিশ্ব কিছু লোক দেখানো হইচই করলেও সবাই ই এটা মেনে নেয়।কিন্তু চির বৈরি প্রতিবেশি পাকিস্তানে ব্যাপক উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার জন্ম নেয়।তাই ১৯৭৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ‘ইউরেনকা’ নামের একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় কাজ করা বিশিষ্ট ধাতুবিদ পাকিস্তানী বংশদ্ভূত ড.এ কিউ খানকে নিজ দেশে(পাকিস্তানে) ফেরত আসার আহ্বান জানানো হয়।দেশের ডাকে তিনি পাকিস্তানে আসেন এবং সাথে করে’সেন্ট্রিফিউজ’এর কিছু ড্রইং নিয়ে আসেন।পাকিস্তান পরমাণু সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় তাঁর ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী কাজ শুরু করে।সেই সময় থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে প্রয়োজনীয় সকল কাঁচামাল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক থেকে সংগ্রহ করা হয়।আর ভারতও নিজেদের পরমানু কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো সমানতালে।তবে এটা ঠিক ভারত পরমানু বোমায় অভিলাষী না হলে হয়তো পাকিস্তানও সে পথে হাঁটতো না।ভারতের চিন্তায় হয়তো আঞ্চলিক ক্ষমতা প্রদশর্ন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তারের একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল কিন্তু পাকিস্তানের ছিল চির বৈরি প্রতিবেশী থেকে আত্মরক্ষার জন্য।সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় ভারতের অভিপ্রায় ছিল আক্রমণাত্মক এবং আগ্রাসী আর পাকিস্তানের ছিল আত্মরক্ষামূলক। যদিও বিশ্বশক্তি পরমাণু কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে ক্রমাগতভাবে পাকিস্তানকেই চাপ প্রয়োগ করেছিল অথচ ভারতের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্ববাসী ছিল নিরব। ড. এ কিউ খান পরমাণু কর্মসূচীর গোপনীয়তা রক্ষার্থে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সাথে এই বিষয়টি নিয়ে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন কোন এজেন্সি বা সংস্থার মাধ্যমে নয়।অর্থ বরাদ্ধ ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা সেভাবেই আসতো।ফলে জুলফিকার আলী ভুট্টাে,জিয়াউল হক সরাসরিই তাঁর সাথে যোগাযোগ করতেন।তারপরে গোলাম ইসহাক খান ক্ষমতায় আসলে তিনি বেসামরিক লোক হওয়ায় যোগাযোগের দায়িত্বটি সেনা প্রধানের কাছে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ও ১৩ মে ভারত যখন পাঁচটি পরমানু বোমার সফল বিস্ফোরণ ঘটায় তখন পাকিস্তান ১৯৯৮ সালের ২৮ ও ৩০ মে ছয়টি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ড.এ কিউ খানের সাথে ইরান, কোরিয়া,লিবিয়া সহ আরো কয়েকটি দেশ বা সংস্থার সাথে ইউরেনিয়াম পাচারে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরে পারভেজ মোশাররফের সরকার পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থে তাঁকে গৃহবন্দী করে। বইটিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে এই পর্যন্ত রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বারংবার হস্তক্ষেপ ও সেটার কারন,গনতন্ত্রের বিকাশ না হওয়ার বিষয়াবলী বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর রাষ্ট্র হওয়ার পিছনে কাস্মীর ও আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতাকে দায়ি করা হয়েছে।পারভেজ মোশাররফ নিজের এই বইটিতে নিজের সকল কার্যক্রমকেই একটা যৌক্তিকতার আলোকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথম জীবনে পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশী এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন কিন্তু মেয়ের পরিবার হুট করেই করাচি ছেড়ে বাংলাদেশ চলে আসায় সেটা আর সামনে এগোয়নি। ভারত ভাগের পর থেকে পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে বইটি অবশ্যই সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
সর্বাধিক পঠিত
-
ইতিহাস4 years ago
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তিদের ভূমিকা
-
অন্যান্য3 years ago
উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়ন
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
শব্দশ্রমিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
-
বাংলাদেশ4 years ago
বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
-
শিল্প-সাহিত্য4 years ago
প্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা
-
ইতিহাস3 years ago
সম্রাট শাহজাহানঃ সৌন্দর্য্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে