আন্তর্জাতিক
গ্রেটা থানবার্গ : দ্যা ডটার অব দ্যা ওয়ার্ল্ড

Published
4 years agoon

আপনাদের ফাঁকা বুলি আমার শৈশব চুরি করে নিয়েছে।‘আমার এখানে থাকার কথা নয়। আটলান্টিকের ওপারে আমার স্কুলে ফিরে যাওয়া উচিত। মানুষ ভুগছে, মানুষ মরছে, ধসে যাচ্ছে পুরো বাস্তুতন্ত্র, আমরা একটি ব্যাপক বিলুপ্তির শুরুতে দাঁড়িয়ে আছি আর আপনারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপকথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের কত বড় দুঃসাহস?’
মাত্র ষোল বছর বয়সই এক কিশোরী, নাম গ্রেটা থানবার্গ পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যেন নিজের ছোট্ট কাঁধে তুলে নিয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানের সময় বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে গ্রেটা থানবার্গ এভাবে দৃঢ় কণ্ঠে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। আমাদের এই পৃথিবীকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার করতে যে সংগ্রাম বা লড়াই শুরু করেছে গ্রেটা থানবার্গ তার জন্য তাকে পৃথিবীর কণ্যা বা ডটার অব দ্যা ওয়ার্ল্ডই বলা চলে।
গ্রেটা থানবার্গ আসলে কে –
বিশ্ব পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর গ্রেটা থানবার্গ, যার বয়স মাত্র ১৬ বছর। ২০০৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন গ্রেটা থানবার্গ। বাবা মা দুজনই অভিনয় শিল্পী। গ্রেটার মা মালেনা এর্নমান একজন অপেরা শিল্পী। আর বাবা সভান্তে থানবার্গ একজন অভিনেতা। অভিনয় এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন গ্রেটার দাদা ওল্ফ থানবার্গও। মাত্র ৮ বছর বয়্সে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে জানতে পারে গ্রেটা । গত বছর ২০১৮ সালে সুইডেনে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও দাবানল গ্রেটাকে পরিবেশ রক্ষার অনুপ্রেরণা পান। পরিবেশ রক্ষায় স্কুল ধর্মঘটের ডাক দেয় ছোট্ট গ্রেটা।

সুইডিশ পরিবেশকর্মী ইগমার রেন্টঝগ ২০১৮ সালে গ্রেটা থানবার্গ যখন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্কুল ধর্মঘটের ডাক দেয় তখন তার একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর কাড়েন বছর ষোলর এই কিশোরী। অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সচেতনতার ক্ষেত্রে এক ত্রাতা কিংবা যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এই গ্রেটা থানবার্গ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রেটা ‘হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ (#FridaysforFuture) আন্দোলনের ডাকে দেয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী এ আন্দোলনে যোগ দেয়। এই শিক্ষার্থীরা প্রত্যেক শুক্রবার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বকে সজাগ করতে আন্দোলনের অঙ্গীকার করেছেন।
পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা গ্রেটার ছোটবেলায়ই একটি সমস্যা ধরা পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মধ্যে ‘অ্যাসপার্গারস’ নামে এক ধরনের জটিল রোগের সন্ধান পান ডাক্তাররা যা এক ধরনের অটিজম। এ ধরণের অটিজমে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির বিকাশ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের ত্রুটি বা পার্থক্য ঘটে, যার ফলে ব্যক্তির সামাজিক আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি অলিখিত সামাজিক নিয়ম-কানুন বুঝতে পারেন না এবং ইশারা ঈঙ্গিতের মাধ্যমে এবং শরীরী ভাষায় বোঝানোর নির্দেশ বুঝতে পারেন না। তবে, তারা দারুণ প্রতিক্রিয়াশীল হন এবং তাদের চিন্তা করার ক্ষমতাও প্রবল হয়, এমনকি যুক্তিতর্কেও তারা অসাধারণ হয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নানা দক্ষতার অভাব দেখা দিতে পারে।
গ্রেটা থানবার্গের সমস্যাটা ছিল আরও জটিল, কারণ অ্যাসপার্গার’স সিনড্রোম ছাড়াও তার মধ্যে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) এবং সিলেকটিভ মিউটিজমের মতো আরও দুটি মানসিক বিকাশগত সমস্যা শনাক্ত হয়। এত শারীরিক অসুস্থতাও দমিয়ে রাখতে পারেনি গ্রেটাকে। পৃথিবীর সুস্থ মানুষগুলো যখন পরিবেশ নিয়ে উদাসীন এবং পরিবেশ দূষণ করে চলেছে তখন শারীরিকভাবে অসুস্থ গ্রেটা পরিবেশ রক্ষায় রীতিমত লড়াইয়ে নেমে পড়েছে।
ছোট্ট গ্রেটার পরিবেশ রক্ষায় স্কুল ধর্মঘট
জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবলায় নিজের পরিবার থেকেই শুরু হয় গ্রেটার লড়াই। পরিবারের দৈন্দিন বিভিন্ন কাজে কার্বন বর্জ্য ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে সে তার বাবা-মাকে আগ্রহী করে তুলেছেন। ২০১১ সালে যখন মাত্র ৮ বছর বয়স ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ভয়ংকর ফলাফল জানতে ও বুঝতে পারে গ্রেটা । এতটুকু বয়সেই পৃথিবীর অনাগত ভবিষ্যত ভেবে বিচলতি হয়ে পড়ে সে। কিন্তু এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ববাসীর উদাসীনতার কারণ বুঝতে পারত না।
মাত্র ১১ বছর বয়সে গ্রেটার মধ্যে অ্যাসপার্গার’স সিনড্রোম নামক অটিজমের লক্ষণটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা তার জলবায়ু বিষয়ক ভাবনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।
গ্রেটার মতকে গুরুত্ব দিয়েছিল তার পরিবারের সদস্যরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর (২০১৮) মাত্র ১৫ বছর বয়সেই এক কঠিন সংগ্রাম শুরু করেন সে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই শুরু করে স্কুল ধর্মঘট কর্মসূচি। তীব্র তাপপ্রবাহ ও দাবানলে সুইডেনের অবস্থা তখন ভয়াবহ। কারণ ২০১৮ সালটি ছিল সুইডেনে ২৬২ বছরের মধ্যে রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রার বছর। শুধু সুইডেন নয়, ইউরোপজুড়ে এমন অসহনীয় তাপমাত্রার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়াকেই দায়ী করেন গ্রেটা। ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ৯ সেপ্টেম্বর দেশটির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্লাসে না গিয়ে তিনি আন্দোলন শুরু করবেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিবিদরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী।

গ্রেটার দাবি ছিল, সুইডিশ সরকারকে যত শিগগির প্যারিস চুক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এই দাবি নিয়ে তিনি সুইডিশ পার্লামেন্ট ‘রিকসদাগ’র সামনে টানা তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এসময় তার হাতে ছিল Skolstrejk för klimatet (জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট) লেখা একটি প্ল্যাকার্ড। এছাড়াও তিনি তার কাছ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সবাইকে একটি লিফলেট বিতরণ করেন। লিফলেটে লেখা ছিল- ‘আমি এটা করছি কারণ তোমরা বড়রা আমার ভবিষ্যৎ ধূলিসাৎ করে দিচ্ছ।’ অভিনব এই আন্দোলন নজর কাড়ে সারা বিশ্বের। সাড়া ফেলে দেওয়া এই আন্দোলনটি গ্রেটা থানবার্গ করেছেন একা একাই!
হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’
সহপাঠীদের নিয়ে স্কুল ধর্মঘট কর্মসূচি করেই থেমে থাকেনি গ্রেটা থানবার্গ। সারা দুনিয়ার ছাত্রছাত্রীদেরকে সে তার আন্দোলনে সামিল করতে চেয়েছিল আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু করে হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেস ফর ফিউচার কর্মসূচির। সারা পৃথিবীর স্কুল ছাত্রছা্ত্রীরা এই কর্মসূচিতে যোগ দেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং গ্রেটার ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করে।

এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈশ্বিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে অংশ নেয় ১২০টিরও বেশি দেশ। বিশ্ব গণমাধ্যমের মতে, গ্রেটার ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আন্দোলন। বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সচেষ্ট হয়েছে আন্দোলনটি। গত ২৫ মে পৃথিবীর ১১৬টি দেশের প্রায় ২ হাজারটি শহরের সঙ্গে বাংলাদেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিতীয় গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক। বাংলাদেশের প্রায় ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে একযোগে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী গ্রেটার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়। সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে এই আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষও। শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই ৩ লাখ মানুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। এদিন লন্ডনের রাস্তায়ও নামে লাখো মানুষ।
ইয়টে ৩০০০ হাজার মাইল আটলান্টিক পাড়ি
পরিবেশ রক্ষার্থে কার্বন নি:সরণকারী যে কোন যানবাহনে চড়তে নারাজ গ্রেটা বিশেষ।বিশেষ করে এরোপ্লেন ও জাহাজ অতিরিক্ত কার্বণ নি:সরণ করে বলে এগুলোতে ভ্রমণ করতে চাই না গ্রেটা। বিপদ বাদল নিউইয়র্কে জলবায়ু সম্মেলনে যোগাদনের আমন্ত্রণ পেয়ে। সুইডেন থেকে নিউইয়র্ক তিনহাজার মাইল পথ পাড়ি দিবেন কি করে। নিজ সিদ্ধান্তে অটল গ্রেটা আর তাই ব্যবস্থাও হয়ে গেল । মালিজিয়া টু নামে একটি দ্রুত গতি সম্পন্ন ইয়টে চড়ে রওনা দিলেন নিউইয়র্কে উদ্দেশ্যে।

য়৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এই ইয়টটি পরিচালনা করেছেন বরিস হারম্যান। পাল তোলা এই ইয়টের বৈদ্যুতিক শক্তি আসে সোলার প্যানেল আর পানির নিচে থাকা কয়েকটি টারবাইনের মাধ্যমে। ফলে এর সাহায্য বাতাসে কোনো কার্বন ছড়িয়ে পড়ে না। আগস্টে আটলান্টিক সমুদ্রে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। তাই এই যাত্রাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। থানবার্গের সঙ্গে তার বাবা ছাড়াও মোনাকোর রাজপরিবারের সদস্য পিয়েরে কাসিরাঘি ও সুইডিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা নাথান গ্রসম্যান ওই দুঃসাহসিক ভ্রমণে ছিলেন। দুই সপ্তাহের স্বাসরুদ্ধকর অভিযানে প্রায় ৩ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ২৮ আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের একটি জেটিতে এসে তাদের ইয়টটি ভেড়ে। এ সময় থানবার্গকে স্বাগত জানাতে হাজার দুয়েক মানুষ উপস্থিত বন্দরে।
হয়ে যেতে পারেন সর্বকনিষ্ট নোবেল বিজয়ী
হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেস ফর ফিউচার বা স্কুল স্ট্রাইকিং, বিশ্বনেতাদের সামনে সাহসী বক্তব্য প্রদান এবং ইয়টে আটলান্টিক পাড়ির মত ঘটনাগুলো কেবল পৃথিবীব্যাপী গ্রেটার পরিচিতি এনে দেয় নি বরং ২০১৯ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য নরওয়ের তিন সাংসদ নোবেল কর্র্তৃপক্ষের কাছে গ্রেটার নাম প্রস্তাব করেন।
পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের নারী অধিকার ও শিক্ষার নিয়ে কাজ করার জন্য ২০১৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন এবং এখন পর্যন্তই তিনিই সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী। ২০১৯ সালে যদি গ্রেটা শান্তিতে নোবেল জিতে যান, তবে মালালাকে টপকে গ্রেটাই হবেন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী।
নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য ২২৩ জন ব্যক্তি এবং ৭৮টি সংগঠন সহ সর্বমোট মনোনয়ন প্রাপ্তির সংখ্যা মোট ৩০১। এদের মধ্যে নোবেল কমিটি কারোরই নাম প্রকাশ প্রকাশ করেনি। গ্রেটার নাম প্রকাশ করেছে প্রস্তাবকারী নরওয়ের সাংসদরাই । ইতোমধ্যে বিকল্প নোবেল হিসেবে খ্যাত সুইডেনের রাইট টু লিভলিহুড পুরষ্কারও পেয়েছে গ্রেটা।
বৈশ্বিক বিভিন্ন সম্মেলনে আলোড়ন
বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে গ্রেটা থানবার্গের উপস্থিতি এবং বক্তব্য প্রদান সারা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলন ২০১৯ জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত হয় । উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্ব বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তথা বিশ্বনেতাদের সামনে সাহসী ব্ক্তব্য প্রদান করে গ্রেটা থানবার্গ। উপস্থিত নেতাদের সামনে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে জোর গলায় তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ বলেন, আমরা সবাই মিলে নাকি জলবায়ু সংকট তৈরি করেছি। কিন্তু এটি মোটেও সত্যি নয়। যদি কেউ একজন অপরাধী হয়, তার জন্য কেন সবাইকে দায়ী করা হবে। যারা অপরাধী, তাদেরই দায়ী করতে হবে। আর জলবায়ু সংকটের পেছনে দায়ী হলো কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠান এবং কিছু নীতিনির্ধারক, এবং তারা খুব ভালো করেই জানেন অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর কী ভীষণ ক্ষতি না করে চলেছেন। আমার বিশ্বাস, সেইসব মানুষদের মধ্যে অনেকেই আজ এখানে উপস্থিত।’
২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে দিনব্যাপী জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে প্রায় ৬০ জন বিশ্ব নেতার উপস্থিতিতে আবেগঘন ও উত্তেজিত কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন ১৬ বছর বয়সী কিশোরী গ্রেটা। নিজেদের স্বার্থে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য বিশ্ব নেতাদের তীব্র ভাষায় নিন্দা ও সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘যখন কোথাও কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং নীতিমালা দৃশ্যমান নয়, তখন আপনারা এখানে এসে কীভাবে অনেক কিছু করে ফেলার দাবি করছেন।’
বক্তব্যের এক পর্যায়ে গ্রেটা উচ্চারণ করেন, ‘পরিবর্তন আসছে, আপনারা তা চান বা না চান।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থিত হলে তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন গ্রেটা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিশ্ব গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে ট্রাম্পের প্রতি গ্রেটার এই ক্ষুদ্ধ মনোভাবের একটি ভিডিও। সম্মেলন শেষ হলেও এখনই ক্লাসে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই গ্রেটার। ইয়টে চড়েই এবার যাবেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। ডিসেম্বরে সেখানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘সিওপি-২৫’ ক্লাইমেট কনফারেন্সেও বক্তব্য দেবেন গ্রেটা।
পরিবেশ নিয়ে গ্রেটার এ লড়াই সফল হয়ে উঠুক আর আমাদের এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে কেবল গ্রেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে বরং আমাদেরও উচিত হবে গ্রেটার এই লড়াইয়ে সামিল হওয়া।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
রাজনীতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা

Published
3 years agoon
June 2, 2020
খোলা চোখে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা
ঘটনাঃ
জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনের বাসিন্দা জর্জ ফ্লয়েডকে (৪৬) গত ২৫ মে আটক করে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলি শহরের পুলিশ। আটকের পর ডেরেক চৌভিন নামের এক(শ্বেতাঙ্গ) পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে সড়কের উপর চেপে ধরলে তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান।এই হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে পুরো যুক্তরাষ্ট্র।
(প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)
বর্তমান আন্দোলনের পটভূমি-
চলমান এই আন্দোলনটি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডই একমাত্র কারন নয়,এই আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে ৩ টি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে-
প্রথমত–
পুলিশি নির্যাতন এবং হত্যাকান্ড,বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হবার ঘটনা।
দ্বিতীয়ত –
বিচার ব্যবস্থা।গোটা বিচার ব্যবস্থা এবং আইনি বিধি বিধানগুলো সংখ্যালঘু,দরিদ্র এবং বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না।
তৃতীয়ত –
সমাজে বিরাজমান বৈষম্য,যার প্রধান শিকার হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা।

ছবিঃ সংগৃহীত
এসবের সাথে সাথে আরো যে বিষয়টি মার্কিন সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা হলো বর্ণবাদ বিষয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বীকৃতির প্রবণতা।সমাজপতি ও রাজনীতিবিদ উভয়েরই মনোভাবটা হলো,এই নিয়ে কথা না বললেই যেন বর্ণবাদ অপসৃত হয়ে যাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড:
- ২০১৪ সালের ১৭ ই জুলাই নিউইয়র্ক শহরে অভিন্ন পন্থায় শ্বাসরোধ করে এরিক গার্ণারের হত্য।
- ২০১৪ সালের মিসৌরির ফার্গুসন শহরে মাইকেল ব্রাউনের হত্যা।
- ২০১৫ সালের বাল্টিমোরে ফ্রোডগ্রের হত্যা।
- ২০২০ সালের মার্চ মাসে কেনটাকির লুইভিল শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে নিজ বাড়িতে হত্যা।
(সূত্রঃ প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)
বর্তমান আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ নেওয়ার কারণ:-
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখলেও সেসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা এবারের মতন জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ লাভ করেনি।ইতিমধ্যেই এই ঘটনাকে বিশেষজ্ঞগণ ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের খুনের ঘটনার পর সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সঙ্গে তুলনা করছেন। সিএনএ,নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ টির বেশি শহর সহ অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন শহর এখন বিক্ষোভে উত্তাল।

ছবিঃ সংগৃহীত
বার্তা সংস্থা এপির মতে, এই পর্যন্ত বিক্ষোভকালে গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে চার হাজার মানুষ,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ মিলিটারি ফোস ন্যাশনাল গার্ডের ৫ হাজার সদস্যকে।
তো প্রশ্ন হলো এবারের আন্দোলনটা এই জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ নেওয়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞগন কয়েকটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেসব হল-
১- অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ধীর নীতি গ্রহণ করাঃ-
২৫ মে মে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা সংগঠিত হলেও ঘটনার ৮ দিন পরে এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত ডেরেক চৌভিনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।১-০৬-২০২০ ইং তারিখে তাকে আদালতে তোলার কথা থাকলেও নানা অযুহাত আর টালবাহানায় সেটাকে পিছিয়ে ০৮-০৬-২০২০ তারিখে আদালতে হাজির করার তারিখ নির্ধারন করা হয়।
২- লুইভিলে শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে হত্যাঃ

ছবি : সংগৃহীত
গত মার্চ মাসে লুইভিলে শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে পুলিশ কর্তৃক নিজ বাড়িতে হত্যা করা হলেও সে ঘটনার এখন পর্যন্ত যথাপোযুক্ত কোন বিচার হয়নি।
৩- সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রবল জোয়ার সষ্টি হওয়াঃ-
সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রতি তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন প্রদান শ্বেতাঙ্গবাদ আরো উস্কে দিচ্ছে।
৪-চীন ও ইরানের প্রকাশ্য মন্তব্য করাঃ-
বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও ইরানের বৈরিতার সম্পর্কের কথা সবারই জানা আছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন,” যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক বর্ণবাদ সমস্যা এবং পুলিশের নিপীড়ন ঘটনায় তুলে ধরেছে এই বিক্ষোভ “
In response to what happened in the US, heads of @_AfricanUnion and many African countries have called for justice against racial discrimination. China stands with the African side in their just cause and will work with them to oppose all forms of racial discrimination. pic.twitter.com/pnyljEMkfs
— Spokesperson发言人办公室 (@MFA_China) June 1, 2020
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মৌসাভী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিজ দেশের জনগনের উপর নিপিড়ন বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান।
( সূত্র: প্রথম আলো- ২ রা জুন ২০২০)
৫-বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারঃ-
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিক্ষোভকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের গভীর ক্ষতটাই পৃথিবীর সামনে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে দশকের পর দশক ধরে বর্ণবাদ চলছে।সাদা কালোর জাহিলি বিভাজন চলমান রয়েছে।ফলে সাম্যবাদ নামক মার্কিন ভন্ডামি আজ সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।এরাই আবার বিশ্বের সামনে মানবতার বুলি কপচিয় সেই সাথে সারাবিশ্বে মানবতার সবক প্রদানের ফেরি করে থাকে।
আজ যেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্ব উত্তাল হয়েছে এমন পুলিশি নির্যাতনে বর্বর ইসরাইলী কর্তৃক ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘটে।দুঃখজনক হলেও সেসব নির্যাতনের সরব বা নিরব কোন প্রতিবাদই দেখতে পাওয়া যায় না।তবুও আমরা চাই পৃথিবীর সব অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ হউক।সব নিপিড়ন আর যুলুমের অবসান ঘটুক। মানবতা আর মাযলুম জনগোষ্ঠী মুক্তি পাক। মুক্তিপাক নিপীড়িত আরাকান, কাস্মীর, উইঘুর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন সহ বিশ্বের সকল মাযলুম জনগোষ্ঠী।
লেখক- তরিকুল আলম তাসিকুল
শিক্ষার্থী – সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান সময়ের সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠী কোনটি? কেউ হয়তো বলবে আরাকানে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের কথা, কেউ বলবে ইহুদি কর্তৃক নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের কথা, কেউ হয়তো বলবে ভারত সরকার কর্তৃক নিপিড়ীত কাস্মীরীদের কথা, কেউ হয়তো বলবে সামাজ্রবাদী কর্তৃক নিপিড়ীত গৃহহারা সিরিয়ানদের কথা,কেউবা বলবে ইয়ামেনের কথা।আর কেউ কেউ হয়তো বলবে উইঘুর মুসলিমদের কথা।পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিতত এসব জনগোষ্ঠীর সবাই মুসলিম ধর্মাবলাম্বী।নির্যাতিতি এসকল জনগোষ্ঠী থেকে উইঘুররা একটু বেশিই দুর্ভাগা এই হিসেবে যে,অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর করা নিপীড়নের খবর কিছুটা হলেও বিশ্ব মিডিয়ায় আসে, পৃথীবির লোকজন জানে কিছুটা হলেও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় কিন্তু উইঘুররদের উপর করা নির্যাতনের কোন খবরই বিশ্ব মিডিয়ায় তেমন একটা আসে না আর পৃথিবীর মানুষও সেসব সম্পর্কে খুব একটা জানে না।এর কারন হিসেবে মিডিয়ার উপর কমিউনিস্ট চীনের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের কথাটাই বলা যেতে পারে।অন্যভাবে বললে উইঘুর মুসলিমদের উপর করা নির্যাতন আর নিপীড়ন ‘মানবতাবাদীদের’ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার খুব একটা কারন হয়তো হচ্ছে না।

উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত,এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী।পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ,যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান।
উইঘুরদের সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। চীনে উইঘুর ছাড়াও হুই, কাজাখ, ডংজিয়াং, খালকাস, সালার, তাজিক, বাওন, উজবেক, তাতার মুসলিম রয়েছে। তবে এদের অধিকাংশ ই সেক্যুলার মুসলিম ফলশ্রুতিতে চীনা সরকার উইঘুরদের প্রতি যতটা খড়গহস্ত অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি ততটা নয়।কারন হিসেবে বলা যেতে পারে উইঘুরদের চীনা কর্তৃপক্ষ জবর দখল করেছে বাকিদেরকে সেটা করা হয়নি।তাছাড়া উইঘুররা রাজনৈতিক ইসলামকে ধারণ করে বাকিরা সেটা করে না।সম্ভববত পৃথিবীতে সব শাসকরাই এই রাজনৈতিক ইসলামকেই ভয় পায়।কি আমেরিকা,কি ইউরোপ,কি সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্য কি বাংলাদেশ বা পাকিস্তান।সব স্থানে একই চিত্র।

উইঘুররা মুসলিম হয়েছিল উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের শাসনামালে।যখন তাঁর বিখ্যাত চার সেনাপতি পৃথিবীর চারদিকে অভিযান পরিচালনা করেছেন।ইতিহাসে আর কোন নৃপতিরা একসাথে এত জন বিজয়ী সেনাপতি ছিল কিনা আমার জানা নেই, এটাও জানা নেই যে এতো বিখ্যাত কোন সেনাপতির এমন করুন অবস্থা হয়েছিল কি না সেটাও।
বিখ্যাত এই চার সেনাপতির মধ্যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১১ খৃষ্টাব্দে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ বিন কাসেম,মধ্যে এশিয়ায় ৭১২ খৃষ্টাব্দে কুতায়বা ইবনে মুসলিম,তাঁর মাধ্যমে ই এই মাজলুম উইঘুররা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।স্পেনে৭১১ খৃষ্টাব্দে তারেক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই চারজন দিগ্বিজয়ী সেনাপতিকেই চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছিল।তাদের মতনই যেন তাদের হাতে বিজিত অঞ্চলের মুসলিমরাও আজ চরম নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার।স্পেনে প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসন থাকলেও তাদেরকে সেখান থেকে এমনভাবে নিচিহ্ন করা হয়েছে যে কোনকালে এই দেশটি মুসলিমরা আবাদ করেছে সেটা বুঝার আর কোন উপায়ই আজ বাকি নেই।মধ্য এশিয়ার উইঘুররা ছাড়া অন্যান্য দেশসমূহ দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট শাসনাধীন থেকে তাদের করুন অবস্থার কথা ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালেই বুঝতে পারা যায় আর সেখানকার চেচনিয়া বসনিয়ার কথা আর নাইবা বললাম।বাকি থাকলো আামাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা,ভারতবর্ষে সুলতানী আমল ও মুঘল আমল মিলিয়ে মুসলমানরা ৮০০ বছর শাসন করেছে,সুলতান আর মুঘলরা এই ভারতবর্ষকে আপন করে সাজিয়েছে কিন্তু বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার,ভারতের মুসলিমদের কী অবস্থা, কাস্মীরের কেমন পরিস্থিতি সেটা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই।মাঝে মাঝে আমার দেশটির কথা ভাবি,আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার যে নিয়ামত প্রদান করেছেন তা কি আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবো?ভিনদেশী হায়েনা আর তাদের এদেশীয় দালালদের কার্যক্রম দেখলে বড্ড ভয় লাগে আবার যুবকদের দেশপ্রেম আর স্বদেশপ্রীতি দেখলে মনে আশা জাগে।

উইঘুরদের মুসলিম হওয়ার পরের ধারাবাহিক ইতিহাস :
★৭৫৫ সালে আন লু সান নামের একজন জেনারেল চীনের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের অধীনে থাকা অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন।
★চীনের কেন্দ্রীয় শাসক চীনা সম্রাট এই বিদ্রোহ দমনের জন্য উইঘুর খানাতেরর কাছে সাহায্য চাইলেন।(খানাত বা খাগানাত তুর্কি শব্দ যা খান শাসিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে)
★সম্রাট উইঘুর খানাতের সহায়তায় আন লু সাং এর বিদ্রোহ দমন করার পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে খোদ খানাতকেই দখল করে নিতে উদ্যত হল।
★স্বাধীনচেতা উইঘুর খানাত স্বল্প শক্তি আর স্বল্প জনবল হওয়া সত্ত্বেও বিপুল জনবল আর শক্তিশালী চিনা সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো।কিন্তু একটা সময় বিপুল সংখ্যক উইঘুর নিহত হবার পরে স্বল্পসংখ্যক বেঁচে থাকা উইঘুর পিছু হটে এবং কোচো রাজত্বে আশ্রয়গ্রহণ করে।সেই থেকে শুরু হয় তাদের টিকে থাকার লড়াই।
★১০০৬ সালে উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হলেন তুর্কি বীর ইউসুফ কাদির খান।তাঁর নেতৃত্বেই পুনরায় মুসলিম সালতানাত ‘কারা খানিদ খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
★১৮ শতকের শেষের দিকে কিং রাজারা জুনগড় এবং তারিম উপত্যকার পূর্বাঞ্চল দখলের মাধ্যমে স্বাধীন উইঘুর রাজ্যকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়।
★এবার উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন তাসখন্দ নিবাসী ইয়াকুব বেগ।এই ইয়াকুব বেগ এর নেতৃত্বে উইঘুররা সংঘটিত হয় এবং কিং রাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাশগরের আশপাশের অঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলে শরিয়াভিত্তিক স্বাধীন কাশগরিয়া রাষ্ট্র।এই কাশগরিয়া রাষ্ট্রকেই আধুনিক পূর্ব-তুর্কিস্তান এর ভিত্তি ধরা হয়।তুরস্কের উসমানি খেলাফতের খলিফা তাঁকে সমর্থন দিয়ে ‘আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রদান করেন।
★১৮৮৭ সালের ২২ মে ইয়াকুব বেগ মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর মৃত্যুর পর পরই চীনের কিং রাজা ও রাশিয়ার জার শাসকরা স্বাধীন ইসলামী উইঘুর এই রাষ্ট্রটিকে দখল করে নিতে উঠেপড়ে লাগে।
★প্রায় সাত বছর লড়াই করার পরে ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বর চীনের মাঞ্চু বা কিং রাজা কাশগর কেন্দ্রীক পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয় এবং সেই সাথে ইয়াকুব বেগের চার সন্তান,নাতি নাতনি ও চার স্ত্রীদের সবাইকে বন্দী করা হয়।বিভিন্ন মেয়াদে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে মাত্র ১১ বছরের মধ্যে সবাইকেই শহীদ করা হয়।
( সূত্র -উইঘুরের কান্না-মুহসিন আবদুল্লাহ,পৃষ্ঠা ১১-১৭)
★১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়।
(সূত্র-দৈনিক যায়যায়দিন, ২৫ মে,২০১৯)
★১৯৩৩ সালে পুনরায় উইঘুর মুসলিমরা কাশগর ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান রাষ্ট্র।
★চাইনিজ জেনারেল শেং শি চাই এর নেতৃত্বে চাইনিজ হানরা এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে বেশিদিন স্বাধীন থাকতে দেয়নি।দখলদার চাইনিজ (হানদের) ব্যাপক হামলা আর আক্রমণের মুখে অল্প দিনেই এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
★১৯৪৪ সালে তুর্কিস্তান ইসলামী পার্টি নেতৃত্বে তিয়েশান পর্বতমালার ওপারে ঘুলজা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইঘুর মুসলিমদের পূর্ব-তুর্কিস্তান।
★১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর ১৩ ই অক্টোবর চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নেয়।
★চীন সরকারের এই দখলদারির বিরুদ্ধে উইঘুররা সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। তাদের এই লড়াই ৬ বছর অব্যহত থাকার পরে ১৯৫৫ সালের ১লা অক্টোবর কমিউনিষ্ট বাহিনী পুরো উইঘুর এলাকার দখল নেয়।
(সূত্র -উইঘুরের কান্না- মুহসিন আবদুল্লাহ)

সেই পূর্ব তুর্কিস্থানই আজকের জিনজিয়াং প্রদেশ।সেখানকার স্বাধীন নাগরিক উইঘুর মুসলিমদেরকে কথিত সায়ত্ত্বশাসনের নামে চীনা শাসকরা পরাধীনতার শিকল পরিয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।নিজেদের ভূমিতে নিজেদের মত করে থাকতে চাওয়াটা নিশ্চয়ই অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না?নিশ্চয়ই সেখানে কোন সামাজ্রবাদী আঘাত হানবে না?কিন্তু পৃথিবীতে মুসলিম নিপিড়নের ক্ষেত্রেই আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সকলেই নিরব থাকে। এমনকি মুসলমানদের নেতৃত্বের দাবিদার তারাও।নির্যাতনের এমন কোন উপায় বাকি রাখেনি যেটা চীনা কর্তৃপক্ষ করেনি।
যে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুররা ছিল শতকরা ৯৫ ভাগ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসী সেখানে আজ চীনা রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন আর রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে উইঘুরদের অবস্থান শতকরা ৪৫ ভাগে নেমে এসেছে।রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে ব্যাপক আকারে চীনা হানদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।যারা আজকে সেখানে শতকরা ৪০ ভাগ অধিবাসী হয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে উপনীত হয়েছে।কে জানে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই হানরাই হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পৌঁছাবে।
আর বর্তমান অবস্থার কথা আর কীইবা বলবো,কম বেশি সবারই জানা আছে।চীনা সরকার জিনজিয়াং প্রদেশে এই বিপুল সংখ্যক উইঘুরদের কেবল পরাধীনতার স্বাদ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।জিনজিয়াংএ তাদের জনসংখ্যার পরিমাণকে অর্ধেকে নামিয়ে আনলো,তাদের মাতৃভাষা উইঘুর ভাষাকে রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের মাধ্যমে পিছিয়ে দেওয়া হলো,তাদেরকে কালচার শিখানোর নাম করে বন্ধী শিবিরে আটকে রাখলো। সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি সেটি হল-
২০১৬ সালে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে বেইজিং সরকার।এর মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের অতিথি হিসেবে থাকতে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।মুসলিমদের সাথে পার্টির ‘সুসম্পর্ক সৃষ্টির’ জন্য নাকি এই উদ্যোগ।কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের সম্ভ্রমহানির অভিযোগ ওঠে।মানসিকভাবে শিশুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে।তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।সেই সাথে শিশুদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ম্যান্ডারিন তথা চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে।
( সূত্র- অন্য দিগন্ত-১৯ নভেম্বর, ২০১৯)

আজকে পশ্চিমা বিশ্ব যে কিছু কিছু কথা বলছে সেটা মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি, কিংবা মানবতার জন্য বলছে তা না,চীনের সাথে রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য তাদেরকে কোনঠাসা করতেই এসব বলা।মন্দের ভালো হিসেবে তবুও তো বলা।পবিত্র কাবার খাদেম বিন সালমান চায়না সফরে গিয়ে উইঘুর নির্যাতনের বৈধতা দিয়ে আসে,হালের কথিত মুসলিম নেতা ইমরান খান জানেনইনা উইঘুরদের উপর নির্যাতন হচ্ছে কি না,ওআইসি নিশ্চুপ, জাতিসংঘে এই বিষয়ে আলোচনার কথা উঠলেই খোদ ১৫-২০ টি মুসলিম রাষ্ট্র ই এর বিরুদ্ধাচারণ করে সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের এই একটু আধটু কথা বলার বিষয়টি(নিয়ত যেমনই থাকুক না কেন) তো ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হবে।
আজকে খবরে দেখলাম উইঘুর নির্যাতনের সাথে অভিযুক্তদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য একটি ফাইল ট্রাম্প সাহেবের সাক্ষরের জন্য তার অফিসে পাঠানো হয়েছে।তিনি সাক্ষর দিলেই সেটা আইনে পরিণত হবে।
আমার প্রত্যাশা পৃথিবীর সকল দেশেই জাতিগত নিপিড়ন বন্ধ হউক।সবার মধ্যেই রাজনীতিকে ছাপিয়ে মানবতাবোধ জাগ্রত হউক।সুখে থাকুক পৃথিবীর সব অংশের সব জাতি ধর্ম আর বর্ণের মানুষ।
লেখক–
তরিকুল আলম তাসিকুল
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকগুলো দেশ ইউরোপ ও জাপানের উপনিবেশ হতে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিশ্বের স্বাধীন রাষ্ট্রের তালিকায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে এদের আর্বিভাব ঘটে। অপরদিকে যুদ্ধপরবর্তী পরাশক্তি আমেরিকাসহ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে এবং তারা তাদের অর্থনৈতিক বাজার হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বেছে নেয়। হতদরিদ্র ও নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে উন্নয়নের সহযোগিতার নামে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আর এভাবে শুরু হয় নতুন উপনিবেশবাদের জয়যাত্রা, যার প্রদান হাতিয়ার হলো অর্থনীতি।
উপনিবেশ স্থাপনের পিছনে প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপাদানগত পরিবর্তন আসলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো পরির্বতন আসেনি। যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে উপনিবেশভুক্ত অঞ্চলগুলো হতে কাঁচামাল পাচার করে তার দ্বারা উৎপাদিত পণ্য ঐসব উপনিবেশিক অঞ্চলে রপ্তানি করার মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতো। তেমনি যুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। দরিদ্র দেশগুলো হতে সস্তায় পাওয়া শ্রম ও জমি (অর্থনীতিতে জমি হলো উৎপাদনের স্থান) বিনিয়োগের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে উৎপাদন করে থাকে এবং উৎপাদিত পণ্য আবার বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে ঐসব প্রান্তিক দেশগুলোতে বাজারজাতকরন করে থাকে। যার মাধ্যমে প্রান্তিক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে উন্নত বিশ্বের হস্তক্ষেপের পথ সুগম হয়।
ছবি : সংগৃহীত
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার হাতিয়ার হিসাবে বিশ্বায়ন ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশ মুক্ত থাকবে। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর বহুজাতিক সংস্থাগুলো অনায়াসে তৃতীয় বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে, কিন্তু এর বিপরীতে তৃতীয় দেশের কোম্পানী অর্থ ও প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবে দিন দিন ঘাটতির মুখে পতিত হতে থাকে। একপর্যায়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় সাবান এ্যারোমেটিকের বাজার ধ্বংস এবং অপরদিকে ইউনিলিভারের লাক্সের একচেটিয়া আধিপত্যের কথা বলা যায়। আবার বহুজাতিক সংস্থাগুলোতে চাকরিরত দেশীয় শ্রমিকের চাকরী হারানো, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ স্থগিতের ভয়ে দেশীয় পণ্য রক্ষা এবং বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। ফলে পরোক্ষভাবে ঐসব কোম্পানীগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকান দেশগুলোতে চীনের বহুজাতিক সংস্থাগুলো আধিপত্য উল্লেখযোগ্য।
অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশে উন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ ব্যবস্থা। ১৯৪৬ সালের পর থেকে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর আর্থ সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঠিক তখনি সুযোগটি শক্তিশালী ধনী রাষ্ট্রগুলো কাজে লাগাতে থাকে। তারা তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান এবং এর বিপরীতে কিছু সংস্কারমূলক শর্তারোপ করে। এসব শর্তাবলির মাধ্যমে অনেক সময় বিনিয়োগকারী দেশ বিনিয়োগকৃত দেশের পররাষ্টনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন ২০১৬ সালের শেষের দিকে চীন শ্রীলংকার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ইজারা নেয়। যার ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে চীনের হাতে আর মাত্র ২০ ভাগ থাকবে শ্রীলংকার সরকারের হাতে। যদিও বলা হয়েছে শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্য এ বন্দর ইজারা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে যে এখানে সামরিক নৌঘাঁটি স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের পদক্ষেপ চীন গ্রহণ করবে তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া অতি সাম্প্রতিককালে চীনের গৃহীত One Belt One Road Policy চীনকে যে এ অঞ্চলের পরাশক্তি হিসাবে পরিণত করছে তা দিন দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
ছবি : সংগৃহীত
এখন WTO বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক এর কথা ধরা যাক। এ দুটি সংস্থা অর্থনৈতিক উপনিবেশ বিস্তারের মূখ্য উপাদানের ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এসব চুক্তি উন্নত বিশ্বের জন্য তৈরী।এসব চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের স্বার্থ হাসিল করা। এর পিছনে উন্নত বিশ্বের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে তাদের প্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো অনুকরণ ও ব্যবহার না করতে পারে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতির ওপর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আর এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজারে উন্নত বিশ্বের সাথে বাণিজ্য করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ টিকে থাকতে পারেনা। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বাণিজ্যের ঘাটতির পাশাপাশি আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদী ঘাটতি দেখা দেয়।
এসব ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বিশ্বব্যাংক এর স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানের পূর্বে কিছু শর্তারোপ করছে। যার সবগুলো পূরণ করা তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে সম্ভবপর নয়, আবার পূরণ করলে দেখা যাচ্ছে ঋণ প্রত্যাশী দেশগুলোর অবকাঠামোগত এমনকি সরকারী নীতি নির্ধারণে বিশ্বব্যাংক এর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক এর অর্থের প্রধান উৎস,কাঠামোগত গঠন এবং পরিচালনার সম্পূর্ণ উন্নত বিশ্বের উপর ন্যস্ত। যেমন বিশ্বব্যাংক এর প্রেসিডেন্ট পদ আমেরিকা আর আইএমএফ এর প্রেসিডেন্ট পদ যুক্তরাজ্যের জন্য নির্ধারিত। অতএব বলাই যায় যে, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।
এরকম শতাধিক উদাহরণ ও উন্নত বিশ্বের পদক্ষেপ আলোচনা করা সম্ভব যার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর নতুন করে অর্থনীতির মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কার্য সঠিক ও সফলভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির এ নতুন কাঠামোই হলো অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ, অর্থনীতি যার মূল চালিকা শক্তি।
শাহ্ আলম
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
সর্বাধিক পঠিত
-
ইতিহাস4 years ago
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তিদের ভূমিকা
-
অন্যান্য3 years ago
উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়ন
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
শব্দশ্রমিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
-
বাংলাদেশ4 years ago
বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
-
শিল্প-সাহিত্য4 years ago
প্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা
-
ইতিহাস3 years ago
সম্রাট শাহজাহানঃ সৌন্দর্য্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে