Connect with us

আন্তর্জাতিক

মোদীর পররাষ্ট্রনীতি এবং বাংলাদেশ-ভারত অমীমাংসিত বিষয়বলী

Published

on

মোদীর পররাষ্ট্রনীতি এবং বাংলাদেশ-ভারত অমীমাংসিত বিষয়বলী

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় অতিক্রম করছে বলে ভারত ও বাংলাদেশের নেতারা দাবী করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের নিরঙ্কুশ সমর্থন না পাওয়া, তিস্তা সহ ৫৪ টি অভিন্ন নদীর পানি বন্ঠন সমস্যা এবং আসামের সাম্প্রতিক সময়ের নাগরিক পঞ্জী বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের সোনালী অধ্যায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের সমধানে ভারতের সমর্থন, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবন্ঠন সমস্যা সহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান আমারা কেন পেলাম না তা বুঝতে গেলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির আর্দশ ও গতি, প্রকৃতি অনুধাবন জরুরী।

মোদীর পররাষ্ট্রনীতি এবং বাংলাদেশ-ভারত অমীমাংসিত বিষয়বলী
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রাণালয়ের মুখপাত্র রাভিস কুমার দুইদেশের সম্পর্কে সোনালী অধ্যায় অভিহিত করে টু্ইট করেছেন , ছবি :সংগৃহীত


ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি বা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান অমাত্য কোটিল্যর একটি শিক্ষাকে অনুসরণ করে থাকে।

“ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাক্সক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেল না এবং সীমান্তবর্তী সবাইকে শত্রু বলে মনে করবে।”

নিজস্বার্থে প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপর আধিপত্যমূলক কর্তৃত্ব পরায়ণতা বজায় রাখতে চায় ভারত, যা ছিল চাণক্য অর্থশাস্ত্রের বিদেশনীতির মূলকথা।

অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে বহুল প্রচলিত ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ (নেহেরু ডকট্রিন)-এ তিনি বলেন, ভারত অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে।


ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান শঙ্কর চৌধুরীর বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে দিল্লীর রাডারের নিয়ন্ত্রন থেকে কোনভাবেই বের হতে দেওয়া যাবে না। ।


সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারত কর্তৃত্ববাদ ও প্রয়োগবাদ অনুসরণ করে। কর্তৃত্ববাদ রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে একচ্ছত্র আধিপাত্যকে নির্দেশ করে থাকে। মূলত প্রয়োগবাদ ( Pragmatism) রাষ্ট্রের ব্যবহারিক, ফলপ্রসূ এবং কার্যকর দিকগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। প্রয়োগবাদ দার্শনিক মতবাদ হিসেবে যতটা না বেশি পরিচিত তার বেশি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বেশি স্বীকৃত। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির দ্বারা সর্বোচ্চ অর্জন করতে চাই আর তাই তার পররাষ্ট্র নীতির দার্শনিক ভিত্তি ও কার্যকর পদ্ধতি হল প্রয়োগবাদ ও কর্তৃত্ববাদ।

ভারতের সংবিধানের ৫১ নং ধারা ও নির্দেশাত্মক নীতির বিদেশনীতিতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা বলা হয়।


অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধা, একে অপরের বিরুদ্ধে অনাক্রমণ,সমতা ও পারস্পারিক সুবিধা অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এই পাঁচটি বিষয়কে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হত, যাকে পঞ্চশীল নীতি বলা হত । ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চশীল নীতির বদল করেছেন। বিজেপি এর ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি পূর্বের পঞ্চশীল নীতিকে পঞ্চামৃতে রূপান্তর করেছে। সম্মান, ( Dignity ) সম্মবাদ ( Dialogue) সম্বৃদ্ধি (Shared prosperity) সুরক্ষা (Regional  & Global Security ) সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক ভিত্তি ( Cultural & Civilization link ) এই পাঁচটি নীতিকে বর্তমান মোদী সরকার পররাষ্ট্র নীতির নতুন প্রয়োগবাদী পাঁচ স্তম্ভ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ অর্জন দ্বারা শক্তিশালী ভারত গঠনে বদ্ধ পরিকর।

শক্তিশালী ভারত গঠনের ডাক দিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের বিজেপী সরকার। পূর্বে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি তথা বৈদেশিক নীাতিতে লুক ইস্ট বা পূর্বে তাকাও নীতি অনুসরণ করত অর্থাৎ ভারত তার সম্মৃদ্ধি,বাণিজ্য, বিনিয়োগ তথা বৈদেশিক ক্ষেত্রে পূর্বে দেশ চীন, জাপান এবং কোরীয়াকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করত। মোদী সরকার দুই দশকের “লুক ইস্ট” পলিসি বা পূর্বে তাকাও নীতি থেকে বেরিয়ে আসে। অ্যাক্ট ইষ্ট পলিসি (নিজেকে পূর্বের দেশ চীন,জাপান, কোরীয়ার সমকক্ষ মনে করছে ভারত) গ্রহন করেছে যা তাকে ভবিষ্যত পরাশক্তি মর্যাদা ( সম্মান, ) দিবে বলে ধারণা করা হয়।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রকুমার গুজরালের গুজরাল ডকট্রিন বলা হয়েছে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির কথা, ট্রানজিটের কথা। মোদী এই নীতির নিজেস্ব সংস্কারণ দাঁড় করিয়েছেন যাকে বলা হয় মোদী ডকট্রিন। এ নীত অনুযায়ী উপআঞ্চলিক সহযোগীতা, আঞ্চলিক যোগাযোগ তথা ট্রানজিট এবং কানেক্টিভিটিকে ব্যবহার করে সম্বৃদ্ধি অর্জন করতে চাই ভারত। প্রথম মেয়াদে মোদীর পররাষ্ট্রনীতি বা মোদি ডকট্রিনের প্রতিবেশী প্রথম নীতির মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিও ট্রানজিট সুবিধা আাদায় করে নেয়। যার মধ্যে উল্লেযোগ্য হল বাংলাদেশের ট্রানজিট প্রদান,সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া, ভারতীয় পন্য পরিবহনের জন্য সোনালী চতুর্ভুজ করিডোর, ৩৩০০ কি.মি. বিস্তুৃত পূর্ব পশ্চিম করিডোর,১৩৬০ কি.মি জুড়ে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সংযোগকারী ত্রিপাক্ষিক সড়কযোগাযোগ ব্যবস্থা ভারত মিয়ানমারের মধ্যে কলাদান মাল্টিমডেল প্রজেক্ট এবং ২৮০০ কি.মি বিস্তুৃত বাংলাদেশ,চীন,ভারত ও মিয়ানমার সংযোগকারী-অর্থনৈতিক করিডোর।

দ্বিতীয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদী প্রতিবেশীর প্রথম নীতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিবেশীর প্রতিবেশী নীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারত প্রচুর জ্বালানী তেলের প্রয়োজন রয়েছে। বৈরী প্রতিবেশ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের প্রতিবেশী খনিজ তেল সম্বৃদ্ধ ইরানেরা সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখে স্বার্থ আদায় করতে চাই মোদী। চীনের প্রতিবেশী রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে সেপ্টেম্বরে মোদীর রাশিয়া সফর করে এবং ভ্লাদভস্টক থেকে চেন্নাই পর্যন্ত নতুন সমুদ্র পথের প্রস্তাবনা করে। একই ভাবে চীনের আরেক প্রতিবেশী সাংহাই কোরঅপারেশনের সভাপতি দেশ কিরগিস্তানের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। চীন দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর দিয়ে তার মহাপরিকল্পা বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন করতে চাই।

ভারত মহাসাগের চীনের উপস্থিতি ভারতকে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। চীনের প্রভাব বৃদ্ধিরোধে এবং এই অঞ্চলের সুরক্ষা তথা বৈশ্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে ভারত অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত মহাসাগরে মলবার প্রণালীতে মালবার মহড়া চালায় যাকে চতুভূর্জ উদ্দ্যোগ বা কোয়ার্ড ল্যাটেরাল ডিপ্লোমেসি বলা হয়ে থাকে।
প্রথম মেয়াদে মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অনত্যম সমর্থক ছিল এবং এ নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম সহায়ক ছিল মোদীর ভারত। কিন্তু একবিংশ শতকের বহুমেরু কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ভারত সামষ্টিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশী প্রাধ্যান দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারত উন্নত দেশের জোট জি-২০ কে গুরুত্ব দিচ্ছে। সামষ্টিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ৩টি বিষয়ের কথা বলে সেগুলো হলো ১. সামুদ্রিক নিরাপত্তা/সহযোগিতা ২.সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ৩.রপ্তানি বহুমুখীকরণ। এই ৩টি ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি হলো প্রয়োগবাদী পররাষ্ট্রনীতি।

এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য ইন্দো-মার্কিন পরমানু চুক্তি ও মালবার প্রণালীতে মালবার মহড়া ভারতের প্রয়োগবাদী পররাষ্ট্রনীতির প্রকাশ করে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান থেকে যেন সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার প্রবেশ না করে এজন্য সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরে অবকাঠামোগত ও রাজনৈতিক পরিবর্তন করছে ভারত এবং আফগানিস্তানের সাথে অংশীদারীত্বমূলক সম্পর্ক করছে।


রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পশ্চিমা দেশসহ,আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের সাথে বানিজ্য সম্পর্কোন্নয়ন করতে প্রয়োজনে করতে বার্ডেন শেয়ার করতে রাজি ভারত।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ভারত জহরলাল নেহেরুর নিপপেক্ষ ভারত একবিংশ শতকের রাজনীতিতে মোদীর প্রয়োগবাদী এবং কতৃত্বাবাদী ভারতে পরিণত হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমার মোদীর ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রয়োগাবদী পররাষ্ট্রনীতি বলতে পারি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান সময়কে সোনালী অধ্যায় বা গোল্ডেন এজ যা কিছুই বলি না কেন প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সমর্থণ, পানি বন্ঠন সমস্যার সমাধান কিংবা আসামের নাগরিক পঞ্জী সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমদের শঙ্কার অবসান হবে তা বলা যাবে না।


রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের নিরঙ্কুশ সমর্থন না পাওয়ার অন্যতম কারণ হল ভারতের প্রয়োগবাদী এ্যক্ট ইস্ট নীতি এই নীতির মূল কেন্দ্রে রয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে ভারতের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে, সামরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং ভারত মিয়ানমারের থেকেই পূর্বে দেশ চীন, জাপানের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চাই। আর এই কারণেই ভারতে জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশকে নিরঙ্কুশ সমর্থণ দিয়ে ভারত কখনই মিয়ানমারকে চীন, রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিবে না।


তিস্তার পানি সুষ্টু পানি বণ্ঠণে প্রশ্নে বারবার চুক্তি হওয়ার প্রতিশ্রæতি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয় না। তিস্তার পানির বদলে আমরা তোর্ষার পানির প্রস্তাব পায়। আর এবারের চুক্তি অনুযায়ী আমরা তো ফেনী নদীর ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমতি ভারতকে দিয়ে এলাম। শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহার এবং বর্ষার মৌসুমে বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের কর্তৃত্ববাদের বহি:প্রকাশ বৈ আর কিছুই না।


ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ববৃন্দ বিভিন্ন সময়ে বলে থাকে আসামের নাগরিক পঞ্জী থেকে বাদ পড়াদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। পরারাষ্ট্রমন্ত্রী জয়সংকর বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এমনি নিউইয়র্কে সাইডলাইন বৈঠকে মোদী প্রধান শেখ হাসিনাকে বলেন এটি ভারতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা এ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনার কিছুই নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এই বিষয়ে খুব বেশী আলোচনা হয়নি বলে জানা গেল। কিন্তু ভারত এই নাগরিক পঞ্জীকেই ডায়াসফোর কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারে অর্থাৎ কৌশলে তাদেরকে বাংলাদেশের বিছিন্ন জনসংখ্যা প্রমাণ করে পুশ ব্যাক করতে পারে।


প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে পূর্বের ন্যায় ৭টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হল কিন্তু বাংলাদেশ ভারত অমীমাংসিত বিষয়গুলোর স্থায়ী সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সহযোগীতা, ৫৪ টি অভিন্ন নদীর পানি বন্ঠন, আসামের নাগরিক পঞ্জীর শঙ্কার কিংবা সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যার মত বিষয়গুলোর স্থায়ী সমাধান হওয়ার বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বর্তমান ক্ষমতাসীন মোদীর সরকারের কতৃত্ববাদী ও প্রয়োগবাদী পররাষ্ট্র নীতি।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা

Published

on

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্সাণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন

খোলা চোখে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা

ঘটনাঃ
জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনের বাসিন্দা জর্জ ফ্লয়েডকে (৪৬) গত ২৫ মে আটক করে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলি শহরের পুলিশ। আটকের পর ডেরেক চৌভিন নামের এক(শ্বেতাঙ্গ) পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে সড়কের উপর চেপে ধরলে তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান।এই হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে পুরো যুক্তরাষ্ট্র।
(প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)

বর্তমান আন্দোলনের পটভূমি-

চলমান এই আন্দোলনটি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডই একমাত্র কারন নয়,এই আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে ৩ টি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে-
প্রথমত
পুলিশি নির্যাতন এবং হত্যাকান্ড,বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হবার ঘটনা।
দ্বিতীয়ত
বিচার ব্যবস্থা।গোটা বিচার ব্যবস্থা এবং আইনি বিধি বিধানগুলো সংখ্যালঘু,দরিদ্র এবং বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না।
তৃতীয়ত
সমাজে বিরাজমান বৈষম্য,যার প্রধান শিকার হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন

ছবিঃ সংগৃহীত

এসবের সাথে সাথে আরো যে বিষয়টি মার্কিন সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা হলো বর্ণবাদ বিষয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বীকৃতির প্রবণতা।সমাজপতি ও রাজনীতিবিদ উভয়েরই মনোভাবটা হলো,এই নিয়ে কথা না বললেই যেন বর্ণবাদ অপসৃত হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড:

  • ২০১৪ সালের ১৭ ই জুলাই নিউইয়র্ক শহরে অভিন্ন পন্থায় শ্বাসরোধ করে এরিক গার্ণারের হত্য।
  • ২০১৪ সালের মিসৌরির ফার্গুসন শহরে মাইকেল ব্রাউনের হত্যা।
  • ২০১৫ সালের বাল্টিমোরে ফ্রোডগ্রের হত্যা।
  • ২০২০ সালের মার্চ মাসে কেনটাকির লুইভিল শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে নিজ বাড়িতে হত্যা।

(সূত্রঃ প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)

বর্তমান আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ নেওয়ার কারণ:-

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক  কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখলেও সেসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা এবারের মতন জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ লাভ করেনি।ইতিমধ্যেই এই ঘটনাকে বিশেষজ্ঞগণ ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের খুনের ঘটনার পর সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সঙ্গে তুলনা করছেন। সিএনএ,নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ টির বেশি শহর সহ অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন শহর এখন বিক্ষোভে উত্তাল।

fire in usa racism

ছবিঃ সংগৃহীত

বার্তা সংস্থা এপির মতে, এই পর্যন্ত বিক্ষোভকালে গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে চার হাজার মানুষ,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ মিলিটারি ফোস ন্যাশনাল গার্ডের ৫ হাজার সদস্যকে।

তো প্রশ্ন হলো এবারের আন্দোলনটা এই জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ নেওয়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞগন কয়েকটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেসব হল-

১- অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ধীর নীতি গ্রহণ করাঃ-

২৫ মে মে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা সংগঠিত হলেও ঘটনার ৮ দিন পরে এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত ডেরেক চৌভিনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।১-০৬-২০২০ ইং তারিখে তাকে আদালতে তোলার কথা থাকলেও  নানা অযুহাত আর টালবাহানায় সেটাকে পিছিয়ে ০৮-০৬-২০২০ তারিখে আদালতে হাজির করার তারিখ নির্ধারন করা হয়।

২- লুইভিলে শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে হত্যাঃ

Breaonna Taylor black us african women killed in usa

ছবি : সংগৃহীত

গত মার্চ মাসে লুইভিলে শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে পুলিশ কর্তৃক নিজ বাড়িতে হত্যা করা হলেও সে ঘটনার এখন পর্যন্ত যথাপোযুক্ত কোন বিচার হয়নি।

৩- সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রবল জোয়ার সষ্টি হওয়াঃ-

সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রতি তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন প্রদান শ্বেতাঙ্গবাদ আরো উস্কে দিচ্ছে।

৪-চীন ও ইরানের প্রকাশ্য মন্তব্য করাঃ-

বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও ইরানের বৈরিতার সম্পর্কের কথা সবারই জানা আছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন,” যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক বর্ণবাদ সমস্যা এবং পুলিশের নিপীড়ন ঘটনায় তুলে ধরেছে এই বিক্ষোভ

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মৌসাভী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিজ দেশের জনগনের উপর নিপিড়ন বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান।
( সূত্র: প্রথম আলো- ২ রা জুন ২০২০)

৫-বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারঃ-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিক্ষোভকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের গভীর ক্ষতটাই পৃথিবীর সামনে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে দশকের পর দশক ধরে বর্ণবাদ চলছে।সাদা কালোর জাহিলি বিভাজন চলমান রয়েছে।ফলে সাম্যবাদ নামক মার্কিন ভন্ডামি আজ সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।এরাই আবার বিশ্বের সামনে মানবতার বুলি কপচিয় সেই সাথে সারাবিশ্বে মানবতার সবক প্রদানের ফেরি করে থাকে।

আজ যেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্ব উত্তাল হয়েছে এমন পুলিশি নির্যাতনে বর্বর ইসরাইলী কর্তৃক ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘটে।দুঃখজনক হলেও সেসব নির্যাতনের সরব বা নিরব কোন প্রতিবাদই দেখতে পাওয়া যায় না।তবুও আমরা চাই পৃথিবীর সব অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ হউক।সব নিপিড়ন আর যুলুমের অবসান ঘটুক। মানবতা আর মাযলুম জনগোষ্ঠী মুক্তি পাক। মুক্তিপাক নিপীড়িত আরাকান, কাস্মীর, উইঘুর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন সহ বিশ্বের সকল মাযলুম জনগোষ্ঠী।

লেখক- তরিকুল আলম তাসিকুল
শিক্ষার্থী – সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

আন্তর্জাতিক

নিপীড়িত উইঘুর জনগোষ্ঠীর কথা

Published

on

উইঘুর নিপীড়ন

যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান সময়ের সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠী কোনটি? কেউ হয়তো বলবে আরাকানে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের কথা, কেউ বলবে ইহুদি কর্তৃক নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের কথা, কেউ হয়তো বলবে ভারত সরকার কর্তৃক নিপিড়ীত কাস্মীরীদের কথা, কেউ হয়তো বলবে সামাজ্রবাদী কর্তৃক নিপিড়ীত গৃহহারা সিরিয়ানদের কথা,কেউবা বলবে ইয়ামেনের কথা।আর কেউ কেউ হয়তো বলবে উইঘুর মুসলিমদের কথা।পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিতত এসব জনগোষ্ঠীর সবাই মুসলিম ধর্মাবলাম্বী।নির্যাতিতি এসকল জনগোষ্ঠী থেকে উইঘুররা একটু বেশিই দুর্ভাগা এই হিসেবে যে,অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর করা নিপীড়নের খবর কিছুটা হলেও বিশ্ব মিডিয়ায় আসে, পৃথীবির লোকজন জানে কিছুটা হলেও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় কিন্তু উইঘুররদের উপর করা নির্যাতনের কোন খবরই বিশ্ব মিডিয়ায় তেমন একটা আসে না আর পৃথিবীর মানুষও সেসব সম্পর্কে খুব একটা জানে না।এর কারন হিসেবে মিডিয়ার উপর কমিউনিস্ট চীনের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের কথাটাই বলা যেতে পারে।অন্যভাবে বললে উইঘুর মুসলিমদের উপর করা নির্যাতন আর নিপীড়ন ‘মানবতাবাদীদের’ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার খুব একটা কারন হয়তো হচ্ছে না।

Uyghur Detention Camp
ছবি : সংগৃহীত

উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত,এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী।পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ,যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান।

 

উইঘুরদের সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। চীনে উইঘুর ছাড়াও হুই, কাজাখ, ডংজিয়াং, খালকাস, সালার, তাজিক, বাওন, উজবেক, তাতার মুসলিম রয়েছে। তবে এদের অধিকাংশ ই সেক্যুলার মুসলিম ফলশ্রুতিতে চীনা সরকার উইঘুরদের প্রতি যতটা খড়গহস্ত অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি ততটা নয়।কারন হিসেবে বলা যেতে পারে উইঘুরদের চীনা কর্তৃপক্ষ জবর দখল করেছে বাকিদেরকে সেটা করা হয়নি।তাছাড়া উইঘুররা রাজনৈতিক ইসলামকে ধারণ করে বাকিরা সেটা করে না।সম্ভববত পৃথিবীতে সব শাসকরাই এই রাজনৈতিক ইসলামকেই ভয় পায়।কি আমেরিকা,কি ইউরোপ,কি সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্য কি বাংলাদেশ বা পাকিস্তান।সব স্থানে একই চিত্র।

 

uyghur muslim
ছবি : সংগৃহীত

উইঘুররা মুসলিম হয়েছিল উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের শাসনামালে।যখন তাঁর বিখ্যাত চার সেনাপতি পৃথিবীর চারদিকে অভিযান পরিচালনা করেছেন।ইতিহাসে আর কোন নৃপতিরা একসাথে এত জন বিজয়ী সেনাপতি ছিল কিনা আমার জানা নেই, এটাও জানা নেই যে এতো বিখ্যাত কোন সেনাপতির এমন করুন অবস্থা হয়েছিল কি না সেটাও।
বিখ্যাত এই চার সেনাপতির মধ্যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১১ খৃষ্টাব্দে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ বিন কাসেম,মধ্যে এশিয়ায় ৭১২ খৃষ্টাব্দে কুতায়বা ইবনে মুসলিম,তাঁর মাধ্যমে ই এই মাজলুম উইঘুররা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।স্পেনে৭১১ খৃষ্টাব্দে তারেক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই চারজন দিগ্বিজয়ী সেনাপতিকেই চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছিল।তাদের মতনই যেন তাদের হাতে বিজিত অঞ্চলের মুসলিমরাও আজ চরম নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার।স্পেনে প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসন থাকলেও তাদেরকে সেখান থেকে এমনভাবে নিচিহ্ন করা হয়েছে যে কোনকালে এই দেশটি মুসলিমরা আবাদ করেছে সেটা বুঝার আর কোন উপায়ই আজ বাকি নেই।মধ্য এশিয়ার উইঘুররা ছাড়া অন্যান্য দেশসমূহ দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট শাসনাধীন থেকে তাদের করুন অবস্থার কথা ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালেই বুঝতে পারা যায় আর সেখানকার চেচনিয়া বসনিয়ার কথা আর নাইবা বললাম।বাকি থাকলো আামাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা,ভারতবর্ষে সুলতানী আমল ও মুঘল আমল মিলিয়ে মুসলমানরা ৮০০ বছর শাসন করেছে,সুলতান আর মুঘলরা এই ভারতবর্ষকে আপন করে সাজিয়েছে কিন্তু বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার,ভারতের মুসলিমদের কী অবস্থা, কাস্মীরের কেমন পরিস্থিতি সেটা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই।মাঝে মাঝে আমার দেশটির কথা ভাবি,আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার যে নিয়ামত প্রদান করেছেন তা কি আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবো?ভিনদেশী হায়েনা আর তাদের এদেশীয় দালালদের কার্যক্রম দেখলে বড্ড ভয় লাগে আবার যুবকদের দেশপ্রেম আর স্বদেশপ্রীতি দেখলে মনে আশা জাগে।

 

The History of uyghur muslims
ছবি : সংগৃহীত

উইঘুরদের মুসলিম হওয়ার পরের ধারাবাহিক ইতিহাস :

★‌‌‍৭৫৫ সালে আন লু সান নামের একজন জেনারেল চীনের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের অধীনে থাকা অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন।
★চীনের কেন্দ্রীয় শাসক চীনা সম্রাট এই বিদ্রোহ দমনের জন্য উইঘুর খানাতেরর কাছে সাহায্য চাইলেন।(খানাত বা খাগানাত তুর্কি শব্দ যা খান শাসিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে)
★সম্রাট উইঘুর খানাতের সহায়তায় আন লু সাং এর বিদ্রোহ দমন করার পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে খোদ খানাতকেই দখল করে নিতে উদ্যত হল।
★স্বাধীনচেতা উইঘুর খানাত স্বল্প শক্তি আর স্বল্প জনবল হওয়া সত্ত্বেও বিপুল জনবল আর শক্তিশালী চিনা সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো।কিন্তু একটা সময় বিপুল সংখ্যক উইঘুর নিহত হবার পরে স্বল্পসংখ্যক বেঁচে থাকা উইঘুর পিছু হটে এবং কোচো রাজত্বে আশ্রয়গ্রহণ করে।সেই থেকে শুরু হয় তাদের টিকে থাকার লড়াই।
★১০০৬ সালে উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হলেন তুর্কি বীর ইউসুফ কাদির খান।তাঁর নেতৃত্বেই পুনরায় মুসলিম সালতানাত ‘কারা খানিদ খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
★১৮ শতকের শেষের দিকে কিং রাজারা জুনগড় এবং তারিম উপত্যকার পূর্বাঞ্চল দখলের মাধ্যমে স্বাধীন উইঘুর রাজ্যকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়।
★এবার উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন তাসখন্দ নিবাসী ইয়াকুব বেগ।এই ইয়াকুব বেগ এর নেতৃত্বে উইঘুররা সংঘটিত হয় এবং কিং রাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাশগরের আশপাশের অঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলে শরিয়াভিত্তিক স্বাধীন কাশগরিয়া রাষ্ট্র।এই কাশগরিয়া রাষ্ট্রকেই আধুনিক পূর্ব-তুর্কিস্তান এর ভিত্তি ধরা হয়।তুরস্কের উসমানি খেলাফতের খলিফা তাঁকে সমর্থন দিয়ে ‘আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রদান করেন।
★১৮৮৭ সালের ২২ মে ইয়াকুব বেগ মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর মৃত্যুর পর পরই চীনের কিং রাজা ও রাশিয়ার জার শাসকরা স্বাধীন ইসলামী উইঘুর এই রাষ্ট্রটিকে দখল করে নিতে উঠেপড়ে লাগে।
★প্রায় সাত বছর লড়াই করার পরে ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বর চীনের মাঞ্চু বা কিং রাজা কাশগর কেন্দ্রীক পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয় এবং সেই সাথে ইয়াকুব বেগের চার সন্তান,নাতি নাতনি ও চার স্ত্রীদের সবাইকে বন্দী করা হয়।বিভিন্ন মেয়াদে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে মাত্র ১১ বছরের মধ্যে সবাইকেই শহীদ করা হয়।
( সূত্র -উইঘুরের কান্না-মুহসিন আবদুল্লাহ,পৃষ্ঠা ১১-১৭)
★১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়।
(সূত্র-দৈনিক যায়যায়দিন, ২৫ মে,২০১৯)

★১৯৩৩ সালে পুনরায় উইঘুর মুসলিমরা কাশগর ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান রাষ্ট্র।

★চাইনিজ জেনারেল শেং শি চাই এর নেতৃত্বে চাইনিজ হানরা এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে বেশিদিন স্বাধীন থাকতে দেয়নি।দখলদার চাইনিজ (হানদের) ব্যাপক হামলা আর আক্রমণের মুখে অল্প দিনেই এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
★১৯৪৪ সালে তুর্কিস্তান ইসলামী পার্টি নেতৃত্বে তিয়েশান পর্বতমালার ওপারে ঘুলজা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইঘুর মুসলিমদের পূর্ব-তুর্কিস্তান।

★১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর ১৩ ই অক্টোবর চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নেয়।

★চীন সরকারের এই দখলদারির বিরুদ্ধে উইঘুররা সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। তাদের এই লড়াই ৬ বছর অব্যহত থাকার পরে ১৯৫৫ সালের ১লা অক্টোবর কমিউনিষ্ট বাহিনী পুরো উইঘুর এলাকার দখল নেয়।
(সূত্র -উইঘুরের কান্না- মুহসিন আবদুল্লাহ)

 

Uighur_map_Correction
ছবি : সংগৃহীত

সেই পূর্ব তুর্কিস্থানই আজকের জিনজিয়াং প্রদেশ।সেখানকার স্বাধীন নাগরিক উইঘুর মুসলিমদেরকে কথিত সায়ত্ত্বশাসনের নামে চীনা শাসকরা পরাধীনতার শিকল পরিয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।নিজেদের ভূমিতে নিজেদের মত করে থাকতে চাওয়াটা নিশ্চয়ই অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না?নিশ্চয়ই সেখানে কোন সামাজ্রবাদী আঘাত হানবে না?কিন্তু পৃথিবীতে মুসলিম নিপিড়নের ক্ষেত্রেই আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সকলেই নিরব থাকে। এমনকি মুসলমানদের নেতৃত্বের দাবিদার তারাও।নির্যাতনের এমন কোন উপায় বাকি রাখেনি যেটা চীনা কর্তৃপক্ষ করেনি।
যে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুররা ছিল শতকরা ৯৫ ভাগ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসী সেখানে আজ চীনা রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন আর রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে উইঘুরদের অবস্থান শতকরা ৪৫ ভাগে নেমে এসেছে।রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে ব্যাপক আকারে চীনা হানদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।যারা আজকে সেখানে শতকরা ৪০ ভাগ অধিবাসী হয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে উপনীত হয়েছে।কে জানে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই হানরাই হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পৌঁছাবে।
আর বর্তমান অবস্থার কথা আর কীইবা বলবো,কম বেশি সবারই জানা আছে।চীনা সরকার জিনজিয়াং প্রদেশে এই বিপুল সংখ্যক উইঘুরদের কেবল পরাধীনতার স্বাদ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।জিনজিয়াংএ তাদের জনসংখ্যার পরিমাণকে অর্ধেকে নামিয়ে আনলো,তাদের মাতৃভাষা উইঘুর ভাষাকে রাষ্ট্রীয় নিপিড়নের মাধ্যমে পিছিয়ে দেওয়া হলো,তাদেরকে কালচার শিখানোর নাম করে বন্ধী শিবিরে আটকে রাখলো। সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি সেটি হল-
২০১৬ সালে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে বেইজিং সরকার।এর মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের অতিথি হিসেবে থাকতে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।মুসলিমদের সাথে পার্টির ‘সুসম্পর্ক সৃষ্টির’ জন্য নাকি এই উদ্যোগ।কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের সম্ভ্রমহানির অভিযোগ ওঠে।মানসিকভাবে শিশুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে।তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।সেই সাথে শিশুদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ম্যান্ডারিন তথা চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে।
( সূত্র- অন্য দিগন্ত-১৯ নভেম্বর, ২০১৯)

 

uighur-us-flag-protest
ছবি : GettyImages

আজকে পশ্চিমা বিশ্ব যে কিছু কিছু কথা বলছে সেটা মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি, কিংবা মানবতার জন্য বলছে তা না,চীনের সাথে রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য তাদেরকে কোনঠাসা করতেই এসব বলা।মন্দের ভালো হিসেবে তবুও তো বলা।পবিত্র কাবার খাদেম বিন সালমান চায়না সফরে গিয়ে উইঘুর নির্যাতনের বৈধতা দিয়ে আসে,হালের কথিত মুসলিম নেতা ইমরান খান জানেনইনা উইঘুরদের উপর নির্যাতন হচ্ছে কি না,ওআইসি  নিশ্চুপ, জাতিসংঘে এই বিষয়ে আলোচনার কথা উঠলেই খোদ ১৫-২০ টি মুসলিম রাষ্ট্র ই এর বিরুদ্ধাচারণ করে সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের এই একটু আধটু কথা বলার বিষয়টি(নিয়ত যেমনই থাকুক না কেন) তো ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হবে।

আজকে খবরে দেখলাম উইঘুর নির্যাতনের সাথে অভিযুক্তদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য একটি ফাইল ট্রাম্প সাহেবের সাক্ষরের জন্য তার অফিসে পাঠানো হয়েছে।তিনি সাক্ষর দিলেই সেটা আইনে পরিণত হবে।
আমার প্রত্যাশা পৃথিবীর সকল দেশেই জাতিগত নিপিড়ন বন্ধ হউক।সবার মধ্যেই রাজনীতিকে ছাপিয়ে মানবতাবোধ জাগ্রত হউক।সুখে থাকুক পৃথিবীর সব অংশের সব জাতি ধর্ম আর বর্ণের মানুষ।

 

লেখক
তরিকুল আলম তাসিকুল
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

আন্তর্জাতিক

অর্থনৈতিক উপনিবেশববাদ ও তৃতীয় বিশ্ব

Published

on

অর্থনৈতিক উপনিবেশববাদ ও তৃতীয় বিশ্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকগুলো দেশ ইউরোপ ও জাপানের উপনিবেশ হতে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিশ্বের স্বাধীন রাষ্ট্রের তালিকায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে এদের আর্বিভাব ঘটে। অপরদিকে যুদ্ধপরবর্তী পরাশক্তি আমেরিকাসহ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে এবং তারা তাদের অর্থনৈতিক বাজার হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বেছে নেয়। হতদরিদ্র ও নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে উন্নয়নের সহযোগিতার নামে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আর এভাবে শুরু হয় নতুন উপনিবেশবাদের জয়যাত্রা, যার প্রদান হাতিয়ার হলো অর্থনীতি।

উপনিবেশ স্থাপনের পিছনে প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপাদানগত পরিবর্তন আসলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো পরির্বতন আসেনি। যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে উপনিবেশভুক্ত অঞ্চলগুলো হতে কাঁচামাল পাচার করে তার দ্বারা উৎপাদিত পণ্য ঐসব উপনিবেশিক অঞ্চলে রপ্তানি করার মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতো। তেমনি যুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। দরিদ্র দেশগুলো হতে সস্তায় পাওয়া শ্রম ও জমি (অর্থনীতিতে জমি হলো উৎপাদনের স্থান) বিনিয়োগের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে উৎপাদন করে থাকে এবং উৎপাদিত পণ্য আবার বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে ঐসব প্রান্তিক দেশগুলোতে বাজারজাতকরন করে থাকে। যার মাধ্যমে প্রান্তিক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে উন্নত বিশ্বের হস্তক্ষেপের পথ সুগম হয়।

অর্থনৈতিক উপনিবেশববাদ ও তৃতীয় বিশ্ব

ছবি : সংগৃহীত

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার হাতিয়ার হিসাবে বিশ্বায়ন ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশ মুক্ত থাকবে। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর বহুজাতিক সংস্থাগুলো অনায়াসে তৃতীয় বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে, কিন্তু এর বিপরীতে তৃতীয় দেশের কোম্পানী অর্থ ও প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবে দিন দিন ঘাটতির মুখে পতিত হতে থাকে। একপর্যায়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় সাবান এ্যারোমেটিকের বাজার ধ্বংস এবং অপরদিকে ইউনিলিভারের লাক্সের একচেটিয়া আধিপত্যের কথা বলা যায়। আবার বহুজাতিক সংস্থাগুলোতে চাকরিরত দেশীয় শ্রমিকের চাকরী হারানো, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ স্থগিতের ভয়ে দেশীয় পণ্য রক্ষা এবং বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। ফলে পরোক্ষভাবে ঐসব কোম্পানীগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকান দেশগুলোতে চীনের বহুজাতিক সংস্থাগুলো আধিপত্য উল্লেখযোগ্য।

অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশে উন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ ব্যবস্থা। ১৯৪৬ সালের পর থেকে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর আর্থ সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঠিক তখনি সুযোগটি শক্তিশালী ধনী রাষ্ট্রগুলো কাজে লাগাতে থাকে। তারা তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান এবং এর বিপরীতে কিছু সংস্কারমূলক শর্তারোপ করে। এসব শর্তাবলির মাধ্যমে অনেক সময় বিনিয়োগকারী দেশ বিনিয়োগকৃত দেশের পররাষ্টনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন ২০১৬ সালের শেষের দিকে চীন শ্রীলংকার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ইজারা নেয়। যার ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে চীনের হাতে আর মাত্র ২০ ভাগ থাকবে শ্রীলংকার সরকারের হাতে। যদিও বলা হয়েছে শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্য এ বন্দর ইজারা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে যে এখানে সামরিক নৌঘাঁটি স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের পদক্ষেপ চীন গ্রহণ করবে তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া অতি সাম্প্রতিককালে চীনের গৃহীত One Belt One Road Policy চীনকে যে এ অঞ্চলের পরাশক্তি হিসাবে পরিণত করছে তা দিন দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

অর্থনৈতিক উপনিবেশববাদ ও তৃতীয় বিশ্ব

ছবি : সংগৃহীত

এখন WTO বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক এর কথা ধরা যাক। এ দুটি সংস্থা অর্থনৈতিক উপনিবেশ বিস্তারের মূখ্য উপাদানের ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এসব চুক্তি উন্নত বিশ্বের জন্য তৈরী।এসব চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের স্বার্থ হাসিল করা। এর পিছনে উন্নত বিশ্বের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে তাদের প্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো অনুকরণ ও ব্যবহার না করতে পারে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতির ওপর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আর এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজারে উন্নত বিশ্বের সাথে বাণিজ্য করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ টিকে থাকতে পারেনা। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বাণিজ্যের ঘাটতির পাশাপাশি আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদী ঘাটতি দেখা দেয়।

এসব ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বিশ্বব্যাংক এর স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানের পূর্বে কিছু শর্তারোপ করছে। যার সবগুলো পূরণ করা তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে সম্ভবপর নয়, আবার পূরণ করলে দেখা যাচ্ছে ঋণ প্রত্যাশী দেশগুলোর অবকাঠামোগত এমনকি সরকারী নীতি নির্ধারণে বিশ্বব্যাংক এর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক এর অর্থের প্রধান উৎস,কাঠামোগত গঠন এবং পরিচালনার সম্পূর্ণ উন্নত বিশ্বের উপর ন্যস্ত। যেমন বিশ্বব্যাংক এর প্রেসিডেন্ট পদ আমেরিকা আর আইএমএফ এর প্রেসিডেন্ট পদ যুক্তরাজ্যের জন্য নির্ধারিত। অতএব বলাই যায় যে, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।

এরকম শতাধিক উদাহরণ ও উন্নত বিশ্বের পদক্ষেপ আলোচনা করা সম্ভব যার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর নতুন করে অর্থনীতির মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কার্য সঠিক ও সফলভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির এ নতুন কাঠামোই হলো অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ, অর্থনীতি যার মূল চালিকা শক্তি।

অর্থনৈতিক উপনিবেশববাদ ও তৃতীয় বিশ্ব

শাহ্ আলম

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত