কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বাঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস কইয়্যা একটা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পিয়াজি সা’বে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ’ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট তারিখে মুছলমান মুছলমান ভাই ভাই কইয়া, করাচী-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজারা বাঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম তারাবি হইয়া গেল।’
স্বাধীনতা যুদ্ধ বা এর উত্তর, যে প্রজন্মেরই বাঙালি হন না কেন, উপর্যুক্ত লেখাটি পড়ার সময় আপনার মস্তিষ্ক যদি আপনার কানে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র পাঠের কণ্ঠধ্বনি শুনাতে ব্যার্থ হয় তবে এই লেখাটি আপনার জন্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে (২৫ শে মে ১৯৭১ থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানটি । পর্যবেক্ষকদের মতে এখন পর্যন্ত বাঙালী রেডিও-টেলিভিশনের প্রচারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হিসেবে ধরা হয় এই ‘চরমপত্র’-কে। যার স্রষ্টা ছিলেন এম আর আখতার মুকুল, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে সাথে নিজের ও চরমপত্রের নাম এমন ভাবেই যোগ্য করে তুলেছিলেন, যাদের ইতিহাস না জানলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানা অপূর্ণ থেকে যায়।
আমার এই লেখায় এম আর আখতার মুকুল এর ‘চরমপত্র’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে এর প্রাসঙ্গিকতার এবং জনমানুষের কাছে এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
প্রথমেই চরমপত্রের প্রাসঙ্গিকতা এবং জনপ্রিয়তার কারণ
সময়টা ১৯৭১, ভয়-অন্ধকার ও অনিশ্চয়তার ভিতরে স্বাধীনতাকামী বাঙালির হৃদয়ের আনন্দ এবং অনুপ্রেরণার রসদ হিসাবে কাজ করেছে চরমপত্র। ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে চরমপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল উৎসাহ-উদ্দীপনাই দেয়নি একেবারে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে ভরপুর এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এম আর আখতার মুকুল দুর্বোধ্য রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রণনীতির ব্যাখ্যাও করেছেন। তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি এবং রণাঙ্গনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
আপামর জনসাধারণের কাছে চরমপত্র অনুষ্ঠানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ হতে পারে দুটো, প্রথমত, এর প্রাঞ্জল ভাষা। দ্বিতীয়ত, ব্যঙ্গাত্মক কৃত্রিম অথচ ভিন্ন কণ্ঠস্বর এর ব্যবহার। প্রধানত ঢাকাইয়া তথা বাঙলা ভাষার সঙ্গে একাত্মতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। মোট মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ জন গ্রাম বাংলার সন্তান হওয়ায় চরমপত্রের এমন ভাষার ব্যবহার স্বভাবতই তাদের কাছে প্রাঞ্জল ছিল। এমনকি লেখক কাজী নজরুল ইসলামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উর্দু ও ফারসি শব্দের পর্যাপ্ত ব্যবহার করেছেন। নতুন নতুন শব্দ উচ্চারণ এবং এর ব্যবহার যা পরবর্তীতে বাংলাভাষাকে নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এসকল আঞ্চলিক ভাষা এবং মিশ্র শব্দের সুগঠিত ব্যবহারের মাধ্যমে একটা রচনা সর্বগ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠার কারণ, গবেষণার বিষয় বস্তু হতে পারে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চরমপত্র প্রকাশের ইতিহাস
১৯৭১ সালের ২৫ মে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম শতবার্ষিকীতে যাত্রা শুরু করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বেতার কেন্দ্রের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ৫০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার সংগ্রহ করে তা প্রচার উপযোগী করার জন্য রাজশাহী সীমান্তে পলাশীর আম্রকাননে সেটা স্থাপন করেন। তারই নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও প্রপাগান্ডা শুরু করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীরা।
এদিকে এম আর আখতার মুকুল মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার অধিকর্তা ছিলেন বিধায়, এই নির্বাসিত সরকারের সকল কর্মকান্ড অন্তরঙ্গ আলোকে অবলোকন করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া নিয়মিত রণাঙ্গন পরিদর্শন এর অভিজ্ঞতা চরমপত্র এর স্ক্রিপ্ট লিখতে তাকে সাহায্য করেছে। তার এই অনুষ্ঠান প্রচারের লক্ষ্যে রেকডে ধারণ করার জন্য কলকাতা বালিগঞ্জের সেই বাড়িটির রেকর্ডিং স্টুডিওতে সময় মত হাজির হতে হতো তাকে, যে বাড়ির একাংশে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী এবং শিল্পীদের।
সময়মত চরমপত্র অনুষ্ঠানটি প্রচার এর জন্য নিয়মিত ভোর চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠতে হতো এম আর আখতার মুকুলকে। প্রতিদিন চরমপত্রের স্ক্রিপ্ট রচনার পেছনে তার সহধর্মিণীর মাহমুদা খানম রেবার স্বামীর প্রতি শাসন ও অনুপ্রেরণা অনস্বীকার্য। কারণ লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সহধর্মিনী তাকে সকালের নাস্তা পর্যন্ত দিতেন না। আর এই অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখা এবং ব্রডকাস্ট এর জন্য তার পারিশ্রমিক নির্ধারিত ছিল ৭ টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাঙালি জাতির সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র। “চরমপত্র” অনুষ্ঠানটি নামকরণ করেছিলেন তৎকালীন বেতার কর্মী আশফাকুর রহমান খান।
বৈচিত্র্যময় প্রতিটি স্ক্রিপ্ট
চরমপত্রের প্রত্যেকটি স্ক্রিপ্ট ছিল হাস্যরসের পরিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি স্ক্রিপ্ট এবং তা ব্রডকাস্টিং এর পিছনে এম আর আখতার মুকুল ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে স্বভাব এবং বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সবথেকে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স গ্রাজুয়েট এবং ক্যালকাটা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত বাবার প্রতিটি বদলির সাথে সাথে ছোটবেলা থেকেই স্কুল বদল হত এম আর আখতার মুকুলের। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। ইতিমধ্যে অসংখ্যবার স্কুল বদলির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা এবং সংস্কৃতির সাথে ছোটবেলা থেকেই তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে। তিরিশ দশকের ‘সন্ত্রাসী আন্দোলন’, বিয়াল্লিশের অসহযোগ আন্দোলন, ৪৩’ এর দুর্ভিক্ষ, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ১৯৪৭ এর ইংরেজদের বিদায় এবং ভারত বিভাগের ঘটনাবলী তার অভিজ্ঞতা পূর্ণ করেছে। ১৯৪৯ সালে দিনাজপুর জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বি এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এম আর আখতার মুকুল। সে বছর পাশের শতকরা হার মাত্র ২১ জন। দিনাজপুর কলেজ থেকে ৬৫ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন পাশ করেছিল, তার ভিতরে একজন ছিলেন এম আর আখতার মুকুল। জেলখানার ভিতরে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে বিশেষ করে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত নেতাদের সাথে উঠাবসা সুযোগ হয় তার। পরবর্তীতে পেশা হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা কে বেছে নিলে তৎকালীন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যেকটি ঘটনা তার অভিজ্ঞতা কে আরো সমৃদ্ধ করে। রাজনৈতিক পেশায় তিনি উত্তরোত্তর সাফল্য পেয়েছেন বটে। ১৯৬৪ সালে জুলাই মাসে সাংবাদিক হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় ওই সফরে সাংবাদিকদের সবাই অবাঙালি, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধি, একমাত্র ‘সবেধন নীলমণি’ ছিলেন এম আর আখতার মুকুল। তাছাড়া তিনি ১৯৬৫ সালে তুরস্ক সফর করেন। খুব কাছ থেকে পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক বিষয়গুলিও লক্ষ্য করার সুযোগ হয়েছে তার। তৎকালীন বিশ্ব নেতাদের সাথে সাক্ষাৎকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কার্যাবলী বিদেশ সফর থাকা অবস্থায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। অবশেষে ১৯৭১, ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সাথে ভাষাশৈলীর এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য সৃষ্টি ‘চরমপত্র’।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল এই চরমপত্র। চরমপত্র যার পুরোটা অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই ‘চরমপত্র’।