তৈরি হও মানবজাতি, ধর্ষণ কাব্যের জন্য
হাজার বছরের ধর্ষণ-মঙ্গলকাব্য

তিনবেলা খাবারে যেমন লবন ছাড়া মুখে রোচেনা, পত্রিকাগুলোর ফ্রন্ট পেইজে ধর্ষণের শিরোনাম ছাড়া যেন পানসে লাগে। এটা কোন ভাবে কটাক্ষ নয় বরং এক নিমপাতার মতো জঘন্য তেতো সত্য। ধর্ষণের খবরাখবর কমে গেলে আমরা অবাক হই। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ত্রিকালে বিশ্বাস। তিন কালে মানুষ পাপ-পুণ্যের যোগসূত্রে মিলিত হয়। তেমনি আমরা ধর্ষণের ত্রিকাল অর্থাৎ অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কে একটা যোগসূত্রে খোঁজার চেষ্টা করবো।

 

একটু ফিরে দেখা যাক তাহলে। মানব সভ্যতার ইতিহাস যতদূর জানা যায় ধর্ষণ/অত্যাচার মেয়ের ভূষণ বলা চলে। সভ্যতার শুরু হয়েছে ক্ষমতা তথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। এক গোষ্ঠীর অন্য গোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব এক জাতি অন্য জাতির উপর কর্তৃত্ব। এবং বিজয়ীদের হাতে নারী হয়েছে ভোগের বলি। সেকালে রাজা জমিদারদের মহলে নারীদের রক্ষিতা হিসেবে রাখা হতো দৈহিক চাহিদা মেটানোর জন্য। যখন দাসব্যবসা চলত তখন সুন্দরী মেয়েদের কিনে নেওয়া হতো। নারী ছিল নেশার দ্রব্য। দুপক্ষের মধ্যে লড়াই হলে কেউ জিতে যেত গণধর্ষণ করার লটারি। নিরেট প্রমাণ মেলে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে।

ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের সৈন্যরা গণহারে ধর্ষণযজ্ঞ চালায় বাংলাদেশের নারী, শিশু কিশোরী, বয়স্কা মহিলাদের উপর। ৩০ লাখ শহীদের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মা-বোন তাদের সম্মান হারিয়েছিল। এখনো সেই ইতিহাস হৃদপিন্ড খামচে ধরে সমগ্র বাঙালির। মূলত ধর্ষণকে যুদ্ধাবস্থায় বিরোধীপক্ষকে দুর্বল করার একটা স্নায়ুবিক অস্ত্র ধরা হয়। এরকম হাজারো উদাহরণ মিলবে ইতিহাস খতিয়ে দেখলে। সভ্যতার বিকাশের পেছনে নারীদের আত্মত্যাগের গাথা আছে সেটা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। অথচ যুগে যুগে নারী হয়েছে পুরুষের জোর প্রদর্শনের লক্ষবস্তু। রানী পদ্মাবতীর হাজার নারীর সাথে নিয়ে আগুনে ঝাপিয়ে সম্মান বাঁচানোকে আমরা গল্পে বলি, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। কিন্তু এর প্রকৃতি খুঁজে দেখার চেষ্টা করি না। কি অবাক ব্যাপার!!

এবারে আসি একুশ শতকের বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত সুশিক্ষিত সুশীল সমাজে নারীদের ধর্ষণের কেচ্ছায়। চলতি দশকের ধর্ষণের কাহিনী খতিয়ে দেখলে মোটামুটি একটা ধর্ষণ কাব্য হয়ে যাবে। মঙ্গলকাব্যের মতন। এই যে উন্নয়নের ¯স্রোতে দেশ ভেসে যাচ্ছে এই বিপরীতে জোয়ারের মতো নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে সন্ত্রাসবাদ, মাদক, দুর্নীতি…। এগুলোর সাথে অতি জীবন্ত অধ্যায় হলো ধর্ষণ। আন্তর্জাতিক পরিসরের হিসেব বাদই দিলাম বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়নের ফুসফুস নষ্ট করে দিচ্ছে ধর্ষণ নামক মহামারী।

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে শুরু করে ডেইলি স্টার পর্যন্ত কোন পত্রিকা বাদ যায়না প্রতিদিন ধর্ষণের কুৎসিত নিউজ থেকে। মাত্র ২/১ বছর আগে ফিরে তাকালেই তনু হত্যা, নুসরাত হত্যার ঘটনা আপনার গায়ে কাঁটা দিবে। দুটো সর্বোচ্চ আলোচিত ধর্ষণ হত্যা মামলা। এদেশের মানুষের কাছে ধর্ষণ শব্দটি এত পরিচিত হয়ে গেছে যে শিশুরা অ- তে অজগর শেখার আগে ধ- তে ধর্ষণ শিখে নেয়। এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না অনিশ্চিত যে জীবনে একবারও কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়নি।

অতীতে তো কিশোরী বয়সী বা নারীরা ধর্ষিত হত। এ শতাব্দীতে তো পাঁচ মাসের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। একটা সমাজ/দেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে যদি সেখানে চার শতাংশ নারী নিয়মিতভাবে নিগৃহীত, ধর্ষিত হয় তাদেরই পুরুষালে দ্বারা। যে সেক্টরেই যাওয়া হয়না কেন ভায়োলেশন আগাইনস্ট ওম্যান আপনার চোখে পড়বেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতি নিরাপত্তার গন্ডিতেও ধর্ষকদের কালোছায়া বিরাজমান। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আর ঘরের কাজ থেকে অফিসের কাজ প্রত্যেক ক্ষেত্রে যেমন মেয়েদের প্রবেশাধিকার বেড়েছে সমানুপাতিক হারে ধর্ষণকেও সঙ্গে নিতে হচ্ছে।

লজ্জার বিষয় হল গ্রামের অশিক্ষিত মূর্খ মেয়েটা যেমন সমাজের ধিক্কারে ধর্ষিত হয়েও মুখ চেপে থাকে। একইভাবে শহরের লেখাপড়া জানা নারী অধিকার সচেতন মেয়েটাও কোন না কোন ভাবে ধর্ষিত হয় আর তাদের ”সোসাইটি ও প্রেস্টিজ” বজায় রাখার জন্য মূক হয়ে থাকে। এজন্যই আমরা এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ছি। বিষয়টা মেয়েদের মনমগজে এমনভাবে গেথে গেছে যেন তাদের এটুকু সহ্য করতে হবে। আইনের কথা পরে ভাবলেও চলবে। আগে তো স্বরূপটা বুঝি –
আজকাল ধর্ষকেরা সেলিব্রিটি হয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তো আবার ধর্ষণের পর হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরিচিত হয়। ব্যাপারটা কত সহজ সেটা ভারতের রাম রহিমের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। চল্লিশোর্ধ একটা মানুষ সাধু সেজে তার আস্তানায় একের পর এক ধর্ষণ করে গেছে। পুলিশ তাকে যখন হাজতে নিল বেশকিছু শ্লীলতাহীন মানুষ মিছিল করা শুরু করে রাম রহিমের জামিনের। অথচ তার আস্তানায় হাজার হাজার কনডম পেয়েছিল পুলিশ। জেলে বসেও সে নারী সহচর্য চাইত।

ভারতের ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কেননা হাজারো রাম রহিম বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে আর দামি গাড়িতে বসে আয়েশে থাকে। এরা গ্রেপ্তার হয়না বলে আমজনতা তাদের খোজ জানেনা।

এই শতাব্দীতে নারী যেমন এভারেস্ট জয় করে এসেছে তেমনি ঘরে ফেরার আগে ধর্ষিত হয়ে ফিরেছে। অতীতের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ধর্ষিত হচ্ছে। রবি ঠাকুরের মতে নারী দেবী! দেবীকে পূজো করো। কিন্তু নারী এখন দেবীর আসন ছেড়ে ———- পরিণত হয়েছে। একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া যার নিয়ম। আচ্ছা তাহলে শিশু ধর্ষণ করে কি করে!! একটা মানুষের মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে কয়েক মাসের শিশুকে নিজের কামের শিকার করতে পারে! হ্যাঁ সভ্যতার সবরকম উন্নয়ন যখন আমাদের হাতের মুঠোয় তখন ক্যান্সারের মতন সমাজকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে ধর্ষণের কিটগুলো।

 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৪১ শতাংশ ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের তুলনায়। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের সংখ্যা ৪৯৬ যেটা কত বছরে ৩৫১-তে ছিল। এদের মধ্যে ৫৩ জনকে গ্যাং রেপ, ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। এদেশের আইনে ধর্ষণের যে শাস্তি বিধিবদ্ধ করা হয়েছে তাতে অপরাধীরা ফ্যামিলি ট্যুর দেওয়ার মতো উপভোগ করে বিষয়টা। এই যদি হয় বর্তমান যুগের অবস্থা তাহলে আজ থেকে ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর নারীদের উপর ধর্ষণের মাত্রা কোথায় পৌঁছাবে? তখনকার সময়ে কি একটা শিশু নির্ভয়ে স্কুলে যেতে পারবে যাতে শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত না হয়??

কে গ্যারান্টি দিতে পারে ৫০ বছর পর বাংলাদেশ একটা নিরাপদ সুস্থ পরিবেশ দিতে পারবে নারীসমাজকে। এখন যেরকম ভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্ণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। প্রযুক্তির সস্থা ব্যবহার তখন তো বেশি হতে পারে। যে দেশে ইসলাম ধর্মের লোক ৮০% এর বেশি সে দেশে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে অথচ ইসলামে নারীর তিনগুন মর্যাদার কথা বলা আছে। প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়া সত্তে¡ও যেখানে নারীরা সম্মানহানির ভয়ে আতঙ্কিত থাকে, ধর্ষণ হলে বিচার হয়না সে দেশে একটা মেয়ে জন্ম নেওয়া মানে একটা ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ানো। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ নম্বর ধারা মতে একজন ধর্ষকের সর্বোচ্চো শাস্তি যাবজ্জীবন অথবা অর্থদন্ড।

কিন্তু আজ অব্দি কেউ এই শাস্তি পায়নি ভবিষ্যতেও পাবে তার কি নিশ্চয়তা?? আচ্ছা ধীরে ধীরে আমরা সেই বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছি না তো? আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এরকম হয়ে যাবে নাতো যে, আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণ থেকে বাঁচানোর জন্য?? হতেই পারে এরকমটা- যদি এরকম হয় তাহলে এই দেশে নয়, সারা বিশ্বের অবস্থা কেমন হবে ভাবা যায়? চক্রাকারে ধর্ষণের বলয় ঘুরতেই থাকবে নাকি অদূর ভবিষ্যতে ধর্ষকদের শাস্তি আরো কঠোর হবে। দেশের নীতি প্রণয়নকারীরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন কিন্তু ধর্ষণের ভবিষ্যত রুপ কি হবে তারা ভাবে না কেন? তারা কখনো ধর্ষণের ত্রিকালের মধ্যে যোগসূত্র ভাবেনি? নাকি আমরা এটা বলব- চিৎকার করার চেয়ে উপভোগ করাই শ্রেয়? নাকি সর্বাধিক ধর্ষণের পুরুষকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা চালু হবে ??

লেখক :
উম্মে কুলসুম ইতি
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়