অন্যান্য
মাদক প্রসঙ্গে
সংজ্ঞাহীনতার গ্রিক প্রতিশব্দ থেকে উৎপন্ন Narcotic বলতে একদা নিদ্রাকর্ষী যেকোন ওষুধকে নির্দেশ করত। মাদকদ্রব্য তথা Narcotics মূলত ভেষজ, যা গ্রহণে মস্তিষ্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায় এবং কখনো কখনো বেদনানাশক রূপে চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। তবে বেশকিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুণ বেদনানাশক হিসেবে এসবের ব্যবহারকে দূর্ঘট করে তোলে। অধিকাংশ মাদকদ্রব্যই আফিমজ, যেমন-মরফিন, কোডিন, হিরোইন ইত্যাদি। গাঁজা, মারিজুয়ানা, ভাং ইত্যাদি ক্যানাবিসের সন্ততি।
ধুতুরা গোত্রজ কিছু মাদকদ্রব্যও অনুল্লেখ্য নয়। তামাকসহ চেতনা আচ্ছন্নকারী নিষিদ্ধ কিছু দ্রব্যের পাশাপাশি বেশকিছু জীবন রক্ষাকারী মহৌষধও নেশার উপকরণ হিসেবে গণ্য। আফিমজাত মাদকদ্রব্য তৈরি হয়ে থাকে পপি নামক উদ্ভিদ থেকে, যার প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয়ে থাকে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট(আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল(লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার)-এ।
বাংলাদেশের অবস্থিতি এই দুই সুবর্ণ পঙ্কিলের মাঝেই বিধায় এ দেশকে ভৌগোলিক কারণেই মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হতে হয়। উৎপাদিত আফিমের দুই-তৃতীয়াংশ হিরোইনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে বছরে ৩০০ টনেরও বেশি উক্ত অপদ্রব্যটি দুনিয়ার নানা মানুষের দেহে সঞ্চারিত হয়ে আসছে এবং উত্তরোত্তর এর প্রবৃদ্ধি ঘটছে। মাদক চোরাকারবারীরা সমুদ্র উপকূল বা জলপথকেই তাদের পণ্য পাচারের অতি সঙ্গত রাস্তা বিবেচনা করে থাকে, শুধু তা-ই নয়।
বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিশাল স্থলসীমান্তও বিবেচ্য এবং তা কাঁটাতারের দেয়ালের বিষয়টা মাথায় রেখেও বলা যায়। ভারতে উৎপাদিত ফেনসিডিল নামক কাশির সিরাপ এবং টাইডিজেসিক নামক ইনজেকশনও বাংলাদেশে মাদক হিসেবে অপব্যবহৃত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, অধুনাতন ইয়াবা নামক উত্তেজক ট্যাবলেট যা মূলত মেথামফেটাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ আর এক বিষবৃক্ষের বীজ হয়ে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে।
আফিম, কোকেন, ক্যানাবিস হচ্ছে প্রকৃতিদেবীর প্রত্যক্ষ প্রসাদে প্রাপ্ত আবর্জনা আর পেথিড্রিন, বারবিচুরেটস, আম্ফিটামাইনস হল ল্যাবরেটরির মাহাত্ম্য বা ভণ্ডামির বিড়ম্বনা। মাদকদ্রব্য মাদক হিসেবেই হোক আর ওষুধ-ভেষজ হিসেবেই হোক, মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে এর ক্রীড়ানৈপুণ্য। আয়ুর্বেদ জমানায় এর স্থান ব্যথানাশক, সর্বদুঃখহর বলে সদ্বিবেচিত। এরই সাথে যুক্ত থাকে এর তন্দ্রাচ্ছন্নতা, রক্তচাপের অবনমন, বমনেচ্ছা, কোষ্ঠবদ্ধতা প্রভৃতি নেতি নেতি গুটিকয় মনোদৈহিক যন্ত্রণা আর প্রায় নিরাময়ের অতীত বৈকল্য। মস্তিষ্কের মনন ও সৃজন অধ্যায় স্তিমিত হয়ে আসে ক্রমে ক্রমে। দেখা দেয় শারীরিক নিস্তেজনা। নানা বর্ণ-গন্ধ-স্বাদের মাদকদ্রব্যের আন্তঃপার্থক্য মূলত এদের কার্যক্ষমতা ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিভিন্নতার মাঝে নিহিত। মাদকের সাথে বরাবরই লেপ্টে থাকে অপরাধ। চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে দেহ ব্যবসা ও তা থেকে এইচআইভির বিস্তৃতি মাদকের পিছু পিছু ছায়ার মত সেঁটে থেকে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে অদূর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নীতিহীনতার করাল গ্রাসে নিক্ষেপ করে। হেন অপরাধ নেই যা একজন মাঝারি মানের নিয়মিত মাদকাসক্তের দ্বারা সম্পাদন অসঙ্গত।
আদম ও মাদক পাচার যে প্রায়ই হাত ধরাধরি করে চলে, এ তথ্যের অবগতির জন্য মানিকবাবুর হুসেন মিয়াকে সাক্ষী রাখতে হয় না। বাংলাদেশ সরকার মাদকাসক্তি নির্মূলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সকল প্রচেষ্টার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং জাতিসংঘ কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০’-কে সংশোধন করেছে এবং একে গতিশীল ও সদা কার্যকর রাখার প্রয়াসের নমুনা হিসেবে একটি বোর্ড(NNCB) গঠন করেছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। কর্তৃপক্ষকে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হলে প্রকল্পকে বুলিসর্বস্ব বা ফাইল নাড়াচাড়ায় সীমিত রাখা যাবে না। পাঠ্যক্রমে মাদক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, মাদকবিরোধী কনসার্ট, মাসে একবার করে মদের দোকান পরিদর্শনের আয়োজন, কেবলমাত্র অ্যালকোহল ও স্পিরিটে উচ্চ মাত্রার করারোপ নিন্দনীয় না হলেও যথেষ্ট নয়।
আরো একটা বিষয় ভেবে দেখার আবশ্যকতা আছে। সেটা হচ্ছে মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তার থেকে বেশি গুরুত্বের বিষয় এটা। ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০’-কে ফৌজদারী দণ্ডবিধির আওতায় রাখা হয়েছে এবং এ আইনে বিধৃত আছে যে, অ্যালকোহল ব্যতীত যে কোন ধরণের মাদকদ্রব্যের চাষ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, স্থানান্তর, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, হস্তগতকরণ, সংরক্ষণ, মজুতকরণ, প্রদর্শন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইনের একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে এর ফাঁক-ফোঁকর যথা লাইসেন্সের প্রসঙ্গ আছে।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বণ করা না হলে সমগ্র বিষয়টি চূড়ান্ত রকমের খেলো হবার অবকাশ ও আশঙ্কা থেকে যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি তামাক তথা মাদকের চাহিদার উল্লম্ফনের অবনমনে যথার্থ সচেষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ, সমাজ বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে মাদকের শিকার টিংটিঙে অসহায় কিছু গরীব লোককে ঠ্যাঙ্গালেই কার্যোদ্ধার হবে না, সমান্তরালে নাটক-সিনেমায় মাদকের অপ্রতিহত সবল উপস্থিতিকে জিইয়ে রেখে। জনি ডেপ, শাকিব খানরা চতুষ্কোণ পর্দায় ফিল্মি স্টাইলে সিগারেট, আর রোমান্টিক নায়কোচিত আবহ আনতে ছ্যাকা খেয়ে পরমব্রতরা গাঁজা এবং রণবীর কাপুররা গেলাস গেলাস মদ গিলবে ভাবসাব নিয়ে আর আমরা যারা তরুণ দর্শক, তারা দোকানে গিয়ে চুইংগাম, ললিপপ খুঁজবো-এটা যেন নীতিনির্ধারকদের মাথায় না আসে। ‘Cigarette causes cancer’-এই একটা লাইন পর্দায় ভেসে ওঠাটা, এমনকি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সতর্কতামূলক ছবির সাম্প্রতিক সংযুক্তিও আমাদেরকে ফেলুদার মত করে সিগারেটে টান মারার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অতি দূর্বল আবেদন রাখে।
বিজ্ঞানী ফিউদর উগলভ বলেছিলেন যে, মানবজাতির জন্য মদ্যপান যুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ, প্লেগের একান্ত প্রতিক্রিয়ার চেয়েও ভয়াবহ। উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাংলাদেশে শুধুমাত্র তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার লোক। পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় আধা কোটিরও ঢের বেশি। এ এমন এক সময় যেখানে অন্ধকারের হাতছানি ক্রমশ তীব্রতা পাচ্ছে ভোগবাদের উল্লম্ফনের প্রতিক্রিয়ায়। আমরা তরুণেরা নৈতিক-সাংস্কৃতিক অবনমনের প্রক্রিয়ায় পরস্পর থেকে অধিকতর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। সামাজিক কর্তব্যবোধের প্রতি বিচ্যুতিটাকে জয় করে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোকে অধিকতর সরল ও সুন্দর করে কাঠামো দিতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর মোড় নেবে। অতএব, যে আগাছা ঝোপে পরিনত হয়েছে, তাকে জঙ্গলের আকার নেয়ার আগেই সমূলে উৎপাটন করতে হবে। আর একটা কথা, আমাদের সমাজে কেউ মাদক গ্রহণ শুরু করলে লোকে প্রথমে গালিগালাজ, বয়সে ছোট হলে চড়-চাপড় দিয়ে শাসন এবং কেউ ছাড়ার চেষ্টা করলে ঘটনাটাকে ভড়ং বলে সিদ্ধান্তে আসার পরিহাস-প্রবণতা মর্মান্তিক। বহুদিন আগে গ্যাটে তার ফাউস্ট-এ বলে গিয়েছিলেন যে, এতকিছুর পরেও জীবন খুব মূল্যবান। আমাদের হতাশ হলে চলবে না সামনে অনেক পথ।
| লেখকঃ রাহুল চন্দ্র দাস |
-
ইতিহাস4 years agoবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তিদের ভূমিকা
-
অন্যান্য3 years agoউন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়ন
-
শিল্প-সাহিত্য3 years agoদ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
-
শিল্প-সাহিত্য3 years agoআধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
-
শিল্প-সাহিত্য3 years agoশব্দশ্রমিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
-
বাংলাদেশ4 years agoবঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
-
শিল্প-সাহিত্য4 years agoপ্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা
-
ইতিহাস3 years agoসম্রাট শাহজাহানঃ সৌন্দর্য্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে