মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের (যে কোন লেখক, সম্পাদক বা প্রকাশক নির্বিশেষে) “বিজ্ঞান আর্শীবাদ না অভিশাপ” নামক প্রবন্ধ রচনায় দু’টি কমন লাইন দেখতে পাওয়া যায়-“বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ” “বিজ্ঞান আমাদের উপকার করবে না অপকার করবে তা নির্ভর করে ব্যবহার ও ব্যবহারকারীর উপর।” বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই যুগে আবেগ-অনুভূতি ও মতামত প্রকাশ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দেশ-বিদেশের খবর, বিনোদন, কেনাকাটাসহ যাপিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের উপর দেশের তরুণ প্রজন্মের নির্ভরতা পৌন:পুনিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ছবি : সংগৃহীত
ট্র্যাক এক্স নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ডেমোগ্রাফিকস-২০১৭’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেসবুকই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। শীর্ষ পাঁচে এর পরে আছে যথাক্রমে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও পিটারেস্ট। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতিমাসে ২০০ কোটি মানুষ ফেসবুকের সেবা গ্রহণ করছে।
ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটাসের হিসাব অনুযায়ী, এশিয়ায় ফেসবুকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এই মাধ্যম ব্যবহারকারী প্রতি তিনজনের একজনই এই মহাদেশের বাসিন্দা।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযু্ক্তি (আইসিটি) বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। সরকারি হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যত এ্যাকাউন্ট আছে, তার ৯৯ শতাংশই ফেসবুককেন্দ্রিক।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আবেগ-অনুভূতি ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ফেসবুকের উপর নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, এই নির্ভরতা কি বর্তমানে যৌক্তিকতার সীমাকে অতিক্রম করছে বা যৌক্তিক মানদন্ডে এই নির্ভরতা কতটুকু যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে?
এক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় এখন আমরা অবলোকন করছি যা আমাদেরকে এ ব্যাপারে ধারণা প্রদান করতে সক্ষম।
প্রথমত, ফেসবুকে অবাধে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ পেয়ে আমরা ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তার মধ্যেকার ফারাক উপলদ্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। যেমন- একজন স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্লাসিংটন ইউনিভার্সিটিতে বায়োটেকনোলজি পড়তে চাইলে কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আরেকজন স্ট্যাটাস দিচ্ছে, সে আলু দিয়ে পরোটা তৈরি করেছে। এখানে প্রথম ব্যাপারটা যতটা প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় ব্যাপারটা ততটা প্রয়োজনীয় নয়। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ফেসবুকের যে মূল লক্ষ্য অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ সেটা হচ্ছে কিন্তু অর্থাৎ ‘যৌক্তিক যোগাযোগ’ বলতে যা বোঝায় সেটা হচ্ছে কি? প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিতে সেটা কি উঠানো হয়েছে নাকি আমাদের প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা বোঝার উপলদ্ধির স্তর ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে?
দ্বিতীয়ত, সেন্সরবিহীন ছবি (বিশেষ করে সেলফি) প্রকাশের সুযোগে মানুষের Face Value’ অর্থাৎ একজন আরেকজনকে দেখার আকুলতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। “বড় সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি”-এসব গান এখন আর মানুষকে আকুল করে না। অথচ ফেসবুক পূর্বযুগে একজন আরেকজনকে দেখার আকুলতা প্রবল ছিল। “কে যাস্ রে ভাটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধনরে কইয়ো নাইর নিতো বইলা”; যারে যা চিঠি লিইখ্যা দিলাম সোনা বন্ধুর নামে রে”-এসব গানে একজন আরেকজকে একনজর দেখার যে অপরিমেয় আবেগ-আকুতি ছিল তা সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝতে পারেন যে, এখন তার আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।

ছবি : সংগৃহীত
তৃতীয়ত, ফেসবুকে ইমোটিকন ব্যবহারের বদৌলতে যে কোন আবেগ, ভাব ও অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে একধরনের কৃত্রিমতা আমাদের মাঝে প্রবেশ করছে। যেমন-এখন আমরা খুব সহজেই কান্না ও হাসির ইমোটিকন ব্যবহার করে অনুভূতির দরজা না খুলেই অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারছি যাকে কোনভাবেই অকৃত্রিম বলা যায় না।
চতুর্থত, ফেসবুকের কারণে `Face to Face’ অর্থাৎ মুখোমুখি বসে কথা বলা বা চোখে চোখ রেখে কথা বলার মত শিল্পিত তথা সাহসী ব্যাপারটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। “চোখ যে মনের কথা বলে”-কথাটি তার সত্যতা হারাচ্ছে। আসলে হয়তো আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের এমন একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছি যেখানে একজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে আমাদের লজ্জা হয়। মানুষ এখন তাই ফেসবুকের ভার্চুয়াল পথেই কথা বলে। কেননা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে একজন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে হয়। মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে। আর মানুষের এই দুর্বলতাকে ঢেকে দিচ্ছে ফেসবুকের ভার্চুয়াল পথ।
পঞ্চমত, ফেসবুক সম্পর্কে অতি সাম্প্রতিককালের একটি অভিযোগ এই যে, অপিরিচিতদের কাছাকাছি আনতে গিয়ে পরিচিতদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে ফেসবুক। উক্ত অভিযোগটির শক্ত ভিত্তি রয়েছে বৈকি। কেননা অধিকাংশ মানুষের ফেসবুক আইডি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাতে পরিচিত ও সুপরিচিতদের চেয়ে স্বল্প পরিচিত ও অপরিচিতদের আনাগোনাই বেশি। অর্থাৎ মানুষ এখন লোক দেখানো সম্পর্কে বিশ্বসী হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে Touchscreens are the real reason why humans lost touch with each other”.
আর নচিকেতার গানের ভাষায়-
“খোকাখুকু আজো প্রেমে পড়ে চলে দলে দলে,
মুখোমুখি বসে তারা মোবাইল ফোনেই কথা বলে।”
যার ফলশ্রুতিতে প্রায়শই মানুষকে এখন হিংসা, প্রতিহিংসা, আক্রোশ, ক্রোধান্ধতা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, ঔদ্ধত্যমূলক ও অমূলক আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ হালকা হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভেঙ্গে যাচ্ছে পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ও আত্মীয়তা। ফেবসুকের সাবেক কর্মকর্তা কামাথ পালিহাপতিয়া বলছেন, ‘লাইক’ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা মানুষকে ক্রমশ মেকি করে তুলছে”। ফেসবুকে তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার আকাঙ্খা মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের সাইকোলজি।
আরেক সাবেক কর্মকর্তা শন পার্কার বলেন ফেসবুকে ‘লাইক’ পাওয়ার জন্য শারীরিক সৌন্দর্য্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যৌন উসকানি দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। ফেসবুক কারও কারও ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও প্রভাবিত করছে বলে দাবি করেন তিনি।
ষষ্ঠত, এবার একটি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। বিষয়টিকে একটি উপমার প্রয়োগে হালকা করে তুলে ধরা যেতে পারে। মৌমাছিদের জীবনচক্রে যখন অসুস্থতা বা বয়সের কারণে রাণী মৌমাছিকে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অযোগ্য মনে করা হয়, তখন রাণী মৌমাছির চারপাশে অন্যান্য মৌমাছিরা গুচ্ছ (Cluster) তৈরি করে রাখে যতক্ষণ না পর্যন্ত রাণী মৌমাছি অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে মারা না যায়। বিষয়টি ‘Cuddle death’ (মৃত্যু আলিঙ্গন) নামে পরিচিত অথবা একে ভালবেসে (মূলত মেকি তথা ভয়ঙ্কর) হত্যাও বলা যেতে পারে।

ছবি : সংগৃহীত
বর্তমানে আমরা কোমলমতি ছেলেমেয়েদের হাতে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বা নিরুপায় হয়ে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা তুলে দিচ্ছি যখন তাদের মূলত পড়াশোনা, সৃজনশীলতার চর্চা এবং খেলার মাঠে খেলাধুলা করার কথা। কিন্তু স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের বদৌলতে তারা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীটাকে কল্পনা করছে এবং বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করার সক্ষমতা হারাচ্ছে। এই বিষয়টিকে রাণী মৌমাছির ‘ Cuddle death’-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কেননা এক্ষেত্রেও আমাদের ক্ষণিক ভালবাসার উত্তাপ কোমলমতি এসব ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতার অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে, সেই সাথে তাদেরকে একটি বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে বৃত্তের বাইরে চিন্তা করা থেকে বিরত রাখছে। কিন্তু তাই বলে কি এসব কোমলমতি ছেলেমেয়েরা এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করবে না? হ্যাঁ- অবশ্যই করবে। তবে সেটা অবশ্যই এসব প্রযুক্তির উপযোগিতা উপলদ্ধি করার সক্ষমতা অর্জনের পরই কেবল মঙ্গলজনক বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
সবশেষে একটি জোকস্ দিয়ে এই বিষয়ে আলোচনার ইতি টানা যেতে পারে। জোকসটি ব্রিটিশ মুল্লুকের। ভারতীয় উপমহাদেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন এক ব্রিটিশ নাস্তিক। সে একমাস উপমহাদেশে কাটালো এবং ফিরে গিয়েই আস্তিক হয়ে গেল।
তখন তার এক বন্ধু তাকে হঠাৎ করে নাস্তিক থেকে আস্তিক হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ব্রিটিশ নাগরিক প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে গিয়ে দেখলাম-এখানে কেউ কোন নিয়ম মেনে চলে না, মানুষ মানুষকে ঠকায়; প্রতারণা করে, হাসতে হাসতে মিথ্যা কথা বলে, প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে, প্রেমিকা-প্রেমিকের সাথে প্রতারণা করে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও উপমহাদেশটা থেমে নেই; চলছে। এর মানে উপরে নিশ্চয়ই আল্লাহ্, ঈশ্বর বা খোদা নামে কেউ আছেন যিনি এত অনিয়ম সত্ত্বেও উপমহাদেশটাকে চালিয়ে নিচ্ছেন। তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব যেহেতু বিদ্যমান সেহেতু তাঁর সৃষ্টি হয়ে তাঁকে ভালোবাসাও আমার উচিত।
এখন এই জোকস্রে সাথে ফেসবুকের প্রাসঙ্গিকতা হচ্ছে, বর্তমানে ফেসবুকের ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে কিন্তু তা সত্ত্বেও ফেসবুকের ব্যবহার সমগ্র বিশ্বের ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মানে ফেসবুকেরও নিশ্চয়ই ভালো, সুন্দর ও উপকারি দিক রয়েছে যার বদৌলতে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
তাই আমাদের উচিত হবে ফেসুবকের সেই ভালো, সুন্দর ও উপকারি দিকগুলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের ও সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করা। এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ফেসবুকে আবেগ ও অনুভূতি অবাধে প্রকাশ করে আমরা যেন আবেগ ও অনুভূতি শুন্য না হয়ে যাই-কেননা কিছু আবেগ-অনুভূতি স্বকল্যাণ ও বিশ্বের কল্যাণের জন্য সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী।
কিংকর দেবনাথ
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়