অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর সঠিক ভৌগলিক ইতিহাস আমাদের প্রায় অনেকেরই অজানা। চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশের আদি ইতিহাস।
আমাদের এই ব-দ্বীপের সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে এই ভূমিরূপের সৃষ্টি এবং আদি অবস্থা সম্পর্কেও।আমাদের অনেকের অজানা যে আমাদের এই ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেট বা এই ভারতীয় উপমহাদেশ পূর্বে মূলত এশিয়ার অংশ ছিলো না।ভূমিকম্প নিয়ে পরিচিতি থাকার সুবাদে টেকটোনিক প্লেট সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি।
জুরাসিক পিরিয়ডে,সেই ডায়নোসর যুগে অর্থ্যাৎ আনুমানিক ১৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট ছিল মূলত একটি বিশাল টেকটোনিক প্লেটের অংশ যার নাম ছিল গন্ডোয়ানাল্যান্ড।সেসময় পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ মেন্টল উথলে ওঠার ফলে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের টেকটোনিক প্লেটে ফাটল ধরে এবং চার খন্ডে বিভক্ত হয়ে তা আফ্রিকান,এন্টার্কটিক,অস্ট্রেলীয় এবং ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেটে পরিণত হয়।আমাদের এই টেকটোনিক প্লেট মূলত ইন্দো-অস্ট্রেলীয় টেকটোনিক প্লেটের অন্তর্ভুক্ত যা মাদাগাস্কার থেকে বিভক্ত হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে আমাদের এই টেকটোনিক প্লেটের পুরুত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার এর মতো যেখানে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অন্যান্য অংশ গুলো ১৮০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি পুরুত্ব সম্পন্ন।ফলে এর গতিবেগও ছিল সবচেয়ে বেশি যা ছিল ১৮ থেকে ২০ সে.মি করে প্রতি বছর,যেখানে অন্যান্য গুলো ছিলো ২-৪ সেন্টিমিটার করে প্রতি বছর।এই প্লেটের উত্তরমুখি আনুমানিক প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার যাত্রার পর আজ থেকে আনুমানিক ৪০-৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে তা ইউরেশিয়ান,অর্থ্যাৎ ইউরোপ এবং এশিয়া যেই টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত তার সাথে প্রবল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।এই যাত্রাকালে সৃষ্টি হয় ভারত মহাসাগর।আর ধারণা করা হয় সংঘর্ষের পর ইউরেশীয় প্লেটের ভূমিরূপকে ঘিরে থাকা টেথিস সাগর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
দুটো টেকটোনিক প্লেটের যখন মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় তখন একটি অপরটির উপরে চলে যায়।এবং পাহাড় পর্বত বা আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয় ভেতরকার ভূমিরূপ বা শিলাস্তর উত্থিত হয়ে।
ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টাল টেকটোনিক প্লেটের সাথে প্রাথমিক মৃদু ধাক্কায় একাংশ যুক্ত হয় ইউরেশিয়ান প্লেট।তখন সমুদ্র তলদেশ থেকে উত্থিত হয় নেপাল এবং তিব্বত উপত্যকা। এরপরই এক প্রবল সংঘর্ষের ফলে বিশাল সীমানাজুড়ে ভূমিরূপে ভয়ানক সংকোচন ঘটে প্রবল ভাঁজ সৃষ্টি হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই ভূমিরূপ উঁচু হয়ে যায়। যার ফলে সৃষ্টি হয় হিমালয়,পৃথিবীর নবীনতম পর্বতশ্রেণী এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দু,মাউন্ট এভারেস্ট।এই সংঘর্ষ এখনো অব্যহত।এবং এর ফলে হিমালয়ের উচ্চতাও গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৫ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে।এবং এই ইন্দোঅস্ট্রেলীয় প্লেট গড়ে ২ থেকে তিন সেন্টিমিটার করে উত্তরমুখী হয়ে সঞ্চরণশীল।
এইতো গেলো হিমালয় সৃষ্টি,এবার আসা যাক বঙ্গীয় ভূমিরূপ বা আমাদের এই ভূখণ্ড কিভাবে হলো এবং বাংলাদেশের পাহাড়গুলো কবেকার সৃষ্টি!
বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চল যেমন রংপুর,দিনাজপুর সহ উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চল গন্ডোয়ানাল্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকাকালীন সময় থেকেই ছিলো।কিন্তু বাকি অংশের কোনো অস্তিত্ব তখনো ছিলো না।এই অঞ্চল সৃষ্টি হয় হিমালয় সৃষ্টির পরপর।দুই টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট হিমালয় অঞ্চল সুস্থিত অবস্থায় আসতে অতিবাহিত হয় অনেক অনেক যুগ।আর এই সুস্থিত হবার কালে এইসব উচ্চভূমির পাদদেশে এসে স্পর্শ করে সমুদ্র। হিমালয়ের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ বাধা পেয়ে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বিভিন্ন উচ্চভূমিতে ধসের ফলে সেই সময়কালে তখন অগভীর জলাশয় উৎপন্ন হওয়া শুরু হয়।এবং এর প্রবাহ থেকে বালি,মাটি,চুনাপাথর জমে পর্বতের নিমজ্জিত অংশগুলো ভাসমান হতে থাকে।অইসব উচ্চভূমি থেকে পানির প্রবাহে ভেসে এসে জমতে থাকা ভূ-ত্বকীয় উপকরণ থেকেই ধীরে ধীরে বঙ্গীয় ভূমি-রূপ সৃষ্টি হয়।সিলেট অঞ্চলে জমা চুনাপাথর অই সময়কার ভেসে আসা জলপ্রবাহেরই নিদর্শন
এরপর প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত পৃথিবীর সমুদ্র তলদেশ অনেক নিচে নেমে যায় যার ফলে প্রচুর পলিমাটি জমা হয় এবং পানির গভীর প্রবাহ গুলোও থেকে যায়।পলি জমতে থাকে।যার ফলে একটা বিশাল ভূমিরূপকে পেঁচিয়ে ধরে শত শত নদী নিয়ে সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয় ব-দ্বীপের। যার ফলে বাংলাদেশের বেধিরভাগ অঞ্চলই সমতল। এদিকে ঠিক একই সময়ে পূর্বাংশের আরাকান অঞ্চলেরও গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতের উত্থান হয়। অইদিকে হিমালয়ের গঠন প্রক্রিয়াও তখন প্রায় সম্পূর্ণ হবার পথে।
আজ থেকে প্রায় ৫০-৫৩ লক্ষ বছর পূর্বে বার্মা রেঞ্জের সাথে ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টাল প্লেটের আবার কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।এতে ধাবমান ইন্ডিয়ান প্লেটের সাথে বার্মা প্লেটের একপ্রকার ঘূর্ণণ গতি সৃষ্টি করে যার ফলে বঙ্গীয় উপকূলের ত্রিভুজাকৃতির চাপ পড়ে এবং পূর্বাংশে উঁচু নিচু ভাজের সৃষ্টি হয় যার থেকে বান্দরবান,সিলেট,চট্টগ্রাম,মেঘালয়,আসামের, ও আরাকান রাজ্যের পাহাড় শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।কিছু জায়গার অধিক সংকোচনের ফলে উঁচু নিচু ভাজের পাহাড় পর্বত সৃষ্টি হয় বেশ কয়েকটি ধাপে, যেমনটা দেখতে পাই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে।আবার কিছু মৃদু ভাজের পাহাড়শ্রেণী ও তৈরী হয়। সীতাকুণ্ড -মীরসরাই রেঞ্জ,,সিলেট রেঞ্জ,কুমিল্লার লালমাই,ময়মনসিংহের গারো পাহাড় এইসব মৃদু ভাঁজ যুক্ত পাহাড়। তারপর বছরের পর বছরের রূপান্তরিত রূপ আজকের এইসব পাহাড়-পর্বত।
সোর্সঃ
1.
http://eurasiatectonics.weebly.com/indian-plate.html
2.
http://onushilon.org/geography/bangladesh/vuprokriti.html
৩.
https://pubs.usgs.gov/gip/dynamic/himalaya.html