বাংলাদেশ তরুণদের দেশ। গবেষকরা বলছেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এমন একটি সময় অতিবাহত করে যখন তার তরুণ এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ এখন এমন একটি সময় অতিবাহিত করছে এবং দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষ। এই তরুণদের যারা ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল, এই সময়টার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে তাদেরকে ‘জেনারেশন জেড’ বা ‘প্রজন্ম জেড’ বলা হয়ে থাকে।
‘স্ট্রাউস’ এবং ‘হোয়ে’ নামক দুজন মার্কিন গবেষক বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মিল রেখে মূলত প্রজন্মের বিভাজন করেছেন এবং তারাই মুলত যারা ১৮- ২৮ বছর বয়সী তাদেরকে জেনারেশন জেড বলে অবিহিত করেছেন এবং এদের ঠিক আগের প্রজন্মের মানুষদেরকে “জেনারেশন ওয়াই” বলে অবিহিত করেছেন। দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন এবং নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে দেশের মোট ভোটারের ২২ শতাংশ তরুণ এবং তাদের সংখ্যা প্রায় আড়াইকোটির মত। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় এই বিরাট সংখ্যক তরুণ ভোটারা নির্বাচনের ফলফল নির্ধারনে অন্যতম অনুঘটক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল তরুণ প্রজন্ম (১৮-২৮ বছর) যাদেরকে ‘প্রজন্ম জেড’ বলা হচ্ছে নির্বাচনে যারা এক্স ফ্যাক্টর তারা আসলে নির্বাচন নিয়ে কতটুকু ভাবে ? দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব নিয়ে তাদের ভাবনা কী? তারা আসলে কতটা রাজনীতি সচেতন?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোজার আগে চলুন দেখি এই তরুনপ্রজন্ম নিয়ে অন্যদের ভাবনা টা কি?
বিবিসির নিউজবাইটের গবেষনা অনুযায়ী, যারা ‘জেনারেশন জেড’ বা ‘প্রজন্মজেড’ তারা নাকি ভুল বুঝাবুঝির শিকার এক প্রজন্ম!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, প্রযুক্তির দুনিয়াতে চোখ ধাঁধানো এই প্রজন্ম ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে বড়ই উদাসীন। তাদের দুনিয়া হাতের মুটোয় বন্দী, মুটো ফোনে বন্দী তাদের জীবন।
যাইহোক এখন আলোচনা করা যাক, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি সচেতন নাকি রাজনীতি বিমূখ ? এক্ষেত্রে দুটি বিষয আলোচনা করা জরুরী এবং তা হল রাজনীতি কি ? এবং আমরা কাদেরকে রাজনীতি সচেতন বলব?
রাজনীতি কি? তা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কমবেশি ধারণা আছে, তারপরও সহজ ভাষা বলা যাই, রাজনীতি হল রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি এবং মানব কল্যাণ সাধনের নীতি।
আমরা কাদেরকে রাজনীতি সচেতন বলব? আমরা জানি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বিশাল অংশ ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বড় বড় রাজনৈতিক দলুগলোর ছাত্র সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি! অনেকেই ভাবেন রাজনীতি সচেতনতা বলতে মূলত বোঝানো হয় যেকোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকা এবং সেই রাজনৈতিক দলের আদর্শ,চেতনা বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করাকে। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
বর্তমান তরুণপ্রজন্মের তাদেরকেই রাজনীতি সচেতন বলা যাই, যাদের মূলত রাজনীতি সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান আছে,ইতিহাস সম্পর্কে জানে ও পড়াশোনা করে এবং সমসাময়িক ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করে নিজেস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মানেই যে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করবেন তা নয় বরং তিনি নিজ অবস্থান থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করে জাতীয় সংসদে পাঠাবেন যার মাধ্যমে দেশের গুণগত পরিবর্তন আসবে।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সাতচল্লিশ, বায়ান্ন , ঊনসত্তর কিংবা একাত্তরের তরুণ প্রজন্মের ন্যায় রাজনীতি সচেতন ভাবে গড়ে উঠতে পারি নি। বরং তারা রাজনীতি বিমূখ , রাজনীতির কাঁদা ছোড়াছুড়ি থেকে দূরে থাকতে তারা নিজেদেরকে যেন প্রযুক্তির দুনিয়াই বন্দী করে রেখেছে। এক সময় যে তরুণ প্রজন্মের বাংলাদেশকে বলা হত জ্বলে পুড়ে ছারখার তবুও মাথা নোয়াবার নয়,সেই তরুণ প্রজন্মের উত্তরসূরিদের মাথা নুইয়ে দিয়েছে প্রযুক্তি তথা হাতের মুটো ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক । রাজনীতি নিয়ে তাদের একবাক্যে মতামত “আই হেইট পলিটিক্স” এবং তা তাদের ফেসবুকে ওয়ালে সদা দৃশ্যমান।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের এই রাজনীতি বিমূখতার পিছনে অনেক গুলো কারণ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র, তরুণ রাজনৈতিক আইকনের অভাব, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে তরুণদের দূরে সরিয়ে রাখা , কলেজ বিশ্ববিদ্যালগুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা সহ বেকারত্ববৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব প্রভৃতি বিষয়গুলো তরুণ প্রজন্মকে হতাশগ্রস্ত করছে, করেছে রাজনীতি বিমুখ ।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যাদেরকে প্রজন্ম জেড বলা হচ্ছে তাদের মনে রাখতে হবে এদেশের তরুণদের সংগ্রামী ইতিহাসের কথা , মনে রাখতে হবে ১৮ বছর ৮ মাস বয়সী তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরামের কথা, ২০ বছর বয়সী তরুণ বিপ্লবী প্রফুল্লচাকীর কথা,যারা জীবন দিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং জীবন দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনে দেওয়া রুমির মত তরুণদের কথা এবং তাদের চেতনায় নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে রাজনীতি সচেতনভাবে। পরিশেষে আশা রাখব, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম সচেতনভাবে ভোট প্রদানের মাধ্যমে দেশেকে যোগ্য ভবিষ্যত নেতৃত্বের কাছে তুলে দিবে।