সাম্প্রতিক সময়ে কিংবা আরো আগ থেকেই বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে একটা বিতর্ক দেখতে পাওয়া যায়।এসব বিতর্কে প্রান্তিক পর্যায়ের লোকদের অংশগ্রহণ খুব কমই আছে।নানা কারনে সমাজের চোখে শিক্ষিত শ্রেণীই এসব বিতর্ক করেন বা সেটাকে উসকে দেন।
আমাদের দেশের অন্যতম সৌন্দর্য মণ্ডিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলটি নিয়ে নানা ধরণের কথা শুনতে পাওয়া যায়।এখাকার বসবাসকারী লোকজনদের নিয়ে এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহও চোখে পড়বার মতন। এরা নানা ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে এরা আদি বাসিন্দা বা ভূমিপুত্র ধরণের কিছু। যদিও ইতিহাসে এর সত্যতা খুব কমই পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ‘২৩ এর-ক ধারাতে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷’
খেয়াল করে দেখুন এখানে পরিষ্কারভাবে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং আদিবাসী বলাটা সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই এরা সবাই উপজাতি।
তারপরেও অতিউৎসাহী, বিভেদকামী কিংবা জ্ঞান পাপী কিছু লোক উপজাতিকে আদিবাসী বলে নিজের স্বার্থ বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে সর্বদাই তৎপর থাকেন।
আমাদের প্রশ্ন যারা উপজাতিকে আদিবাসী উল্লেখ করেন তারা কী বুঝাতে চান? পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বসবাস কত বছর ধরে?
বর্তমানে পাহাড়ে পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিদের বসবাস কত কালের? কত বছর ধরে তারা এখানে বসবাস করছেন?
পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিরা এদেশের সমতলে বসবাস করা মানুষদের যেভাবে স্যাটেলার বলে কটাক্ষ করেন যদি উল্টো তাদেরকে স্যাটেলার বলা হয় তখন বিষয়টি কেমন হবে?
পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে দেখি বিজ্ঞজনেরা কি বলেছেন-
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী বিষয়ে ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট(ডিসিডিএম)ক্যাপ্টেন টমাস হার্বার্ট লেউইনের মতে, চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর বেশির ভাগই নিশ্চিতভাবে দুই পুরুষ আগে ‘আরাকান’(অর্থাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে)থেকে এসেছে।
আসলে ১৮২৪ সালে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) যুদ্ধে শরণার্থী হিসেবে এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এখানে এসেছিল। শস্য-সুফলা আরাকানের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের শেষ হয়।’
তথ্যসূত্র-
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও অধিবাসী: অনুবাদ: রাজীব এল দাস, দিব্য প্রকাশ, ২০১৭, পৃষ্ঠা: ৩৮
‘পার্বত্য চট্টগামে ১২টা ভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাস করে। এদের বেশির ভাগই ১৬ থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় এই অঞ্চলের বাইরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে আগে আসে চাকমা সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি অঞ্চল অতিক্রম করে এসে ১৭ শতকের মধ্যেই তারা চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে শুরু করে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বাস করতে থাকে। সে সময় স্থানীয় বাঙলাভাষীদের সাথে জমি নিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের নিরন্তর ঝামেলা লেগেই থাকতো। তাই এক সময় চাকমাদেরকে সরে গিয়ে পাকাপাকিভাবে পাহাড়েই আশ্রয় নিতে হয়।’
তথ্যসূত্র-
Genocide in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh; IWGIA Document 51, Wolfgang May (ed.), Page: 14-15
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারও মনে করে বাংলাদেশে বসবাসরত এক শ্রেণির মানুষ ‘আদিবাসী’ শব্দটির মাধ্যমে বিতর্ক উসকে দিতে চায়।
আদিবাসী বিতর্কের মাঝে একটি বিশ্ব রাজনৈতিক চাল আছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।
তিনি বলেন, যারা নিজেদের এককালে উপজাতি হিসেবে দাবি করতেন, তারাই এখন বিদেশে গিয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চালায়।
তথ্যসূত্র- বিবিসি বাংলা, ৯ অগাস্ট ২০১৬.
আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, জাতিগত ভিন্নতা থাকতে পারে, থাকতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় কিন্তু আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক এই পরিচয়টিতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ বা আপোষ করার সুযোগ নেই।
সত্যি বলতে কি ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয়ে আমরা কোন হস্তক্ষেপ চাই না তবে যারা এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভিনদেশি কোন রাষ্ট্র বা জাতির দালালি করবে তাদের বিষয়ে অবশ্যই আমাদের প্রশ্ন বা পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি থাকবে।
আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক,আমরা সবাই বাংলাদেশী। এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এদেশে বসবাস করতে হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য বলেই আমরা মনে করি।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
খোলা চোখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা
ঘটনাঃ জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনের বাসিন্দা জর্জ ফ্লয়েডকে (৪৬) গত ২৫ মে আটক করে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলি শহরের পুলিশ। আটকের পর ডেরেক চৌভিন নামের এক(শ্বেতাঙ্গ) পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে সড়কের উপর চেপে ধরলে তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান।এই হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে পুরো যুক্তরাষ্ট্র। (প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)
বর্তমান আন্দোলনের পটভূমি-
চলমান এই আন্দোলনটি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডই একমাত্র কারন নয়,এই আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে ৩ টি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে- প্রথমত– পুলিশি নির্যাতন এবং হত্যাকান্ড,বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হবার ঘটনা। দ্বিতীয়ত – বিচার ব্যবস্থা।গোটা বিচার ব্যবস্থা এবং আইনি বিধি বিধানগুলো সংখ্যালঘু,দরিদ্র এবং বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না। তৃতীয়ত – সমাজে বিরাজমান বৈষম্য,যার প্রধান শিকার হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা।
ছবিঃ সংগৃহীত
এসবের সাথে সাথে আরো যে বিষয়টি মার্কিন সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা হলো বর্ণবাদ বিষয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বীকৃতির প্রবণতা।সমাজপতি ও রাজনীতিবিদ উভয়েরই মনোভাবটা হলো,এই নিয়ে কথা না বললেই যেন বর্ণবাদ অপসৃত হয়ে যাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড:
২০১৪ সালের ১৭ ই জুলাই নিউইয়র্ক শহরে অভিন্ন পন্থায় শ্বাসরোধ করে এরিক গার্ণারের হত্য।
২০১৪ সালের মিসৌরির ফার্গুসন শহরে মাইকেল ব্রাউনের হত্যা।
২০১৫ সালের বাল্টিমোরে ফ্রোডগ্রের হত্যা।
২০২০ সালের মার্চ মাসে কেনটাকির লুইভিল শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে নিজ বাড়িতে হত্যা।
(সূত্রঃ প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)
বর্তমান আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ নেওয়ার কারণ:-
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখলেও সেসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা এবারের মতন জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ লাভ করেনি।ইতিমধ্যেই এই ঘটনাকে বিশেষজ্ঞগণ ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের খুনের ঘটনার পর সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সঙ্গে তুলনা করছেন। সিএনএ,নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ টির বেশি শহর সহ অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন শহর এখন বিক্ষোভে উত্তাল।
ছবিঃ সংগৃহীত
বার্তা সংস্থা এপির মতে, এই পর্যন্ত বিক্ষোভকালে গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে চার হাজার মানুষ,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ মিলিটারি ফোস ন্যাশনাল গার্ডের ৫ হাজার সদস্যকে।
তো প্রশ্ন হলো এবারের আন্দোলনটা এই জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ নেওয়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞগন কয়েকটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেসব হল-
১- অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ধীর নীতি গ্রহণ করাঃ-
২৫ মে মে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা সংগঠিত হলেও ঘটনার ৮ দিন পরে এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত ডেরেক চৌভিনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।১-০৬-২০২০ ইং তারিখে তাকে আদালতে তোলার কথা থাকলেও নানা অযুহাত আর টালবাহানায় সেটাকে পিছিয়ে ০৮-০৬-২০২০ তারিখে আদালতে হাজির করার তারিখ নির্ধারন করা হয়।
২- লুইভিলে শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে হত্যাঃ
ছবি : সংগৃহীত
গত মার্চ মাসে লুইভিলে শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে পুলিশ কর্তৃক নিজ বাড়িতে হত্যা করা হলেও সে ঘটনার এখন পর্যন্ত যথাপোযুক্ত কোন বিচার হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রতি তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন প্রদান শ্বেতাঙ্গবাদ আরো উস্কে দিচ্ছে।
৪-চীন ও ইরানের প্রকাশ্য মন্তব্য করাঃ-
বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও ইরানের বৈরিতার সম্পর্কের কথা সবারই জানা আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন,” যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক বর্ণবাদ সমস্যা এবং পুলিশের নিপীড়ন ঘটনায় তুলে ধরেছে এই বিক্ষোভ “
In response to what happened in the US, heads of @_AfricanUnion and many African countries have called for justice against racial discrimination. China stands with the African side in their just cause and will work with them to oppose all forms of racial discrimination. pic.twitter.com/pnyljEMkfs
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মৌসাভী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিজ দেশের জনগনের উপর নিপিড়ন বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান। ( সূত্র: প্রথম আলো- ২ রা জুন ২০২০)
৫-বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারঃ-
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিক্ষোভকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের গভীর ক্ষতটাই পৃথিবীর সামনে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে দশকের পর দশক ধরে বর্ণবাদ চলছে।সাদা কালোর জাহিলি বিভাজন চলমান রয়েছে।ফলে সাম্যবাদ নামক মার্কিন ভন্ডামি আজ সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।এরাই আবার বিশ্বের সামনে মানবতার বুলি কপচিয় সেই সাথে সারাবিশ্বে মানবতার সবক প্রদানের ফেরি করে থাকে।
আজ যেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্ব উত্তাল হয়েছে এমন পুলিশি নির্যাতনে বর্বর ইসরাইলী কর্তৃক ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘটে।দুঃখজনক হলেও সেসব নির্যাতনের সরব বা নিরব কোন প্রতিবাদই দেখতে পাওয়া যায় না।তবুও আমরা চাই পৃথিবীর সব অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ হউক।সব নিপিড়ন আর যুলুমের অবসান ঘটুক। মানবতা আর মাযলুম জনগোষ্ঠী মুক্তি পাক। মুক্তিপাক নিপীড়িত আরাকান, কাস্মীর, উইঘুর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন সহ বিশ্বের সকল মাযলুম জনগোষ্ঠী।
লেখক- তরিকুল আলম তাসিকুল শিক্ষার্থী – সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামল ও পাকিস্তানি আধিপত্যের সময়ে বাংলাদেশ শাসিত হয়েছিল বিদেশি স্বার্থে। বৈষম্য দমন পীড়ন তাই ছিল স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধেরমাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের নিজেদের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত ছিল ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব এর অনুকরনে আমাদের স্বাধীনতার প্রারম্ভিক ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম’ ।
এছাড়াও আমাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র লিখিত হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদলে (বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৭১) । এই দুই সংগ্রাম ইউরোপ ও পাশ্চাত্যে সংঘটিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যেই। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যে আমরা একই প্রতিশ্রুতিতেই প্রতিষ্ঠা করেছি তা বলা বাহুল্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার সকল নীতি বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিতকরনের প্রতিষ্ঠানসমুহ হয়েছে কলুষিত। সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায় নি। সংবিধান বার বার আঘাত পেয়েছে। সেনাশাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য সংবিধানকে কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে। ব্যাক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে আইনকে নিচে নামানো হয়েছে। সংবিধানে নির্দেশিত ‘ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠানটি এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। সংবিধানে উল্লিখিত বাক স্বাধীনতা বার বার আঘাত পেয়েছে। যার উদাহরন অভিজিৎ হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক আবরার হত্যা।
বিচার ও নির্বাহী বিভাগ এখনও পুরোপুরি পৃথক নয়। বিচারপতি অপসারণে পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ এর উদাহরন রয়েছে (ষোড়শ সংশোধনী আইন, ২০১৪)। সামরিক শাসনামলেও বিচারপতি নির্বাচনে প্রচ্ছন্নভাবে একনায়কোচিত নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বিতর্কিত গণভোট, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অবৈধ নির্বাচন, ১৯৯৬ এর বিতর্কিত নির্বাচন, ২০১৪ সালে বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়েও উঠেছে অনেক অভিযোগ। স্বাধীনতার পর থেকে এমন একটি নির্বাচনও হয়নি যেখানে কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। কারচুপি না হলেও নির্বাচন এতটাই সচ্ছ হওয়া উচিত যাতে কোন প্রশ্নই না উঠে। কিন্তু এরকম নির্বাচন নিশ্চিত করা যায় নি। এমন অবস্থা হয়েছে যে মানুষ ভোট দেওয়ার কোন উৎসাহই পাচ্ছে না । বিরোধী দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের একসময়ের বিরোধী দল এখন পার্লামেন্টে কোণঠাসা। গঠনমূলক সমালোচনা করার বদলে চলছে ব্যাক্তি আক্রমন ও বিষদগার। যথাযথ আন্দোলনের বদলে ঘটেছে সহিংসতা। ২০১৫ সালে বিএনপি জোট ও ২০০৬ সালে আওয়ামী জোটের আন্দোলন দুটিতেই সহিংসতার উদাহরন রয়েছে ।
ছবিঃ সংগৃহীত
গনমাধ্যম তাদের কাজে বাধা পেয়ে আসছে বারবার। দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় ডিজিটাল আইনের অপব্যাবহার করে সাংবাদিক গ্রেফতার ও হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে । অর্থাৎ সুশাসন কায়েম করার সকল প্রতিষ্ঠান তাদের কাজে ব্যর্থ। সুশাসনের নীতিসমুহ বাস্তবায়ন হয়নি স্বাধীনতার এত বছর পরও। এর পেছনের কারন রয়েছে। অপশাসনের ভাইরাস আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তার ভেতরে, বাইরে নয়। বাইরের এসব ঘটনা শুধু রাষ্ট্র বা সমাজদেহে সেই ভাইরাসের উপসর্গ বা লক্ষন। যেহেতু সেই ভাইরাসকে স্পর্শ করা যায় নি তাই এত ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের সরকার এসেও মুল দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে পারে নি। এই দায় নির্দিষ্ট কোন সরকারের নয়। এই দায় আমাদের সমাজের, আমাদের জাতির। যখন কোন শরীরে ভাইরাস আক্রমন করে তখন তার জন্য সেই শরীরের কোন নির্দিষ্ট একটি অঙ্গকে দোষ দেয়া যায় না। পুরো শরীরের অধিকারী ব্যাক্তির খামখেয়ালিপনা বা অনিয়মকে দায়ী করতে হয়। তেমনি এই অপশাসনের ভাইরাস শুধু একটি দল বা গোষ্ঠীর দায় নয় এই পুরো রাষ্ট্র ও সমাজদেহের, আমাদের সবার। অনেকেই মনে করেন কোন নির্দিষ্ট একটি দলকে সরিয়ে আরেকটি নির্দিষ্ট দল ক্ষমতায় এলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। যারা এমন মনে করছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। প্রবন্ধে উল্লিখিত অপশাসনের উদাহরনগুলো দেখলেই স্পষ্ট হবে যে বাংলাদেশে সকল গণতান্ত্রিক দলের আমলে এবং সেনা শাসনের সময়ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ছবিঃ সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান আবার সুশাসনের আশা জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভাইরাসের প্রতিষেধক প্রয়োগ না করে শুধু লক্ষন উপশমের চেষ্টা বৃথা। ২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট এর মাধ্যমে প্রায় অনেকটা একই চেষ্টা করেছিল বিএনপি জোট সরকার। কিন্তু সমস্যার শিকড়ে না পৌঁছানোয় যা লাউ তা কদুই রয়ে গেছে। এবার সে একই ভুল করা মোটেও উচিত হবে না। তাই সমস্যার মুলে যে অপশাসনের ভাইরাস তার উৎপত্তিস্থল জানতে হবে আর প্রয়োগ করতে হবে যথাযথ প্রতিষেধক।
আরিফ সোহেল,
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববদ্যালয়।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৭১
২. প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হওয়ার দায় সরকারি দলের: সিইসি, ফেনী ,২৯.৩. ২০১৯, দৈনিক যুগান্তর
৩. লগি-বৈঠা আন্দোলনের ৮ বছর, রাইজিংবিডি ডট কম, ২০১৪-১০-২৮, নজিরবিহীন আন্দোলন, জিম্মি
সাধারণ মানুষ শরিফুল হাসান, ০৬ মার্চ ২০১৫, দৈনিক প্রথম আলো
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুগান্তরের সাংবাদিক গ্রেফতার, যুগান্তর ডেস্ক, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯,
দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
উনিশশো সাতচল্লিশ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল ধর্মের নিরিখে। গঠিত হয়েছিল দুটি রাষ্ট্র- এক. হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ভারত দুই. মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোটি আবার বিশ্ব মানচিত্রে একেবারেই নতুন। একটি রাষ্ট্রের দুটি অংশ দুই প্রান্তে অবস্থিত – এরকমটা ছিল বিরল। অতীতেও এরকম রাষ্ট্র দেখা যায় নি, ভবিষ্যতেও হয়তো দেখা যাবে না।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বলতে – একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে বোঝায়। যেমন- পাকিস্তান, ভারত, ইসরাইল। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বলতে- একটি নির্দিষ্ট জাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে বোঝায়। যেমন- বাঙালি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। একটি জাতির প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতি- যা হবে একক ও ঐ জাতিগোষ্ঠীর জন্য অভিন্ন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য যখন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান তৈরি হল- তখন ভাবা হয়েছিল একই ধর্মের লোকজন মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। সদ্য সৃষ্টি অবিভক্ত পাকিস্তানে দেখা দিল এক নতুন সমস্যা। তা হলো- জাতীয়তাবাদ। ধর্ম এক হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে আপন করে নিতে পারল না। শুরু হলো পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রায় ছাপ্পান্ন শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঘোষণা দিয়ে বসল- উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
এটা বাংলাভাষীরা মানতে পারল না, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও এটা মানার কথাও না। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও জীবন দানের মাধ্যমে অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিল- উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও হবে রাষ্ট্রভাষা ( উনিশশো ছাপ্পান্ন সালের সংবিধানে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল )। ভাষার জন্য জীবন দান এটা ছিল ইতিহাসের পাতায় বিরল, অথচ এটি আলোচনার টেবিলে সমাধান হওয়ার কথা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি হওয়া সত্বেও সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে বাঙালি ছিল সর্বোচ্চ ত্রিশ শতাংশ, অফিসার লেভেলে ছিল আরও অনেক কম। উন্নয়ন বাজেটেও দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মত।
পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন বাজেট ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। অথচ রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অবশেষে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে উনিশশো একাত্তর সালে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিল মুসলিম বাঙালি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ ( হিন্দু বাঙালিরা ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে )।
এই যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লক্ষ ( সংখ্যাটি নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে ) পূর্ব পাকিস্তানি নিহত হয় ও প্রায় দুই লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানি মা-বোন সম্ভ্রমহানির শিকার হয়। সেইসাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। অথচ নিহতদের বেশিরভাগ ছিল মুসলিম, যারা হত্যা করেছে তারাও ছিল মুসলিম ( কিছু বাঙালি আবার পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনে সহায়তা করেছিল )।
এছাড়াও উনিশশো সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে নি ( এই নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচন, এই দেশটি উনিশশো সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল ), এর আগে উনিশশো চুয়ান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে প্রায় দুই মাসের মাথায় বরখাস্ত করে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয় ( যেমনটা জম্মু ও কাশ্মীরের সাথে করা হচ্ছে, এমনকি ভারতীয় সংবিধানের ‘তিনশত সত্তর’ অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে তাদের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এই ‘তিনশত সত্তর’ অনুচ্ছেদ তাদের কাগজে-কলমে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দিত কিন্তু তা শূণ্যের কাছাকাছি ছিল )।
যে শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ও বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে উনিশশো সাতচল্লিশ সালে মুসলিম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল তার ফলাফল আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতেই পেলাম ( সম্প্রতি পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বীকার করেছেন- বৈষম্যমূলক নীতি ও দমন-পীড়নের জন্যই বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রয়োজন অনুভব করেছিল ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল )।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উনিশশো একাত্তর সালে মুসলিম বাঙালি জাতিভিত্তিক গঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ যে খুব ভালো আছে, তা বলা যাবে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও গণতন্ত্র নেই বললেই চলে, গঠনমূলক ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা টুকু নেই। সরকার বিরোধী মতামতকে একদম সহ্য করতে পারছে না ( অবশ্য এটি বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই হয়ে আসছে ) । দেশ স্বাধীন হওয়াতে পাল্টেছে শুধু দৃশ্যপট, পরাধীন অবস্থায় পাকিস্তানি সরকার বিরোধী মতামতকে দমন পীড়ন চালাতো আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি সরকারই বিরোধী মতামতকে দমন করছে। অর্থ্যাৎ যে উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন নিয়ে উনিশশো সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান এবং উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশ গঠিত হলো তা পূর্ণ হলো না, ইতিহাস আপাতত এটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এবার আসা যাক মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট হচ্ছে- কুর্দি সংকট। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, ইরান ও আর্মেনিয়ায় কুর্দি জাতির লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেলজুক তুর্কি সুলতান সাঞ্জার সম্ভবত বারশো শতকে কুর্দিদের আবাসভূমি বিজয় করেছিলেন ও কুর্দিস্তান নামে একটি প্রদেশ গঠন করেছিলেন। এর রাজধানী ছিল বাহার শহর, যা বর্তমানে ইরান ভূখণ্ডে পড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হলে স্বাধীন কুর্দিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল কিন্তু ইতিহাস কুর্দিদের সাথে বেইমানি করেছে।
কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর সিংহভাগ হচ্ছে মুসলিম। মুসলমান হওয়া সত্বেও কুর্দিরা মুসলিম দেশ তুরস্ক, ইরাক ও সিরিয়ায় নির্যাতনের শিকার। ইরাকে কুর্দিদের উপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে। তুরস্ক কুর্দি ভাষার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তুরস্কে চৌদ্দ মিলিয়ন, ইরাক, সিরিয়া ও ইরানে ছয় মিলিয়ন করে কুর্দি বসবাস করে। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে তেল-গ্যাসের খনি থাকায় মূলত তাদের উপর শোষণের খড়গ চাপিয়ে দিয়েছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো। অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো যেও একই ধর্মের মানুষেরাও নির্যাতনের শিকার।
আবার জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র যদি ইয়েমেনের দিকে তাকাই, সেখানেও শান্তি নেই। ইয়েমেন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। বেশিরভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার, শিশুরা টিকা নিতে পারছে না। যুদ্ধের জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। যদিও কলকাঠি বাইরের কোনো দেশ থেকে নাড়া হচ্ছে তবুও ইয়েমেনিরা দায় এড়াতে পারে না। কেননা কিছু ইয়েমেনি পুতুলের ভূমিকাতে আছে বলেই বাইরের শক্তি কলকাঠি নাড়তে পারছে।
বস্তুত প্রতীয়মান হচ্ছে যে শান্তি স্থাপনের জন্য ধর্ম বা জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন কোনো সমাধান নয়। প্রধান সমস্যা হচ্ছে- নৈতিকতা। যতদিন না আমরা অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা ও সম্মিলিত স্বার্থকে প্রাধান্য না দিব ততদিন পৃথিবীতে শান্তি আসবে না। পুরো পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করা হলেও অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা না করলে ঘরে ঘরে সংঘাত অনিবার্য।
রাকিব মোনাসিব
অর্থনীতি বিভাগ
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।