Connect with us

রাজনীতি

তাজউদ্দীন আহমদের জীবনদর্শনই হোক আমদের প্রেরণা

Published

on

তাজউদ্দীন আহমদ

এই বঙ্গীয় বদ্বীপ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পলি মাটির এই ভূখন্ড, যত সূর্য সন্তানকে জন্ম দিয়েছে ও তার বুকে লালন করেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বঙ্গতাজ বা বাংলার তাজ, তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতার দাবি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত প্রাণ, ত্যাগী একজন নেতার নাম তাজউদ্দীন আহমদ।

তাজউদ্দীন আহমদের জীবনদর্শনই হোক আমদের প্রেরণা
তাজউদ্দিন আহমদ , photo source: prothome alo

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সাড়ে সাতকোটি বাঙালির কেবল নেতা হিসেবে নয় বরং ত্রাতা, ভ্রাতা কিংবা পিতা হিসেবে আর্বিভূত হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ নয় মাসে সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের জন্মদানে যেন ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ জন্মেছিলেন এখনকার গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে| মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পবিত্র কুরআনে হাফেজ ছিলেন। ভালো ছাত্র হিসেবে উন্নততর শিক্ষার আশায় স্কুলের শিক্ষকদের প্রেরণায় ক্রমাগত স্কুল পাল্টেছেন। পড়েছেন গ্রামের মক্তবে, নিজ বাড়ি থেকে দূরে ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে, কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। পরে গেছেন কালীগঞ্জের মিশনারি স্কুল সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকে ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল ঘুরে গেছেন সেই সময়ের বিখ্যাত মিশনারি বিদ্যাপীঠ সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। এখান থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গেই পাস করেছেন ম্যাট্রিকুলেশন।

তৎকালীন কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৪৪ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি নেন। স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রাদেশিক রাজনীতিতে যুক্ত হন স্কুলে থাকা অবস্থাতেই। ১৯৪৩ সালেই ঢাকার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অফিস ও সংগঠন গড়ার কাজে ব্যাপৃত হন। সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণেই নিয়মিত ছাত্র হিসেবে যথাসময়ে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি।

১৯৪৮ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। ইন্টারমিডিয়েটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হয়ে ওঠেন।

১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনের বছরেই দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসামান্য দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে স্বাধীন দেশে প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তিনি গ্রেফতার হন। এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বর্তমান প্রজন্মকে রাজনীতি সচেতন করে গড়ে তুলতে এবং আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের জীবনীপাঠ ও জীবনদর্শন অনুধাবন জরুরী। তাজউদ্দীনের জীবনদর্শন বিশ্লেষণ করে আমরা ত্যাগ, আপোষহীনতা, দূরদর্শিতা, নিখাদ দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দৃঢ়তা, শোষণও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা পেতে পারি। রাজনীতিতে সব সময় অর্জন নয় বরং ত্যাগও যে একজন নেতাকে কত মহান করতে পারে সেই শিক্ষা আমরা তাজউদ্দীন আহমদের জীবন থেকে পাই।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারকে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলতেন মুক্তিযোদ্ধরা যদি পরিবার ছেড়ে থাকতে পারে আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবনা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন আমি চলে গেলাম তুমি সন্তানদের নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। দীর্ঘ নয় মাস পরিবারকে ছেড়ে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই ভূখন্ডকে স্বাধীন করেন। ত্যাগী এই মানুষটার কারণে আমার এই স্বাধীন ভূখন্ডটি পেয়েছিলাম। তিনি নিদ্বিধায় মুছে যাক আমার নাম, তবু বেচে থাক বাংলাদেশ। রাজনীতিতে মেধা ও প্রজ্ঞা যে কতটা জরুরী তা একজন অসম্ভভব মেধাবী ও প্রজ্ঞাবন তাজউদ্দীনকে দেখলেই বুঝি।

তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার কাছে ধরাশয়ী ছিল ইয়াহিয়া, ভূট্টোসহ তাবৎ পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে বিতর্কে ধরাশয়ী করছিলেন ভূট্টোকে। আর তাইতো ভূট্টো পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “মুজিবকে ধরাশায়ী করা গেলেও তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত”। রাজনীতিকে বলা হয় “আর্ট অফ কম্প্রমাইজ” অর্থাৎ রাজনীতিতে নাকি আপোষ করতেই হয়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দর্শন আমাদের আপোষহীনতার শিক্ষা দেয় ।

পশ্চিম পাকিস্তানের কচুক্রী শাসক গোষ্ঠীর সাথে যেমন তিনি আপোষ করেন নি, তেমননি আপোষ করেন নি পাকিস্তানের তৎকালীন মিত্র ক্ষমতা ধর মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও। আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে যখন মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তোলে তোমরা স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও তখন তিনি বলেছিলেন আমরা স্বাধীনতাও চাই, মুজবিকেও চাই। এমনকি তিনি আপোষ করেন নি আওয়ালীগের অভ্যন্তরের ষড়যন্ত্রকারী খোন্দকার মোস্তাকের মত নেতাদের কাছেও।

যুদ্ধচলাকালীন আপোষহীন ও অসম্ভব প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির অধিকারী তাজউদ্দীন আওয়ামীলীগের ভিতরের যড়যন্ত্রকে যেমন মোকাবেলা করেছিলেন তেমনি মোকাবেলা করেছিলেন পাকিস্তানসহ বহি:বিশ্বের সকল যড়যন্ত্রকে আর তাই আমরা এই লাল সবুজের পতাকা পেয়েছিলাম আর পেয়েছিলাম এই স্বাধীন ভূ-খন্ডকে। তাজউদ্দীন আহমদের জীবন দর্শন আমদেরকে নিখাদ দেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়ে থাকে। মানুষ হিসেবে, নেতা হিসেবে দেশটাকে যে কতটা ভালবাসতে হয় সে শিক্ষা আমরাএকজন তাজউদ্দীনের কাছ থেকেই পেয়ে থাকি। তাঁর দর্শন ছিল দেশকে কিছু চাওয়ার আগে দেশকে আমি কতটা দিয়েছি সেটা বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলতেন “আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করব যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এই দেশটাকে খুজে পায়, কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে। একজন রাজনীতিবিধ, একজন নেতা যে কতটা প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী হতে পরে সেই শিক্ষা আমরা তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে পাই। দূরদর্শী তাজউদ্দীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষতে বলেছিলেন “এটা আমাদের যুদ্ধ,আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না ”।

আমরা চাই না,ভারত তার সৈন্য দিয়ে অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। তার রাজনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদাশীল চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ফিরে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন সম মর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ভারত বন্ধুত্ব হতে পারে।

ব্যক্তিতাজউদ্দীনের রাজনৈতিক দৃঢ়তা, ক্ষমতার কাছে মাথা নত না করার মানসিকতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় একজন নেতা কতটা মানসিক দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী হবে। স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দৃঢ়তা এতটাই বেশী ছিল যে দুনিয়ার পরাক্রমশালী শক্তির কাছেও মাথা নত করেনি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম বিরোধী শক্তি ছিল ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন নিক্সন প্রশাসনের অন্যতম নীতিনির্ধারক ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম হোতা ছিলেন ম্যাকনামার।

১৯৭২ সালে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হয়ে ম্যাকনামার ঢাকাতে আসেন এবং অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি প্রথমে রাজী হননি। পরবর্তী সাক্ষাতে গিয়ে তাজউদ্দীন যা করেছিলেন তা ছিল অভাবনীয়, সিনেমার গল্পকে হার মানানো কাহিনী। স্বয়ং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট যখন বলেছিলেন, মিস্টার মিনিষ্টার আপনাদের কি লাগবে আমাকে বলেন। তখন তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন আমদের প্রচুর গরুর দড়ি লাগবে। কারণ যুদ্ধে আমাদের কৃষকের গরুগুলো গোয়াল ছাড়া। হ্যা এটাই ব্যক্তি তাজউদ্দীন,

যার রাজনৈতিক দৃঢ়তা ক্ষমতাকেও ভ্রুকুটি দিয়েছেন, তোষামোদী, ক্ষমতার তাবেদরী না করা মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন আর তা হয়তো স্বাধীনতার পর তোষামোদী, সুযোগসন্ধানী মানুষদের কারণে তার ভালবাসার মুজিব ভাইয়ের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। মেধা, প্রজ্ঞা, ত্যাগ দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেশপ্রেম আর আপোষহীনতার বলে বলীয়ান এক অসাধারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। না তাজউদ্দীন আহমদ কেবলই একজন ব্যক্তি সত্তা নয় এক আর্দশের নাম, এক জীবনদর্শনের নাম যে জীবন দর্শন থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আজ ২৩ শে জুলাই তাজউদ্দীন আহমদের ৯৪ তম জন্মদিন। এই দিনে আমার যেমন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো তেমনি তার জীবন দর্শনকে আমাদের পাথেয় হিসেবে নিব এই প্রত্যাশা রইল।


মূল প্রবন্ধ : joytvbd.com

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

রাজনীতি

আদিবাসী নয় উপজাতি

Published

on

আদিবাসী নয় উপজাতি

সাম্প্রতিক সময়ে কিংবা আরো আগ থেকেই বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে একটা বিতর্ক দেখতে পাওয়া যায়।এসব বিতর্কে প্রান্তিক পর্যায়ের লোকদের অংশগ্রহণ খুব কমই আছে।নানা কারনে সমাজের চোখে শিক্ষিত শ্রেণীই এসব বিতর্ক করেন বা সেটাকে উসকে দেন।

আমাদের দেশের অন্যতম সৌন্দর্য মণ্ডিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলটি নিয়ে নানা ধরণের কথা শুনতে পাওয়া যায়।এখাকার বসবাসকারী লোকজনদের নিয়ে এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহও চোখে পড়বার মতন। এরা নানা ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে এরা আদি বাসিন্দা বা ভূমিপুত্র ধরণের কিছু। যদিও ইতিহাসে এর সত্যতা খুব কমই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের  সংবিধানের ‘২৩ এর-ক ধারাতে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷’

খেয়াল করে দেখুন এখানে পরিষ্কারভাবে ‘উপজাতি’  শব্দটি ব‍্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং আদিবাসী বলাটা সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই এরা সবাই উপজাতি।

তারপরেও অতিউৎসাহী, বিভেদকামী কিংবা জ্ঞান পাপী কিছু লোক উপজাতিকে আদিবাসী বলে নিজের স্বার্থ বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে সর্বদাই তৎপর থাকেন।

আমাদের প্রশ্ন যারা উপজাতিকে আদিবাসী উল্লেখ করেন তারা কী বুঝাতে চান? পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বসবাস কত বছর ধরে?

বর্তমানে পাহাড়ে পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিদের বসবাস কত কালের? কত বছর ধরে তারা এখানে বসবাস করছেন?
পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিরা এদেশের সমতলে বসবাস করা মানুষদের যেভাবে স্যাটেলার বলে কটাক্ষ করেন যদি উল্টো তাদেরকে স্যাটেলার বলা হয় তখন বিষয়টি কেমন হবে?
পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে দেখি বিজ্ঞজনেরা কি বলেছেন-

‘পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী বিষয়ে ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট(ডিসিডিএম)ক্যাপ্টেন টমাস হার্বার্ট লেউইনের মতে, চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর বেশির ভাগই নিশ্চিতভাবে দুই পুরুষ আগে ‘আরাকান’(অর্থাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে)থেকে এসেছে।
আসলে ১৮২৪ সালে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) যুদ্ধে শরণার্থী হিসেবে এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এখানে এসেছিল। শস্য-সুফলা আরাকানের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের শেষ হয়।’

তথ্যসূত্র-
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও অধিবাসী: অনুবাদ: রাজীব এল দাস, দিব্য প্রকাশ, ২০১৭, পৃষ্ঠা: ৩৮

‘পার্বত্য চট্টগামে ১২টা ভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাস করে। এদের বেশির ভাগই ১৬ থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় এই অঞ্চলের বাইরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে আগে আসে চাকমা সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি অঞ্চল অতিক্রম করে এসে ১৭ শতকের মধ্যেই তারা চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে শুরু করে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বাস করতে থাকে। সে সময় স্থানীয় বাঙলাভাষীদের সাথে জমি নিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের নিরন্তর ঝামেলা লেগেই থাকতো। তাই এক সময় চাকমাদেরকে সরে গিয়ে পাকাপাকিভাবে পাহাড়েই আশ্রয় নিতে হয়।’
তথ্যসূত্র-
Genocide in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh; IWGIA Document 51, Wolfgang May (ed.), Page: 14-15

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারও  মনে করে বাংলাদেশে বসবাসরত এক শ্রেণির মানুষ ‘আদিবাসী’ শব্দটির মাধ্যমে বিতর্ক উসকে দিতে চায়।
আদিবাসী বিতর্কের মাঝে একটি বিশ্ব রাজনৈতিক চাল আছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।
তিনি বলেন, যারা নিজেদের এককালে উপজাতি হিসেবে দাবি করতেন, তারাই এখন বিদেশে গিয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চালায়।
তথ্যসূত্র- বিবিসি বাংলা, ৯ অগাস্ট ২০১৬.

আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে,  জাতিগত ভিন্নতা থাকতে পারে, থাকতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয় কিন্তু আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক এই পরিচয়টিতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ বা আপোষ করার সুযোগ নেই।

সত্যি বলতে কি ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয়ে আমরা কোন হস্তক্ষেপ চাই না তবে যারা এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভিনদেশি কোন রাষ্ট্র বা জাতির দালালি করবে তাদের বিষয়ে অবশ্যই আমাদের প্রশ্ন বা পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি থাকবে।

আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক,আমরা সবাই বাংলাদেশী। এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এদেশে বসবাস করতে হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য বলেই আমরা মনে করি।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা

Published

on

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্সাণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন

খোলা চোখে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন ও কিছু কথা

ঘটনাঃ
জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনের বাসিন্দা জর্জ ফ্লয়েডকে (৪৬) গত ২৫ মে আটক করে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলি শহরের পুলিশ। আটকের পর ডেরেক চৌভিন নামের এক(শ্বেতাঙ্গ) পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে সড়কের উপর চেপে ধরলে তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান।এই হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে পুরো যুক্তরাষ্ট্র।
(প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)

বর্তমান আন্দোলনের পটভূমি-

চলমান এই আন্দোলনটি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডই একমাত্র কারন নয়,এই আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে ৩ টি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে-
প্রথমত
পুলিশি নির্যাতন এবং হত্যাকান্ড,বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হবার ঘটনা।
দ্বিতীয়ত
বিচার ব্যবস্থা।গোটা বিচার ব্যবস্থা এবং আইনি বিধি বিধানগুলো সংখ্যালঘু,দরিদ্র এবং বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না।
তৃতীয়ত
সমাজে বিরাজমান বৈষম্য,যার প্রধান শিকার হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন

ছবিঃ সংগৃহীত

এসবের সাথে সাথে আরো যে বিষয়টি মার্কিন সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা হলো বর্ণবাদ বিষয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বীকৃতির প্রবণতা।সমাজপতি ও রাজনীতিবিদ উভয়েরই মনোভাবটা হলো,এই নিয়ে কথা না বললেই যেন বর্ণবাদ অপসৃত হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড:

  • ২০১৪ সালের ১৭ ই জুলাই নিউইয়র্ক শহরে অভিন্ন পন্থায় শ্বাসরোধ করে এরিক গার্ণারের হত্য।
  • ২০১৪ সালের মিসৌরির ফার্গুসন শহরে মাইকেল ব্রাউনের হত্যা।
  • ২০১৫ সালের বাল্টিমোরে ফ্রোডগ্রের হত্যা।
  • ২০২০ সালের মার্চ মাসে কেনটাকির লুইভিল শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে নিজ বাড়িতে হত্যা।

(সূত্রঃ প্রথম আলো-২রা জুন ২০২০)

বর্তমান আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ নেওয়ার কারণ:-

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক  কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখলেও সেসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা এবারের মতন জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ লাভ করেনি।ইতিমধ্যেই এই ঘটনাকে বিশেষজ্ঞগণ ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের খুনের ঘটনার পর সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সঙ্গে তুলনা করছেন। সিএনএ,নিউইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ টির বেশি শহর সহ অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন শহর এখন বিক্ষোভে উত্তাল।

fire in usa racism

ছবিঃ সংগৃহীত

বার্তা সংস্থা এপির মতে, এই পর্যন্ত বিক্ষোভকালে গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে চার হাজার মানুষ,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ মিলিটারি ফোস ন্যাশনাল গার্ডের ৫ হাজার সদস্যকে।

তো প্রশ্ন হলো এবারের আন্দোলনটা এই জাতীয় বা আন্তজার্তিক রূপ নেওয়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞগন কয়েকটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেসব হল-

১- অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ধীর নীতি গ্রহণ করাঃ-

২৫ মে মে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা সংগঠিত হলেও ঘটনার ৮ দিন পরে এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত ডেরেক চৌভিনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।১-০৬-২০২০ ইং তারিখে তাকে আদালতে তোলার কথা থাকলেও  নানা অযুহাত আর টালবাহানায় সেটাকে পিছিয়ে ০৮-০৬-২০২০ তারিখে আদালতে হাজির করার তারিখ নির্ধারন করা হয়।

২- লুইভিলে শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে হত্যাঃ

Breaonna Taylor black us african women killed in usa

ছবি : সংগৃহীত

গত মার্চ মাসে লুইভিলে শহরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সকে পুলিশ কর্তৃক নিজ বাড়িতে হত্যা করা হলেও সে ঘটনার এখন পর্যন্ত যথাপোযুক্ত কোন বিচার হয়নি।

৩- সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রবল জোয়ার সষ্টি হওয়াঃ-

সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে শ্বেতাঙ্গবাদের প্রতি তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন প্রদান শ্বেতাঙ্গবাদ আরো উস্কে দিচ্ছে।

৪-চীন ও ইরানের প্রকাশ্য মন্তব্য করাঃ-

বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও ইরানের বৈরিতার সম্পর্কের কথা সবারই জানা আছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন,” যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক বর্ণবাদ সমস্যা এবং পুলিশের নিপীড়ন ঘটনায় তুলে ধরেছে এই বিক্ষোভ

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মৌসাভী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিজ দেশের জনগনের উপর নিপিড়ন বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান।
( সূত্র: প্রথম আলো- ২ রা জুন ২০২০)

৫-বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারঃ-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিক্ষোভকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের গভীর ক্ষতটাই পৃথিবীর সামনে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে দশকের পর দশক ধরে বর্ণবাদ চলছে।সাদা কালোর জাহিলি বিভাজন চলমান রয়েছে।ফলে সাম্যবাদ নামক মার্কিন ভন্ডামি আজ সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।এরাই আবার বিশ্বের সামনে মানবতার বুলি কপচিয় সেই সাথে সারাবিশ্বে মানবতার সবক প্রদানের ফেরি করে থাকে।

আজ যেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সারা বিশ্ব উত্তাল হয়েছে এমন পুলিশি নির্যাতনে বর্বর ইসরাইলী কর্তৃক ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘটে।দুঃখজনক হলেও সেসব নির্যাতনের সরব বা নিরব কোন প্রতিবাদই দেখতে পাওয়া যায় না।তবুও আমরা চাই পৃথিবীর সব অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ হউক।সব নিপিড়ন আর যুলুমের অবসান ঘটুক। মানবতা আর মাযলুম জনগোষ্ঠী মুক্তি পাক। মুক্তিপাক নিপীড়িত আরাকান, কাস্মীর, উইঘুর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন সহ বিশ্বের সকল মাযলুম জনগোষ্ঠী।

লেখক- তরিকুল আলম তাসিকুল
শিক্ষার্থী – সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

রাজনীতি

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনঃ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

Published

on

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনঃ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামল ও পাকিস্তানি আধিপত্যের সময়ে বাংলাদেশ শাসিত হয়েছিল বিদেশি স্বার্থে। বৈষম্য দমন পীড়ন তাই ছিল স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধেরমাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের নিজেদের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত ছিল ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব এর অনুকরনে আমাদের স্বাধীনতার প্রারম্ভিক ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম’ ।

এছাড়াও আমাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র লিখিত হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদলে (বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৭১) । এই দুই সংগ্রাম ইউরোপ ও পাশ্চাত্যে সংঘটিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যেই। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যে আমরা একই প্রতিশ্রুতিতেই প্রতিষ্ঠা করেছি তা বলা বাহুল্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার সকল নীতি বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিতকরনের প্রতিষ্ঠানসমুহ হয়েছে কলুষিত। সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায় নি। সংবিধান বার বার আঘাত পেয়েছে। সেনাশাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য সংবিধানকে কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে। ব্যাক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে আইনকে নিচে নামানো হয়েছে। সংবিধানে নির্দেশিত ‘ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠানটি এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। সংবিধানে উল্লিখিত বাক স্বাধীনতা বার বার আঘাত পেয়েছে। যার উদাহরন অভিজিৎ হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক আবরার হত্যা।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনঃ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

বিচার ও নির্বাহী বিভাগ এখনও পুরোপুরি পৃথক নয়। বিচারপতি অপসারণে পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ এর উদাহরন রয়েছে (ষোড়শ সংশোধনী আইন, ২০১৪)। সামরিক শাসনামলেও বিচারপতি নির্বাচনে প্রচ্ছন্নভাবে একনায়কোচিত নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বিতর্কিত গণভোট, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অবৈধ নির্বাচন, ১৯৯৬ এর বিতর্কিত নির্বাচন, ২০১৪ সালে বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়েও উঠেছে অনেক অভিযোগ। স্বাধীনতার পর থেকে এমন একটি নির্বাচনও হয়নি যেখানে কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। কারচুপি না হলেও নির্বাচন এতটাই সচ্ছ হওয়া উচিত যাতে কোন প্রশ্নই না উঠে। কিন্তু এরকম নির্বাচন নিশ্চিত করা যায় নি। এমন অবস্থা হয়েছে যে মানুষ ভোট দেওয়ার কোন উৎসাহই পাচ্ছে না । বিরোধী দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের একসময়ের বিরোধী দল এখন পার্লামেন্টে কোণঠাসা। গঠনমূলক সমালোচনা করার বদলে চলছে ব্যাক্তি আক্রমন ও বিষদগার। যথাযথ আন্দোলনের বদলে ঘটেছে সহিংসতা। ২০১৫ সালে বিএনপি জোট ও ২০০৬ সালে আওয়ামী জোটের আন্দোলন দুটিতেই সহিংসতার উদাহরন রয়েছে  । বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনঃ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

ছবিঃ সংগৃহীত

গনমাধ্যম তাদের কাজে বাধা পেয়ে আসছে বারবার। দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় ডিজিটাল আইনের অপব্যাবহার করে সাংবাদিক গ্রেফতার ও হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে  । অর্থাৎ সুশাসন কায়েম করার সকল প্রতিষ্ঠান তাদের কাজে ব্যর্থ। সুশাসনের নীতিসমুহ বাস্তবায়ন হয়নি স্বাধীনতার এত বছর পরও। এর পেছনের কারন রয়েছে। অপশাসনের ভাইরাস আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তার ভেতরে, বাইরে নয়। বাইরের এসব ঘটনা শুধু রাষ্ট্র বা সমাজদেহে সেই ভাইরাসের উপসর্গ বা লক্ষন। যেহেতু সেই ভাইরাসকে স্পর্শ করা যায় নি তাই এত ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের সরকার এসেও মুল দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে পারে নি। এই দায় নির্দিষ্ট কোন সরকারের নয়। এই দায় আমাদের সমাজের, আমাদের জাতির। যখন কোন শরীরে ভাইরাস আক্রমন করে তখন তার জন্য সেই শরীরের কোন নির্দিষ্ট একটি অঙ্গকে দোষ দেয়া যায় না। পুরো শরীরের অধিকারী ব্যাক্তির খামখেয়ালিপনা বা অনিয়মকে দায়ী করতে হয়। তেমনি এই অপশাসনের ভাইরাস শুধু একটি দল বা গোষ্ঠীর দায় নয় এই পুরো রাষ্ট্র ও সমাজদেহের, আমাদের সবার। অনেকেই মনে করেন কোন নির্দিষ্ট একটি দলকে সরিয়ে আরেকটি নির্দিষ্ট দল ক্ষমতায় এলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। যারা এমন মনে করছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। প্রবন্ধে উল্লিখিত অপশাসনের উদাহরনগুলো দেখলেই স্পষ্ট হবে যে বাংলাদেশে সকল গণতান্ত্রিক দলের আমলে এবং সেনা শাসনের সময়ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনঃ একটি দুঃখজনক বাস্তবতা

ছবিঃ সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান আবার সুশাসনের আশা জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভাইরাসের প্রতিষেধক প্রয়োগ না করে শুধু লক্ষন উপশমের চেষ্টা বৃথা। ২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট এর মাধ্যমে প্রায় অনেকটা একই চেষ্টা করেছিল বিএনপি জোট সরকার। কিন্তু সমস্যার শিকড়ে না পৌঁছানোয় যা লাউ তা কদুই রয়ে গেছে। এবার সে একই ভুল করা মোটেও উচিত হবে না। তাই সমস্যার মুলে যে অপশাসনের ভাইরাস তার উৎপত্তিস্থল জানতে হবে আর প্রয়োগ করতে হবে যথাযথ প্রতিষেধক।

 

আরিফ সোহেল,

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববদ্যালয়।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৭১
২. প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হওয়ার দায় সরকারি দলের: সিইসি, ফেনী ,২৯.৩. ২০১৯, দৈনিক যুগান্তর
৩. লগি-বৈঠা আন্দোলনের ৮ বছর, রাইজিংবিডি ডট কম, ২০১৪-১০-২৮, নজিরবিহীন আন্দোলন, জিম্মি
সাধারণ মানুষ শরিফুল হাসান, ০৬ মার্চ ২০১৫, দৈনিক প্রথম আলো
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুগান্তরের সাংবাদিক গ্রেফতার, যুগান্তর ডেস্ক, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯,
দৈনিক যুগান্তর

 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত