Connect with us

শিল্প-সাহিত্য

দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম

Published

on

দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম

যে কবির কাব্যে আছে মৃত্যুঞ্জয়ী চিরযৌবনের জয়ধ্বনি,অগ্নিবীণার সুর ঝংকার;যিনি ধ্বীরস্থির অঞ্চল বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছিলেন দুর্বার কালবৈশাখীর ঝড়,তিনি বিদ্রোহ ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন নবযৌবনের জয়গান।

নজরুলের অগ্নিঝরা বাণী,তার অনিরুদ্ধ যৌবন শক্তির গীতিময় প্রকাশ। তার বন্ধন অসহিঞ্চু চিত্তের আগ্নেয় দুর্দান্ততা সবাইকে অভিভূত করে। নজরুল অমেয় প্রাণময়তার বহ্নিমান প্রতিমূর্তি। তার ললাটে চির যৌবানের রাজটিকা।কবির কাব্যজগতে প্রবেশ করলে ঊর্ধ্বকাশে দেখি ঝাঞ্চার আলোড়ন। নিম্নদেশে মাটির শ্যামল কোমলতা । বাঙালির ললিত গীতের রাজ্যে তিনি আমাদের শোনালেন রণক্ষেত্রের ভূর্যধ্বনি। নজরলের রক্ত টগবগানো গান গেয়ে তরুণ-প্রাণ সকলে কেড়ে নিয়েছেন।

দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

কবি নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে মে । ছেলেবেলাতেই পিতৃহারা হয়ে নিদারুণ দারিদ্র্য আর অভিভাবকহীনতার কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হন। এ সময়ে লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযোজনা করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুল প্রতিভার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কর্মজীবনের প্রতি বেশি ঝুকে পড়েন। প্রথম মহাযুদ্ধে সময়ে তিনি বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং সেনা বাহিনীতে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।

বাংলাকাব্যে নজরুল :

বিদ্রোহের জয়ধ্বনা উড়িয়ে ধূমকেতুর মতো কাজী নজরুল ইসলাম আবর্ভূত হয়েছিলেন বাংলা কাব্যে। উদাত্ত কন্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন-


’ বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।’


কেবল এ ’বিদ্রোহী’ কবিতাতেই বাংলা কবিতার আসরে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। কবি নজরুল হলেন বাংলার ’বিদ্রোহী কবি’। কবির বিদ্রোহী আত্মার জন্মের মূলে সে অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল তা হলো কবির প্রেম।

কবি তার আত্মপ্রকাশে বলে গেলেন-


’মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর অন্য হাতে রণতুর্য।’


কবি কন্ঠে উচ্চরিত হয়েছে।’জগতে আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম’সেখানে আমি প্রেম পাইনি’সেখানেই বিদ্রোহ করেছি।’কবি সত্য,সুন্দর ও মানবতার পূজারী। সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

নজরুলের আবির্ভাবকাল :

ভারত বর্ষের এক অস্থিতিশীল পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরম্ভ হলে তিনি সেনাদলে যোগ দিলেন। স্কুলেন পড়া ছেড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে করাচি চলে এলেন। যুদ্ব শেষ হলে(১৯১৮) নজরুল হাবিলদার হয়ে ফিরে এলেন। তখন তার বয়স আঠারো-উনিশ। এ সময়ে বিপ্লবী বীর বারীন ঘোষের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুত্রে তিনি বাঁধা পড়লেন। মেতে গেলেন স্বদেশী হাঙ্গামায়,জেলে গেলেন,বেদুইন নজরুল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন,ভাঙার গান’ লেখার প্রেরণা পেলেন। এভাবে উদাম ’বিদ্রোহী’ কবি জীবনে তার নেমে পড়ার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হতে লাগল। নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’অগ্নিবীণা’ বেরুল ১৯২২ সালে।

দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক নজরুল, ছবি : সংগৃহীত

প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম ওঠে নজরুলের। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে রচিত তার কবিতা’মুক্তি’এরই মধ্যে একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছাটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসার অবতীর্ণ হলেন। কোরআন,ও গীতা ও মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি,ফারসি,সংস্কৃতি ও বাংলার শব্দভান্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তার হাতে। আর ছিল উদাত্ত কন্ঠ ও রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কীর্তন বাউল জারি-সারি-ভাওয়ালিয়ার প্রতি প্রাণের টান। সেই সাথে ফারসি গজলের প্রাণ মাতানো সুরবাহারের প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ।

দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

বিদ্রোহ ও যৌবনের কবিঃ
নজরুল চিরযৌবনের কবি। দুর্বার প্রাণ-প্রাচুর্যই যৌবনের নিশ্চিত প্রাণ-স্পন্দন। সব ধরণের শোষণ-শাসন-শৃঙ্খল আর দুর্জয় সাধনায় কবি ছিলেন ব্রতচারী,প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল দেখলেন দেশ পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি। ধনিক শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে কঙ্কাল পরিকীর্ণ এক বিশাল শ্মশানভূূমি। তখন তিনি গাইলেন-


’কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্তজমাট শিকল-পূূজার পাষাণ বেদী।’


সামাজিক জড়তা ও ক্লান্তিকর নৈষ্কর্ম্যরে মধ্যে কালবৈশাখি ঝড়ের মতো তিনি আবেগ জড়িত কন্ঠে গাইলেন-


’মেনে শত বাধা টিকি হাঁচি
টিকে দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি,এবার সব্যসাচী।’


নজরুলের বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে,তেমনি তার বিদ্রোহ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও। তার দৃষ্টিতে সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদই কৃত্রিম ও মিথ্যে। তার কথায়-


’ও কি চন্ডাল! চমকাও কেন? নহেও ঘৃণ্যজীব
ও হতে পারে হরিচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।’


তার ’অগ্নিবীণা’ ’বিষের বাঁশী’ ’সর্বহারা’ ’ফনি-মনসা’ প্রভৃতি কাব্যগুলোতে মূলত বিদ্রোহেরই সোচ্চার জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হয়েছে।


শ্রেণিবৈষম্য,ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ দুর্বলের রক্ত শোষণ মানব প্রেমিক কবিকে একেবারে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সুস্থ মানব সমাজের প্রতিই তার দৃষ্টি ছিল স্থিরবদ্ধ। সমষ্টিক মানুষের কল্যাণই ছিল তার প্রার্থিতা সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিভেদ মূলক কোনো প্রশ্ন কবির চিত্তকে সংকীর্ণতার পথে পরিচালিত করেনি। তার কাছে স্বদেশ ও স্বজাতিই ছিল সবচেয়ে বড় সত্য। তিনি জানতেন,হিন্দু-মুসলমান একই বৃন্তে দুটি কুসুম। তাই ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হলে কবি ’কান্ডারি হুশিয়ার’ ধ্বনিতে বললেন-

’হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষে,সন্তান মোর মার।’

দোষে-গুণে নজরুলঃ


নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন প্রচুর। গান লিখেছেন অসংখ্য। এসব কবিতা ও গানের সুর বৈচিত্র্যও কম নয়। তার কবিতা গুলোকে স্বদেশী কবিতা,প্রেমের কবিতা,নিসর্গ মূলক কবিতা ইত্যাদি কয়েকটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যায়। তার লেখার দোষ গুণ দুই-ই আছে। কবিতাগুলোতে একদিকে দেখা যায় কবিত্ব শক্তির আশ্চর্য অজ¯্রতা, অন্যদিকে দেখা যায় ওই শক্তির উচ্ছৃঙ্খলা অপচয়।তার কারণ,কবি কখনো সতর্ক হয়ে লেখেননি,লেখার পরিমার্জনা কাকে বলে তা জানতেন না। তাই এ গুলোর মধ্যে শিল্প সংগত পারিপাট্যের অভাব লক্ষণীয় । গানগুলো অধিকাংশই ফরমায়েশী। কাজেই কবির বেশির ভাগ গানে ভক্তির গানে-সত্যিই তিনি নিবিষ্ট চিত্ত শিল্পী সাধক। কবিতার শিল্পগত অপরিচ্ছন্নতা এ সংগীতে তিনি অনিকটা কাটিয়ে উঠেছেন। এসব দোষ-গুণ নিয়েই নজরুলের কাব্য প্রতিভা।


খুব বড় হওয়ার বাসনা নজরুল পোষণ করতেন না। নিজের ক্ষমতার সীমা কোথায়,তা তার অজানা ছিল না। যুগের দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে বিদ্রোহের সুরে গান বাঁধতে তিনি এসেছেন এবং তাই তার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। তিনি তো নিজেই আমাদের শুনিয়েছেন, ’বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী।’এতে সমালোচকদের কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে। নজুরলের এ উজ্জ্বল অনন্যতা সর্বজনস্বীকৃত।


নজরুল বিদ্রোহী কবি,ব্যথিত মানবতার কবি। আমাদের প্রিয় কবি। তিনি তো বিদ্রোহী যৌবনের কপালে জয়তিলক একে দিয়ে তাকে ’দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার উত্তরণের মন্ত্রে’ দীক্ষিত করেছেন। নজরুলের সৃজনশীল সৃষ্টি আজও আমাদের প্রাণে শক্তি জোগায়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। নজরুল গণজাগরণের কবি,নিপীড়িত মানুষের কবি এবং আমার প্রিয় কবি।

লেখক,

মাধবী হাবিব বেলী

শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

শিল্প-সাহিত্য

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ৩)

Published

on

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস

“আমি বহুদিন যাবৎ মনে মনে এই আশাটি পোষণ করিতেছিলাম যে, ভারতীয় মুসলমানদের শৌর্য- বীর্য সংবলিত এমন একটি যুদ্ধকাব্য লিখিয়া যাইব, যাহা পাঠ করিয়া বঙ্গীয় মুসলমান স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারেন যে, এক সময়ে ভারতীয় মুসলমানগণও অদ্বিতীয় মহাবীর ছিলেন।”

— কায়কোবাদ

পূর্বের পর্বঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

কলকাতার ঠাকুর বাড়ির পিছনে বিশাল আমবাগান। গ্রীস্মের দুপুর গুলোর প্রায়ই কাদম্বরী দেবী আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন। রবী ঠাকুর এই সময়টাতে নতুন কি লিখেছে তা শোনায় বৌদি কাদম্বরী কে। কিন্তু আজ দুদিন রবীন্দ্রনাথ আসছে না, মুখোমুখি হওয়াও বন্ধ প্রায়। হঠাৎ হঠাৎ এই দেবরটির কি যে হয় কাদম্বরী ঠিক বুঝতে পারে না। রবীকে কাদম্বরী মন থেকে স্নেহ করে কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় রবি বোধহয় আরেকটু বেশি চায়। অন্তত রবির চোখের চাহনি হঠাৎ অভিমান এসব তাই প্রকাশ করে। কিন্তু সে বেশিটুকুর পরিমাণ কাদম্বরী দেবী পরিমাপ করতে পারে না। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কাদম্বরী মন থেকে ভালোবাসে। আশেপাশের সবাই যখন নারীকে শুধু অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে দেখে তখন তাঁর স্বামী তাকে নারী স্বাধীনতা উপভোগ করাচ্ছেন। সমাজের নাক সিটকানি উপেক্ষা করে কাদম্বরী দেবীকে বাড়ির অন্দর থেকে বাইরে এনেছেন তিনি। তবে ব্যাপারটাতে সবাই যে একযোগে বাঁকা চোখে দেখছে তা নয়। কেউ কেউ জ্যোতিকে বাহবাও দিচ্ছে। ভারতবর্ষের সামাজিক পরিবর্তন আনতে গেলে যে নারী-পুরুষ সকল সামাজিক জীবেরই জীবন – যাপন, মনন – চিন্তার পরিবর্তন আনতে হবে এটা বুঝতে পারারাই বাহবা দেবার দলে। ভারতে স্বদেশী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির ভুমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে দীর্ঘকাল ভারতীয় উপমহাদেশে দেশীয় রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সেই চেতনার যোগাযোগ সৃষ্টিতে ঠাকুর পরিবারের একাধিক সদস্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (৪ মে ১৮৪৯ – ৪ মার্চ ১৯২৫) উল্লেখযোগ্য।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছবিঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে বাঙালির সামাজিক জাগরণ তথা স্বাদেশিকতার রাজনৈতিক ও সাহিত্য মূল্য অনেক। এই জাগরণের ধারা শুরু হয় নবগোপাল মিত্রের “হিন্দুমেলা” (১৮৬৭), কেশবচন্দ্র সেনের “ভারতসংস্কার” (১৮৭০), মহেন্দ্র লাল সরকারের “ভারতীয় বিজ্ঞান সভা” (১৮৭৬) প্রভৃতির মাধ্যমে।জ্যোতি ঠাকুর তার সময়ে এই নবজাগ্রত স্বাদেশিকতার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে অনুবাদক হিসেবে তিনি যেমন পথ দেখিয়ে গেছেন তেমনি রাজনীতিতে রেখে গেছেন সংস্কারকের ভূমিকা। ভারতীয় সমাজ থেকে ইংরেজ প্রাদুর্ভাব দূরীকরণে, স্বদেশী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার চেষ্টায়, হিন্দু মেলার সংগঠনে কিংবা আদি ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে জ্যোতি ঠাকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে অনেকে। এত রাজনৈতিক ব্যাস্ততার মাঝেও একের পর এক ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্য কর্মের বাংলা অনুবাদ করেছেন তিনি। শেকসপিয়ারের “জুলিয়াস সিজার” তিনিই প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৮৮৪ সালে স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর থেকে হঠাৎ করেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন সকল ব্যাস্ততা থেকে। এমনটা না হলে হয়তো বাংলার সাহিত্য কিংবা রাজনীতি, দু জায়গার কোথাও থিতু হয়ে ইতিহাসে আরো রঙ ছড়াতেন তিনি।বাংলার নাট্য অনুবাদে এই মানুষটি থাকবেন সবসময় প্রথিতযশা হয়ে। তবে বাংলা নাটকে স্বাদেশিকতার উত্তেজিত মন্ত্রের প্রবেশ ঘটান উপেন্দ্র নাথ দাস (১৮৪৮-৯৫)। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী এইসব উত্তেজনা দমনে সরকার “ড্রামাটিক পারফরম্যান্স এক্ট” (১৮৭৬) পাস করতে বাধ্য হয়। উপেন্দ্রনাথের “শরৎ সরোজিনী” (১৮৭৪) ও “সুরেন্দ্র – বিনোদিনী” (১৮৭৫) নাটক দুটিতে সরাসরি ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো হয়।

বিংশ শতকের শুরুর সময় থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্য সমাজ মিলেমিশে নতুন দিক প্রশস্ত করেছিল। মোঘল শাসনের পর থেকে পাদপ্রদীপের আলো থেকে সর্বক্ষেত্রে দূরে থাকা মুসলিম সমাজ সাহিত্য ও রাজনীতি দুই মাধ্যমেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আবার সাহিত্য সমাজে স্বদেশী চেতনার উত্তেজিত মন্ত্রের প্রবেশ ঘটান কেউ কেউ। বড় ভাই জ্যোতি ঠাকুরের হাত ধরে বিদেশি সমাজ চেতনার একটি পরিচয় যেমনি দেশী সাহিত্য প্রেমীরা পেতে থাকে তেমনি বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হবার প্রারম্ভে ছোটভাই রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষেরাও চিনতে শুরু করে। গত দুটি পর্বে প্রথম বঙ্গভঙ্গ আর বঙ্গভঙ্গ রদের অপরাপর সময়ে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখন ওই সময়ের সাহিত্য সমাজের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ উত্থান নিয়ে আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে বিংশ শতকের শুরুর দিকের একটি বিদেশি ঘটনার প্রতি আলোকপাত করা উচিত। ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন ভারতীয় “নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস” প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। সেখানে ভারতীয়দের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯ – ১৯৪৮)। যিনি পরবর্তীতে মহাত্মা (মহান আত্না) গান্ধী নামে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হন এবং ভারতের জাতির জনক হিসেবে যার জীবনাবসান ঘটে। এই মহান ব্যাক্তিকে নিয়েও আলোচনা করা হবে তবে এখনি না, যথাসময়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছবিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রবেশ ঘটতে থাকে শিক্ষিত সমাজের হাত ধরে। তৎকালীন বিদেশ ঘুরে আসা শিক্ষিত জনদের মাঝে বেন্থাম- মিল – কোমট – রুশোর মতবাদের প্রচলন শুরু হয়।এরপর রামকৃষ্ণ – বিবেকানন্দদের শিক্ষা এবং গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শ প্রধান হয়ে দেখা দেয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের(১৮১২-১৮৫৯) সম্পাদনায় বাংলার প্রথম দৈনিক “সংবাদ প্রভাকর” (সাপ্তাহিক ১৮৩১, দৈনিক ১৮৩৯) যাত্রা শুরু করে। বাংলার নবজাগরণ ও নীল বিদ্রোহের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলে পত্রিকাটি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি ঘিরে পরবর্তীতে একঝাঁক জাতীয়তাবাদী চেতনাধারী কবি – সাহিত্যিকদের উদ্ভব হয় বাংলায়। এদের মধ্যে মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) অন্যতম। গুপ্তবাবুর শিক্ষা সংস্কার, ধর্মসংস্কার প্রভৃতি মনোমোহন বসুকে আন্দোলিত করে। এদেশে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক আগ্রাসনের তিনি বিরোধী ছিলেন। তাইতো লিখেছিলেন, “ইউরোপীয় সমাজ আর স্বদেশীয় সমাজ বিস্তর ভিন্ন। ইউরোপীয় রুচি ও দেশীয় রুচি যে সম্যক স্বতন্ত্র পদার্থ তাহা অনেকে ভাবিয়া দেখেন না “। ঐ সময়ে নাটকে ইংরেজি নাট্যাদর্শের প্রচলন শুরু হয়েছিল। এর বিপরীতে গিয়ে বসু বাবু নাটকে বাংলা কবি যাত্রার প্রচলন ঘটায়। নাটকের নতুন এই দেশীয় ধাস বাঙালির রাজনৈতিক চেতনাকে নাড়া দিয়েছিলো। তাঁর “হরিশ চন্দ্র” (১৮৭৫) নাটকে ধর্মীয় ভক্তিরসের সঙ্গে হিন্দুমেলার জাতীয়তাবাদী স্বাদেশিকতার সুরটিও বেজেছে।

দীর্ঘদিন সাহিত্য সমাজের নেতৃত্ব থেকে মুসলমানদের দূরে থাকার সমাপ্তি ঘটে বিংশ শতকে। মহাকাব্য “মহাশ্মশান” (১৯০৪) লিখে মহাকবির মর্যাদা পেয়েছিলেন কায়কোবাদ। তাঁর পুর্ণ নাম কাজেম আল কোরেশি। কায়কোবাদ

ছবিঃ কায়কোবাদ

তৎকালীন রাজনৈতিক সমাজে হীন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খোঁজার জন্য মুসলমান নেতৃবৃন্দকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তাঁর সাহিত্য কর্ম। “মহররম শরীফ” (১৯৩৩) কায়কোবাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা যার দরুন বাংলার রাজনৈতিক সমাজে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। বাংলা সাহিত্যের হিন্দুত্ববাদী দখলের বিপরীতে তিনিই প্রথম শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হন। মুসলমান সাহিত্যিক হলেও সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর চেতনা প্রসারে লেখকসমাজে কায়কোবাদের জনপ্রিয়তাও ছিল অগ্রগণ্য। কারবালার যুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলীকে প্রেক্ষাপট বানিয়ে হামিদ আলী (১৮৭৪-১৯৫৪) দুটি মহাকাব্য লেখেন। তাঁর “কাসেমবদ কাব্য” (১৯০৫) ও “জয়নালোদ্ধার কাব্য ” (১৯০৭) রচনাগুণে উন্নত না হলেও বাংলা সাহিত্যে মুসলিম প্রতিনিধিত্বে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে মুসলিম রক্ষণশীল চেতনা থেকে বেড়িয়ে এসে দেহধর্মী প্রণয় কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন মোজাম্মেল হক(১৮৬০-১৯৩০)। তিনি “লহরী” নামে একটি কবিতার পত্রিকা বের করা শুরু করেছিলেন। “মোসলেম ভারত” (১৯২০) সাহিত্য পত্রিকার তিনি ছিলেন সম্পাদক। ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম লেখকদের বিকাশে পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা রাখলেও হিন্দু লেখকদেরও সম্মিলন ঘটেছিলো সেখানে। এমনকি পত্রিকার প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীও সংযোজিত ছিল। মোজাম্মেল হক রচিত জীবনীকাব্য “হযরত মোহাম্মদ” (১৯০৩) সে সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

আর এভাবেই বিংশ শতকের গোড়াতেই বাংলার মানুষ রাজনীতির ময়দানে বঙ্গভঙ্গ আর বঙ্গভঙ্গ রদের সাথে সাথে সাহিত্য সমাজের রাজনৈতিক সংসর্গের সাক্ষী হয়। ১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীনতম নিদর্শন “চর্যাপদ” আবিস্কৃত হয়।

চর্যাপদ

ছবিঃ চর্যাপদ

নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে এটি আবিষ্কার করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (৬ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ – ১৭ নভেম্বর, ১৯৩১) । তার আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য।তবে বাঙালির সাহিত্য সমাজের সবচেয়ে বড় ঘটনা তখনো ঘটে নি। একজন বাঙালি প্রথম নন ইউরোপীয় হিসেবে প্রথমবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাহিত্য স্বীকৃতি অর্জন করে নেয় কিছু পরে। তাঁর এই অর্জনের পরপরই বাঙালি সাহিত্য তথা সমাজের ওপর নজর পড়ে ইউরোপীয় সাধারণ জনগণের। পৃথিবীব্যাপী মানুষেরা “বাংলা” নামটি শুনতে পারে গৌরব আর অর্জনের অংশ হিসেবে। আমাদের ভাষায় কথা বলা, কবিতা লেখা, জাতীয়তাবাদী বক্তব্য দেওয়া একজন মানুষ “বিশ্বকবি” হিসেবে আবির্ভূত হওয়া শুরু করে এই অর্জনের ঘটনার পর। তাই এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব অনেক। তবে সে গল্প এখন আর নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের হাড়হীম করা রাজনৈতিক গল্পগুলো আসছে সামনের পর্বে।

(চলবে…)

লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

শিল্প-সাহিত্য

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

Published

on

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

(পূর্বের পর্ব >> আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১) )

“… অইরে মোসলেম! দেখরে চাহিয়া
নির্জীব যে জাতি তারাও সাজিয়া
তারাও কেমন সাহস ধরিয়া
উন্নতির পথে ধাইছে ছুটি।
তোমাদের তরে নিদ্রিত দেখিয়া
প্রকাশ্যে তোদেরে অবজ্ঞা করিয়া
দেখরে কেমন চলিছে ছুটিয়া
দেখরে মেলিয়া নয়ন দুটি।”

— ইসমাইল হোসেন সিরাজী

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)
ছবি : সংগৃহীত

কদিন ধরে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ির ছাদে প্রায় বিকেলে কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে গল্প করতে দেখা যায় একজন ভদ্রমহিলাকে। মূলত তাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জোঁড়া সাকোর এ বাড়ি থেকে জন্ম নেওয়া সাহিত্য পত্রিকা ‘ভারতী’ নিয়ে। ভদ্রমহিলাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ আগস্ট ১৮৫৫ – ৩ জুলাই ১৯৯২)। এই নারী ১৮৭৬ সালে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে লিখে ফেলেন ‘ দীপনির্বাণ ‘ উপন্যাস। এটি প্রকাশের মাধ্যমে রাজনীতি সচেতন এই সাহিত্যিক লাভ করেন প্রথম বাঙালী নারী ঔপন্যাসিক হবার মর্যাদা। একজন নারীর এই সাহিত্যিক হয়ে ওঠা তৎকালীন নারী সমাজে বৃহৎ আলোচনার সৃষ্টি করে। স্বর্ণ দেবীর প্রথম উপন্যাসটি তাই স্বভাবতই নারী সমাজে পঠিত হতে থাকে বেশি সংখ্যায়।নিজেদের স্বাতন্ত্র্য জাতীয়তাবাদী একটি ভাবধারা তৎকালীন নারীসমাজে প্রবেশ করাতে স্বর্ণ দেবীর রাজনৈতিক ভূমিকা অনেক৷ পাঠিকা সমাজ যে বঙ্গভঙ্গ সহ ব্রিটিশ বিরোধী একটি চেতনা নিজেদের মননে গড়ে তুলছিল সে অবদান স্বর্ণ দেবীর অনেকখানি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

ছবি : সংগৃহীত

ওদিকে লর্ড ডালহৌসি সাহেব লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে নতুন বাংলা প্রদেশ গঠন করে বসে আছেন ১৮৫৪ সালে। এর ঠিক চার বছর পরই প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত ধরে প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল'(১৮৫৮) প্রকাশিত হয়ে গেলো। এই ১৮৫৮ সালটি বিভিন্ন কারণে ভারতীয় রাজনীতি ও বাংলার সাহিত্য ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এবছরই বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের(২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩) আবির্ভাব আবার ‘ভারত শাসন আইন ১৮৫৮’ করার মাধ্যমে কোম্পানির শাসনের বদলে ভারতবর্ষে শুরু হয় রাণীর শাসন। মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে বিপ্লব সৃষ্টি করেন অন্যদিকে সেই সময়ে সিপাহীদের বিপ্লবের ফলেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়।অমিত্রাক্ষরছন্দে রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য ‘ (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ রচনা।আর এই মেঘনাদবধ কাব্যের সময় থেকেই আধুনিক সাহিত্যের বিকাশকাল শুরু।১৮৬১ সালে বাংলা সাহিত্যের সাথে সাথে ভারতের সরকার ব্যাবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। ‘ভারতীয় কাউন্সিল এক্ট ১৮৬১ ‘ এর মাধ্যমে সরকার গঠনে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রবেশের প্রাথমিক রাস্তার সৃষ্টি হয়।মেঘনাদবধ কাব্য রচনার কিছুকাল পরে মাইকেল মধুুসূদন দত্ত প্রবাসে বসে সনেট লিখতে শুরু করেন, যা চতুর্দশপদী কবিতাবলি নামে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। বলা হয় বাস্তবে মধুসূদনের দ্বারাই বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়। এদেশের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে এবং বিশ্বসমাজে আমাদেরকে আলোচনায় আনতে মধুসূদনই প্রথম ভুমিকা রেখেছেন। অন্যদিকে মধুসূদনের হাত ধরেই পশ্চিমের শিল্প – সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঢেউ আমাদের সাহিত্য সমাজে সর্বপ্রথম আছড়ে পড়া শুরু করে। যে ঢেউ পরবর্তীতে বাংলার রাজনৈতিক চেতনাকেও শানিত করেছে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

এবার আমরা একটু লাফ দিয়ে চলে আসবো বঙ্গভঙ্গের সময়টিতে। রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রমে শরীক হয়েছিলেন বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন ও পৃষ্ঠপোষক, যা কিনা ইতিহাসে বিরল। এদের মধ্যে কলকাতার চৈতন্য লাইব্রেরি ও বীডন স্কয়ার লিটারারি ক্লাব এবং এ দুটি সংগঠনের কর্তাব্যক্তি গৌরহরি সেন উল্লেখযোগ্য। সেন বাবু বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবার প্রাক্কালে ১৯০৫ সালের ২২ জুলাই পকেটের পয়সা খরচ করে রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রবন্ধ পাঠের বিরাট আয়োজন করেন। অন্যদিকে কিছু কিছু সাহিত্য সংগঠন বঙ্গভঙ্গের পক্ষেও কাজ করেছে। যেমন মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি ও মুসলিম সাহিত্য সমিতি বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। বঙ্গভঙ্গ থেকে রদ হবার সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ‘স্বদেশী সঙ্গীত’।তাঁর এসব গান লেখার খবর পেয়ে কোলকাতায় স্বদেশী গান শেখানের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর রচিত ২১টি স্বদেশী গান নিয়ে খেয়া কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।সেগুলোর তালিকা—১) ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, ২) মা কি তুই পরে দ্বারে পাঠাবি কি তোর ঘরের ছেলে, ৩) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা, ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে, ৬) যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু, ৭) তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, ৮) সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না, ১০) ওরে তোরা নেই বা কথা বললি, দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী, ১১) ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি, ১২) বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই, ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে, ১৪) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে, তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে, ১৫) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, ১৭) আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার, ১৮) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ১৯) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন কাটবে, ২০) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে, ২১) ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না। হবার যা নয় কোনোমতেই হবেই না সে, হতে দেব না।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)
ছবি : সংগৃহীত

আমাদের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” বঙ্গভঙ্গের সময়েই রচিত। কুষ্টিয়ার বাউল গগন হরকরার “আমি কোথায় পাব তারে” গানের সুরেই রবীন্দ্রনাথ “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুর করেন।গিরিশচন্দ্র ঘোষ (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৪ – ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক ও নট। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তারই অবদান।ইংরেজি নামের নাট্যদলের ভিড়ে ১৮৭২ সালে তিনিই প্রথম বাংলা পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটকগুলো সেসময়ে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে সিরাজুদ্দৌলা, মীর কাসিম, ছত্রপতি শিবাজি প্রভৃতি উল্লেখ্য। আরেক সঙ্গীতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও (১৯ জুলাই ১৮৬৩ – ১৭ মে ১৯১৩) ঐ সময়ে জাতীয়তাবাদি চেতনা প্রচারে কাজ করেছেন। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন।এই গানগুলি বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গান “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”, “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। তাঁর ইতিহাসাশ্রয়ী নাটক তারা বাঈ, রাজা প্রতাপ সিং, চন্দ্রগুপ্ত ইত্যাদির রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অতুলনীয়। এসব সাহিত্যকর্ম ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে সামাজিকভাবে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে কাজ করে।বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সাহিত্য সমাজের এমন প্রতিরোধের চেয়েও আরো কয়েকগুণ বেশি প্রতিরোধ ছিল রাজনৈতিক সমাজে। সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি, অরবিন্দ ঘোষ, বিপীন চন্দ্র পাল প্রমুখ বর্ণ হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনে নেমে গেছে। হিন্দু সাহিত্য সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজ যেখানে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক হয়ে মিলেমিশে একাকার সেখানে মুসলমান সমাজ কিঞ্চিৎ দ্বিধাবিভক্ত। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সামাজ, মুসলমান নিম্নবিত্ত ও হিন্দু নিম্নবিত্ত। সে সময় বাখরগন্জে নমশূদ্রদের এক সভায় ঘোষণা করা হয়, “ব্রাহ্মণদের ঘৃণা ও অপছন্দ এবং কায়স্ত ও বৈদ্যদের কারণে বিরাট এই নমশূদ্র সম্প্রদায় পশ্চাৎপদ। অথচ মুসলমান ও তাঁরাই পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং এই সম্প্রদায়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই বঙ্গভঙ্গ রদ করে পুনরায় ঐসব উচ্চ বংশীয় হিন্দুদের সঙ্গে কাজ করার।বরংচো তারা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবেন তাদের মুসলমান ভাইদের সঙ্গে”। ১৯০৮ সালে ঐ সময়কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান রাজনৈতিক নেতা নওয়াব আলী চৌধুরী এক বক্তৃতায় বলেন, ” পুরনো প্রশাসনে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা অববাহিকা ছিল অবহেলিত। বর্তমান নতুন প্রশাসন চালু হওয়ায় পূর্ববঙ্গ ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। কলকাতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় যেন সুন্দর জীবন ফিরে এসেছে”। পূর্ব বাংলায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলিম জনমত গঠনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন স্যার নবাব সলিমুল্লাহ। তিনি বঙ্গভঙ্গের পরপরই সেসময়কার হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী ও বঙ্গভঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের বিপরীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিক হিসেবে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এসবের পিছনে যে ব্রিটিশদের হাত আছে সেটা প্রকাশ পেতে দেরি হয় নি। নবাব সলিমুল্লাহকে সেসময় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দিয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের অর্থাৎ হিন্দু রাজনীতিবিদদের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। তবে সব মুসলিম রাজনীতিবিদ যে ব্রিটিশদের কাঠের পুতুল হয়ে ছিল এমন না।সেই অস্থির সময়ে সর্বপ্রথম হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের নীতি অনুসরণের চিন্তাভাবনা মুসলমানদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে শুরু করেন তৎকালীন তরুণ নেতা এ কে ফজলুল হক। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আসবে সামনে।

বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন সৃষ্ট বাংলার রাজনীতিকে ব্রিটিশদের মনমর্জি মতো পরিচালনা করা গেলেও কেনা যায় নি সাহিত্য সমাজকে। আর এই কারণেই সাহিত্যের সঙ্গে সেসময়ের ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক অন্যরকম মেলবন্ধনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়। পুরো বাংলার সাহিত্য সমাজই প্রধানত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনকি সেসময়কার বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০ – ১৯৩১) বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই সিরাজী ছিলেন ১৯ ও ২০ শতকে বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন। তিনি মুসলিমদের জন্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা, নারীদের শিক্ষা এসবের পক্ষে লেখালেখি করেন। তার ‘অনল-প্রবাহ'(১৯০০) কাব্যগ্রন্থটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং তিনি কারাবন্দী হন। তো বঙ্গভঙ্গ এবং এটির পরবর্তী রাজনৈতিক সময়টাকে বিশ্লেষণ করে দেখাযায় সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী প্রভাবের প্রতিফলন হিন্দু রাজনৈতিক জীবনে প্রকটভাবে ধারণ করে। অন্যদিকে মুসলমান রাজনৈতিক সমাজ বিভিন্ন যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের মধ্যে হিন্দু -মুসলিম দাঙ্গার দামামা বেজে ওঠে ভারতবর্ষে। এমনকি বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারের পদত্যাগও (১৯০৬ এর ১৫ জুলাই) এই অরাজকতা বন্ধ করতে পারে নি। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে সরকারি কাজ অরাজকতা পূর্ণ পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে সড়িয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গভঙ্গ রদ করা গেলেও এই ঘটনার ঘনঘটায় যে সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বীজ ভারতবর্ষে রোপিত হয়েছিল সেটাকে ওপড়ানো যায় নি। যে বীজ পরবর্তীতে মহীরুহ হয়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো পুরো ভারতবর্ষের মানচিত্রকে। গঙ্গা – যমুনা দিয়ে বারবার বয়ে চলা রক্তের ইতিহাস আসছে এরপর।

লেখকঃ শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

(পরবর্তী পর্বঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ৩) )

 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

শিল্প-সাহিত্য

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)

Published

on

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
“বঙ্গভঙ্গের পরই ভারতের প্রকৃত জাগরণ ঘটেছে” -মহাত্মা গান্ধী। “

 

১৯০৫ সালের ৬ই জুলাই কাক ডাকা ভোর। দিনের আলো গত হওয়া রাতের অন্ধকারকে দূরে ঠেলে কলকাতার রাস্তাঘাট দখল করা শুরু করেছে। এই আলোর সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা খবর পুরো ভারতবর্ষকে দখল করে নেবার দৌড়ে নেমেছে, বাংলা প্রদেশ ভাগ হবার খবর।  কলকাতা প্রেস যখন প্রথম জনসাধারণের কাছে বঙ্গভঙ্গের খবর পৌঁছে দিচ্ছে তখন ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ পর্বের চার দশক পার হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের জনগণ আগামী তিনমাস পর হতে যাওয়া দেশের সবচেয়ে বড় প্রদেশটি বিভক্তি করণের সংবাদ আজকেই প্রথম পেয়েছে।

 

তবে সরকারি এই নির্দেশনার খবর অনেক আগেই পেয়েছে চার দশক পার করা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন মহারথীরা। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে, কেউবা প্রদান করেছে সায় আবার কেউ রয়েছে চুপ। কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবার সাথে সাথেই যে বাংলার রাজনীতির সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যের পথচলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে এ ধারণা হয়তো কেউই করতে পারে নি।

 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
ছবি : সংগৃহীত
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার কুশীলব হিসেবে লর্ড কার্জনকেই আমরা চিনি। তবে এই সিদ্ধান্তের পিছনে থাকা অন্য দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হলেন স্যার বাম্পফিল্ড ফুলার ও স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার। প্রথমজন বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট নতুন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লেফটেন্যান্ট গভর্নর এবং দ্বিতীয়জন ১৯০১ সালে বাংলার সীমানা পুনঃ বিন্যাসের প্রস্তাবকারী (যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের চিন্তা মাথায় আসে লর্ড কার্জনের)।

 

বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকতে পারে অনেক গুলোই, ছিল যৌক্তিক অনেক কারণও।মুগল শাসনামলের পর থেকে বঞ্চিত মুসলিম বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা ছিল, কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন শিল্প-বাণিজ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে ঢাকা-চিটাগং এর উন্নয়ন করা জরুরি ছিল, সাথে ছিল এ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারেরও প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনায় হয়তো বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা তৎকালীন সময়ে সত্যিই ছিল। কিন্তু ভারত সরকারের তৎকালীন প্রধান সচিবের একটি নোট অনেক কিছু পরিষ্কার করে দেয়।

 

তিনি বঙ্গভঙ্গের কার্যকর হওয়ার একটি নথিতে লিখে গেছিলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসন বিরোধীদের দুর্বল করা। ” তার এ কথা দ্বারাই অনেক কিছু প্রকাশ পেয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট হওয়া বঙ্গ প্রদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সিদ্ধান্তটি হয়তো ভুমিকা রেখেছিল কিন্তু ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাবার ক্ষেত্রে পুরো ভারতবর্ষেরই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হবার কারণও হয়েছিল এই বঙ্গভঙ্গ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশ পর্বের (১৮৬১ সাল থেকে বিকাশ পর্ব শুরু) সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা এই বঙ্গভঙ্গ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশ পর্বের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনার জন্যও আমরা প্রথমে বঙ্গভঙ্গ এবং এই বিভাজনের প্রেক্ষাপটের সময়টাকেই প্রারম্ভ হিসেবে ধরে এগোবো।

 

বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম প্রধান ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম এবং কম হিন্দুপ্রধান আসামকে নিয়ে “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। আর তৃতীয় বারের মতো আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা রাজধানী হবার গৌরব অর্জন করে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
ছবি : সংগৃহীত
বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের শুরুতে যে সাহিত্যিক বাঙালী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁর নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৭ জুন ১৮৩৮ – ৮ এপ্রিল ১৮৯৪)। কমলাকান্ত ছদ্মনামের এ ঔপন্যাসিক বাংলা ভাষার আদি সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বঙ্গভঙ্গ থেকে বঙ্গভঙ্গ রদের সময় জুড়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশে এ সাহিত্য পত্রিকাটি বিপ্লবী রঙ ছড়িয়েছে।

 

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) বাংলা সাহিত্যেরও প্রথম সার্থক উপন্যাস। তবে বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে পরবর্তী ভারতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের সম্পূর্ণ সময় জুড়ে বঙ্কিম রচিত আনন্দমঠ (১৮৮৪) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলার সাহিত্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম এই উপন্যাসের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবে উপন্যাসটির হাতে লেখা গোপন সংস্করণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

 

উপন্যাসটি মুসলমান-বিরোধী মতধারার জন্য কিছুটা বিতর্কিত। এই উপন্যাসের কাহিনী ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত উত্তর বঙ্গের সন্ন্যাসী আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এই উপন্যাসেই বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম গানটি লেখেন। পরবর্তীতে ভারতীয় স্বদেশপ্রেমীরা “বন্দে মাতরম” বাক্যটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান হিসাবে গ্রহণ করে। বঙ্গভঙ্গ বাতিলের লক্ষ্যে এদেশের বিপ্লবীরা যে ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশী ‘ আন্দোলন শুরু করে সেটার মূল চেতনাবীজ হিসেবে সাহিত্যকর্মটির বিশেষ মর্যাদা আছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
ছবি : সংগৃহীত
বঙ্গভঙ্গের শুরু থেকে রদ পর্যন্ত ছয়টি বছর বাংলার সাহিত্য ও রাজনীতি যার দুহাত ধরে হেটেছে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(৭মে ১৮৬১- ৭ আগস্ট ১৯৪১)। সাহিত্য এবং রাজনীতি এই দুটো আলাদা মাধ্যমকে বাংলার ইতিহাসে এই একজন মাত্র ব্যাক্তিই একীভূত করে নিয়েছিলেন।

 

দুই মাধ্যমের যোগাযোগ ঘটিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তকে বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যক্রম দিয়ে প্রতিহত করেছেন৷ এ সময়টিতে রাজনীতির ময়দানে ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেমনি রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী কৃষিমেলা, হিন্দু-মুসলমান মিলন, রাখি বন্ধন, প্রচলিত নেতৃত্বের বাইরে নতুন ধরনের নেতৃত্বের সন্ধান ইত্যাদি কার্যক্রম উদ্ভাবন করেছেন তেমনি কলম হাতেও একের পর এক প্রতিবাদগাঁথা লিখে গেছেন৷

 

তবে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে নেই। কোনো সভাতে অংশ নিতে তাঁকে দেখা যায় না। তিনি কোনো বক্তৃতাও করছেন না। কোনো প্রবন্ধও লিখছেন না।
তাঁর চেনা পরিজন অনেকেই এই আন্দোলনে আছেন কিন্তু তিনি নেই। এমন কি শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ নীরবতা পালন করছেন। অথচ এর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। তাঁর এমন নীরবতায় অনেকেই আশ্চর্য হয়েছিলেন।

 

তিনি নীরবতা ভাঙলেন বঙ্গভঙ্গের ঠিক আগের বছর ১৯০৪ সালে। তার আগের বছর প্রকাশিত ‘চোখের বালি ‘(১৯০৩) উপন্যাসে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কিছুটা রঙ দেখা যায়। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘বিহারি’ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে খানিকটা দৌড়াদৌড়ি করে। তবে সে দৌড়ানোটা ‘বিনোদিনী’র কাছ থেকে ‘বিহারি’কে সড়িয়ে রাখতে রবীন্দ্রনাথ গল্পে ঢুকিয়েছেন নাকি সত্যিকারে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একটা মতামত প্রকাশ করার জন্য ঢুকিয়েছেন তা তখনও বোঝা যায় না। এমনকি উপন্যাসের একটি সংলাপে বিনোদিনী যখন বিহারিকে প্রশ্ন করে বসে বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে পারবে কিনা তখন বেশ ইতস্তত করে অন্তত চেষ্টা করার উত্তর আসে। এটা থেকে ধারণা করা যেতে পারে লেখক নিজেও হয়তো দোলাচালে ছিল বঙ্গভঙ্গ নিয়ে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
ছবি : সংগৃহীত
তবে যখন থেকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মনোভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন তখন থেকে বাংলার রাজনৈতিক ও সাহিত্য ইতিহাস নতুন বাঁক নেওয়া শুরু করলো।রবীন্দ্রনাথের নীরব থাকার এ ব্যাপারটাকে অনেকে একটু বাঁকা চোখেও দেখেন। তাদের মতে সে সময়কার বাঙালী সমাজে রবী ঠাকুরের মতো প্রভাব বিস্তারকারী ব্যাক্তির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তাদের এমন নিরবতাই সে সময় বঙ্গভঙ্গের জন্য বৃটিশ সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। আরেকটি দল তো আরেকটু বাড়িয়ে বলে। তাদের মতে বঙ্গভঙ্গ সৃষ্টির গোড়ার সময়টাতে ঠাকুর বাবু বৃটিশদের অনুগ্রহ প্রাপ্ত ছিলেন তাই উচ্চবাচ্য করেন নি। ঠাকুর বাবুর প্রতি বৃটিশদের এই অনুগ্রহ দানের গোপন বিষয়টি আরেকটু জোরালো ভাবে উচ্চারিত হয়েছিল যখন তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ সম্পন্ন হবার আগেই পুনরায় নীরব হয়ে যান। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন থেকে নিজেকে সড়িয়ে নেওয়ায় রবীন্দ্রনাথ বিরোধী দ্বিতীয় দলটি নানা কথাই প্রচার করা শুরু করে। তবে ওসব অপপ্রচার ধোপে টেকেনি রবীন্দ্রনাথের ব্রিটিশ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কর্মগুনে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রবীন্দ্রনাথের কলম একের পর এক বিপ্লবী সাহিত্য কর্মের জন্মদিতে থাকে। এ সময়টাতে তাঁর লেখা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রবন্ধ গুলোর বিশেষ মর্যাদা আছে। বিশেষত- স্বদেশী সমাজ, শোক চিহ্ন, করতালি, উদ্বোধন, দেশনায়ক প্রভৃতি প্রবন্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। আর এসব প্রবন্ধের বেশিরভাগই ছাপা হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের শুরু করে যাওয়া বঙ্গদর্শন পত্রিকায়।

 

এ সময়ে রবীন্দ্র সাহিত্য কর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণুতাবাদ ও কলাকৈবল্যবাদ এর উদ্ভব। পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য গর্ভে জন্ম নেওয়া এ বিশেষ দুটি শাখা স্বল্প মাত্রায় প্রবেশ করতে থাকে বাংলা সাহিত্যে। কলাকৈবল্যবাদের প্রধান বক্তব্য ছিল – ” আর্টের সঙ্গে বাস্তব ইউটিলিটির কোনো সম্পর্ক নেই “।ক্ষয়িষ্ণুবাদের বিষয়বস্তু ছিল সুপরিকল্পিতভাবে সকল আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে একটা প্রচন্ড ওলট-পালট ও বিপর্যয় আনা। তাই জীবনের স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছলতাকে এড়িয়ে এই ধারার শিল্পীরা তাদের সৃষ্টিতে প্রবেশ করান কৃত্রিম সাজসজ্জা, মাদকদ্রব্য, বিকৃত মানবিক সম্পর্ক ও অস্বাভাবিক যৌন আচরণের। বিদেশি সবকিছু বর্জনের যে ডাক রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন নিজের সাহিত্য কর্মে সেটা নিজেই রক্ষা করতে পারেন নি। তবে তাঁর সাহিত্যকর্মে কলাকৈবল্যবাদ ও ক্ষয়িষ্ণুবাদের প্রভাব ছিল যৎসামান্য। তাঁর রচিত ‘ঘরে বাইরে ‘ উপন্যাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী চেতনা যেমন প্রকাশ পেয়েছে ঠিক তেমনি কলাকৈবল্যবাদ ও ক্ষয়িষ্ণুবাদও ধরা দিয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায় স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও স্ত্রী বিমলা বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা তীব্রভাবে আকর্ষিত। আবার সন্দীপের মানবিক দোষত্রুটি, বিকৃত লোভ এবং পরস্ত্রী কাতরতার মতো অস্বাভাবিক যৌন আচরণের অনুভূতিও গল্পে মিলেমিশে একাকার।

 

তথ্যসূত্র:

০১/ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন ও মোঃ মাহবুবর রহমান।

০২/ বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন – ড. হারুন অর রশিদ।

০৩/ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ – কুলদা রায় ও এম এম আর জালাল।

০৪/ অগ্নিযুগের সাহিত্য – রকিবুল হাসান।

০৫/ The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar

০৬/From Plassey to Partition – A History of Modern India (2004), Sekhar Bandyopadhyay

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত