শিল্প-সাহিত্য
প্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা

Published
4 years agoon

কে তুমি বিষন্ন ফুল,তোমার পায়ের শব্দে আমি ছিন্ন ভিন্ন, বিষাদ ছুঁয়েছে আজ ,মন ভাল নেই,মনে কেন কাঁদে, কোথায় যাই, কার কাছে যাই, বহুদিন ভালবাসাহীন,কেউ ভালবাসে না, কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ, সুন্দরের হাতে আজ হাত কড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া, অন্তহীন নেতৃত্বের মহড়া, অর্ধেক ডুবেছি প্রেমে, অর্ধেক বিরহ, এ বড়ো আনন্দ, এ বড়ো বেদনা, লাজুক লিরিক, একা হয়ে যাও “ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্যের গাঁথুনি দিয়ে কবিতা সাজিয়ে কাব্যগ্রন্থগুলো যিনি লিখেছেন তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলা সাহিত্য জগতের অন্যতম নক্ষত্র কবি মহাদেব সাহা।বাংলা কবিতাকে যিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, করেছেন উপন্যাসসম জনপ্রিয়। প্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা।মানুষের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা-কষ্ট, বেদনা-বিরহ, একাকিত্ব ও সমাজ বাস্তবতায় তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য।

বুকের ভিতর সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় পুষে রাখা বেদনা, বিরহ- একাকিত্ব জ্বলন্ত লাভার ন্যায় উদগীরিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।বাংলার কবিতার উবরতার মহাজাগরণ বলা হয়ে থাকে যে ষাটের দশককে,সেই ষাটের দশকের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা।রফিক আজাদ,নির্মলেন্দু গুণ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ রফিক প্রমুখ কবিদের সাথে কবিতার পথে মহাদেব সাহাও ষাটের দশকের সহযাত্রী।১৯৭২ সালে “এ গৃহে এ সন্নাস্যে” কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কবিতার পথের যে যাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন তা আজও চলমান, আজ ও অগণিত পাঠক হৃদয় আলোড়িত হয় তার কবিতায়।তাঁর কবিতার নেশায় বুদ হয়ে থাকে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা।

১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার ধানগড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন কবি মহাদেব সাহা।সাহিত্য অনুরাগী পিতা গদাধর সাহার বাড়িতে আসত তৎকালীন সময়ের মাসিক বসুমতী সংবাদ, দৈনিক লোকসেবক, বাইউইকলি অমৃতবাজার পত্রিকা,কলকাতার পিএম, বাগচী ও এক্সপ্রেস পঞ্জিকা।
বগুড়ার ধনুট হাইস্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন কবি মহাদেব সাহা। উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেও শারীরিক অসুস্থতা কারণে ফিরে গিয়ে ভর্তি হন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে। আজিজুল হক কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে ১৯৬৭ সালে অনার্স শেষ করে পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাংলা সাহিত্যেই মাস্টার্স পাশ করেন।পড়শুনা শেষে ইংরেজি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত হলে কবিতা লেখার অদম্য ইচ্ছা গবেষণা ছাড়তে বাধ্য করে তাকে। পরবর্তী ঢাকায় এসে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সহায়তায় তৎকালীন সময়ের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় যোগদান করেন।মহাদেব সাহা বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন এবং দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় থেকে অবসর গ্রহণ করে সাংবাদিকতা থেকে অবসন নেন।

বাংলাসাহিত্য তথা কবিতার জগতের একজন শুদ্ধতম সাধক মহাদেব সাহা। কবিতার অন্যতম পূজারী এই মানুষটার ধ্যানে ও প্রানেই যেন কবিতা। বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন সহজ সরল প্রঞ্জালরূপ।সহজ সরল অভিব্যক্তিতেই প্রায় শকতের কাছাকাছি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি।তার কবিতার তীব্রজীবন বোধ,গভীর ভাবাবেগ, অনুভূতি সংসবেদনশীলতা পাঠহৃদয়কে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।যার কারণে তার কবিতার জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পশী। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তাইতো বলেছেন , আমি অবাক হয়ে যায় মহাদেবের কাব্যগ্রন্থগুলো উপন্যাসের মত জনপ্রিয় এবং প্রত্যেক বছর বই মেলাতে কবিতার বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণ বের হয়।
শৈশবে ফুলেজোড়া নদীর তীরে বেড়ে ওঠা মহাদেব সাহার কবিতায় প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গ যেন সুনিপুণ ভাবে ফুটে ওঠে।বাংলার নদী,জল, ফুল -ফল পাখি সবকিছুকেই ভালবেসে পর মমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। বর্ষার কদম. শরতের আকাশ ও কাশফুল এবং বসন্তের কোকিলের ডাক প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানকে কবি ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়।হুতুম পেঁচার ডাক, ঘুঘুর ডাক,দোয়েল-শালিখ,সুবজ গ্রাম, পদ্মদিঘী,ধুলোউড়া পথ, ক্লান্ত মহিষ,শুকিয়ে যাওয়া খাল, টিনের চাল প্রভৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়। তার কবিতায় গোলাপ স্বর্ণচাপা, জুঁই, বেলী, পদ্ম, চামেলী থেকে শুরু করে অসংখ্য ফুলের নাম যেমন ব্যবহার করেছেন, ঠিক তেমনি কংস, খোয়াই, কুমার, সুরমা, বংশী, মেঘনা, পদ্মা, কীর্তনখোলা থেকে শুরু করে অসংখ্য নদীর নাম তার কবিতায় উঠে এসেছে। যেমনিভাবে উঠে এসেছে পাখি ও গাছের নাম। যেমন-চুড়ই, দোয়েল, শ্যামা, তিতির, শালিক, মাছরাঙাসহ অসংখ্য পাখি। আর গাছ হচ্ছে- দেবদারু, ঝাউ, শিমুল, পলাশ, শালবীথি, নিম, তুলসী, আমলকী পাকড় ইত্যাদি।মহাদেব সাহার আমার সোনার বাংলা,আমার সুবজ গ্রাম, যেতে যেতে অরণ্যকে বলি, তাকেই বলি প্রকৃতি, পাখরি শায়ন প্রভৃতি কবিতায় সুনিপুনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান বা অনুষঙ্গ।
প্রকৃতির কবি মহাদেব সাহা প্রকৃতি ও প্রেমের অররূপ সমন্বয় ঘটিয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রেম যে প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত এবং প্রাকৃতিক বিষয় তা তার কবিতা থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান ।তাঁর পঙ্কতি
শীত খুব তোমার পছন্দ, কিন্তু আমি
শীত-গ্রীষ্ম-বসন্তের চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসি;
যে-কোনো ঋতু ও মাস, বৃষ্টি কিংবা বরফের চেয়ে
মনোরম তোমার সান্নিধ্য, আমি তাই
কার্ডিগান নয় বুকের উষ্ণতা দিয়ে ঢেকে দেই
তোমার শরীর-
(কবিতা এই শীতে আমি হই তোমার উদ্ভিদ)
স্বভাবে লাজুক কিন্তু প্রেমাঙ্গনের অসম্ভব সাহসী কবি মহাদেব সাহা তার কবিতায় প্রেমিকার প্রভৃতি গভীর হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেছেন। প্রেমিকার বিরহ, শূণ্যতা, না পওয়ার বেদনা ও একাকিত্বকে তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন প্রধান উপজীব্য হিসেবে। আজকের এই সোসালমিডিয়ার যুগে চিঠির গুরুত্ব হারালেও একসময়কার প্রেমের অন্যতম মাধ্যম চিঠির সাথে প্রেমের নিবিড় বন্ধনকে তিনি তার কবিতায় তুলেছেন। কবিতায় তিনি বলেছেন-
করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিওআঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি।
(কবিতা :চিঠি )
একাকিত্বকে পরম মমতায় ভালবাসেন কবি। নিজে যেমন একাকিত্তকে ভালবাসেন ঠিক তেমনি তাঁর প্রেমিকাকেও একাকিত্ত্ব অনুভব করার উদত্য আহবান জানিয়েছেন কবি তাঁর কবিতায়।
একা হয়ে যাও, নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
ঠিক দুঃখমগ্ন অসহায় কয়েদীর মতো
নির্জন নদীর মতো,
তুমি আরো পৃথক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও
স্বাধীন স্বতন্ত্র হয়ে যাও
খণ্ড খণ্ড ইওরোপের মানচিত্রের মতো;
একা হয়ে যাও সব সঙ্গ থেকে, উন্মাদনা থেকে
আকাশের সর্বশেষ উদাস পাখির মতো,
নির্জন নিস্তব্ধ মৌন পাহাড়ের মতো
একা হয়ে যাও।
কবি মহাদেব সাহাকে প্রেম, প্রকৃতি ও একাকিত্বের কবি বলা হলেও যাপিত জীবনের রূঢ় বাস্তবতা ও সমাজ বাস্তবতা থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন নি। বরং সমাজ প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনা সংবেদনশীল কবি হৃদয়কে আলোড়িত করে।তাইতো কবি কবিতায় বলেছেন-
এ-কী বৈরী যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সকলে
সূর্য নিয়ত ঢাকা চিররাহুগ্রাসে, মানবিক
প্রশান্ত বাতাস এখন বয় না কোনখানে
শুধু সর্বত্র বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব;
তাদের কদর্য চিৎকারে ফেটে যায় কান,
চোখ হয়ে যায় কী ভীষণ রক্তজবা, সহসা
দিগন্ত জুড়ে নেমে আসে ঘোর সন্ধ্যার আঁধার।
( কবিতা: যদুবংশ ধ্বংসের আগে \ মহাদেব সাহা)
দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও মহাদেব সাহার কবিতার অন্যতম বিষয়বস্তু হিসেবে আমার দেখে থাকি।মাতৃভূমিকে ভালবেসে তিনি রাজনৈতিক ও সমাজিক নানা উপাদানকে উপজীব্য করে কবিতা লিখে গেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে সাহস দিয়েছেন তিনি কবিতার মাধ্যমে। বাংলা ও বাঙালির অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে গভীর ভাবে ভালবেসে লিখেছেন কবিতা। গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা, তোমার বাড়ি, তোমার অভাবে এই স্বাধীনত আমি কি বলতে পেরেছিলাম, কফিন কাহিনীর মত কবিতাগুলো।
কবি বলেছিলেন আমি আমার সমস্ত কবিত্বশক্তি উজাড় করে যে কবিতা লিখেছি,তার নাম শেখ মুজিব
যে-কবিতা লিখেছি তার নাম শেখ মুজিব, এই মুহূর্তে আর কোনো নতুন কবিতা লিখতে পারবো না আমি
কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল শাপলা-পদ্ম-গোলাপ- সেই গোলাপের বুক জুড়ে
ফুটে আছে মুজিবের মুখ
এ দেশের প্রতিটি পাখির গানে মুজিবের প্রিয় নাম শুনি, মনে হয় এরা সকলেই আমার চেয়ে আরো বড়ো কবি।
শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা
মুজিব গোলাপ হয়ে ফোটে, লালপদ্ম হয়ে ফোটে
হৃদয়ে হৃদয়ে;
আমার না-লেখা প্রতিটি নতুন কবিতা জুড়ে
গাঁথা আছে তার নাম, তার মুখচ্ছবিলিখি বা না-লিখি শেখ মুজিব বাংলাভাষায় প্রতিটি নতুন কবিতা।
(শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা)
কবিতার উপজীব্য হিসেবে কেবল বঙ্গবন্ধুকে বেচে নেননি কবি,গভীর শ্রদ্ধাবোদ থেকে এবং বঙ্গবন্ধুকে পূজনীয় মেনেই কবিতা লিখেছেন মহাদেব সাহা।
প্রকৃতি,প্রেম আর একাকিত্ত্ব কিংবা বিরহের কবি হিসেবে পরিচিতি পেলেও কবি মহাদেব সাহা আপদমস্তক একজন পূণাঙ্গ কবি যিনি সমাজ বাস্তবতা, যাপিত জীবনের বাস্তবতা, দেশপ্রেম, স্বদেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধকেও কবিতার প্রধান উপজীব্য হিসেবে নিয়ে এখন পূর্ণাদ্যমে কবিতা লিখে চলেছেন। ৫ আগস্ট প্রণয়সিন্ধু মন্থনের কবি, প্রেমাঙ্গনে সাহসী কবি ,গভীর জীবনবোধের কবিত মহাদেব সাহার জন্মদিন। জন্মদিনে শ্রদ্ধা অপর্ন করি কবি তোমার প্রতি।
তথ্যসূত্র:
মহাদেব সাহার কাব্য সমগ্র (১ম থেকে ৫ম খন্ড)
ভোরর কাগজ সাময়িকী
প্রথমআলো সাময়িকী (শিল্প ও সাহিত্যা)
ইত্তেফাক সাময়িকী
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
শিল্প-সাহিত্য
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ৩)

Published
3 years agoon
January 25, 2020By
শফিক মুন্সি
“আমি বহুদিন যাবৎ মনে মনে এই আশাটি পোষণ করিতেছিলাম যে, ভারতীয় মুসলমানদের শৌর্য- বীর্য সংবলিত এমন একটি যুদ্ধকাব্য লিখিয়া যাইব, যাহা পাঠ করিয়া বঙ্গীয় মুসলমান স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারেন যে, এক সময়ে ভারতীয় মুসলমানগণও অদ্বিতীয় মহাবীর ছিলেন।”
— কায়কোবাদ
পূর্বের পর্বঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)
কলকাতার ঠাকুর বাড়ির পিছনে বিশাল আমবাগান। গ্রীস্মের দুপুর গুলোর প্রায়ই কাদম্বরী দেবী আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন। রবী ঠাকুর এই সময়টাতে নতুন কি লিখেছে তা শোনায় বৌদি কাদম্বরী কে। কিন্তু আজ দুদিন রবীন্দ্রনাথ আসছে না, মুখোমুখি হওয়াও বন্ধ প্রায়। হঠাৎ হঠাৎ এই দেবরটির কি যে হয় কাদম্বরী ঠিক বুঝতে পারে না। রবীকে কাদম্বরী মন থেকে স্নেহ করে কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় রবি বোধহয় আরেকটু বেশি চায়। অন্তত রবির চোখের চাহনি হঠাৎ অভিমান এসব তাই প্রকাশ করে। কিন্তু সে বেশিটুকুর পরিমাণ কাদম্বরী দেবী পরিমাপ করতে পারে না। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কাদম্বরী মন থেকে ভালোবাসে। আশেপাশের সবাই যখন নারীকে শুধু অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে দেখে তখন তাঁর স্বামী তাকে নারী স্বাধীনতা উপভোগ করাচ্ছেন। সমাজের নাক সিটকানি উপেক্ষা করে কাদম্বরী দেবীকে বাড়ির অন্দর থেকে বাইরে এনেছেন তিনি। তবে ব্যাপারটাতে সবাই যে একযোগে বাঁকা চোখে দেখছে তা নয়। কেউ কেউ জ্যোতিকে বাহবাও দিচ্ছে। ভারতবর্ষের সামাজিক পরিবর্তন আনতে গেলে যে নারী-পুরুষ সকল সামাজিক জীবেরই জীবন – যাপন, মনন – চিন্তার পরিবর্তন আনতে হবে এটা বুঝতে পারারাই বাহবা দেবার দলে। ভারতে স্বদেশী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির ভুমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে দীর্ঘকাল ভারতীয় উপমহাদেশে দেশীয় রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সেই চেতনার যোগাযোগ সৃষ্টিতে ঠাকুর পরিবারের একাধিক সদস্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (৪ মে ১৮৪৯ – ৪ মার্চ ১৯২৫) উল্লেখযোগ্য।
ছবিঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে বাঙালির সামাজিক জাগরণ তথা স্বাদেশিকতার রাজনৈতিক ও সাহিত্য মূল্য অনেক। এই জাগরণের ধারা শুরু হয় নবগোপাল মিত্রের “হিন্দুমেলা” (১৮৬৭), কেশবচন্দ্র সেনের “ভারতসংস্কার” (১৮৭০), মহেন্দ্র লাল সরকারের “ভারতীয় বিজ্ঞান সভা” (১৮৭৬) প্রভৃতির মাধ্যমে।জ্যোতি ঠাকুর তার সময়ে এই নবজাগ্রত স্বাদেশিকতার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে অনুবাদক হিসেবে তিনি যেমন পথ দেখিয়ে গেছেন তেমনি রাজনীতিতে রেখে গেছেন সংস্কারকের ভূমিকা। ভারতীয় সমাজ থেকে ইংরেজ প্রাদুর্ভাব দূরীকরণে, স্বদেশী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার চেষ্টায়, হিন্দু মেলার সংগঠনে কিংবা আদি ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে জ্যোতি ঠাকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে অনেকে। এত রাজনৈতিক ব্যাস্ততার মাঝেও একের পর এক ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্য কর্মের বাংলা অনুবাদ করেছেন তিনি। শেকসপিয়ারের “জুলিয়াস সিজার” তিনিই প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৮৮৪ সালে স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর থেকে হঠাৎ করেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন সকল ব্যাস্ততা থেকে। এমনটা না হলে হয়তো বাংলার সাহিত্য কিংবা রাজনীতি, দু জায়গার কোথাও থিতু হয়ে ইতিহাসে আরো রঙ ছড়াতেন তিনি।বাংলার নাট্য অনুবাদে এই মানুষটি থাকবেন সবসময় প্রথিতযশা হয়ে। তবে বাংলা নাটকে স্বাদেশিকতার উত্তেজিত মন্ত্রের প্রবেশ ঘটান উপেন্দ্র নাথ দাস (১৮৪৮-৯৫)। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী এইসব উত্তেজনা দমনে সরকার “ড্রামাটিক পারফরম্যান্স এক্ট” (১৮৭৬) পাস করতে বাধ্য হয়। উপেন্দ্রনাথের “শরৎ সরোজিনী” (১৮৭৪) ও “সুরেন্দ্র – বিনোদিনী” (১৮৭৫) নাটক দুটিতে সরাসরি ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো হয়।
বিংশ শতকের শুরুর সময় থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্য সমাজ মিলেমিশে নতুন দিক প্রশস্ত করেছিল। মোঘল শাসনের পর থেকে পাদপ্রদীপের আলো থেকে সর্বক্ষেত্রে দূরে থাকা মুসলিম সমাজ সাহিত্য ও রাজনীতি দুই মাধ্যমেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। আবার সাহিত্য সমাজে স্বদেশী চেতনার উত্তেজিত মন্ত্রের প্রবেশ ঘটান কেউ কেউ। বড় ভাই জ্যোতি ঠাকুরের হাত ধরে বিদেশি সমাজ চেতনার একটি পরিচয় যেমনি দেশী সাহিত্য প্রেমীরা পেতে থাকে তেমনি বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হবার প্রারম্ভে ছোটভাই রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষেরাও চিনতে শুরু করে। গত দুটি পর্বে প্রথম বঙ্গভঙ্গ আর বঙ্গভঙ্গ রদের অপরাপর সময়ে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখন ওই সময়ের সাহিত্য সমাজের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ উত্থান নিয়ে আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে বিংশ শতকের শুরুর দিকের একটি বিদেশি ঘটনার প্রতি আলোকপাত করা উচিত। ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন ভারতীয় “নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস” প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। সেখানে ভারতীয়দের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯ – ১৯৪৮)। যিনি পরবর্তীতে মহাত্মা (মহান আত্না) গান্ধী নামে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হন এবং ভারতের জাতির জনক হিসেবে যার জীবনাবসান ঘটে। এই মহান ব্যাক্তিকে নিয়েও আলোচনা করা হবে তবে এখনি না, যথাসময়ে।
ছবিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রবেশ ঘটতে থাকে শিক্ষিত সমাজের হাত ধরে। তৎকালীন বিদেশ ঘুরে আসা শিক্ষিত জনদের মাঝে বেন্থাম- মিল – কোমট – রুশোর মতবাদের প্রচলন শুরু হয়।এরপর রামকৃষ্ণ – বিবেকানন্দদের শিক্ষা এবং গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শ প্রধান হয়ে দেখা দেয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের(১৮১২-১৮৫৯) সম্পাদনায় বাংলার প্রথম দৈনিক “সংবাদ প্রভাকর” (সাপ্তাহিক ১৮৩১, দৈনিক ১৮৩৯) যাত্রা শুরু করে। বাংলার নবজাগরণ ও নীল বিদ্রোহের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলে পত্রিকাটি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি ঘিরে পরবর্তীতে একঝাঁক জাতীয়তাবাদী চেতনাধারী কবি – সাহিত্যিকদের উদ্ভব হয় বাংলায়। এদের মধ্যে মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) অন্যতম। গুপ্তবাবুর শিক্ষা সংস্কার, ধর্মসংস্কার প্রভৃতি মনোমোহন বসুকে আন্দোলিত করে। এদেশে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক আগ্রাসনের তিনি বিরোধী ছিলেন। তাইতো লিখেছিলেন, “ইউরোপীয় সমাজ আর স্বদেশীয় সমাজ বিস্তর ভিন্ন। ইউরোপীয় রুচি ও দেশীয় রুচি যে সম্যক স্বতন্ত্র পদার্থ তাহা অনেকে ভাবিয়া দেখেন না “। ঐ সময়ে নাটকে ইংরেজি নাট্যাদর্শের প্রচলন শুরু হয়েছিল। এর বিপরীতে গিয়ে বসু বাবু নাটকে বাংলা কবি যাত্রার প্রচলন ঘটায়। নাটকের নতুন এই দেশীয় ধাস বাঙালির রাজনৈতিক চেতনাকে নাড়া দিয়েছিলো। তাঁর “হরিশ চন্দ্র” (১৮৭৫) নাটকে ধর্মীয় ভক্তিরসের সঙ্গে হিন্দুমেলার জাতীয়তাবাদী স্বাদেশিকতার সুরটিও বেজেছে।
দীর্ঘদিন সাহিত্য সমাজের নেতৃত্ব থেকে মুসলমানদের দূরে থাকার সমাপ্তি ঘটে বিংশ শতকে। মহাকাব্য “মহাশ্মশান” (১৯০৪) লিখে মহাকবির মর্যাদা পেয়েছিলেন কায়কোবাদ। তাঁর পুর্ণ নাম কাজেম আল কোরেশি।
তৎকালীন রাজনৈতিক সমাজে হীন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খোঁজার জন্য মুসলমান নেতৃবৃন্দকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তাঁর সাহিত্য কর্ম। “মহররম শরীফ” (১৯৩৩) কায়কোবাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা যার দরুন বাংলার রাজনৈতিক সমাজে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। বাংলা সাহিত্যের হিন্দুত্ববাদী দখলের বিপরীতে তিনিই প্রথম শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হন। মুসলমান সাহিত্যিক হলেও সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর চেতনা প্রসারে লেখকসমাজে কায়কোবাদের জনপ্রিয়তাও ছিল অগ্রগণ্য। কারবালার যুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলীকে প্রেক্ষাপট বানিয়ে হামিদ আলী (১৮৭৪-১৯৫৪) দুটি মহাকাব্য লেখেন। তাঁর “কাসেমবদ কাব্য” (১৯০৫) ও “জয়নালোদ্ধার কাব্য ” (১৯০৭) রচনাগুণে উন্নত না হলেও বাংলা সাহিত্যে মুসলিম প্রতিনিধিত্বে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে মুসলিম রক্ষণশীল চেতনা থেকে বেড়িয়ে এসে দেহধর্মী প্রণয় কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন মোজাম্মেল হক(১৮৬০-১৯৩০)। তিনি “লহরী” নামে একটি কবিতার পত্রিকা বের করা শুরু করেছিলেন। “মোসলেম ভারত” (১৯২০) সাহিত্য পত্রিকার তিনি ছিলেন সম্পাদক। ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম লেখকদের বিকাশে পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা রাখলেও হিন্দু লেখকদেরও সম্মিলন ঘটেছিলো সেখানে। এমনকি পত্রিকার প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীও সংযোজিত ছিল। মোজাম্মেল হক রচিত জীবনীকাব্য “হযরত মোহাম্মদ” (১৯০৩) সে সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
আর এভাবেই বিংশ শতকের গোড়াতেই বাংলার মানুষ রাজনীতির ময়দানে বঙ্গভঙ্গ আর বঙ্গভঙ্গ রদের সাথে সাথে সাহিত্য সমাজের রাজনৈতিক সংসর্গের সাক্ষী হয়। ১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীনতম নিদর্শন “চর্যাপদ” আবিস্কৃত হয়।
ছবিঃ চর্যাপদ
নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে এটি আবিষ্কার করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (৬ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ – ১৭ নভেম্বর, ১৯৩১) । তার আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য।তবে বাঙালির সাহিত্য সমাজের সবচেয়ে বড় ঘটনা তখনো ঘটে নি। একজন বাঙালি প্রথম নন ইউরোপীয় হিসেবে প্রথমবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাহিত্য স্বীকৃতি অর্জন করে নেয় কিছু পরে। তাঁর এই অর্জনের পরপরই বাঙালি সাহিত্য তথা সমাজের ওপর নজর পড়ে ইউরোপীয় সাধারণ জনগণের। পৃথিবীব্যাপী মানুষেরা “বাংলা” নামটি শুনতে পারে গৌরব আর অর্জনের অংশ হিসেবে। আমাদের ভাষায় কথা বলা, কবিতা লেখা, জাতীয়তাবাদী বক্তব্য দেওয়া একজন মানুষ “বিশ্বকবি” হিসেবে আবির্ভূত হওয়া শুরু করে এই অর্জনের ঘটনার পর। তাই এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব অনেক। তবে সে গল্প এখন আর নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের হাড়হীম করা রাজনৈতিক গল্পগুলো আসছে সামনের পর্বে।
(চলবে…)
লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
শিল্প-সাহিত্য
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)

Published
3 years agoon
January 21, 2020By
শফিক মুন্সি
(পূর্বের পর্ব >> আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১) )
“… অইরে মোসলেম! দেখরে চাহিয়া
নির্জীব যে জাতি তারাও সাজিয়া
তারাও কেমন সাহস ধরিয়া
উন্নতির পথে ধাইছে ছুটি।
তোমাদের তরে নিদ্রিত দেখিয়া
প্রকাশ্যে তোদেরে অবজ্ঞা করিয়া
দেখরে কেমন চলিছে ছুটিয়া
দেখরে মেলিয়া নয়ন দুটি।”
— ইসমাইল হোসেন সিরাজী
ছবি : সংগৃহীত
কদিন ধরে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ির ছাদে প্রায় বিকেলে কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে গল্প করতে দেখা যায় একজন ভদ্রমহিলাকে। মূলত তাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জোঁড়া সাকোর এ বাড়ি থেকে জন্ম নেওয়া সাহিত্য পত্রিকা ‘ভারতী’ নিয়ে। ভদ্রমহিলাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ আগস্ট ১৮৫৫ – ৩ জুলাই ১৯৯২)। এই নারী ১৮৭৬ সালে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে লিখে ফেলেন ‘ দীপনির্বাণ ‘ উপন্যাস। এটি প্রকাশের মাধ্যমে রাজনীতি সচেতন এই সাহিত্যিক লাভ করেন প্রথম বাঙালী নারী ঔপন্যাসিক হবার মর্যাদা। একজন নারীর এই সাহিত্যিক হয়ে ওঠা তৎকালীন নারী সমাজে বৃহৎ আলোচনার সৃষ্টি করে। স্বর্ণ দেবীর প্রথম উপন্যাসটি তাই স্বভাবতই নারী সমাজে পঠিত হতে থাকে বেশি সংখ্যায়।নিজেদের স্বাতন্ত্র্য জাতীয়তাবাদী একটি ভাবধারা তৎকালীন নারীসমাজে প্রবেশ করাতে স্বর্ণ দেবীর রাজনৈতিক ভূমিকা অনেক৷ পাঠিকা সমাজ যে বঙ্গভঙ্গ সহ ব্রিটিশ বিরোধী একটি চেতনা নিজেদের মননে গড়ে তুলছিল সে অবদান স্বর্ণ দেবীর অনেকখানি।
ওদিকে লর্ড ডালহৌসি সাহেব লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে নতুন বাংলা প্রদেশ গঠন করে বসে আছেন ১৮৫৪ সালে। এর ঠিক চার বছর পরই প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত ধরে প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল'(১৮৫৮) প্রকাশিত হয়ে গেলো। এই ১৮৫৮ সালটি বিভিন্ন কারণে ভারতীয় রাজনীতি ও বাংলার সাহিত্য ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এবছরই বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের(২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩) আবির্ভাব আবার ‘ভারত শাসন আইন ১৮৫৮’ করার মাধ্যমে কোম্পানির শাসনের বদলে ভারতবর্ষে শুরু হয় রাণীর শাসন। মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে বিপ্লব সৃষ্টি করেন অন্যদিকে সেই সময়ে সিপাহীদের বিপ্লবের ফলেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়।অমিত্রাক্ষরছন্দে রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য ‘ (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ রচনা।আর এই মেঘনাদবধ কাব্যের সময় থেকেই আধুনিক সাহিত্যের বিকাশকাল শুরু।১৮৬১ সালে বাংলা সাহিত্যের সাথে সাথে ভারতের সরকার ব্যাবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। ‘ভারতীয় কাউন্সিল এক্ট ১৮৬১ ‘ এর মাধ্যমে সরকার গঠনে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রবেশের প্রাথমিক রাস্তার সৃষ্টি হয়।মেঘনাদবধ কাব্য রচনার কিছুকাল পরে মাইকেল মধুুসূদন দত্ত প্রবাসে বসে সনেট লিখতে শুরু করেন, যা চতুর্দশপদী কবিতাবলি নামে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। বলা হয় বাস্তবে মধুসূদনের দ্বারাই বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়। এদেশের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে এবং বিশ্বসমাজে আমাদেরকে আলোচনায় আনতে মধুসূদনই প্রথম ভুমিকা রেখেছেন। অন্যদিকে মধুসূদনের হাত ধরেই পশ্চিমের শিল্প – সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঢেউ আমাদের সাহিত্য সমাজে সর্বপ্রথম আছড়ে পড়া শুরু করে। যে ঢেউ পরবর্তীতে বাংলার রাজনৈতিক চেতনাকেও শানিত করেছে।

আমাদের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” বঙ্গভঙ্গের সময়েই রচিত। কুষ্টিয়ার বাউল গগন হরকরার “আমি কোথায় পাব তারে” গানের সুরেই রবীন্দ্রনাথ “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুর করেন।গিরিশচন্দ্র ঘোষ (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৪ – ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক ও নট। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তারই অবদান।ইংরেজি নামের নাট্যদলের ভিড়ে ১৮৭২ সালে তিনিই প্রথম বাংলা পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটকগুলো সেসময়ে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে সিরাজুদ্দৌলা, মীর কাসিম, ছত্রপতি শিবাজি প্রভৃতি উল্লেখ্য। আরেক সঙ্গীতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও (১৯ জুলাই ১৮৬৩ – ১৭ মে ১৯১৩) ঐ সময়ে জাতীয়তাবাদি চেতনা প্রচারে কাজ করেছেন। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন।এই গানগুলি বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি না
বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন সৃষ্ট বাংলার রাজনীতিকে ব্রিটিশদের মনমর্জি মতো পরিচালনা করা গেলেও কেনা যায় নি সাহিত্য সমাজকে। আর এই কারণেই সাহিত্যের সঙ্গে সেসময়ের ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক অন্যরকম মেলবন্ধনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়। পুরো বাংলার সাহিত্য সমাজই প্রধানত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনকি সেসময়কার বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০ – ১৯৩১) বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই সিরাজী ছিলেন ১৯ ও ২০ শতকে বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন। তিনি মুসলিমদের জন্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা, নারীদের শিক্ষা এসবের পক্ষে লেখালেখি করেন। তার ‘অনল-প্রবাহ'(১৯০০) কাব্যগ্
লেখকঃ শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
(পরবর্তী পর্বঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ৩) )
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
শিল্প-সাহিত্য
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)

Published
3 years agoon
January 20, 2020By
শফিক মুন্সি
“বঙ্গভঙ্গের পরই ভারতের প্রকৃত জাগরণ ঘটেছে” -মহাত্মা গান্ধী। “




এ সময়ে রবীন্দ্র সাহিত্য কর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণুতাবাদ ও কলাকৈবল্যবাদ এর উদ্ভব। পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য গর্ভে জন্ম নেওয়া এ বিশেষ দুটি শাখা স্বল্প মাত্রায় প্রবেশ করতে থাকে বাংলা সাহিত্যে। কলাকৈবল্যবাদের প্রধান বক্তব্য ছিল – ” আর্টের সঙ্গে বাস্তব ইউটিলিটির কোনো সম্পর্ক নেই “।ক্ষয়িষ্ণুবাদের বিষয়বস্তু ছিল সুপরিকল্পিতভাবে সকল আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে একটা প্রচন্ড ওলট-পালট ও বিপর্যয় আনা। তাই জীবনের স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছলতাকে এড়িয়ে এই ধারার শিল্পীরা তাদের সৃষ্টিতে প্রবেশ করান কৃত্রিম সাজসজ্জা, মাদকদ্রব্য, বিকৃত মানবিক সম্পর্ক ও অস্বাভাবিক যৌন আচরণের। বিদেশি সবকিছু বর্জনের যে ডাক রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন নিজের সাহিত্য কর্মে সেটা নিজেই রক্ষা করতে পারেন নি। তবে তাঁর সাহিত্যকর্মে কলাকৈবল্যবাদ ও ক্ষয়িষ্ণুবাদের প্রভাব ছিল যৎসামান্য। তাঁর রচিত ‘ঘরে বাইরে ‘ উপন্যাসে তৎকালীন ব্রিটিশ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী চেতনা যেমন প্রকাশ পেয়েছে ঠিক তেমনি কলাকৈবল্যবাদ ও ক্ষয়িষ্ণুবাদও ধরা দিয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায় স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও স্ত্রী বিমলা বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা তীব্রভাবে আকর্ষিত। আবার সন্দীপের মানবিক দোষত্রুটি, বিকৃত লোভ এবং পরস্ত্রী কাতরতার মতো অস্বাভাবিক যৌন আচরণের অনুভূতিও গল্পে মিলেমিশে একাকার।
০১/ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন ও মোঃ মাহবুবর রহমান।
০২/ বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন – ড. হারুন অর রশিদ।
০৩/ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ – কুলদা রায় ও এম এম আর জালাল।
০৪/ অগ্নিযুগের সাহিত্য – রকিবুল হাসান।
০৫/ The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar
০৬/From Plassey to Partition – A History of Modern India (2004), Sekhar Bandyopadhyay
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
সর্বাধিক পঠিত
-
ইতিহাস4 years ago
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তিদের ভূমিকা
-
অন্যান্য3 years ago
উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়ন
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
শব্দশ্রমিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
-
বাংলাদেশ4 years ago
বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
-
ইতিহাস3 years ago
সম্রাট শাহজাহানঃ সৌন্দর্য্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ২)