Connect with us

সিনেমা পাড়ায়

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি

Published

on

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি

আনন্দ কুমার ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনার অদূরের এক মলিন গ্রামের কলেজ পড়ুয়া যুবক। অসম্ভম মেধাবী এবং গণিতে অসম্ভব দক্ষ আনন্দ কুমারের বাবা একজন ডাকপিয়ন। গণিত এবং ঋতু তার জীবনের দুই ভালবাসা। কলেজের প্রতিযোগিতায় প্রখ্যাত গণিতবিদ রামনুযান পদক পাওয়া আনন্দ কুমারকে নিয়ে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রীও আশাবাদী এবং ভবিষ্যতে সব ধরণের সহয়তা করার আশ্বাস দেন।

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি
বাস্তব আনন্দ কুমার ও পর্দার আনন্দ কুমার ঋুত্ত্বিক , ছবি : সংগৃহীত

গণিতের পাগল আনন্দ কুমার লাইর্বেরীতে গিয়ে বিদেশী জানার্লে প্রকাশিত গণিতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে থাকে। লাইব্রেরীর কর্মকর্তা যখন আবিষ্কার করল লাইব্রেরী কার্ড ছড়াই লাইব্রেরীতে তার অযাচিত প্রবেশ, তখন বিদেশী জার্নাল কেড়ে নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের করে দিল তাকে। লাইব্রেরী থেকে বের করে দেওয়ার সময় এক কর্মচারী তাকে পরামর্শ দিল জানার্লে তার লেখা ছাপাতে, তাহলে সে জার্নাল ফ্রিতেই পাবে।


রাজার ছেলে রাজ হবে এই দর্শনে কখনই বিশ্বাসী নয় আনন্দ কুমার ও তার বাবা। অর্থনৈতিক ভাবে অস্চ্ছল হলেও তারা বিশ্বাস করে প্রকৃত মেধাবী ও হকদারই প্রকৃত স্থান তথা যোগ্যতম স্থানের অধিকারী। আর তাই জার্নাালের জন্য লেখা পাঠাতে আনন্দ কুমার ডাকঘারে আসলে তার বাবাকে এক কর্মচারী ব্যঙ্গ করলে তখন তার মোক্ষম জবাব দিয়ে দেন।

বেশ কিছু দিনপর বিশ্ববিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ডসনের চিঠির মাধ্যমে কেমব্রিজে ভর্তির জন্য ডাক পায় আনন্দ কুমার। কিন্তু স্বপ্নের দেশ ইংল্যান্ডের স্বপ্নের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে যে লাগবে অনেক অর্থ। শুরু হয়ে যায় অর্থ জোগাড়ের সংগ্রাম। রাজ্যের যে শিক্ষা মন্ত্রী তাকে সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দেয় তার কাছে গেলেও পায় অর্থের বদলে অযাচিত উপদেশ।

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি
পাপড় বিক্রেতা আনন্দ কুমার, ছবি: সংগৃহীত

মন্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাখত আনন্দ কুমারের বাবা যখন ছেলেকে কেমব্রিজে পাঠাতে ব্যর্থ হয় তখন একদিন হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় ।
বাবার এই করুণ মৃত্যু আনন্দ কুমারের কেমব্রিজে যাওয়া স্বপ্নকে শুধু ফ্যাকাশে করে দেয় না বরং পরিবারের জীবিকার তাগিদে একজন পাপড় বিক্রেতায় পরিণত করে। দশ রুপিতে জোড়া পাপড় বিক্রি করতে করতে একদিন কেমব্রিজের ভর্তি ফরমটিও পাপড়ের মোড়ক হিসেবে দিয়ে দেয় আনন্দ কুমার।

কলেজের বড় ভাই এবং মন্ত্রীর সহযোগী ললন শিং একদিন গণিতের মেধাবী ছাত্র আনন্দ কুমারকে পাপড় বিক্রেতা হিসেবে আবিষ্কার করে। ললন সিং তাকে নিয়ে যায় তার এক্সসেলেন্স একাডেমীতে এবং টিচার হিসেবে পড়ানোর সুযোগ করে দেয়। গণিতের সেরা ছাত্র আনন্দ কুমার শিক্ষক হিসেবে যোগদানের ফলে আই,আইটি ভর্তি কোচিং এক্সসেলেন্স একাডেমীর ছাত্র সংখ্যাও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আনন্দ কুমারের জীবনেও স্বচ্ছলতাফিরে আসে।


একদিন রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটি ছেলেকে পড়তে দেখে আনন্দ কুমারের সম্বিত ফিরে পায়। রাজা ছেলে রাজ নয় মেধার সাথে অর্থের জয় নয় বরং হকদারই যোগ্যতম জায়গায় অধিকারী বাবার সেই দর্শনের কথা মনে পড়ে তার।

বিলাসী ও ব্যয় বহুল এক্সসেলেন্স একাডেমীতে পড়ানো ছেড়ে দেন আনন্দ কুমার। শুরু হয় এক সংগ্রাম, এক লড়াইয়ের। এই লড়াই মেধার সামনে অর্থের লড়াই এই লড়াই সমাজের অর্থলোভী, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে এক মেধাবী গণিতবিদের লড়াই।
ভারতের স্বনামধন্য ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ ‘ইন্ডিয়ান ইনিস্টি্িটউট অফ টেকনলজিতে’ যোগ্য ও মেধাবীদের পৌচ্ছে দিতে আনন্দ কুমারে শুরু করেন এক অভিনব স্কুলের যার নাম সুপার থার্টি।

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি
ছবি :সংগৃহীত


সমাজের সুবিধা বঞ্চিত কিন্তু মেধাবী ত্রিশ শিক্ষার্থীকে আাইআইটিতে পৌচ্ছে দিতে শুরু করেন এক অভিনব পাঠদান পদ্ধতির। যেখানে বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় বাস্তবতার নিরিখে ছাত্রদেরকে পড়ান আনন্দ কুমার।


পদে পদে বাধা আসে, ললন সিং, মন্ত্রী মিলে আনন্দ কুমারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সুপার থার্টি এবং আনন্দ কুমার ও তার ভাই সম্মলিতিভাবে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দেয়। আর এক অসম সাহসিকতা ও সংগ্রামের ফসল হিসেবে আনন্দ কুমারের সুপার থার্টি পৌচ্ছে যায় আই আই টি এর ঝক ঝকে ক্যাম্পাসে ও শুরু হয় এক সোনালী অধ্যায়ের। এভাবেই জিতে যায় আনন্দ কুমার ও তার ছাত্ররা এবং মেধার সাথে অর্থের যুদ্ধে জিতে যায় মেধা।

এক লড়াকু গণিতজ্ঞের আখ্যান সুপার থার্টি
সুপার ৩০ ও আনন্দ কুমার, ছবি :সংগৃহীত

গত ১৮ বছর ধরে ‘সুপার থার্টি’ কোচিং ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন আনন্দ। প্রতি বছর তিরিশ জন মেধাবীর জন্য অবৈতনিক কোচিং ক্লাস করান তিনি। এই ক্লাসের মধ্যে দিয়ে পড়ুয়াদের আইআইটির জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে পারে। তাঁর কোচিং ক্লাসের মধ্যে দিয়ে প্রচুর পড়ুয়া আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছেন। আর আনন্দ কুমার হয়ে উঠেছেন জাতি গড়ার প্রকৃত কারিগর।

২০১০ টাইম ম্যাগাজিন সুপার থার্টিকে এশিয়ার সেরা স্কুল ঘোষণা করে। নিউজ উইক আনন্দ কুমারের সুপার থার্টিকে বিশ্বের সেরা চারটি অভিনব স্কুুলের একটি ঘোষণা করে।

বিহারের এই বিখ্যাত জাতি গড়ার কারিগর আনন্দ কুমারের বাস্তবজীবনের গল্প রুপালী পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক বিকাশ বহেল। আর আনন্দ কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক রোশন। অভিনয় ও আখ্যান অন্যবদ। পঙ্কজ ত্রিবেদী ও আদিত্য শ্রীবাস্ততের অভিনয় অসাধারণ কিন্তু ঋত্তিক রোশন পুরোপুরি আনন্দ কুমার হয়ে উঠতে পেরেছে বলা যাবে না। সুপার থার্টির সিনেমাটোগ্রাফি মোটামুটি ভাল তবে সিনেমার দৈর্ঘ্য ২ ঘন্টা ৪৭ মিনিট বদলে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট হলে বোধহয় আর বেশি টান টান উত্তেজনা পূর্ণ হত।


যাইহোক সুপার থার্টিতে আপনি ডুবে থাকতে পারবেন আনন্দ কুমারের স্ট্রাগল দেখে। বার বার পড়ে গিয়ে তার ওঠা দেখে আপনার হয়তো মনে হবে এতো আমারই গল্প । শুধু নিজের সাথেই নয় আমাদের সমাজের এমন অনেক হারতে হারতে জিতে যাওয়া মানুষের গল্প মনে হবে আপনার।

আর আপনার হয়তো তখনই মনে হবে আহা আনন্দ কুমার জিতে যাক , জিতে যাক আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রথা ভাঙাতে গিয়ে বার বার পড়ে যাওযা মানুষ গুলো।
পরিচালক বিকাশ বহেলকে ধন্যবাদ দিতেই হয় আনন্দ কুমারের আখ্যানকে রূপালী পর্দায় এভাবে অন্যবদ্যভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার জন্য।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

সিনেমা পাড়ায়

ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন

Published

on

ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন

Brexit: The Uncivil War” – মুভিটা যতোটা না পলিটিকাল- তার চেয়েও বেশি আমাদের ভাবাবে বর্তমানের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় আধুনিকায়ন আর প্রযুক্তির ক্রমাগত জয়জয়কার নিয়ে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ব্রেক্সিট সম্পর্কে নিখাঁদ সত্য ফ্যাক্ট জানতে সরাসরি কোনো বিশ্বস্ত নিউজ,ডকুমেন্টারি বা বিশেষজ্ঞদের এনালাইসিস- সেসব স্টাডি করাই শ্রেয়। কোনো “ডকুড্রামাকে” সঠিক বলে ভেবে নেয়াটাও কি চরম বোকামির পথের প্রথম পদক্ষেপ না?

মুভিটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা “Exit of Britain” অর্থাৎ “ব্রেক্সিট”কে কেন্দ্র করে বানানো। এবং মূল চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন বেনেডিক্ট কম্বারব্যাচ, যদিও এরূপ “প্রোপাগান্ডা”মূলক বিতর্কিত ফিল্মে কেন তিনি কাজ করতে রাজি হলেন সেটা নিয়ে তার ভক্তদের মাঝের একাংশের মনে তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও গভীর হতাশা। বেনেডিক্টের এই সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক- সেটা নিয়ে এমন অনর্থক কাদা ছোড়াছুঁড়ি বাদ দিয়ে যদিই এরা নিজেদের সকল সিদ্ধান্ত নিজে বিচার করতে বসতো! আমাদের সকলের বর্তমান জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো “সোশ্যাল মিডিয়া”। আর, হোন আপনি চুনোপুঁটি বা বিশাল কোনো সেলেব্রিটি- আপনার একটা বড় পরিচয় আপনি যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রেই- “হয় কাস্টমার নয়তো পটেনশিয়াল কাস্টমার”। সো, আপনি যেইই হোন আপনার তথ্যাবলী বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির নিকট চরাদামে বিক্রি হওয়ার যোগ্য এবং আশঙ্কা করা হয় এসব তথ্য বিক্রি হচ্ছেও। আরও বড় ভাববার বিষয়- এসব তথ্য কেবল সাধারণ কোনো ড্রেস, বার্গার এরকম পণ্য বিক্রির জন্যই শুধু বিক্রি হয় না। বরং এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো রাজনৈতিক প্রচার প্রচারণার জন্য আপনার কাছেও আক্ষরিকভাবে বানানো ভুল তথ্য এনে বিক্রি করতে পারে। যখন কোনো প্রোডাক্ট আপনাকে ফ্রিতে দেয়া হয় তখন বুঝতে হবে প্রোডাক্ট আপনি নিজেই! তাই “ভার্চুয়াল লাইফ” বলে দিয়েই আপাত জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাকে এড়িয়ে যাওয়া বা গুরুত্ব না দেয়াটা- অবশ্যই কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন

ছবি : সংগৃহীত

মুভি প্লটঃ

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের জন্য ব্রিটেনের ভোট – এটিই ব্রেক্সিট নামে পরিচিত, মুভিটা ২০১৬ সালের ব্রিটেনের গণভোটের পেছনের গল্প। ফলাফলে শতকরা ৫২ : ৪৮ ভোটে ব্রেক্সিট “Leave EU” ক্যাম্পেইন জয়ী হয়। বিশেষত এটি ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার প্রচারণার পরিচালক ডমিনিক কামিন্স (অভিনয়ে, বেনেডিক্ট কম্বারবাচ) এর ঘটনাসমষ্টি। কামিন্স একটি ছোট কানাডিয়ান আইটি সংস্থা ‘এগ্রিগ্রেট আইকিউ’কে “Leave” মতাদর্শ প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ডেটা মাইনিং করার জন্য নিয়োগ দেয় এবং তারা প্রায় তিন মিলিয়ন সম্ভাব্য ব্রেক্সিট ভোটারের লিস্ট করেছিল যারা “Remain EU” ক্যাম্পেইনে থাকবে কিন্তু এটার প্রভাব সম্পর্কে কিছুই জানে না। কামিন্সের কৌশলটিতে সান জুর “আর্ট অব ওয়ার” এর কিছু মূল বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন, “অন্ধকারে রেখে লড়াই করতে থাকুন”। অর্থাৎ, ভোটাররা যেসব তথ্য জানেই না সেসব তথ্যকে এমনভাবে তাদের সামনে তুলে ধরা যাতে তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই তারা সেটা বিশ্বাস করে এবং নিজ মতামত পরিবর্তন করে ফেলে!উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডে সম্ভাব্য তুর্কী অভিবাসী হিসেবে যেই বিশাল সংখ্যাকে তারা তাদের প্রচারণায়
ফোকাস করেছিল সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের সমগ্র জনসংখ্যা! এছাড়া নোম চমস্কির বলা শক্তিশালী স্লোগানের গুরুত্বও দেখা যায় মুভিতে। যখন “Leave” ক্যাম্পেইন তাদের স্লোগান ফোকাস করে “Take Back Control”- জনগণ সেটা শুনেই এক অজানা আশার আলো দেখে ও মোহগ্রস্ত হয়ে যায়। তবে, “কন্ট্রোল তো ফিরিয়ে নিবে- কিন্তু কিসের কন্ট্রোল? কিভাবে নিবে? কার থেকে?” – এসব প্রশ্নের কোনো জবাব জনগণের কাছে ছিলো না। আসলে, স্লোগানটা এতোই আশাজাগানিয়া যে জনগণের মনে এই প্রশ্নগুলো আসেই নি!! কামিন্সের মতে, জনগণ ৪০ বছর ধরে EU নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আশাময় বিশ্লেষণ শুনে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত। আর সেটার সুযোগই কামিন্স ও তার ক্যাম্পেইন নিয়েছে সর্বোচ্চ ভাবে।

ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন

ম্যানিপুলেশনের টেকনিক্যাল কথাবার্তাঃ

বিদেশী সরকারের গণভোটে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পরে যুক্তরাজ্যের জনপ্রশাসন এবং সাংবিধানিক বিষয়ক কমিটির সংসদ সদস্যদের প্রতিবেদন যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উক্ত জুন মাসে ভোটার নিবন্ধন ওয়েবসাইটটি ক্র্যাশ করেছিল, হাজার হাজার লোককে ভোটবঞ্চিত করার হুমকি দিয়ে সরকারকে নিবন্ধনের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য বাধ্য করেছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট ক্রাশ একটি সামান্য উদাহরণ। কারণ, এ তো সবে শুরু। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার এটা নিয়ে জানিয়েছে যে দুর্ঘটনায় BotNet হামলার ইঙ্গিত ছিল। এরপর আরও অনেক ঝামেলার বিবরণ বের হচ্ছে। অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সম্ভবত প্রচারণার একটি ‘উল্লেখযোগ্য কিন্তু অদৃশ্য’ উপাদান ছিল। তবে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা, “Leave EU” প্রচারণার সাথে যুক্ত ডেটা অ্যানালিটিক্স ফার্ম, BotNet বা অন্য কোনও অবৈধ কার্যকলাপ ব্যবহার করেছে- এর কোনো মজবুত প্রমাণও নেই। এটি আইনি গন্ডির মধ্য থেকেই জনমতকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কারণ- নতুন প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ফলে এখনও দেশীয় আইনে এসব আধুনিক অপরাধের কোনো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই। কিন্তু, এসব মিডিয়ায় সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলি ন্যায্য কারণেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি, কারণ এটি অতিপ্রচলিত ও বিস্তৃতভাবে জনগণের নিকট পৌঁছায় এবং গণভোটে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলেছিল। কমিক বইয়ের মতোই অভাবনীয় এই সাইবার ম্যানিপুলেশনটি কোনো কল্পকাহিনী নয় এবং ইইউ এর গণভোট
ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে জয়ের ব্যপারেও ভূমিকা রেখেছিল। ‘ক্যারোল ক্যাডওয়াল্ডার’-এর ব্যতিক্রমী তদন্তমূলক কাজ এই সমস্যার বিস্তৃত প্রভাবগুলিকে প্রকাশ করেছে। তাঁর মতে, এটি কেবল ইইউর গণভোটেই নয়, ট্রাম্পের বিজয়েও এটি জড়িত। বিলিয়নিয়ার রবার্ট মার্সার হলেন ট্রাম্পের বৃহত্তম দাতা। এবং এই মার্সার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মালিক বলেও জানা গেছে। মার্সারের সাথে নাইজেল ফ্যারাজের সম্পর্ক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে “Leave EU” জন্য নেতৃত্ব দেয়াতে সহায়ক হিসাবে প্রমাণ করছে এবং তারা কীভাবে প্রোফাইলিং করে, লোককে টার্গেট করে এবং ফেসবুক প্রোফাইলগুলি থেকে ডেটা অর্জন ও বিন্যাস করতে হয় তা গবেষণা করে
এবং সেই অনুযায়ী প্রচারণা চালায়। ক্যাডওয়াল্ডার সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেন ‘Leave EU’ এর যোগাযোগ পরিচালক স্বীকার করেছেন যে- “পুরো প্রচারের মূল বিষয় ফেসবুকই ছিল। ফেসবুকের লাইক অপশনটিই তাদের
সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছি যেটা নির্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্কে সমস্ত ধরণের তথ্য এবং কী ধরণের বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বোঝাতে হয় সেটা জানায়। এবং স্বভাবতই তাদের নেটওয়ার্কে আরও কিছু লোক থাকবে যারা তাদের পছন্দকেই পছন্দ করবে- তাই সেটা ছড়িয়ে পড়ে আরো দ্রুত। এবং তারপরেও আপনি তাদের অনুসরণ করতে থাকুন। ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন

কম্পিউটারের সুবিধা হলো, এটি কখনও শেখা বন্ধ করে না এবং কখনও পর্যবেক্ষণও থামায় না।” কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাজগুলি এতটাই উদ্বেগজনক যে তথ্য কমিশনার কার্যালয়ের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহারের রিপোর্টও করা হয়েছে। “Leave EU” স্বীকার করেছে যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা প্রচারে সহায়তা করেছে, তবে কোনো অর্থ তাদের প্রদান করা হয়নি। এটিকে ডোনেশন বা অনুদানের মত করেই নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, লবিস্ট এবং বিলিয়নেয়াররা স্বচ্ছতার বিধিবিধানকে অস্বীকার করে আইনের ফাঁকফোকড়কে ব্যবহার করে মিডিয়া এবং জনমতকে ইচ্ছাকৃতভাবে চালিত করেছে। যদিই ধরি, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা এসব Bot ব্যবহার করেনি, তবুও অন্য কেউ স্পষ্টভাবে তা করেছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষণা বলে যে কীভাবে একটি বড় গ্রুপের বটগুলি জনমতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করতে পারে। এদের মতে, “এসব Bot বাস্তব ব্যবহারকারীদের মতোই টুইট করতে পারে, একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত হতে পারে।  নির্দিষ্ট বিষয়ের মতামত ট্র্যাক করার জন্য সংস্থাগুলি এবং গবেষকদের দ্বারা ব্যবহৃত মেট্রিকগুলিতে প্রকৃত
মানুষের মতই ইতিবাচক বা নেতিবাচক টুইট পোস্ট করতে পারে।”

অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের প্রমাণ থেকে জানা যায় যে ইইউ গণভোটের আগে সমস্ত টুইটার ট্র্যাফিকের এক তৃতীয়াংশই আসলে Bot ছিল!

 

মুভির বিপক্ষে যুক্তিঃ

পলিটিকাল মুভি যতোই নিরপেক্ষভাবে তৈরির ইচ্ছা করুক নিরপেক্ষতা ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই এই মুভিকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সবচেয়ে বড় হতাশা- তারা ব্রেক্সিট বেপারটাকে সম্পন্নও হতে দিলো না, তার আগেই তারা পুরো একটা মুভি করে ফেলল! ব্রেক্সিট হবার অফিশিয়াল তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০২০, আর মুভিটা যুক্তরাজ্যে রিলিজ হয় ৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে। তাছাড়া, মুভিটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছে যে- উভয় পক্ষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশাল ডেটাবেইজকে ব্যবহার করেছিল। মুভিটি এড়িয়ে গেছে যে, প্রত্যক্ষ স্বার্থের সাথে প্রভাবিত বহু সংখ্যক প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান (উদাহরণস্বরূপ, বিবিসির নিজের কন্টেন্ট বিশ্লেষণায় দেখা গেছে যে “বিশেষজ্ঞরা” 3:1 অনুপাতে ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছেন!) তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল তাদের কাছে শক্তিশালী অ্যান্টি-ব্রেক্সিট বার্তা থাকা সত্ত্বেও! সবশেষে, চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা নিজেরাও তো প্রত্যক্ষ স্বার্থেই রয়েছেন। এই চলচিত্রের সাথেও সংশ্লিষ্ট ছিল বিভিন্ন EU সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তারা কি নিরপেক্ষ? নাকি তারাও নিজ স্বার্থটাই প্রচার করে যাচ্ছেন? ব্রেক্সিট-দ্যা আন সিভিল ওয়ার : সোশ্যাল মিডিয়া, গণতন্ত্র ও জনমত ম্যানিপুলেশন
আচ্ছা ঠিক আছে, ধরেই নিলাম গণভোটের চূড়ান্ত রায় ভুল। মানুষকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে। ম্যানিপুলেট করা না হলে ব্রেক্সিট হতোই না। এরকমই যদি ভাবেন তাহলে বলুন- ব্রেক্সিট হবে কি হবেনা সেটার জন্য এই ভোট সেটা কেন শুরু হয়েছিল? বেশিরভাগ মানুষ যদি ব্রেক্সিট নাইই চাইতো তবে তো গণভোটটিই হতো না! স্পষ্টতই, ভোটটি হয়েছিল কারণ বেশিরভাগ জনগণ এটি চেয়েছিল। সুতরাং, সিদ্ধান্ত ম্যানিপুলেট হয়নি, যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেমনই হয়েছে! এত এত মানুষকে এভাবে বোকা বানানো সহজ নাকি? এরকম করে সর্বোচ্চ শতকরা ২০/৩০ জনকে বোকা বানানো যায়, শতকরা ৫২ জনকে না!!

 

মুভি মূল্যায়নঃ

এই গল্পটি হাস্যরসাত্মক বা ভীতিজনক কিনা তা দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। হাস্যকর দিক হলো, আপনি “Remain” সাইডের হতাশাজনক অবস্থা দেখতে পাবেন কারণ “Leave” সাইডটি নায্য নিয়ম মানছে না- তাও আবার বিভিন্ন হাস্যকর তথ্যের দ্বারা। ভীতিকর দিক হলো, সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা আমজনতার ম্যানিপুলেট  হওয়া এটা ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে সত্য বা মিথ্যা যেটাই হোক- ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বা আমাদের সাথেও যে এরকমটা হবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। সত্যমিথ্যার হিসেব ভিন্ন হবে, তবে মুভি হিসেবে এটি খারাপ ছিল না।

 

শেষকথাঃ

এটা নিয়ে পজেটিভ নেগেটিভ সব চিন্তার কাদা ছোড়াছুঁড়ি যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশ ওরাই করুক। সেসব রেখে আমাদের বরং কিছু শেখার আছে। এরিস্টটল বহুকাল আগেই বলেছিলেন “গণতন্ত্র হলো মূর্খের শাসন”- কথাটা যে মোটেও হাস্যকর বা মিথ্যা নয়- সেই সত্যটা এই এতোবছর বাদে এসেও যেন কতশত প্রমাণ চারদিকে ছড়িয়ে রেখে চোখের সামনেই ঘুরে বেরাচ্ছে।
সাধারণ জনগণকে ঠিক কতোটা দ্রুত ও কতবেশি সহজেই ম্যানিপুলেট করা যায় তার খুব ছোট্ট একটা প্রতিফলন দেখানো হয়েছে মুভিটিতে। আবার আরেকটা বিতর্কিত ঘটনা, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পেছনে থেকে রাশিয়ার সোশ্যাল মিডিয়ার ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে পূর্বের স্ট্যাটিস্টিক্সে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা হিলারি ক্লিনটনও হেরে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিকট – এই ঘটনার সত্যতার সম্ভাবনাও একদমই উড়িয়ে দেয়া যায় না। স্বয়ং ফেসবুক বেশ কয়েকবারই মামলার কাঠগড়ায় গিয়েছে ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রির অভিযোগে। যা রটে তার তো কিছু তো অন্তত ঘটে… তাই এরূপ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে সাধারণ বা সহজভাবে দেখার কোনো উপায় নেই।
অন্যদিকে, গণতন্ত্রে অধিকাংশ জনগণের মতামতই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমরা “সাধারণ মানুষ যারা আছি” তারা যে অন্য কারুর মতামত বা আদর্শের দ্বারা ইতিমধ্যেই ব্রেইনওয়াশড হইনি বা হচ্ছি না – তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? যেই কথাটা আমরা মুখে বলছি সেটাই কি প্রকৃতপক্ষেই নিজের মনে ও মগজে ভেবেছিলাম? বা যেটা ভেবেছিলাম বা ভাবছি আল্টিমেটলি সেটাই কি চরম সত্য বা একদম সঠিক? স্বদেশ ও নিজের সম্পূর্ণ ভবিষ্যতের মতো বিশাল সিদ্ধান্তটি গ্রহণের সময় কি কখনো কোনোমতেই ভুল করার মতো বিলাসিতা দেখানো উচিত? আমরা কি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে- এই দুঃখজনক বিলাসিতা বা উদাসীনতা আমরা এখনই দেখাচ্ছি না? আমরা যেই সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছি সেগুলো আসলেও কি স্বয়ং আমাদের নিজেদেরই নেয়া? অনলাইনের চিন্তা বাদই দিন, এইযে
অফলাইনে আমাদের দেশের বিভিন্ন নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রচারণা- সেগুলোর দ্বারাই কি আমরা অনেকভাবেই ম্যানিপুলেট হচ্ছি না? কিছু টাকার বদলে ভোট – একবেলা খাবারের বিনিময়ে ভোট- সেগুলো কি গণতন্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য? আজ এক প্যাকেট বিরিয়ানির লোভে যাকে ভোট দিচ্ছি তাকে কি আসলেও আমি আমার নেতা হিসেবে চেয়েছিলাম বা তাকে নেতা বানানোটা কি আমার উচিত? এই চিন্তাগুলো কি আমরা কখনও করেছি? এইযে আপনি কেবল এই লিখাটা পড়লেন, এবং যে মুভিটা নিয়ে এতোক্ষণ আমি এতো কথা বললাম, এই লিখাটা বা ওই মুভিটা – এসবও যে কোনো প্রোপাগান্ডার অংশ না- তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?

আবারও বলি- মুভিটা তেমন বেশি অসাধারণ মাস্টওয়াচ টাইপ কিছু নয়, কিন্তু ওই মুভিটা না দেখলেও
অন্তত এখন যা যা পড়লেন- সময় সুযোগ করে ঠান্ডা মাথায় – সেই চিন্তাগুলো অন্তত করুন। নিজের
মাথায় বাকি সবার সমান মগজই আছে, সেই মাথাটা খাটান, পুরো মহাজগতে আপনার একক
অনন্যতার বিষয়টা অবশ্যই কখনো ভুলে যাবেন না। হ্যাপি ফ্রি থিঙ্কিং….

সোর্সঃ
https://papers.ssrn.com/sol3/papers.cfm?abstract_id=2798311
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Criticism_of_Facebook
https://www.theguardian.com/commentisfree/2017/apr/17/brexit-voter-manipulation-eu-
referendum-social-media
https://m.imdb.com/title/tt8425058/
https://www.rottentomatoes.com/m/brexit
https://www.theguardian.com/politics/2017/mar/04/cambridge-analytica-democracy-
digital-age
https://hothardware.com/news/researchers-discover-massive-twitter-star-wars-botnet-
dormant

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সিনেমা পাড়ায়

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ

Published

on

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ

কথায় আছে- “Time is the best healer- সময়ই সেরা নিরাময়কারী।” -তবে এটা কি সব জায়গায় সত্য?

নাৎসি বাহিনী দ্বারা পরিচালিত মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভয়াবহ মানবিক অপরাধের ভয়াবহ চিত্র যখন আমাদের সামনে আসে তখন আমরা এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বাধ্য।

বা, আমাদের নিজেদের দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা ভয়ংকর হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের শিকার হবার পরে ‘সময়’ কি পেরেছে আমাদের সেসব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে?


এই চলচ্চিত্রটি আমাদের এই সত্যের মুখোমুখি করে যে- “কোনো যুক্তিই মানুষ হত্যা করা বা মানবতাবিরোধী অপরাধকে বৈধতা দেয়ার মতো শক্তিশালী হতে পারে না।” মুভিটি দেখিয়েছে – আশপাশের অন্যায়কে কেয়ার না করা বা প্রতিবাদ না করার চূড়ান্ত পরিণতি।

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ
ছবি : সংগৃহীত

১৯৬১ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি এই ২০২০ সালে এসেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ এখনও বাংলাদেশের একটি আলোচিত এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয় হচ্ছে- একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। চলচ্চিত্রটির বক্তব্য তাই আজও সময়োপযোগী, আর তাই নির্দ্বিধায় চলচ্চিত্রটিকে কালোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের তালিকার প্রথম সারিতেই রাখা যায়। পৃথিবীর যেখানেই যেই সময়েই যুদ্ধাপরাধের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হোক না কেন, সেইসব অপরাধ এবং অপরাধের পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিতর্কের নানান দিকের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে এই একটি চলচ্চিত্রের মাঝেই। এখানেই “Judgement at Nuremberg” মুভির সফলতা। মোটকথা- চলচ্চিত্রটি মানব সভ্যতার শেষ দিন পর্যন্ত একটি দালিলিক চিত্রায়ন।

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ
ছবি : সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অনেক সিনেমাই নির্মিত হয়েছে। তবে এই চলচ্চিত্রটি একটি বিশেষ কারণে অনন্য। কারণ এখানে বিচারকেরা নিজেরাই বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিন বছর পরে, জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরের কোর্টরুমে চারজন জার্মান বিচারক এমনই এক অভাবনীয় বিচার ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হন। কালো গাউন পরিহিত বিচারকের কাছে যখন মানুষের প্রত্যাশা থাকে সুবিচারের, ঠিক সেখানেই যখন একটি দেশের সরকারি বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সংগঠিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং সেই অপরাধের জাস্টিফিকেশন দেওয়া হয় বিচার ব্যবস্থার পুরো সিস্টেম ব্যবহার করে তখন সেই বিচারকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখাটা- একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

পুরো জার্মান জাতিসহ ইউরোপ তখন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ঐদিকে শুরু হয়েছে আমেরিকা আর সোভিয়েত রাশিয়ার কোল্ড ওয়ার। ঠিক সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এই চার বিচারকের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিপক্ষে ছিল অনেকেই। খোদ জার্মানির জনগণই এই বিচারকে মেনে নিতে পারছিল না। এমনকি ট্রাইব্যুনাল পরিচালনাকারী দেশ আমেরিকার প্রশাসনও চাইছিল একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মাধ্যমে এই বিতর্কের অবসান হোক। কিন্তু অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক আমেরিকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারক Dan Haywood এবং ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর Col. Tad Lawson সবার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধ বিরুদ্ধে সুবিচার প্রতিষ্ঠার এক অন্য লড়াইয়ে বদ্ধপরিকর।

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ
ছবি : সংগৃহীত

Dr. Ernst Janning, Emil Hann, Freidrich Hoffstetter, Werner Lammpe- এই চার বিচারক হিটলারের ক্ষমতায় থাকাকালীন জার্মানির প্রধান চার বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এদের আইনি কূটবুদ্ধির সাহায্যেই হিটলারের নাজি বাহিনী তাদের অপরাধগুলোকে আইনি ব্যবস্থার আড়ালে আশ্রয় দিয়ে বৈধতা দিয়ে চলেছিল।

এই সম্পূর্ণ মামলা চলাকালীন নাজি বাহিনীর সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধের চিত্রগুলো উঠে আসে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি প্রমাণ করে বন্ধ্যাকরণ, থার্ড রাইখের বিরুদ্ধচারনকারীদের মৃত্যুদণ্ড, রেসিয়াল পলিউশন বা ইহুদীদের সাথে সম্পর্কের কারনে মৃত্যুদণ্ড এবং শুধুমাত্র ইহুদী হওয়ার অপরাধে (?) নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে নিয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করার মতো ভয়ংকর জঘন্য নির্মম অপরাধ সংগঠিত হয় জার্মান বিচার ব্যবস্থার আশ্রয়েই। আর এইসব অপরাধের শাস্তিনামায় স্বাক্ষর করার অপরাধে বিচারের মুখোমুখি চার বিচারক। এই চার অপরাধীর ডিফেন্স আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন Hans Rolfe.

মুভি রিভিউঃ জাজমেন্ট এ্যাট নুরেমবার্গ

ছবি : সংগৃহীত

এই সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটি হোলোকাস্ট ভিত্তিক অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো একরোখা বা একপাক্ষিক নয়। অপরাধীদের পক্ষে বেশকিছু শক্ত যুক্তি সহকারে এখানে জার্মানদের কথাও বলা হয়। ফৌজদারি আইনজীবিরা তাদের দৃঢ় কঠিন যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে চান যে এই বিচারকরা দোষী নন। কারণ তারা নিজের দেশের সাধারণ আইনের পক্ষেই কাজ করেছিলেন এবং সর্বোপরি তাদের লক্ষ্য ছিল দেশপ্রেম।
.
আইনজীবি Hans Rolfe তার সম্মানিত শিক্ষক Ernst Janningকে নির্দোষ প্রমাণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তার পক্ষে অন্যতম যুক্তিটি হলো- “আমেরিকার কোনো অধিকার নেই জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার করে।”

এখানে আরেকটি যুক্তি বড় হয়ে দেখা দেয় যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ইহুদী নিধনের এই ঘটনা সাধারণ জার্মান এবং বিচারের মুখোমুখি হওয়া এই বিচারকগন জানতেনই না। তাদের অজান্তেই হিটলার এই জঘন্য অপরাধ সংগঠিত করেছিলো। রল্ফের দাবি- শুধুমাত্র হিটলার এবং তার সহযোগীরাই এই অপরাধে যুক্ত ছিল। এখানে সাধারণ জার্মান নাগরিকদের ন্যুনতম কোনো ভূমিকাই ছিল না।
.
বিচারের মুখোমুখি হওয়া চার বিচারকের মধ্যে Ernst Janning ছিলেন জার্মানির প্রধান বিচারপতি। যদিও তিনি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, জার্মানি সহ তিনি বিশ্বজুড়ে দক্ষ আইনজীবী হিসাবে সুপরিচিত। তাঁর বহু বই সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শিক্ষার পাঠ্যবই হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তিনি পুরো বিচার চলাকালীন নিশ্চুপ বসেছিলেন। কিন্তু আইনজীবী যখন তাদের নির্দোষ প্রমাণের জন্য একটি কঠিন বিচারের মাধ্যমে সাক্ষীদের পরাজিত করার চেষ্টা করছেন, তখন তার প্রতিক্রিয়া এবং আদালতের মন্তব্য দর্শকদের সত্যই মোহিত করবে এবং উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমি এখানে তার একটি সংলাপ উল্লেখ না করে পারছি না।–
.
যখন তার পক্ষের আইনজীবী Hans Rolfe তাকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তুমুল তর্ক করছেন যে বিচারকগণ জেনোসাইডের ব্যপারে কিছুই জানতেন না, তখন Janning চিৎকার করে ওঠেন, “আমার আইনজীবী হয়তো যুক্তি দেখাবে- মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা জানতাম না। হয়ত মাত্র কয়েকশ মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা জানতাম। কিন্তু সেটা কি আমাদের নির্দোষ প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট? আমরা জানিনি, কারণ আসলে আমরা জানতেই চাইনি। কোথায় ছিলাম আমরা, যখন আমাদের প্রতিবেশীদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো? আমরা কি অন্ধ ছিলাম? বধির ছিলাম?” – পরিশেষে উনি উনার দোষ স্বীকার করে নিলে ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়ার ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।
.
একেবারে শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই যে ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি যখন বিচারের পরে আমেরিকায় ফিরে আসবেন তখন Janning প্রধান বিচারকের সাথে দেখা করতে চান। আর এটিই ছিল তাদের শেষ বৈঠক এবং মূলত সিনেমার শেষ দৃশ্য। এখানে উচ্চারিত এই শেষ সংলাপটির মধ্য দিয়েই, চলচ্চিত্রটি যেন পুরো বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়ে ভাবনার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

এটি সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি সিনেমা, সুতরাং এর সমাপ্তি আমরা প্রত্যেকেই জানি। তবুও কেন দেখবেন এই সিনেমা? এতোজন তারকা অভিনেতা এক মুভিতে ও তাদের অভাবনীয় সুন্দর অভিনয় আর সাথে মুভিটির অসাধারণ সব সংলাপ- এটুকুর কারণে হলেও মুভিটা সবারই দেখা উচিত।

এটা দেখার জন্য আসলেও কঠিন সিনেমা এবং বেশ দীর্ঘ- প্রায় ৩ ঘণ্টার। তবে প্রতিটি ভাবুক চিন্তাশীল শান্তিপ্রিয় মানুষের অবশ্যই মুভিটি দেখা উচিত- এবং দরকার পরবর্তী সময়ে এটি নিয়ে অন্ততপক্ষে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে সময় কাটানো। এরকম কোনো অবসর পেলে ধৈর্য ধরে মুভিটি দেখুন, এবং নিজের ভাগের সেই চিন্তাটুকু করুন। হ্যাপি ওয়াাচিং।

আফীফাহ হক মীম,

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সিনেমা পাড়ায়

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস

Published

on

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস

মানব ইতিহাসের সব থেকে ঘৃণ্যতম ও হতাশাজনক ঘটনার মধ্যে গণহত্যা অন্যতম। রাজনীতি,ধর্ম,বর্ণ,জাতিগত বিদ্বেষের কারণে সাধারণ মানুষের উপর গণহত্যা চালানো ইতিহাসের কোন সাধারণ ঘটনা নয়। গণহত্যার মত ন্যাক্কারজন বিষয় নিয়ে অনেক উপন্যাস রচনা, প্রামাণ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও পৃথিবী থেকে এখনো আমরা এই মানব চরিত্রের ঘৃণ্য আচরণের অপসরণ দেখতে পাই না।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালীন জার্মানীর হিটলার কর্তৃক ইহুদিদে উপর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। নির্মাতা মার্ক হারম্যান চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আইরিশ ঔপন্যাসিক জোয়ান বাইনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস’কে কাহিনীচিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস

চলচ্চিত্রটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে একজন উচ্চ পদস্থ নাৎসী সেনা কর্মকর্তার সন্তান ব্রুনো নামের আট বছরের একটি শিশু ও ইহুদী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের থাকা স্যামুয়েল নামের শিশুটিকে কেন্দ্র করে। কাহিনী বিবর্তনে দেখা যায় ব্রুনো ও স্যামুয়েল এই দুইটি শিশুর বন্ধুত্ব হার মানিয়ে দেয় তাদের মধ্যকার সামাজিক ও রাজনৈতিক পার্থক্যকে যা ছাপিয়ে যায় তাদের ঐতিহাসকি বিদ্বেষমূলক অবস্থা।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস
সামাজিক ও রাজনৈতিক পার্থক্যকে ছাপিয়ে যাওয়া দুই বন্ধূ স্যামুয়েলস ও ব্রুনো ছবি : সংগৃহীত

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রইপড পাজামাস চলচ্চিত্রে নাৎসীবাহিনীর ইহুদীদের গণহত্যা,তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ ও নিমর্মতার বিষয়গুলো গৌণভাবে  ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে দুটি আলাদা প্রেক্ষপট থেকে উঠে আসা বাচ্চার বন্ধুত্বের বিষয়টিকে মূখ্যভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রের কাহিনীর প্রেক্ষাপটে দেখা যায় আট বছরের শিশু ব্রুনো তার পরিবারের সাথে বার্লিনে থাকে। যার বাবা রালফ একজন  নাৎসী সেনা কমান্ডার  যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ইহুদী নিপীড়ন ক্যাম্পের  কমান্ডার  হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। যে কারণে ব্রুনো তার মা  এলসা, বার বছরের বোন গ্রেটেল এবং তাদের গৃহের পরিচারিকা মারিয়া সহ ক্যাম্পের পাশে একটি উঁচু দেয়াল বেষ্টিত কড়া নজরদারির বাড়িতে আসে যেখানে সৈন্যরা টহলে নিয়োজিত থাকে সব সময়।

অ্যাডভেঞ্চার বই পড়তে আগ্রহী ছিল ব্রুনো এবং বন্ধুপ্রিয় থাকার কারণে বাড়িতে একাকিত্ব অনুভব করে। যে কারণে সে অনুসন্ধান শুরু করে। সে বাড়ি থেকে কিছু দূরে ইহুদিদের ক্যাম্প দেখতে পায় যেটা সম্পর্কে তাকে পরিচিত করানো হয় একটি ফার্ম হিসেবে। ব্রুনো খেয়াল করেছিল তার বাড়িতে পাভেল নামক কৃষক স্ট্রাইপড পাজামা পরিহিত ছিল যা তার কাছে আলাদা ও ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল। ব্রুনো তার বাবাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তার বাবা তাতে উত্তর হিসেবে বলেছিল তুমি যাকে মানুষ মনে করছ সে আসলে মানুষ না।

চলচ্চিত্রের এ অংশটিতে আমরা দেখতে পাই একজন নাৎসী সেনা একজন ইহুদীকে মানুষ বলতেই নারাজ। ব্রুনো একদিন তার মায়ের অগোচারে অনুসন্ধান করতে করতে ইহুদী শিবিরের কাছে পৌছায় এবং শিবিরের কাঁটা তারের বেড়ার পাশে স্যামুয়েল নামের একটি শিশুকে আবিষ্কার করে। শিশুটি তার বয়সের জেনে  আনন্দিত হয় এবং তারা এক পর্যায়ে বন্ধু হয়ে যায়। একই বয়সের সম্পূর্ণ আলাদা পটভূমি থেকে উঠে আসা দুজনের বন্ধুত্ব হলেও ব্রুনো স্যামুয়েলের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। স্ট্রাইপড পাজামাতে নাম্বার লেখা দেখে ব্রুনো ভেবেছিল এটা কোন খেলার অংশ কারণ তার বাবা ফার্ম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল। কিন্তু স্যামুয়েল বলেছিলো এখানে আসার পর তাদের সবাইকে একইরকম পোশাক পরতে হচ্ছে এবং এই নাম্বার কোন খেলার অংশ নয়। তবে কেন এর রকম তা সে  জানে না।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস
ব্রুনোর বোন গ্রেটেল নাৎসীবাদে অণুপ্রাণিত, ছবি : সংগৃহীত

ব্রুনোর বোন গ্রেটেল এবং ব্রুনোর জন্য একজন গৃহশিক্ষক আসতো যিনি কট্টর নাৎসীবাদী। যিনি ব্রুনোকে অ্যাডভেঞ্চার বই পড়তে নিরুৎসাহিত করে এবং নাৎসী মানসিকতায় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং গ্রেটেলের ক্ষেত্রে সফল হন।

চলচ্চিত্রটির এক পর্যায়ে এসে দেখা যায় ছোট্ট ব্রুনোতে তার পরিস্থিতি ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পাওর না তার চারপাশে কি ঘটছে, কেন তার ১২ বছরের বোন পুতুল বাদ দিয়ে নাজী তরুণদের ছবি দিয়ে ঘর সাজানো শুরু করেছে। ব্রুনো হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না কেন পাভেল যাকে  কৃষক হিসেবে দেখানো হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পেশায় একজন ডাক্তার অথচ এখন কৃষক হয়েছেন, কেনই বা সকল কৃষক স্ট্রাইপড পাজামা পরিধান করে।

মার্ক হারম্যান তার চলচ্চিত্রে একটি নিষ্পাপ বালক ব্রুনোর দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে সফল হয়েছেন যেটা এই চলচ্চিত্রের একটি শক্তিশালী দিক। ব্রুনোর কাছে তার বাবা একজন মহৎ ব্যক্তি যে দেশকে রক্ষা করেছেন এবং সে তার বাবার জন্য গর্ববোদ করেন। ব্রুনোর কাছে ক্যাম্প থেকে আসা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা পোড়ানোর গন্ধ আর ব্রæনোর কাছে অদ্ভুদ ও অস্বভাবিক বিষয় বিশ্বাযোগ্য হয়েছে কারণ তাকে এভাবেই শিখানো হয়েছে। এমনকি যখন স্যামুয়েলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে তখনও ইহুদিদের ওপর ক্যাম্পে যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তা ধারণা করতে পারেনি। ব্রুনোর বাবার একটি প্রপাগান্ডা ভিডিও তাকে এই নির্মম সত্যেও প্রতি অন্ধ করে রাখে।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস
নাৎসী সৈন্যরা ই্হুদীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিচ্ছে, ছবি : সংগৃহীত

চলচ্চিত্রে ব্রুনোর নিজেস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে স্যামুয়েল ও পাভেল এর প্রতি ইতিবাচকতা মনোভাব গড়ে উঠতে দেখা যায়। পাভেল কে যখন সৈনিক কোটলার আঘাত করে তখন তার বাবার নীরব আচরণ সে প্রত্যাশা করতে পারেনি যা তাকে পীড়া দেয়। কিন্তু গ্রেটেল এটাকে স্বাভাবিক বলে দাবী করে। ব্রুনোকে ইহুদীদের ক্যাম্পে কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে গ্রেটেল বলে ইহুদীরা তাদের শত্রু এবং তারা কোন কিছুতেই ভালো নয়। ইহুদীরা জঘন্য ও বিপদজনক। যা ইহুদীদের প্রতি গ্রেটেলের বিধ্বংসী মনোভাবের প্রকাশ করে।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস
নাজী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদী বালক স্যামুয়েল, ছবি : সংগৃহীত

গৃহশিক্ষক লিসজট ব্রুনো ও গ্রেটেলকে বর্ণবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শিক্ষায় উদ্ভুদ করে যা নিন্দানীয় ও নেতিবাচক।

ইহুদীরা সংস্কৃতির ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক শত্রু,তাদের  কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী পরাজিত  হয়েছে। ইহুদীদের দুর্নীতির কারণেই জার্মানীর দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তাদের যে প্রভাব তা ক্ষতিকর এবং তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল শাসক হওয়া। ইহুদী জাতি সৃষ্টিশীল নয় তারা  ধ্বংসাত্মক। তিনি ব্রুনোকে আরো বলেন যদি সে একজন ভাল ইহুদী খুঁজে পায় তাহলে সে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানকারী হবে।

গল্পে দেখা যায় ব্রুনোর যে পরিবেশে ছিল সেখানকার বড়রা সবাই ইহুদী জাতিকে হীন করে দেখছে এবং ঘৃণা পোষণ করছে কিন্তু তা স্বত্তেও ব্রুনো,স্যামুয়েল ও পাভেলকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছে তাদের সাথে প্রথম পরিচয়ের সুন্দর অভিজ্ঞতার জন্য। এখানে স্যামুয়েল এর সাথে ব্রুনোর বন্ধুত্বে সাহসিকতা নয় বরং নিষ্পাপ মনের সৌন্দার্য প্রকাশ করছে এবং বড়দের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতি অলিখিত ঘৃণা  ফুটে উঠেছে।

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস
মা এলসা ও ব্রুনো, ছবি : সংগৃহীত

চরম অন্যায় ও বর্বরতায় সমাজ যখন ধ্বংসের পথে তার  মধ্যেও মানুষ হিসেবে সঠিক ও সত্যের পথে থাকার মানবিক গুনাবলি ধরে রাখা এবং প্রতি দায়িত্বশীল থাকার ও বিবেকের জাগ্রত রাখার শিক্ষা এলসা চরিত্রের মাধ্যমে পাওয়া

দ্যা বয় ইন দ্যা স্ট্রাইপড পাজামাস চলচ্চিত্র হলোকাস্টের উপর নির্মিত হলেও নির্বিচারে হতাযজ্ঞকে এমনভাবে তুলে ধরতে পারেনি যা দর্শকদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। জেনারেল রালফের স্ত্রী এলসার ইহুদীদের প্রতি নৃশংস আচরণের সম্পর্কে যে অজ্ঞতা দেখা যায় তা কোন অজুহাতের মাধ্যমে হালকা করে দেখা যায় না।

সিনেমাটিতে ইহুদীদের প্রতি নির্মম আচরণকে ক্ষীণভাবে দেখনো হয়েছে যা বাস্তবতার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এই চলচ্চিত্রটি যদি গণহত্যা কিংবা হলোকাস্টের ধারণা নেই এমন কেউ দেখে তাহলে তার পক্ষে নাৎসীবাদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে যাবে অনেক ক্ষেত্রে নাৎসীবাদকে নায়োকচিতভাবে গ্রহণ করার মতো ভয়ংকর ভুলও হতে পারে।

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত