Connect with us

ভ্রমণ কাহিনী

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (৩য় পর্ব)

Published

on

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

মানালির দ্বিতীয় দিন

আগের পর্ব পড়ুন: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)
(২৩.০১.২০২০, বৃহস্পতিবার)
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এখনই চেক আউট করে বেরিয়ে যেতে হবে। ম্যানেজারের সাথে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে নিজ নিজ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে চড়লাম। এবার গন্তব্য মানালি ক্লাব হাউজ। ক্লাব হাউজে যেতে রাস্তার কিছু অংশ খুবই ভয়ংকর। মাইক্রোর মতন কম শক্তিশালী গাড়ি নিয়ে সেখানে যাওয়া টা একটু ঝুঁকিপূর্ণ ই বটে। বেশ কিছুটা সময় আমাদের গাড়িটা ছোট একটা যানজটে আটকে থাকলো। যানজটটা মূলত ঝুকিপূর্ণ বরফাবৃত রাস্তার কারনেই হয়েছে। আশেপাশের লোকজনও দেখলাম সহযোগিতার মনোভাপন্ন।
যানজট ছাড়াতে তাদেরকেও বেশ তৎপর মনে হলো। আসলে এসব গাড়িতে আসা সিংহভাগ লোকই পর্যটক আর যত পর্যটক ততই স্থানীয়ের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ। ক্লাব হাউজের সামনেই গাড়ি পার্ক করে পাশে থাকা একটা খাবারের দোকানে নাস্তার জন্য বসলাম। দোকানটিকে আমাদের দেশের অনেকটা “আল সালাদিয়া ঢাকা”হোটেল সদৃশ বলা যেতে পারে। ছাদ খোলা হোটেলের সামনে দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া বিয়াস নদীর সৌন্দর্য মন্দ লাগলো না।

মনে হয় মানালীর সবটাই এই বিয়াস দ্বারা পরিবেষ্টিত। নাশতা খেয়ে কাউন্টারে টিকেট কেটে ক্লাব হাউজে প্রবেশ করা হলো।

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর

ক্লাব হাউজটি মানালির থেকে ২ কি.মি.বাম দিকে বিয়াস ঘেঁষে অবস্থিত। এটির স্থাপত্যশৈলি বৃটিশের অনুকরন করা হয়েছে। ফলে প্রথম দেখে যে কেউই এটাকে বৃটিশ আমলে তৈরি বলে ভাবতে পারে, আমিও তেমনটিই ভেবেছিলাম, পরবর্তীতে জানা গেল ইনডোর খেলার প্রতি আগ্রহী করতে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিস্ট ডেপোলপমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি করেছে। সম্ভবত বরফে ঢাকা এই প্রদেশটির খেলার মাঠ না থাকার দরুন বিনোদনের কথা বিবেচনা করেই এমনটি করেছেন। তাছাড়া এই ক্লাব হাউজে পর্যটকদেরও কিছু অর্থের বিনিময়ে খেলাধুলা করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমে ঘুরে ঘুরে ক্লাব হাউজের সবটুকু দেখলাম। আমার কাছে মনে হলো এটা নামেই ক্লাব হাউজ, সবটুকুই বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর

খেলার জায়গা কমই, বেশিরভাগ স্থানই দোকানপাটে ঠাসা। বেশ কিছুটা সময় ঘুরে ঘুরে দেখার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ব্যাডমিন্টন খেলার। চারজন খেলা শুরু করলো, দর্শকসাড়িতে বসে সে খেলাতে মনোনিবেশ করলাম। বেশ হাড্ডাহাড্ডিই হলো লড়াইটা। তাদের বাকি দুজন নামলাম। টিম করা হল আমি আর আইভি আর বিপক্ষ টিমে হিমেল আর এলিন। প্রথম দিকে ওরা টানা পয়েন্ট পেলেও শেষের দিকে আমরাও টানা পয়েন্ট পেতে শুরু করলাম। খেলায় যখন টানটান উত্তেজনা ঠিক তখনই গার্ড এসে আমাদের সময় শেষ বলে জানালেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলায় ইস্তফা দিয়ে রেকেট জমা দিলাম। মাইনাস তাপমাত্রা সত্ত্বেও আমাদের শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়ছিলো। সত্যি বলতে কি খেলাটা মন্দ লাগেনি। ক্লাবের সামনে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। এখানেও দেখলাম পর্যটকদের পয়সা খসানোর জন্য স্থানীয় লোকজন বেশ কতেক পসরা নিয়ে বসছেন। ক্লাব হাউজ শেষ করে এবার রওনা করলাম একটু দূরে হাদিম্বা টেম্পলের দিকে।

টেম্পল ও এর আঙ্গিনায় পর্যটকদের ভীড়

বেশ উঁচুতে এই টেম্পলটিতে যেতে হলে গাড়ি ছাড়াও অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। তাছাড়া ভয়ংকর বরফের পিচ্ছিল পথে হোঁটচ খাওয়ার ভয় তো আছেই। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটেই চলতে লাগলাম। এখানে ঘনবসতি একটু বেশি হওয়ায় রাস্তাগুলো বেশ সরু আর বাড়িঘরও একেবারে রাস্তা লাগোয়া। অনেকটাই হিজিবিজি অবস্থা। টেম্পলের সীমানায় এসে অনেকগুলো পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে টেম্পল চত্বরে পৌঁছলাম।
হাদিম্বা টেম্পলটি ১৫৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই টেম্পলের স্থাপত্যশৈলির বিশেষত্ব পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

টেম্পল ও এর আঙ্গিনায় পর্যটকদের ভীড়

টেম্পল ও এর আঙ্গিনায় পর্যটকদের ভীড়

চার স্তর বিশিষ্ট প্যাগোডা ছাদ মন্দিরে যোগ করেছে আলাদা বিশেষত্ব। আসলে এটি একটি গুহা মন্দির যা চমৎকারভাবে কাঠের কার্ভিং করা। মন্দিরটি ভীমের স্ত্রী দেবী হাদিম্বার উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। ভীম ছিলেন মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবের একজন।
সিঁড়ির মতন মন্দির চত্বরটাও বেশ পিচ্ছিল ছিল। একটু অসাবধান হলেই ঘটতে পারতো ভয়ংকর কোন দুর্ঘটনা। লোকজন দেখলাম লাইন ধরে পূজো বা প্রণাম করতে মন্দিরে প্রবেশ করছে কেউবা ছবি তুলছে। স্থানীয় অনেক লোকজন পর্যটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন ছোটখাটো কাজকর্ম ও করছে। আমাদের সফর সঙ্গী হিমেলও সিরিয়াল ধরে মন্দির থেকে প্রণাম করে আসলো। বড় বড় অনেক গাছগাছালিতে ঘেরা এই স্থানটিকে একটা আধ্যাতিকতার রূপ দান করেছে। তাছাড়া বরফের মাঝে এসব বড় বড় গাছগাছড়া অন্যরকম সৌন্দর্যেরও অবতারণা করেছে।
বেশ কিছুটা সময় এই মন্দির চত্বরও তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে পার্কিংয়ে থাকা  গাড়ির কাছে আসলাম। আমাদের হাতে তখনও বেশ কবছুটা সময় ছিল তাই ড্রাইভার সাহেব শহরের একটু বাহিরে উষ্ণ প্রস্রবনের একটা ঝিরির কাছে নিয়ে গেলেন।
মাইনাস তাপমাত্রার এই মানালিতে উষ্ণ পানির ঝিরি একটু অবাক করার বিষয়ই বটে। হয়তো এর বৈজ্ঞানিক কোন কারনও থাকবে।

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী

বিয়াস নদীর কূল ঘেঁষা এই ঝিরিতে  বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। বিয়াসের বড় বড় পাথরের উপরে বসে  ছবিও তুললাম। খরস্রোতা পাথুরে বিয়াস নদী পাশেই বড় বড় পাহাড় সেই সাথে সবুজ বনাঞ্চল,

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী

প্রকৃতির সবটুকুই যেন এখানে একেবারে উজাড় করে দিয়েছে। ফিরতে যদিও ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু সময় তো আর বসে থাকছে না। দ্রুতই মল রোডে ফিরলাম।

মানালি মল রোড

মানালি মল রোড

পূর্বের সেই মুসলিম হোটেলেই দুপুরেরখাবার খেলাম। খাবার খেয়ে আমাদের নির্ধারিত মাইক্রো নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা করলাম। বাস স্ট্যান্ডটি শহর থেকে একটু বাহিরে।

মানালি বাস স্টেশন

মানালি বাস স্টেশন

পর্যটন নির্ভর এই  নগরীকে অযথা হাঙ্গামা থেকে রেহাই দিতেই  এই ব্যবস্থা। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর ড্রাইভার সাহেব থেকে বিদায় নিলাম। আসলে সব বিদায়ই কষ্টের, ব্যথার।
ড্রাইভার সাহেব সম্পর্কে একটু বলি, উনার নাম জগদীশ, বাড়ি চণ্ডীগড়। সিমলা-মানালি রুটের অধিকাংশ ড্রাইভারের বাড়িই সম্ভবত চণ্ডীগড়। লোকটা খুব কম কথা বলেছেন আর গাড়িটাও মোটামোটি ভালোই চালিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে জানিয়েছেন আমরা সিমলা থেকে মানালীতে থাকার জন্য যে টাকায় প্যাকেজটি নিয়েছি সরাসরি উনার মাধ্যমে সেটি নিলে অন্তত আমাদের ১০০০ হাজার রুপি করে কম লাগতো। সত্য মিথ্যা জানিনা তবে পর্যটন এরিয়াতে থার্ডপার্টি এড়িয়ে সরাসরি মূল পার্টির সাথে কথা বলতে পারলে অনেকটাই সাশ্রয় করা সম্ভব এতে কোন সন্দেহ নেই। ড্রাইভার সাহেব নিজের কার্ড দিয়ে আমাদের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা বাসস্ট্যান্ডে প্রবেশ করলাম।

মানালি বাস স্টেশন

মানালি বাস স্টেশন

মানালি থেকে দিল্লি

(২৩.০১.২০২০, বৃহস্পতিবার)

বাসস্ট্যান্ডের পরিবেশ খুব একটা ভালো লাগলো না একটু নোংরাই মনে হল, বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে বিয়াস নদীর পাড়টিও বেশ নোংরা আর আবর্জনায় ভর্তি। বড় বড় বাসের ভীড়ে আমরা আমাদের দিল্লিগামি  নির্ধারিত বাসটি খুঁজে সেটাতে আসন গ্রহণ করলাম। বাস ছাড়তে তখনও ২০-২৫ মিনিট বাকি। বাসে আমরাই বাংলাদেশি ছিলাম। অনেকেই দেখলাম খাবার নিয়ে উঠছে, বুঝতে পারলাম যাত্রা বিরতিতে এরা বাহিরের খাবার খাবেন না। নির্ধারিত সময় বিকেল ৫ টার সময় ই বাস যাত্রা শুরু করলো। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে বিকেল ৪ঃ৪৫-৫ঃ১৫ মিনিট এর মধ্যে প্রতিদিনই ১০-১৫ টি দিল্লিগামী বাস ছাড়ে। ভারতীয় রেল এখনোও পর্যন্ত এই পাহাড়ি হিমাচলের মানালী পর্যন্ত আসতে পারেনি। কে জানে হয়তো অদূর বা দূর ভবিষ্যতে ভারতীয় রেল এই পাহাড়েও উঠে আসবে। রেল ব্যবস্থাটি ভারতীয়দের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম, সেটা না থাকাতেই এখানে বাসের জমজমাট অবস্থা। এইবার আমার পাশের সিটে বসেছে মাসুদ। যদিও আমাদের ভ্রমনের বেশির ভাগ সময়ই আমার বাসম্যাট হয় হিমেল। আমাদের সামনে স্ত্রী কন্যা সমেত যে ভদ্রলোক বসেছেন উনার কন্যাটি বাস ছাড়ার শুরু থেকেই বমি করা শুরু করেছেন এবং সেটা অনবরত চলছেই। এই বিষয়টি সবার জন্য ই কষ্টের। যদিও পাহাড়ি এসব রাস্তায় এমনটি হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। বাস ছাড়ার পর থেকেই আমারো কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো। আসলে পাহাড়ি রাস্তা, তাছাড়া কয়েকদিনের টানা জার্নি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না হওয়া, বাসের সামনের যাত্রীর অনবরত বমি হওয়া সবকিছু মিলিয়ে সেই খারাপ লাগাটা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলো। চেষ্টটা অনেকটাই সফল হল তবে বেশি সময়ের জন্য না। হটাত করেই কেমন যেন ভ্যাপসা গরম লাগা শুরু হলো, আমি একে একে জুতা খুললাম, মোজা খুললাম, জ্যাকেট খুললাম, হাত মোজা খোললাম তারপরেও কেমন যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে নিচ্ছিলো। পানি পান করে মনোযোগটাকে অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিলোনা। বুঝতে পারলাম যেকোন মুহূর্তে আমিও বমি করে দিতে পারি। চোখ বন্ধ করে এক নাগাড়ে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলাম। আস্তে আস্তে মন্দ লাগাটা কিছুটা কমতে লাগলো। প্রায় ৫ ঘন্টা গাড়ি চলার পরে রাত ১০টার দিকে একটি হোটেলে আমাদের যাত্রা বিরতি দিল। খুব খারাপ লাগা অবস্থা নিয়ে বাস থেকে বের হয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে গেলাম। এই তীব্র ঠাণ্ডায় বেসিনের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানি দিয়েই চোখ মুখ ধৌত করলাম। নাক মুখ আর ঘাড়ে ঠাণ্ডার পানির পরশ পাওয়া পরে একটু ভালো লাগলো। ভ্যাপসা একটা অস্থির গরম লাগা সেটাও কমতে লাগলো। এবার গেলাম খাবার খেতে, সুজন আর এলিনের বেশি খারাপ লাগাতে খাবার না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি, মাসুদ, হিমেল আর আইভি খাবার খাওয়ার জন্য বসলাম। ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার নিলেন। ভাত দেখে আমরা ভাতেরই অর্ডার করলাম কিন্তু সেটার বিল যে এতো হবে কখনোই ভাবতে পারিনি। আমাদের দেশে আমরা ভাতের প্লেট কত টাকা দেই? আমাদের ক্যাম্পাসে ৬ টাকা, বাহিরে না হয় বড়জোর ২০ টাকা, ভারতে সেটা না হয় তিনগুন বেশি হয়ে ৬০ টাকা হবে কিন্তু সেটার দাম যখন ১৫০ রুপি হয় তখন অবাক হওয়ার উপায়ও বাকি থাকে না। ভারত সফরে পুরো অংশেই দেখেছি সালাদ হিসেবে ওরা মুলার একটু স্লাইড দেয় আমরা সেটা ছোঁয়েও দেখতাম না। এখানে সালাদ চাওয়াতে একটা পেঁয়াজের উপরের একটা খোঁসা কয়েকটা খন্ড করে দিয়েছে আর সেটার সাথে যথারীতি কয়েকটা মুলার টুকরো। এটারও বিল ধরেছে ৮০ রুপিয়া। মোট কথা খাবার খেয়ে তৃপ্তি তো পাইনিই যখন বিল শুনলাম ১০৬০ রুপি তখন যেন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মতন অবস্থা। কি আর করা বিল দিয়ে বাসে উঠে এলাম। বুঝতে পারলাম কেন লোকজন বাসে খাবার নিয়ে উঠছিল।

পুনরায় বাস চলতে শুরু করলো। সেই সাথে আমার খারাপ লাগাটাও শুরু হলো। ঘুমও আসছিলো না। আমার সিটম্যাট মাসুদেরও দেখলাম আমার মতনই অবস্থা। পাশে হিমেল আর আইভি ভালোই ঘুমোচ্ছিলো। পিছনে সুজন আর এলিনকে অন্ধকারে দেখা না গেলেও বোধ করি তারাও ঘুমাচ্ছিলো ভালোই। একদিকে ওয়াসরুমের চাপ আর আরেকদিকে এই খারাপ লাগা, কি যে বিশ্রী একটা পরিস্থিতির মধ্যে বসে আছি। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাস চণ্ডীগড়ে এসে পোঁছলো। আমাদের সামনের সিটে থাকা ভদ্রলোক নিজের কন্যা আর স্ত্রী কে নিয়ে নামবেন। এই সুযোগে আমি আর মাসুদ নামলাম। মাসুদ কিছুটা উগড়ে দিলো আর আমিও খোলা স্থানেই সুস্থির হলাম। একটু ভালো লাগার পরে হালকা একটা ঘুমের ভাব আসছিলো কিন্তু সেটাকে ঘুম বলা যাবে না কোনভাবেই। বাম পাশের সিটে হিমেল আর আইভির একাগ্রচিত্তের ঘুম দেখে কিছুটা ইর্ষাই লাগছিলো। সত্যি বলতে কি এমন জার্নিতে ঘুমিয়ে পরাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ, তা নাহলে সমস্যা হতেই পারে। যাই হোক ভোর চারটা বা সাড়ে চারটায় আমাদেরকে দিল্লির কোন একটা স্থানে নামিয়ে দেওয়া হলো। দিল্লি নামতেই বিশ্রী হাঁড় কাঁপানো শীতে কাঁপতে লাগলাম। দিল্লির ঠাণ্ডাটা সত্যিকার অর্থেই বিশ্রী। মানালির বরফের রাজ্যের মাইনাস তাপমাত্রায়ও এতোটা হাঁড় কাপানো ঠাণ্ডা লাগেনি যতটা এখানে লেগেছে।

দিল্লিতে সারাদিন

(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার)

সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে কলকাতার বিমান হওয়ায় সারাদিন  দিল্লিতেই থাকতে হবে। হোটেল খোঁজার জন্য অটোতে চড়ে যাত্রা করলাম সেই পাহাড়গঞ্জের দিকে। কয়েক দিন আগের বিশ্রী অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আবার কেন পাহাড়গঞ্জের দিকেই যাত্রা করলাম সেটা আমার বোধগম্য হলো না। একে তো ক্লান্ত তার উপর ঘুম জড়ানো চোখে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করেই তাদের সাথে রওনা করলাম। অটো ড্রাইভার একেকটা হোটেলে নিয়ে যায় আর বাংলাদেশী শুনে নাক কুচকিয়ে ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। কি একটা অবস্থা, এই ভোর বেলাতে আমরা একেকটা হোটেলে যাচ্ছি আর বাংলাদেশি বলে রুম না পেয়ে ফেরত আসছি। খুবই অপমানজনক আর লজ্জাষ্কর পরিস্থিতি। আমার বুঝে আসছিলো না, ভারত আমাদেরকে তাদের দেশের ভিসা দিলো, সব স্থানে যাওয়ার অনুমতি দিলো, আমাদেরকে দিয়ে তাদের লক্ষ কোটি টাকা আয় হলো অথচ আমাদেরকে তারা থাকার জন্য  হোটেল ভাড়া দিচ্ছে না?আর আমাদের মন্ত্রীর ভাষায় তো ভারত বাংলাদেশ নাকি এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক পার করছে, যদিও এনআরসি নিয়ে আসামের ৪০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশি বলে ভারতীয় কর্তারা সর্বদাই তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছে, সীমান্ত মানুষ হত্যা করছে, আমাদের পানি নিয়ে যাচ্ছে এমন হাজারো কিছু। তবুও নিছক বাংলাদেশী বলেই আমাদেরকে হোটেল দেওয়া হচ্ছে না। মনটা খুব তিক্ত হয়ে উঠছিলো। অটো ড্রাইভারও আমাদের চেয়ে আরো বেশি তেতে উঠে একের পর এক হেটেলে নিয়ে যাচ্ছেন এবং বারবার আমাদেরকে অভয় দিচ্ছেন। অটো ড্রাইভার আমাদেরকে একটা স্থানে নামিয়ে দিয়ে যায়নি বরং দাযিত্ব নিয়ে কোন একটা হোটেলে উঠিয়ে দিয়েই তারপর গিয়েছেন। এটাকে হয়তো অনেকে অর্থ পাওয়ার একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু আমি এটা অটো ড্রাইভাবের মানবতা বা দায়িত্বশীলতা বলেই ব্যাখ্যা করবো। অনেক ঘুরাঘুরির পরে অত্যন্ত চড়া দামে খুবই নিম্ন মানের একটা হোটেলে আমরা উঠলাম এবং চেকইন করে কোনরকমে ব্যাগপত্র রেখেই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর পরে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। নাশতা খাওয়ার জন্য দোকান খুঁজতেই কলকাতা বাংলা খাবার, আসমীয় বাংলা খাবার প্রভৃতি দোকানের ভীড়ে দূর থেকে ঢাকা হোটেলের একটি সাইনবোর্ড দেখে এক মুহূর্ত ও দেরি না করে সেটাতেই প্রবেশ করলাম। মালিক হলেন ঢাকা উত্তরার আর কর্মচারি বাহ্মণবাড়িয়ার। কয়েকদিন ধরে ভিনদেশি ভাষা শুনতে শুনতে আর অশুদ্ধ উচ্চরণে বলতে বলতে কানটা একেবারে পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেখানে এই বাংলাদেশী বাংলা ভাষা এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসলো। তৃপ্তিভরে ডালভাজি, ডিম আর পরোটা খেলাম। এমনকি থোড়াও নিলাম। যদিও দিল্লির কোন হোটেলেই থোড়া নেই এমনকি কলকাতায়ও  চেয়ে থোড়া পাইনি। নাস্তা খেয়ে এখন জামে মসজিদের চাদনী চক এলাকায় যেতে হবে। সেখানেই শপিং করার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। অনেকটা বাংলাদেশের  চকবাজারের মতন। আমাদের সবারই টাকা সেই মানালী থাকতেই শেষ পর্যায়ে ছিল। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু টাকা বাংলাদেশ থেকে কলকাতা পর্যন্ত আনানো গেলেও কলকাতা থেকে  মানালি পাঠানো যায়নি। দিল্লির এই এলাকাটিতে দেখলাম রকেট বিকাশের প্রচুর দোকান। চাইলে দেশ থেকে এখানেই সরাসরি টাকা আনানো যেতো যদিও এটা অবৈধ। আমাদের টাকা যেহেতু কলকাতায় এসেছে সেখান থেকে দিল্লি আনানো হলো। কিন্তু কিছু জটিলতায় হাতে আসতে দেরি হচ্ছিলো। আগ্যতা টাকা না নিয়েই চাঁদনি চকের দিকে রওয়ানা করলাম। চাঁদনি চকটি দিল্লি জামে মসজিদ এলাকায়। মসজিদের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম বিকট শব্দে একদল লোক ঢোল, সানাই, বাঁশি বাজিয়ে কি যেন ধর্মীয় রীতি পালন করছে। একেবারে মসজিদের সাথে ই। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সোয়া এগারটা বাজে। আর ৪০ মিনিট পরেই জুমুআর আযান হবে। উল্লেখ্য এই জামে মসজিদ এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত।

দিল্লি জামে মসজিদ

দিল্লি জামে মসজিদ

আশপাশের লোকগুলোর মধ্যে এক ধরণের বেদনা দেখতে পেলাম, কেমন যেন একটা অস্বস্তি সবার চোখে মুখে। বুঝতে পারছিলাম লোকগুলোর মধ্যে চাপা বেদনা আছে, হয়তো কিছুটা ক্ষোভও আছে। জানিনা আযানের সময়টিতে সেসব রীতি তারা থামিয়েছিল কিনা। মার্কেটগুলো কেবল খুলছিলো। আমার ইচ্ছে ছিল কেমনে করে বিয়ের শপিং করা হয়, কি কি কেনা হয় সেটা দেখবার, দেখে একটু শিখবার কিন্তু টাকা সংগ্রহ করার জন্য আইভি আর সুজনকে সাথে করে আমাকে হোটেলের পাশে বিকাশের দোকানে যেতে হয়েছিল। সত্যি বলতে কি এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। হিমেল মাসুদ আর এলিন শপিং এ থেকে গেলো আমরা রওয়ানা করলাম টাকা সংগ্রহ করতে। যাবার পথে জামে মসজিদে লোকজনের জুমুআর নামাযে শরীক হতে প্রবেশ করতে দেখলাম। কল্পনায় ভেসে উঠলো আবদুল্লাহ বুখারীর কথা।
১৯৭৩ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করা দিল্লি জামে মসজিদের মরহুম খতীব আবদুল্লাহ বুখারী কলকাতার হাইকোর্টে যখন পবিত্র কোরআন নিষিদ্ধ করার মামলা হয়েছিলো তখন বজ্রকন্ঠে বলে উঠেছিলেন-

“আমি শুধু দিল্লি শাহী জামে মসজিদের ইমাম নই আমি সারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইমাম বলছি, আমরাই ভারতকে আটশত বছর শাসন করেছি, এই ভারতকে আমরাই সাজিয়েছি। যদি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোন বিচারক মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে বাজেয়াপ্ত করার রায় প্রদান করার মত দুঃসাহস দেখায়, আমি ঐ বিচারকের বুকের উপর পা দিয়ে ওর জিহ্বা কেটে ফেলব। “

সেইদিন পুরো ভারত কেঁপে উঠেছিলো ঈমাম সাহেবের ঐকথা শুনে, এবং ভারতের কোন বিচারক আর কোরআন নিষিদ্ধের মত দু:সাহস দেখান নি ..।

ভারতের আজকের প্রেক্ষাপটে এমন একটি কণ্ঠ, এমন একটি ন্যায়ানুগ হুঙ্কার অনেক বেশি প্রয়োজন।
আজকের ভারতে এই শাহী মসজিদকেই ভাঙ্গার হুংকার ছুঁড়ছে সাম্প্রদায়িক সংঘঠন শিবসেনা। জানি না অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় মুসলিমদের কী অবস্থা হবে?

রিকসা করে পুরোনো দিল্লির বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে পাহাড়গঞ্জে আমাদের হোটেলের কাছে পৌঁছলাম। বিকাশের দোকানদারকে খুঁজে পেতে একটু সময় লাগছিলো। প্রয়োজনটা যেহেতু আমাদেরই বেশি ছিল তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায়ই ছিল না। বেশ একটা সময় পরে দোকানদার আসলেন। ভদ্রলোক কলকাতার বাঙ্গালি। তাই বাংলাতেই কথা বললাম। উনি নিজেই বিকাশের এই প্রক্রিয়াটার কথা ব্যাখ্যা করলেন। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে টাকাটা যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সেটা পৌঁছে। যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি উনার কাছে টাকা আসেনি বরং বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লিতে উনার কাছে এসেছে তাই  টাকাটা বেশ কয়েকটি জায়গাতে চার্জ দিতে গিয়ে বেশ একটা ভালো ‘এমাউন্ড’ই গচ্চা দিতে হয়েছে। আমরা যখন টাকা হাতে পেয়েছি তখন ঘড়িতে ২ঃ৩০ মিনিট। সন্ধ্যায় আমাদের কলকাতাগামী ফ্লাইট থাকায় এখন আর পুনরায় মার্কেটে যাওয়ার সময় ছিল না। তাছাড়া হিমেলও ততক্ষণে মাসুদকে নিয়ে বিয়ের বাজার শেষ করে ফেলেছে। কি আর করা হোটেলের রুমেই চলে এলাম। খুব বেশি কিছু গোছানোর ছিল না তবুও সবগুছিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। হিমেল, মাসুদ আর এলিন আসার সাথে সাথে ই বের হলাম। সকালের নাশতা খাওয়া ঢাকা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে টেক্সি নিয়ে বিমান বন্দরের রওয়ানা করলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার একটু বয়সী ছিলেন এবং সেইসাথে একটু রসিকও ছিলেন। বিমান বন্দরটি দিল্লি শহর থেকে প্রায় ১৬ কি.মি.বাহিরে।
আমাদের সময় কম ছিল কিন্তু চাচা মিয়ার ট্যাক্সির গতিও কম ছিল। এ যেন সমানে সমানে। তার উপরে সামান্য পথ গিয়ে উনি চাকায় হাওয়া নেওয়ার জন্য ট্যাক্সি থামালেন। কি আর করা, আমাদের উৎকণ্ঠা দেখে উনি অভয় দিলেন এবং সঠিক সময়েই বিমান বন্দরে পৌছানোর নিশ্চিয়তা দিলেন। আমাদের রসিক আইভি তখন বলে উঠলো, ‘চাচা, বিমান মিস করলে কিন্তু আপনার বাসাতেই রাখতে হবে আামাদের’। উনিও বেশ হেসেই এই রসিকতার উত্তর দিলেন। দিল্লির রাস্তাঘাট বেশ চওড়া হওয়ায় গাড়ি প্রচুর থাকলেও ট্রাফিক জ্যামও তেমন একটা পরেনি।
এই দিল্লিতেই ৮০০ বছর মুসলিম শাসনের কেন্দ্রভূমি ছিল। সেসব শাসক বিদেশ থেকে আসলেও ভারতবর্ষকেই নিজেদের স্বদেশ হিসেবে আপন করে নিয়েছিল। বৃটিশদের মতন শাসন করে টাকা বৃটেনে পাচার করেনি। সেন্টার আর পেরেফেরির বিভাজন করেনি। মুসলমানদের ৮০০ বছর শাসনকালে ভারতবর্ষ ই সেন্টার আর পেরিফেরি ছিল। বৃটিশরা এসে পেরিফেরি বানায় বৃটেনকে আর সেন্টার থাকে এই ভারতবর্ষই। যে লোকেরা ভারতবর্ষকেই নিজেদের আপন করে নিয়ে সকল কিছু ভারতবর্ষে ই রাখলো তারাই এখন পরদেশি, বিদেশি আরো কত কি। আর যারা লুটেপুটে সব নিলো তারাই আপন। সুলতানি আমল আর মুঘল আমলের কত স্থাপত্য আজও দিল্লির আলিগলিতে দৃশ্যমান। যদিও সেসব মুছে ফেলতে বিজেপি সরকার বদ্ধপরিকর। আওরঙ্গজেব রোডের নামকরণ হয়েছে এপিজে আবদুল কালাম, তাজমহলকে দাবি করা হচ্ছে তেজো মন্দির সহ আর কত কি। জানি না আর দুয়েক প্রজন্ম পরে মুসলিম শাসন যে ভারতে ৮০০ বছর ছিল সেটা হয়তো কল্পনাই করতে পারবে না। আর নাটক, সিনেমা, সিরিয়ালে যেভাবে মুসলমানদের সন্ত্রাসী, পরদেশি আর টেরোটিস্ট আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তাদের মুসলিম পরিচয় নিয়েই হয়তো ভারতবর্ষে টিকে থাকাটা কষ্টকর হয় যাবে।
যাই হোক গাড়ির হর্ণে ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে ফেরত আসলাম। দূর থেকে ইন্দিরাগান্ধী বিমান বন্দরটি দেখতে পেলাম। বিমানবন্দরের একটু আগেই আমাদের টেক্সি প্রথম দফা চেক হলো। চেকিংয়ে আমাদের সবাইকেই নামতে হলো। কতব্যরত গার্ড আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে একটু সহজ হয়ে মুখে একটা হাসি টানলেন। তাদের দেশ কেমন লাগলো সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। একটু সহজভাবেই চেকিং শেষ করে বিমানবন্দর চত্ত্বরে এসে টেক্সি ছেড়ে দিলাম।

পর্ব-৪: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (শেষ পর্ব) 

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

ভ্রমণ কাহিনী

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (শেষ পর্ব)

Published

on

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি
আগের পর্ব: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (৩য় পর্ব)

দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর ও আমার প্রথম বিমানে চড়া

(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার ) লাইনধরে সবাই টিকেট হাতে নিয়ে এক একজন করে প্রবেশ করছে সবার সাথে লাইনে দাঁড়ালাম। পূর্বে কখনো বিমানে চড়া হয়নি ফলে কোন এয়ারপোর্টের ভিতরেও প্রবেশ করা হয়নি। কেমন করে ইমিগ্রেশন হয় সেই বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতাই নেই। তবে নাটক সিনেমাতে এসব দেখার কারনে খুব একটা সমস্যা হয়নি। তাছাড়া আমাদের বন্ধু সুজন সৌদি আরবে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরী করার কারনে স্বাভাবিকভাবেই ইমিগ্রেশনের যাবতীয় বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ছিল। বাকি ৫ জনই এই বিষয়ে তার সহায়তা নিয়েছি। এয়ারএশিয়া এয়ারলাইনের ফ্লাইটটি ছিল সন্ধ্যা ৭:০৫ মিনিটে। বিমান বন্দরে প্রবেশ করি ৪ঃ৩০ মিনিটের কিছু পরে। ভিতরে প্রবেশ করে এয়ারএশিয়ার অনেকগুলো কাউন্টার থেকে একটি কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ালাম। একজন একজন করে যাচ্ছে আর টিকেট চেক করে লাগেজে ট্যাগ লাগাচ্ছে। নিজের পাসপোর্ট রাখার পাসটি ছাড়া বাকি দুটি ব্যাগই লকারে দিয়ে দিলাম। আমার বন্ধুদের কাজ শেষ হয়ে গেলেও আমার কাউন্টারে একটু জটিলতা দেখা দেওয়ার ফলে আমাকে নিয়ে কাউন্টারে থাকা ভদ্রমহিলা অপর একটি কাউন্টার থেকে প্রয়োজনীয়  কাজ শেষ করে আমাকে “ছাড়পত্র “দেন। এবার আরেক দফা এবং চূড়ান্ত চেকিংয়ের পালা।
ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

এখানেও লাইনে দাঁড়ালাম, শুধুমাত্র রুপি ছাড়া প্যান্টের বেল্ট, জ্যাকেট, পাসপোর্ট, পার্স, মানিব্যাগ সব একটা বক্সে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সামরিক বাহিনীর লোকজন স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পর চেকিং করছেন। সন্দেহ হলে কারো কারো জুতা ও মোজাও খুলতে বলছেন। ভাগ্যিস আমাকে সে পর্যন্ত যেতে হয়নি। স্ক্যানার পেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হলো। অবশ্য এক্সিলেটরও ছিল।
ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

এক সময়  এই বিমানবন্দরটির নাম ছিল পালাম বিমানবন্দর। বর্তমান নাম ইন্দিরাগান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি  নতুন দিল্লি শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে পালামে অবস্থিত। বিমানবন্দরটি মোট ৫, ১১০ একর জমি নিয়ে গঠিত। এই বিমানবন্দরে মোট ৩টি রানওয়ে ও তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। এটি ভারতের অন্যতম ব্যস্ততম বিমানবন্দর ও বিশ্বের ২১তম  ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিবছর ৭ কোটি যাত্রী চলাচল করে থাকে। আমরা এই বিশাল এয়ারপোর্টের নিজেদের নির্ধারিত ৩ নম্বর টার্মিনালের ৬ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। টার্মিনালের সামনে এসে বিমানে চড়ার আগে আরেকদফা চেকিং শেষ করে বিমানে প্রবেশ করলাম। বিমানে চড়ার সময় অনেকটা সদরঘাটের অনুভূতি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ঘাটে ভেড়ানো জাহাজ  চড়লাম। সিট নম্বর অনুযায়ী আমাদের ৬ জনের মধ্যে এলিন, সুজন আর মাসুদ একসাথে, হিমেল আর আইভি একসাথে বসেছে। আমি সবার সামনে একাকিই বসলাম। একে একে যাত্রীরা এসে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করছেন। আমার পাশে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা নিজের স্বামীকে নিয়ে এসে বসলেন। দেখে মনে হয়েছিল ভারতীয়। কিন্তু উনি যখন বাংলায় আমার সাথে আলাপ শুরু করলেন তখনই বুঝতে পারলাম উনি বাংলাদেশী। চিকিৎসার জন্য দিল্লি এসেছেন এখন সেটা শেষ করে কলকাতা যাচ্ছেন। সেখানে দিন দুয়েক থেকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাংলাদেশে ফিরবেন। বিমানের দরজা বন্ধ হওয়ার পরে লাউডস্পিকারে বিমান ছাড়ার ঘোষণা এলো। জানালার পাশে যেহেতু বসতে পারিনি তাই বাহিরের কিছুই দেখা সম্ভব হয়নি। আর অন্ধকার রাতে তেমন কিছু দেখাও সম্ভব ছিল না। এয়ার হোস্টেসগণ ইংরেজি ও হিন্দিতে সিট বেল্ট বাঁধা সহ প্রযোজনীয় দিকনির্দেশনা মুখে বলে ও অভিনয় করে বুঝিয়ে দিলেন। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো মেয়েদের সৌন্দর্যের দিকটিই যে বেশি প্রাধান্য দেয় সেটা উনাদেরকে দেখেই বুঝতে পারা গেলো। এতো পরিমান মেকাপ ছিল যে এদের আসল সৌন্দর্য ই বুঝা দায়। দিল্লির আলো ঝলমলে বিমানবন্দর ছেড়ে বিমান আকাশে উড়াল দিল।
পাখির চোখে রাতের দিল্লি

পাখির চোখে রাতের দিল্লি

এই সময়টিতে যেন খারাপ লাগা না স্পর্শ করতে পারে সেজন্য বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম উপড়ের দিকে উঠে এখন বিমান আকাশে সমানভাবে উড়ছে তখনই চোখ খোললাম। পাশে বসা আন্টির সাথে আলাপনে জানতে পারলাম উনার  অসুস্থ স্বামী চকবাজারের বড় ব্যবসায়ী। উনারা থাকেন কেরানীগঞ্জ। উনি এখন আর গদিতে নিয়মিত বসেন না, মাঝে মাঝে গিয়ে বসেন। পার্টনার আর কর্মচারীরাই ব্যবসার যাবতীয় দিক দেখভাল করেন। উনাদের সাথে তাদের বড় মেয়ে ও তার সন্তান এসেছে। উনার স্বামীকে একবার ওযাসরুমেও নিয়ে গেলাম। তখন আন্টির কৃতজ্ঞ চাহনি আমাকে বেশ প্রশান্তি দিযেছে। কিছুক্ষণ পরে এযার হোস্টেস নাশতা নিয়ে আসলো। টিকেট অনুযায়ী একেকজনকে একেক রকমের নাশতা দিচ্ছে। আমার পাশে বসা অন্টিদের টিকেটে কোন নাশতা ছিল না। আমি নিজের নাশতা থেকেই উনাদের সাথে শেযার করলাম। উনার স্বামী শুধু কফিটুকুই খেলেন। আন্টির সাথে গল্প করে জানতে পারলাম উনাদের বিরাট ফ্যামেলি বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় সবাইমিলে একত্রে ট্যুরে বের হন। ভারতে উনি ১০-১২ বারের মতন এসছেন এবং আজমীর, রাজস্থান, মানালি, দিল্লি সহ বহু স্থানে ঘুরেছেন। উনার সাথে গল্প করতে বেশ ভালোই লাগছিলো। দিল্লি থেকে কলকাতার দূরত্ব হচ্ছে ১৫০০ কি.মি.। যাওয়ার পথে ট্রেনে আমাদের সময় লেগেছিল প্রায়২০ ঘন্টার মতন। আজকে লাগবে মাত্র ২ ঘন্টার মতন। গল্পে গল্পে কখন যে ২ ঘন্টা কেটে গেল টেরই পেলাম না। লাউড স্পীকারে যখন ঘোষণা আসলো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতার নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর বিমান বন্দরে আমরা অবতরণ করবো আর সেই সাথে তাদের বিমানে চড়ার জন্য ধন্যবাদও জানালো। আন্টি আমার ফোন নম্বর নিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ও শুভকামনা জানিয়ে বিমান থেকে নামলাম। তখন আদীব হুজুরের একটা কথা মনে আসছিলো “পৃথীবিতে অধিকাংশ লোকের সঙ্গে একবারই দেখা হয়”। যদিও হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন প্রকৃতি নাকি মানুষের সাথে ৪ বার দেখা করায়। এসব ভাবতে ভাবতে লাগেজ দেওয়া নয় নম্বর বেল্টের দিকে হাঁটতে লাগলাম। নয় নম্বর বেল্টে এসে নিজ নিজ লাগেজ সংগ্রহ করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে  দ্বিতীয়বারের মতন কলকাতার মাটিতে পা রাখলাম।

কলকাতায় প্রথম রাত ও ভারতে এযাত্রায় শেষ রাত

(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার )
রাতের কলকাতা

রাতের কলকাতা

কলকাতায় আমাদের গন্তব্য শহরের মার্কুই স্টিট। সেখানেই রাত্রি যাপন করে সকালে হালকা শপিং করে ১১ টা নাগাদ কলকাতা ত্যাগ করবো।  নেতাজি সুবাস বসু বিমানবন্দরটি কলকাতা শহর থেকে ১৭ কি.মি. বাহিরে। নেতাজি নামটির সাথে ই বাঙ্গালির মনে কি পশ্চিম বঙ্গ কি বাংলাদেশ সবারই একটা আবেগ কাজ করে। নেতাজি অনেক বাস্তববাদী এবং উদার রাজনীতিবিদ ছিলেন। অনেক রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন যে, নেতাজি বেঁচে থাকলে কিংবা নেতাজির অন্তর্ধান নাহলে হয়তো ভারতবর্ষ কখনোই ভাগ হতো না, হয়তো জহরলাল নেহেরু শেষ মুহূর্তে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না।রাজনীতি বড় পিচ্ছিল জায়গা। যার পদে পদে হয় সৃষ্টি নাহয় ধ্বংস লেখা থাকে। আমার মনে হয় সুভাস বসুর মৃত্যু বা অন্তর্ধানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই পশ্চিম বঙ্গই। কত কিছু মনে পড়ছিলো কিন্তু বাস্তবতায় ফেরত আসলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই ট্যাক্সি ভাড়া করার কাউন্টার দেখতে পেলেও সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া না করে একটু হেঁটে সামনে গেলাম। সেখান থেকে দুটি হলুট ট্যাক্সি নিয়ে রওয়ানা করলাম। এই ট্যাক্সিগুলো ভারতীয় সিনেমায় বহুত দেখেছি আজ চড়া হলো। রাতের কলকাতার ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি খুব দ্রুতই চলছিল। আজকে কলকাতার নতুন অংশ হয়ে যাচ্ছি। ফলে রাস্তার দুপাশে গিজগিজ অবস্থা না দেখে বেশ গুছানো পরিপাটি ছিমছাম কলকাতাকে দেখলাম। একটানা ৪০-৫০ মিনিট চলার পরে মার্ককুইস স্টীটে এসে পৌঁছলাম। এখানে এই রাতেও প্রচুর বাংলাদেশি দেখতে পেয়ে মনে হলো  কলকাতা যে  বাংলাদেশি মারফত প্রচুর বাণিজ্য করে থাকে সেটা অসত্য নয়। বাংলাদেশি বিভিন্ন বাসের কাউন্টার, বাংলা ভাষার ব্যবহার কেমন যেন একটা সহজ সহজ ভাব। টেক্সি থেকে যেখানে নেমেছি সেখানে প্রচুর হোটেল আর লজ রয়েছে। আমাদের এই টুরিস্টি হালাত দেখে মাছির মতন হোটেলের দালালগন ঝেঁকে ধরছে। সবাই ই বলছে কমদামে ভালো হোটেল একটু তার সাথে গিয়ে দেখে আসতে। আমরা কারো কথাকেই তেমন পাত্তা দেইনি। আমি, সুজন আর এলিন রাস্তার পাশে সবার ব্যাগগুলো নিয়ে বসে থাকি আর মাসুদ, হিমেল আর আইভি হোটেল খুঁজতে যায়। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে ৬ জনের থাকার জন্য হোটেল সালিমার প্যালেসের একটি রুম বুক করে। হোটেল বুকিং করার পরে রাতের খাবারের জন্য খাবারের হোটেলে ঢুকি। সেখানে  মুরগি আর ডাল সবজি এসব দিযে রাতের খাবারটা শেষ করলাম। বিল মিটিয়ে হোটেল সালিমার প্যালেসের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হোটেলে এসে সবাই ব্যাগ রেখে একে একে গোসল করে ফ্রেস হলাম। এবার হিসাব করার পালা। সারাটা ট্যুরে হিসাবের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে মাসুদ। এই দাযিত্বটা সব সময় মাহবুব পালন করতো কিন্তু বিশেষ সমস্যার কারনে সে আসতে না পারায় মাসুদ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এটা পারন করেছে। টাকা পয়সার হিসেব আসলেই অনেক জামেলার। বাংলাদেশ থেকে দশহাজার টাকার বিকাশ আনিয়ে আমি পেলাম ৭ হজার রুপি। মাসুদও তেমনই। এসব হিসেব শেষ করে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

কলকাতায় শেষ দিন

(২৫.০১.২০২০, শনিবার ) আজকেই ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হবে। শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে দুপুরের দিকে একটি ট্রেন আছে সেটা যাবে বনগাঁ পর্যন্ত। সে ট্রেনটিই  ধরার পরিকল্পনা। সকাল ৮ টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তারপর নিচে নামলাম। কলকাতার হোটেলের লিফটগুলো কেচি গেট সংশ্লিষ্ট। গত ট্যুরে শিলিগুড়িতেও এমনটি দেখেছি। আমাদের বাংলাদেশে এমন লিফটের ব্যবহার কোথাও দেখিনি। মোটামোটি মানের একটা হোটেলে নাস্তার জন্য ঢুকলাম। এখানেও বেশ কজন বাংলাদেশী দেখতে পেলাম। ছোট্ট দোকান আর কাস্টমার বেশি হওয়াতে বেশ ভিড় ছিল। একটু সময় নিয়ে হলেও পরোটা সবজি আর ডিমভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। কলকাতার মার্কেটগুলো তখনও খুলেনি। দুই একটি দোকান বিক্ষিপ্তভাবে খুলেছে কেবল। তাড়া থাকায় এর মধ্যেই টুকটাক কেনাকাটা করতে হচ্ছিলো। গতকাল রাতে ৭ হাজার রুপি হাতে পেয়েছিলাম, এর মধ্যে কিছু বকেয়া পরিশোধ করে ৪ হাজারের মতন ছিল। শপিংয়ের প্রতি বরাবরই অনীহা। তবুও কিছু একটা কিনতেই হবে, কোন পরিকল্পনা ছাড়াই অনেকগুলো চকলেট কিনে ফেললাম, শ্রী লেদারে গিয়ে ভাতিজির জন্য একটা ব্যাগ কিনলাম,
শপিং শেষে শ্রীলেদারের সামনে

শপিং শেষে শ্রীলেদারের সামনে

এই দোকানে এসেই অভিনেতা- নির্মাতা তৌকির আহমেদকে দেখেছি। আমার সঙ্গীরা তাঁর সাথে ছবি তুললেও আমি তেমন আগ্রহ পাইনি। কসমেটিকস এর দোকান থেকে অল্পস্বল্প কিছু কিনতেই টাকা শেষ হল। এসব দোকান ঘুরে আমি একটা বিষয় লক্ষ করলাম আপনি যত টাকার শপিং ই করেননা কেন কোন দোকানদারই আপনাকে এক পয়সাও ছাড় দিবে না। কি মুসলিম দোকানদার, কি হিন্দু দোকানদার এখানে  সবার মনোভাব অভিন্নই দেখলাম। বাংলাদেশীদের প্রতি কলকাতার মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বুঝার চেষ্টা করছিলাম। মনে হল বাংলাদেশীরকে ওরা কেবল মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই দেখে, সেখানে শ্রদ্ধাবোধের বালাই খুব কমই আছে। আমার আর কোন কেনাকাটা বা কাজ না থাকায় হোটেলে চলে আসলাম। আসার পথে বেশ কয়েকজনই জিজ্ঞেস করেছে, ” দাদা বিকাশে টাকা আনা লাগবে”। বুঝতে পারলাম এই বিষয়টি এখানে খুব প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচুর লোকজন এখানে যাতায়াত করে আর সবাই হয়তো বিকাশে টাকা আনানোর কাজটি করে। কাজটি সম্পূর্ণই বেআইনি কিন্তু পৃথিবীর কত কিছুই তো আইনসিদ্ধ নয়, তবুও তো সেসব চলছে। জানি না এভাবে দৈনিক কত হাজার লক্ষ টাকা লেনদেন হচ্ছে। তাড়া থাকায় একে একে সবাই হোটেলে ফিরলো। ব্যাগ নিয়ে সবাই নিচে নামলাম। লিফটি অনেক ছোট হওয়ায় একসাথে সবাই নামতে পারলাম না। তিনজন তিনজন করে দুইবারে নামলাম। চেক আউট করে দুটি ট্যাক্সি নিলাম শিয়ালদার উদ্দেশ্যে।
কলকাতার হলুদ টেক্সি

কলকাতার হলুদ টেক্সি

শিয়ালদাহ থেকেই বানগাঁর ট্রেনে চড়বো। কলকাতার যে রাস্তা দিয়ে আমরা শিয়ালদাহ পৌঁছলাম সেটা বেশ সরু রাস্তা। কলকাতার লেখকদের যে বইগুলো আমরা পড়ি কে জানে হয়তো এসব রাস্তা বা বাড়ির বিবরণই সেখানে রয়েছে। শিয়ালদাহ স্টেশনটি খুব বড় না। মূলত লোকাল যাত্রীই এখানে বেশি। স্টেশনে গিয়ে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। সময়মতই বনগাঁ লোকাল ট্রেনটি এসেছে। লোকজন দেখলাম হুড়মুড়িয়ে বগিতে চড়ে যার যার সিট দখল করছে। আমরাও একটি বগিতে চড়ে নিজেদের মত করে আসন নিয়ে বসলাম। শুরুতে একটু ফাঁকা থাকলেও স্টপেজ যত বাড়ছিলো লোকজনও বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।
বনগাঁ লোকাল ট্রেন

বনগাঁ লোকাল ট্রেন

কলকাতার এই লোকাল ট্রেনে উঠলে সেখানকার মানুষদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে কলকাতার বাঙ্গালির (কি হিন্দু কি মুসলিম )থেকে বাংলাদেশী বাঙ্গালি (কি মুসলিম কি হিন্দু ) অনেক বেশি উদার, অনেক বেশি দিলখোলা। এটা হয়তো মাটিরই প্রভাব, এটা হয়তো সংস্কৃতি আর কৃষ্টিরই প্রভাব। ওরা যতই বলুক না কেন আমরা এক, আমরা অভিন্ন, আমাদের ভাষা সংস্কৃতি আর রীতিনীতি সব এক আমি এটা বিশ্বাস করবো না। ধর্মীয় বিভাজন ছাড়াও ওদের মানুষিকতার সাথেই আমাদের দেশের হিন্দু মুসলিম কারোর মানুষিকতাই মিলবে না। ট্রেন চলছে আস্তে আস্তে হেলে দুলে। লোকাল ট্রেন তাই সব স্টেশনেই থামছে। যাত্রী উঠছে, যাত্রী নামছে। কলকাতা শহর আর শহরতলী পার হতেই  দুই পাশের ঘিঞ্জি ভাবটা কমে ফাঁকা জমির দেখা পাচ্ছিলাম। সবুজের এই সমারোহটা বাংলাদেশের মতনই।
যশোর সীমান্তে পশ্চিমবাংলা অংশের সবুজ প্রকৃতি

যশোর সীমান্তে পশ্চিমবাংলা অংশের সবুজ প্রকৃতি

চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এটা দেখেই হয়তো সাহিত্যিকগন দুই বাংলা একই রকম হওয়ার লেকচার কপচান কিন্তু সত্যি বলতে কি সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে যেটা প্রকাশ করা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। সুভাস বসুর পরে শরৎ বসু ও আমাদের শেরেবাংলা পাকিস্তান ভারতের বাহিরে থেকে দুই বাংলাকে এক রেখে স্বতন্ত্র রাখতে বা থাকতে চেয়েছিল, কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও তাতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দ্বারা যারা আক্রান্ত লোকগুলোই সেখানে বাগড়া দিয়েছিল। ১৯০৫ সালে যখন বাংলাকে ভাগ করে তখন কি হুলুস্থুল কান্ডকারখানা ই না করলো, বিপ্লবি আন্দোলন বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদ, আমার সোনার বাংলা লিখা সহ কতশত সভাসমিতি আরো কত কিছু। শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বৃটিশরা সেটা রদ করতে বাধ্য ই হলেন। তবে বৃটিশদেরও যে এখানে কূটচচ ছিল না সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই হুলুস্থুল করা লোকগুলোই ১৯৪৭ সালে এসে  আর বাংলাকে এক রাখার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করলেন না। এখানেও নাম চলে আসে সেই সুভাস বসুরই। ইশ যদি তিনি থাকতেন, যদি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো বাংলা অবিভক্ত ই থাকতো। সত্যি বলতে কি ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগের বিরোধিতা যেমন কতেক মানুষের  ব্যবসায়িক স্বার্থে ছিল তেমনি ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের পক্ষ থাকাটাই তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ আর সংকীর্ণ মনোভাবেরই প্রকাশ ছিল। এসব আবেগ আর অনুভূতির প্রকাশ ছিল রাজনীতির মাঠ গরম করার ফাঁকা বুলি। তবে আমার মনে হয় দুই বাংলা বিভক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের যতটানা ক্ষতি হয়েছে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ওদেরই। অবিভক্ত বাংলা থাকলে আমরা হয়তো কখনোই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পেতাম না, হয়তো কলকাতার লোকগুলো আমাদেরকে নিয়ে চিরকালই নাক কুঁচকিয়ে থাকতো, হয়তো একটা সময়ে ভারত ডোমিয়েনে যোগ দিয়ে ফেলতো। আমরা বাংলাদেশীরা চিরকাল নিগৃহীত ই হতাম। ভারতীয়দের সাথে পাকিস্তানের যতই বৈরি সম্পর্ক থাকুক না কেন ক্রিকেটে তারা বাংলাদেশের বিপরীতে পাকিস্তানকেই সমর্থণ করবে। এটাকে আমি একটা প্রতিকী হিসেবেই মনে করি। আমি জানি এখানে অনেকেই ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা নিয়ে আসবেন। কিন্তু ৭১ সালের ভারতের সহায়তা যতটা বাংলাদেশের স্বার্থে ছিল ঠিক ততটাই ভারতের নিজের স্বার্থেই ছিল। আর ভারতের অভিলাষ ছিল বাংলাদেশকে একটি কদর রাজ্য হিসেবে রাখা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতন পাহাড়মস ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতা সেই ৭২ সালে বাংলাদেশের জন্মের অঙ্কুরেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কারো কদর রাজ্য নয় বরং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজও ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে ক্রিকেট ম্যাচ হলে ভারতীয়রা (কলকাতার অধিবাসীরা )পাকিস্তানের পক্ষেই গলা ফাটায়, নিজেদের হাততালি সব আফ্রিদি আর আমিরদের জন্য ই সংরক্ষিত রাখে। গত টি টোয়ান্টি বিশ্বকাপের ইডেন গার্ডেনের বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচটিই তার প্রমাণ। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বনগাঁ চলে এসেছি টের পাইনি। বনগাঁ স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো করে বর্ডারে আসলাম। বর্ডারে আসতেই লোকজন রুপি দিয়ে টাকা করার অফার করলো। ভারত থেকে যারা এখন বাংলাদেশ ফিরবে তাদের বেঁচে যাওয়া রুপি বাংলাদেশী  টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করাই ওদের টার্গেট। আমার কাছে কোন রুপি না থাকাতে তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে ইমিগ্রেশনের দিকে হাঁটা ধরলাম। ভারত অংশের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বাংলাদেশ অংশে ঢুকার আগে কিছুটা অপেক্ষা করতে হলো। দুই দেশের বর্ডার গার্ড কুচকাওয়াজ করছিলো। সেজন্য ইমিগ্রেশনের কাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ। দুই দেশের সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখলাম। কেন যেন আমার দেশের সৈন্যদের কুচকাওয়াজ বেশি ভালো লাগলো। আমার দেশের সৈনিকদের ওদের তুলনায় বেশি দক্ষ মনে হলো। মনে পড়ে গেলো কয়েকদিন আগের রাজশাহী সীমান্তে এক অফিসারের কথা। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষের পরে ভারতীয় প্রোপাগাণ্ডার জবাবে কঠিন ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা জাতিগতভাবে মদ্যপ নই”। একটি বাক্য যে হাজারও বুলেট থেকে শক্তিশালী হতে পারে ঐ অফিসারের এই বাক্যটিই তার প্রমাণ। কত বিষয় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন এই একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে। একটা সময় কুচকাওয়াজ শেষ হলো। ভারতীয় ভূখন্ড ছেড়ে নো ম্যানস ল্যাণ্ড পেরিয়ে পা রাখলাম আমার ভূমিতে, আমার স্বদেশের ভূমিতে। এমন একটা তৃপ্তিবোধ আমাকে পেয়ে বসলো সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতন না। মনে হচ্ছিলো এই বর্ডার গার্ড, এই ভবন, এই পুলিশ এসবই আমার, আমাদের। আমার এই পুলিশ যদি এখন আমাকে জেলও দেয় তবুও আমার দেশের জেল। আমার দেশের আইন। আমার দেশের কানুন। সত্যি বলতে কি এই প্রথম এতোদিন দেশের বাহিরে গিয়ে থাকা ফলে আবেগটা একটু বেশিই ছিল। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে আমি যখন  বের হচ্ছিলাম তখন মুক্ত মানুষের অনুভূতি হচ্ছিলো।

বাংলাদেশে প্রবেশ ও আমাদের নিজ নিজ নীড়ে ফিরা

  বর্ডার পার হতেই বাসের স্টাফরা  মৌমাছির মতন ঘিরে ধরলো। সবাই চাচ্ছে তাদের বাসে যাই এবং সবাই ই ভাড়া কমানোর অফার দিচ্ছে। ধীরস্থির ভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিলাসবহুল সেবা গ্রীনলাইন বাসে যাত্রা করার মনোস্থির করলাম। বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে আর কোন যাত্রী আসবে না সুতরাং দরকষাকষিতে আমরাই ছিলাম সুবিধাজনক অবস্থায়। কাউন্টারে ব্যাগগুলো রেখে ফ্রেস হয়ে খাবার খেতে গেলাম। তার আগে আমি বিকাশ থেকে টাকা তুললাম। আব্বার সাথে কথা বলে নিরাপদে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের বিষয়টি জানালাম সেই সাথে সুস্থ আছি সেটাও বললাম। সকালের নাশতার পরে আর কোন খাবার খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যা বেলায় অন্য কোন খারার না খেয়ে ভাত, ডাল আর ডিমভাজি খেলাম। গরম ভাত হওয়ায় খাবারটা বেশ তৃপ্তিদায়কই হল। খাওয়া শেষে চা পান করে সবাইকে ছোট্ট একটা মিটিং করলাম। সেখানেএই সফরে যদি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে থাকে তাহলে সবাই সবাইকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানালাম। সবাই এতে বেশ স্বতস্ফুর্তভাবেই সহমত পোষণ করলো। খাবার হোটেল থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে গেলাম। ব্যাগগুলো বাসের লকারে তুলে নির্ধারিত আসনে বসলাম। ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও বাস ছেড়েছে ৭ঃ৩০ মিনিটে। রেডিওতে বিবিসির সন্ধ্যার খবর শুনার চেষ্টা করলাম কিন্তু এফএম তরঙ্গ ভালো না থাকার কারনে শুনতে পাচ্ছিলাম না। একটু সামনে আসতেই বিজিবির নিয়মিত চেকাপ। সেটা শেষ করতেই বাস আবার চলা শুরু করলো। আমি মোবাইলে ভূতএফএম ছেড়ে কানে হেডফোনগুজে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। ঘন্টাখানিক বা তারচেয়ে বেশি চলার পর যশোর শহরে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। বাস থেকে নেমে কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করলাম। আবার বাস ছাড়লো, ঘুমের চেষ্টা করলাম। হালকা ঘুম আসলো। ঘুমের মধ্যে টের পেলাম ঘাটে চলে এসেছি। খুব বেশি ভিড় না থাকায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফেরিতে উঠে ঘাট পার হয়েছি। মানিকগঞ্জ যখন পার হচ্ছিলাম তখনই পুরোপুরি চোখ খুলে বাস থেকে নামার  মানুষিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাস যখন নবীনগর পার হয়ে প্রান্তিক গেইটে আসলো তখনই বাস থেকে নামলাম। লকার থেকে ব্যাগপত্র নিলাম। নামার আগে আদীব হুজুরের কথা মতন চালক ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম। আমাকে প্রান্তিকে রেখে বাসটি সোজা ঢাকার পথে চলে গেলো। রাত ৪ টা ছুঁইছুঁই, এই সময়ে কোন রিক্সা পাওয়া যাবে না। কাঁধে একটি বিশাল ব্যাগ আর দুই হাতে দুটি হাতব্যাগ নিয়ে হলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার হল একেবারে জাবির শেষ মাথায় গেরুয়া ঢালের একটু আগে। সত্যি বলতে কি এতোক্ষণ ভূত এফএম শুনাতে শরীরটা একটু ছমছম করছিলো। তবুও হাঁটতে থাকলাম। মনে মনে একটা রিক্সার প্রত্যাশা করছিলাম কিন্তু চৌরঙ্গী এসেও কোন রিক্সা না পেয়ে সেটার আশা ছেড়ে দিয়েই টান্সপোর্ট, আলবেরুনি (সম্প্রসারিত ) এর পাশ দিয়ে সালাম বরকত কামালউদ্দীন পার হয়ে বটতলায় এসে দুই একজন মানুষ দেখতে পেলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ আর আরজের মাঝখানে একটি রিক্সা দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা আর নিলাম না, হেঁটেই বাকি পথটুকু ঘামে ভিজে পারি দিয়ে আমার নীড় ৪২৬ নম্বরের সামনে আসলাম। বারন্দার বাতিটি জ্বালিয়ে দরজায় নক করলাম। সোহাগ সাহেব দরজা খোলে দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হলো আমার ভারত সফর। সমাপ্ত

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

ভ্রমণ কাহিনী

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)

Published

on

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

আগের পর্ব পড়ুন: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব)

টয় ট্রেনে যাত্রা

(২০.০১.২০২০, সোমবার)

টয় ট্রেনে নিজ নিজ আসন নিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই তা চলতে শুরু করলো। আসলে ট্রেন হলেও এতো উপরের পাহাড়ি পথে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ১৮৬৪ সালে বৃটিশ সরকার সিমলাকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করার পরে ১৮৯৮ সালে এই রেল লাইনটির কাজ শুরু হয় এবং ১৯০৩ সালে এসে শেষ হয়। কালকা থেকে সিমলার রেল দূরত্ব হল ৯৬.৫৪ কি.মি এবং এই পথে ১৮টি স্টেশন রয়েছে।
১-০ কি.মি.কালকা
২-৬ কি.মি.টাকসাল
৩-১১ কি.মি.গাম্মান
৪-১৭কি.মি.কটি
৫-২৭ কি.মি.সন্বোয়ারা
৬-৩৩ কি.মি.ধরমপুর
৭-৩৯ কি.মি.কুমারহাট্টি
৮-৪৩ কি.মি.বারোগ
৯-৪৭ কি.মি.সোলান
১০-৫৩ কি.মি.সালোগ্রা
১১-৫৯ কি.মি.কান্দাঘাট
১২-৬৫ কি.মি.কানোহ
১৩-৭৩ কি.মি.কাথলীঘাট
১৪-৭৮ কি.মি.শঘী
১৫-৮৫ কি.মি.তারাদেবি
১৬-৯০ কি.মি.টটু(জতুগ)
১৭-৯৩ কি.মি.সামারহিল
১৮-৯৬ কি.মি.সিমলা

কালকা সিমলা রেলপথে সেতুঃ-

এই রেললাইনে ৮৬৪ টি সেতু আছে যার একটি ১৮.২৯ মিঃ লম্বা স্টিলের সেতু। বাকিগুলো প্রাচীন রোমান স্থাপনা সদৃশ অনেকটা গ্যালারীর মতন দেখতে।

মানালির

ছবি: সেতু

কান্দাঘাট ও কানোহ স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ৪৯৩ নম্বর সেতুটি “আর্ক গ্যালারী” নামে পরিচিত। পাথরের তৈরি এই সেতুটি তিন স্তর বিশিষ্ট  গ্যালারী মতন।

সিমলাসন্বোয়ারা ও ধরনমপুরের মাঝে অবস্থিত ২২৬ নং সেতুটি পাঁচ স্তরবিশিষ্ট গ্যালারীর মত।

কালকা সিমলা রেলপথের সুরঙ্গ:-

প্রথমদিকে কালকা- সিমলা রেলওয়ে রুটে মোট ১০৭ টি সুরঙ্গ পথ ছিল। ১৯৩০সালে এই ১০৭টি সুড়ঙ্গ পথের ৪টি সুড়ঙ্গ পথ ভেঙে ফেলা হয় এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে আরো একটি (৪৬ নম্বর সুড়ঙ্গটি)ভেঙে ফেলার কারনে বর্তমানে মোট ১০২ টি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে।

সুরঙ্গ

ছবিঃ সুরঙ্গ

সবচেয়ে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ হল বারোগে সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গ নিয়ে স্থানীয় লোকের মধ্যে একটা কিংবদন্তী রয়েছে। এ সুড়ঙ্গের জনৈক প্রকৌশলী নিজ খননকৃত সুড়ঙ্গের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন। তিনি সুড়ঙ্গটি তৈরী করতে গিয়ে দুই দিক থেকেই খনন শুরু করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি উভয় দিক থেকে জোড়া লাগাতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার শাস্তিস্বরূপ তাকে ১ টাকা জরিমানা করা হলে তিনি এতটাই অপমানিত হন যে, ব্যর্থতার সে গ্লানি  সহ্য করতে না পেরে অসম্পূর্ণ সেই সুড়ঙ্গেই  আত্মহত্যা করেন। পরবর্তীতে প্রধান প্রকৌশলী এইচ. এস. হেরলিংটন এই কাজটি ১৯০০-১৯০৩ সালে শেষ করেন। কালকা-সিমলা’র টয়ট্রেন খ্যাত এই রেললাইনটি ২০০৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বৃটিশ ভারতের রাজধানী সিমলা

দুই পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে  শেষ বিকেলে সিমলা শহরে এসে পৌঁছা হলো। সিমলা স্টেশনটি শহর থেকে একটু দূরে। ট্রেন থেকে নামতেই হোটেল আর কটেজের এজেন্টরা ঝাঁকে ঝাঁকে টুরিস্ট  বগলদাবা করার চেষ্টা করতে লাগলো। কোন এজেন্টের মাধ্যমে হোটেল না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে আসার কারনে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। স্টেশনে হালকা ফটোশেসন করে শহরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
এই সিমলা শহররের নাম করন করা হয়েছে সনাতন ধর্মীয় শ্যামলা দেবির নামানুসারে। ১৮১৭ সালে সিমলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এখানকার আবহাওয়া এবং প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা এখানে হিমালয় রেঞ্জের বনভূমির নিকটে শহরের পত্তন করে। সিমলা মোট ১৯টি পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

ছবি:সিমলা

১৮০৬ সালে নেপালের ভিসমেন থাপা আজকের সিমলার দখল নেন। পরে ১৮১৪-১৮১৬ সালের দুই দফায় যুদ্ধের পর এর দখল চলে যায় ইংরেজদের কর্তৃত্বে। ১৮১৯ সালে লেঃ রোজ এখানে একটি কাঠের কটেজ নির্মাণ করেন। তিন বছর পর প্রথম পাকা দালান গড়ে ওঠে ১৮২২ সালে। ১৮২৫-১৮৩০ সালের দিকে বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রশাসক এবং কর্মচারীরা ছুটি কাটাতে সিমলা আসেন এবং এর  আবহাওয়া-প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করেন যার প্রেক্ষিতে ১৮৩০ সালে বৃটিশ রাজ এখানে বসত গড়ার উদ্যোগ নেয়। এই লক্ষ্যে ১৮৩২ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেণ্টিক এবং তৎকালীন মহারাজা রণজিৎ সিং এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৪৪ সালে সিমলার বিখ্যাত চার্চটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
সিমলা পূর্বে দুটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল, ছোট সিমলা এবং মূল সিমলা।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)

১৮৫০ সালে দুই সিমলার মাঝে সেতু নির্মিত হয়ে সংযোগ স্থাপিত হয়। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিমলার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফিট এবং দৈর্ঘ্যে (পূর্ব-পশ্চিমে)নয় কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সিমলার সবচেয়ে উঁচু স্থান জাখু হিল যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ফিট উপরে যেখানে জাখু মন্দির নামে একটি মন্দির রয়েছে।

সিমলা শহরটি বর্তমানে ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। ১৮৬৪ সালে বৃটিশ আমলে সর্বপ্রথম সিমলাকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করা হয়। ১৮৭১ সাল থেকে সিমলা পাঞ্জাবের রাজধানী ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। বর্তমানে এই প্রদেশে মাত্র ২ লাখ লোক বসবাস করে যা জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় সবচেয়ে কম।

রাতের সিমলা

ছবি: রাতের সিমলা

ডানপাশে পাহাড় আর সেখানকার বসতি দেখতে দেখতে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পরে শহরের কাছাকাছি পৌঁছা হল। হাতের বাম পাশে হোটেল ভিক্টোরিয়া নামক হোটেলটির লোকেশন আর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে আমাদের খুবই ভালো লাগলো। আগ্রহী হয়ে কথা বলতে ম্যানেজারের রুমে গেলাম। ম্যানেজার সাহেব আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় শুনে প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন আমার হোটেলে প্রচুর বাংলাদেশি আসে। আপনারা আগে রুম দেখে আসেন যদি পছন্দ হয় তারপর দরদাম করবো। দুইজন রুম দেখে এসে নিজেদের পছন্দেন কথা জানাতেই ভদ্রলোকের সাথে দরদাম শুরু হল। তিনি আমাদের প্লান শুনে একরাত এই হোটেলে থাকা, দুইরাত মানালি হোটেলে থাকা এবং বিভিন্ন স্পটে সার্বক্ষণিক একটা মাইক্রোর সুবিধা সহ একটি প্যাকেজ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ দরদাম করার পরে জনপ্রতি ৩৫০০ রুপিতে ঠিক করা হলো। ৬ জনের দুটি রুম, গিজার ছেড়ে ভালো করে একটি গোসলের পরে খুব আরাম লাগছিলো।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

সত্যি বলতে কি হোটেলের পরিচ্ছন্নতা আর বাহিরের সুন্দর প্রকৃতি এক ধরণের মানুষিক প্রশান্তি দিচ্ছিলো। সবার গোসল আর টুকটাক কাজ শেষ করতে শহর দেখতে বের হলাম। ভিক্টোরিয়া হোটেলটি মূল শহর থেকে সামান্য দূরে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি আর ভাবছি বৃটিশরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের শাসন আর শোষণের স্বার্থে কতকিছুই না করে গেছে। এই সেই সিমলা শহর যেখানে বৃটিশদের সাথে ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মিটিং হয়েছে, বৃটিশদের সাথে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মিটিং হয়েছে, পাকিস্তান-ভারতের মিটিং হয়েছে, বৃটিশরা ভারত ছাড়ার আগে সিমলায় থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথি পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। কে জানে হয়তো সেসব নথিতে বৃটিশদের শত শত কুকীর্তি আর ভন্ডামির কথা লিপিবদ্ধ ছিল। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের “ভারত স্বাধীন হল” বইটিতে সিমলায় বৃটিশদের সাথে কংগ্রেসের মিটিংয়ের বর্ননা আছে। তাছাড়া ভারতীয় বড় বড় রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য এই সিমলা শহরে আসতেন। হোটেলের ম্যানেজার কাস্মীরি ভদ্রলোক জনাব মইন সাহেবই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর, কেউ থুতু ফেলছে না, বাহিরে ধূমপান করছে না মানে ধূমপান করা নিষিদ্ধ। পশ্চিমা কোন শহর আমি দেখিনি এখানে কেমন যেন একটা পশ্চিমা শহরের অনুভূতি  আসলো। যদিও সেসব দেশে কখনোই যাওয়া হয়নি। একে একে বিখ্যাত গির্জা, ইন্দিরাগান্ধীর
ভাস্কর্য, জিরোপয়েন্ট, সেনানিবাস সহ গোটা শহরটিই দেখা হলো। জিরো পয়েন্ট থেকেই বৃহৎ হনুমানের ভাস্কর্যটি দেখা যায়। বৃটিশদের সময় সিমলাই ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের সেনা সদর দফতর।
রাতের খাবারের জন্য মইন সাহেব খাবারের একটা দোকানে নিয়ে গেলেন। নান রুটি আর মুরগির কারি করা একটা খাবার, নামটি ভুলে গেলেও খাবারের স্বাদটি এখনোও মুখে লেগে আছে।  ভারতে প্রবেশের পরে এই প্রথম কোন খাবার খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হলো। খাবারের পর সিমলা জিরো পয়েন্টে মইন সাহেবর গল্প শোনলাম। কাস্মীরে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন এবং তাদের স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের কথাও বললেন। মাইনাস তাপমাত্রায় বাহিরে প্রচন্ড বাতাস থাকার কারনে খুব ঠাণ্ডা লাগছিলো। কিছু সময় পরে  ঢালু বেয়ে নামতে নামতে  হোটেলে ফিরে আসলাম। কয়েক দিনের ক্লান্তি সেই সাথে ঘুমানোর সুন্দর পরিবেশ আর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। একটু পরেই জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টির মত তুষারপাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে থোকায় থোকায় তুলা পড়ছে। জানালার পাশে আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছি। সোডিয়াম বাতির আলোয় তুষারপাত আরো সুন্দর লাগছিলো। একটু পরে আমরা হোটেলের লবিতে গিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা আর শীতকে উপেক্ষা করেই ঝটপট বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আসলাম। রাত প্রায় ১২ টার পরে আমরা বিছানায় গেলাম।

সিমলা থেকে মানালী

(২১.০১.২০২০, মঙ্গলবার)

কয়েকদিনের ভ্রমন আর ক্লান্তির কারনে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরিই হল। ঘুম থেকে উঠেই দেখি পুব দিকে সারা পাহাড়ে সাদা তুষারে ছেয়ে আছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য।

আমরা বাংলাদেশীরা তুষার, তুষারপাত এসব সিনেমা আর গল্পই পড়েছি। বাস্তবিক আমাদের দেখার সুযোগ কমই। এমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখে হা হয়ে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অপরূপ দৃশ্য দেখলেও খুব দ্রুত মানালির দিকে রওয়ানা করার তাড়া ছিল। তাই ফ্রেশ হয়ে দ্রুতই হোটেলের চেক আউট করা হলো। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির ড্রাইভার রাজেশ সাহেবের মাইক্রোতে উঠে বসলাম। সিমলা শহরের পাহাড়কে বামপাশে রেখে মাইক্রো মানালি অভিমুখে যাত্রা করলো।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

সিমলা থেকে মানালির দূরত্ব ২৪৫ কি.মি.। কিন্তু পাহাড়ি পথ আর বিভিন্ন স্পট দেখে দেখে মানালি পৌঁছতে প্রায় ৮-১০ ঘন্টা লেগে যায়। সেজন্য ই ড্রাইভার সাহেব আমাদের আরো আগে রওনা করা দরকার ছিল বলে মত প্রকাশ করলেন। সিমলা শহরের একটু বাহিরে এসে একটা ধাবায়(খাবারের দোকান)নাশতা খাওয়ার জন্য বিরতি নেওয়া হলো। গাড়ি থেকে নামতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার একটা তীর আমাদের শরীরকে বিদ্ধ করলো। অথচ সবাই ভারি ভারি একাধিক শীতবস্ত্র পরিহিত। কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে বসে ম্যানু থেকে খাবারের অর্ডার করা হলো। সত্যি বলতে কি খাবার আর দামের সমন্বয় হচ্ছিলো না, আর ভারতে এসে খাবার নিয়ে আপনি কখনোই সন্তুষ্ট হবেন না। প্রায় ২০ মিনিট পরে  খাবার আসলো, খেতে আরো ২০ মিনিট। বিল মিটিয়ে পুনরায় গাড়িতে চড়ে যাত্রা করতে করতে একঘন্টা শেষ। ক্ষাণিক চলতেই বুঝতে পারলাম পাহাড়ি এই রাস্তাতেই খাবার না খেয়েই যাত্রা করা উচিত ছিল কিংবা খাবার খেয়ে বেশ কিছুটা সময় বিশ্রামের পর যাত্রা করা দরকার ছিল। মোট মোচড় দিয়ে সবারই কমবেশি বমির ভাব হচ্ছিলো।

বলতে না বলতেই একজনের বমি হয়ে গেলো। আর ভ্রমনে এই বমির বিষয়টা কি পরিমাণ বিরক্তিকর সেটা ভুক্তভোগি না হলে বুঝতে পারা যায় না। আর বমিটা একটা সংক্রামক ব্যধি। একজন শুরু কররে অন্যজন সংক্রমিত হবেই। যাই হোক গাড়ি থামিয়ে তাকে ঠিক করে পুনরায় যাত্রা শুরু হলো। কিছুদূর যেতেই আরেকজন বমি করলো । আবার গাড়ি থামানো হল। পাশে একটা ধমীর্য় স্থাপনা ছিল সেখানকার কল থেকে পানি নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গাড়ি পরিষ্কার করে পুনরায় যাত্রা শুরু হল। ড্রাইভার সাহেব মনে হয় এসবে অভ্যস্ত। উনি বেশ পেশাদারিত্বের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছিলেন। আমি তখন মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম, কোনদিন এমনটি হয়নি যদি আজ  হয়ে যায় তাহলে তো এতোদিনের রেকর্ড ভেস্তে যাবে। শেষ পর্যন্ত রেকর্ড অক্ষুন্নই থেকেছে। তবে পাহড়ি রাস্তায় এমনটি হওয়া  খুবই স্বাভাবিক বিষয়। হালকা হালকা বিরতিতে গাড়ি চলছিলো। একটু পরে রাস্তার পাশের দোকান থেকে লেবুর শরবত, কমলা এসব খাওয়া ও ওয়াশরুম থেকে আসার পর মোটামোটি সবারই মধ্যেই একটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছিলো। এর পরে আর কেউ বমি করেনি। মোটামোটি সহনীয় গতিতেই আমাদের গাড়ি চলছিলো। গাড়িতে পানজাবি সঙ্গীত আর বাহিরে প্রকৃতির সৌন্দর্য।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরিআমরা চলছি আর প্রকৃতি দেখছি, কতশত অজানা জনপদ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়িটি মানালির দিকে ছুটছে। পাহাড়ি রাস্তা আর পাশে নদী থাকায় ভ্রমনটা বেশ চিত্তাকর্ষক ই লাগছিলো।
সিমলা থেকে মানালি যাবার পথে বেশ কয়েকটি বড় ছোট সিমেন্টের কারখানা পরে। ডাললা ঘাট নামক স্থানে ভারতের বিখ্যাত আম্বুজা সিমেন্ট কারখানা অবস্থিত। কতশত লড়ি আর ট্রাকের সারি দেখলাম। এসব বাহনে করেই আম্বুজা সিমেন্ট সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে যাবে। আরেকটু সামনে বারোমানা নামক স্থানে acc নামক আরেকটি সিমেন্ট কারখানা। সেখানেও সারিবদ্ধ কতশত ট্রাক আর লরি। আসলে সারা ভারতবর্ষে এতো ভৌগলিক, কৃষ্টি আর স্বাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অখণ্ড থাকার অনেকগুলো কারনের মধ্যে ব্যবসায়িক দিকটিও অন্যতম একটি কারন। কেননা এতো বিশাল বাজার সারা ইউরোপ মিলিয়েও নেই। তাই ভারতকে অখন্ড রাখার পিছনে ব্যবসায়ীদের অর্থ খরচেরও একটা বিষয় রয়েছে। কোথাও পাহাড়ি রাস্তা আর কোথাওবা সমতল কিন্তু সর্বত্রই প্রকৃতি এতো সুন্দর করে সাজানো আর গুজানো কেবল তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের পাশে একটি পাথুরে নদী রয়েছে স্থানীয় ভাষায় এটার নাম শতেন্দ্রু নদী। পানি অল্প হলেও স্রোত রয়েছে অন্যান্য পাহাড়ি নদীর মতনই। আরেকটু সামনে গিয়ে সুন্দরনগর। এই সুন্দরনগরেই একটি লেক রয়েছে, মানালি যাওয়ার পথে  অনেকেই এখানে একটু থামেন। আমরাও সেটা মিস করেনি। ওয়াচ টাওয়ার থেকে  লেকটিকে আরো অপরূপ লাগছিলো। সত্যি বলতে কি, সিমলা থেকে মানালির সবটুকু পথই সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যে ভরপুর। দরকার শুধু দেখার মতন চোখ আর অনুধাবন করার মন, তাহলেই হয়তো সুন্দরের নিত্য নতুন শাখার সাথে পরিচয় ঘটে যাবে। সুন্দরনগর থেকে ২৫ কি.মি. পরেই হল মান্ডি শহর। এই মান্ডি থেকেই বিখ্যাত বিয়াস নদীর শুরু। এই বিয়াস নদী এখান থেকে মানালি পর্যন্ত সঙ্গ দিবে। মান্ডি শহর থেকে একটু সামনে গেলেই পান্দ ডেম। এই পান্দ ডেমের মাধ্যমেই ভারত সরকার বিয়াস নদীর জলকে নিয়ন্ত্রণ করে জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এই ডেমের একটু সামনে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি রেখে চা পান করলাম। কিছুক্ষণ বসে থেকে পান্দডেম আর বিয়াস নদীর নীলাভ পানির সৌন্দর্য দেখলাম।

বিয়াস নদী

ছবি: বিয়াস নদী

অন্যান্য পাহাড়ির অঞ্চলের মতন এখনকার অদিবাসীরাও সম্ভবত নারী প্রধান। দোকানদার ও তার সহকারী উভয়ই নারী। যারা নারীকে ঘরের বাহিরে এসে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করাকেই আধুনিকতার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেন তাদের দৃষ্টিতে হয়তো সকল পাহাড়ীয়রাই আধুনিক। মান্ডির পরেই শুরু হয় কুল্লু। কুল্লু থেকে মানালি এই অংশটুকু খুবই ভয়ংকর আবার সেই সাথে সুন্দরও বটে। পাহাড়ের নিচ দিযে খাঁজ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বর্ষার সময় প্রায়শই এই স্থানটিতে পাহাড় ধস নামে ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড় ধস বন্ধ করতে ভারত সরকারের  চলমান ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ চোখে পরলো। ভারতীয় সরকার এই পর্যটন খাতে ব্যাপক অর্থ খরচ করছে। ওদের পরিকল্পনাও আছে সেই সাথে সেটার কম দুর্নীতিতে বাস্তবায়ন ও আছে। আমাদের হয় পরিকল্পনা আছে বাস্তবায়ন নেই, অথবা বাস্তবায়ন আছে সঠিক পরিকল্পনা নেই, তাই তো ফ্লাওভার করার পরে মনে পড়ে প্ল্যানে ভুল, রেললাইন বসানোর পরে মনে পরে এটা ভুল হয়েছে খুলে আবার নতুন করে বসাতে হবে, আর দুর্নীতির কথা আর নাইবা বললাম। চীনে এক কি.মি. রাস্তা করতে সেখানে ১০ টাকা খরচ হয় আমাদের দেশে সেটা চারগুনে ৪০ টাকা খরচ লাগে। এই জন্য ই হয়তো স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপ ছিল সারা পৃথিবী পায় সম্পদের খনি আর আমি পাই চোরের খনি। একটু স্লো গতিতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। সামনেই একটা টানেল দেখতে পেলাম একেবারে পাহাড়ের মধ্যেখান দিয়ে। ২.৮ কিমি দৈর্ঘ্যের এই টানেলটির নাম হল উট টানেল। টানেল পার হওয়ার পরে বিয়াস নদীর পাগলকরা সৌন্দর্য দেখে আমি একেবারেই মোহিত হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি গত কয়েকদিনের ক্লান্তি, আজকের সেই সকাল থেকে টানা জার্নি সবকিছুই যেন নিমেষে ই হাওয়া হয়ে গেল। এতো বিশাল ভারতবর্ষের পরতে পরতে সৌন্দর্যের এতো খনি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের মাঝখানে নীলাভ স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের উপরে ছোট বড় গাছের সাড়ি। একেবারে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। জায়গাটার প্রতি আমার এমন মনোভাবের জন্যই হয়তো সেটাকে আরো ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া গেলো। সামনের একটা বেইলী ব্রিজে হালকা যানজট থাকায় গাড়ি থেমে গেলো, নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তখনই  গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেলাম। ঝটপট কয়েকটি ফটো তুলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। সত্যি ই ভারতবর্ষে  যে প্রচুর পর্যটক আসে সেটার কারনও আছে। ওদের সৌন্দর্য আছে সেটা রক্ষা করার সরকারি বেসরকারী চেষ্টাও আছে সেই সাথে ওদের মধ্যে সচেতনতাও আছে। আমাদের দেশে না আছে সরকারি প্রচেষ্টা না আছে সচেতনা। তাই তো প্রায়ই দেখা যায় চন্দনাথ পাহাড়ের উপরের বিরিয়ানির প্যাকেট, গুলিয়াখালি বিচে শত শত পলিথিন আর প্যাকেট, টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ভাসমান সারি সারি এলকোহলের  বোতল। বাংলাদেশের পর্যটকগন ফেসবুকে ছবির দেওয়ার টুরিস্ট। হৃদয়ে ধারণ করার টুরিস্ট নয়। সৌন্দর্য বোধ আমাদের অন্তরেই হয়তো নেই। তবে খুব ধীরে হলেও একটা পরিবর্তন আসছে। সেটাই আশাব্যঞ্জক।

বিয়াস নদীর অপর পাড়ের পাহাড়টি হিমালয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চাল। আর কিছুদূর যেতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। রাস্তা অনেক চওড়া আর মসৃণ হওয়াতে এই অন্ধকারেও গাড়ি চালাতে কোন সমস্যা ই হচ্ছিলো না। একটু পরেই হাতের বাম দিকে পাহাড়ের উপরে কুল্লু শহরটি দেখতে পেলাম। পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর আর সেসব ঘরের আলোকে দূর থেকে  পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার জোনাক জ্বলার মতন মনে হচ্ছিলো। কুল্লু শহরে থেকে মানালি যেতে ৪০-৫৫ মিনিটের মতন লাগে। শপিংয়ের জন্য কুল্লু শহরের এক প্রান্তে থাকা একটা শালের দোকানের কাছে বিরতি দেওয়া হল। সন্ধ্যার সাথে সাথেই মনে হয় এখানকার দোকানপাট সব বন্ধ করে ফেলা হয়, আমরা যেতেই দেখলাম দোকান বন্ধের আয়োজন শুরু হয়েছে তবে আমাদের কারনেই কিছুক্ষণ দেরি করলো। আমাদের সফরসঙ্গীরা খুব শপিং করলো, সবাই ই বাসায় নিজ নিজ আপনজন আর প্রিয়জনদের সাথে অডিও ভিডিও কলে কথা বলে কাপড় চোপড় পছন্দ করছিলো, আমি ঘুরে ঘুরে সেসব দেখছিলাম। সত্যি বলতে কি শপিং এর প্রতি আমার কখনোই আকর্ষণ ছিলো না আর এটা আমার ভালোও লাগে না। আমার পরিচিত জনেরা বিয়ের পরে আমার দুরাবস্থার কথা ভেবে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মেয়েরা নাকি শপিংয়ে খুব আগ্রহী থাকেন, কে জানে হয়তো তখন আমিও আগ্রহী হবো কিংবা আমার  বউও আমারই মতন শপিংয়ে অনাগ্রহী হবে। যাই হোক সবার শপিং দেখে মায়ের কথা মনে পরে গেলো, মা থাকতে কোনদিনও মায়ের জন্য কিছু কিনে নিযে যাইনি আর এখন তো মা নেই ই!!!!
বেশ সুন্দর মাফলার দেখে সেটা কিনতে চেয়েছিলাম কিন্তু সত্যি বলতে কি সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করতে পারিনি। আমার কিছুটা বিমর্ষ চেহেরা দেখেই মাসুদ মায়ের স্মরণের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। মাসুদ আমাকে সেটি বলেও দিয়েছিল। আসলে ভালোবাসার মানুষজনেরা হয়তো এমনি করেই হৃদয়ের কথাটি টের পেয়ে যায়।
সেলসম্যান মেয়েটির সাথে আমাদের আইভি দেখলাম খুব খাতির জমিয়ে ফেলেছে আসলে কে কাকে পরাস্ত করলো সেটা না বুঝতে পারলেও উভয়ের হাসি দেখে বুঝলাম উভয় পক্ষই খুশি। হিমেল দেখলাম হবু বউয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে জামা পছন্দ করলো। এলিন, সুজনও বাসায় কার কার সাথে যেন কথা বলছিলো। আমাকে ছাড়া বাকি পাঁচজনই শপিং করলো। শপিং শেষে এখানে চা আর হালকা নাশতা করে পুনরায় গাড়িতে চড়ে মানালির পথ ধরলাম। এখন আর বড়জোর একঘন্টা, তারপরেই হাজির হবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানালি শহরে। গাড়ি চলছে আর আমরাও শেষ সময়ে একেবারে অধৈর্য হয়ে পরছিলাম। মানালির কাছাকাছি আসতেই আকাশ থেকে তুলার পেজের মতন বরফ পড়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ড্রাইভার সাহেব একটু চিন্তিত হয়ে দ্রুত হোটেলে পৌঁছতে চাচ্ছিলেন। যদিও মল রোডে রাতের খাবার খেয়ে তারপর হোটেলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল  কিন্তু ওনার কথা শুনে বুঝলাম আমাদের দ্রুতই হোটেলে যাওয়া উচিত। কারন তুষারপাত বৃদ্ধি পেলে গাড়ি যেকোন সময়ই রাস্তায় আটকে যেতে পারে। একথা শুনে একটু শঙ্কিত ই হলাম। বিদেশি বহু মুভিতে রাস্তায়  বরফের কারনে সাড়ি সাড়ি গাড়িকে আটক অবস্থায় দেখেছি। একটু পর সব শঙ্কা কাটিয়ে ড্রাইভার সাহেব হোটেলে সামনেই নামিয়ে দিলেন। হোটেলে উঠে দুটি রুমে নিজ নিজ ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হলাম। যখন মানালি শহরে ঢুকছিলাম তখনকার তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪-৫। রুমে আসার পরে সেটা মাইনাস ৭-৮ দেখতে পেলাম।
এই মানালি শহরটি ভারতের উত্তর হিমাচল প্রদেশের কুল্লু জেলার বিয়াস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনীর মনুর নাম অনুসারে মানালী নামকরণ করা হয়েছে। মানালি শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০৫০মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। মানালিতে আসা যাওয়ার রাস্তাটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মানালির মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার হাজার। এদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জন পুরুষ আর ৩৫ জন মহিলা। সাক্ষরতার হার শতকরা ৭৪.৫।
হালকা ফ্রেশ হয়ে হোটেলের নিচে খাবার খেতে যাই। দাম একটু বেশি হলেও এই শীতে গরম খাবার খেতে পারাটা কম সৌভাগ্যের বিষয় না। একটা বিষয়ে বুঝতে পারলাম ভারতে এসে ভাত খাওয়াটা অনেক বেশি বিলাসিতা। পাহাড়ি মানালিতেও সেটার ব্যত্যয় হয়নি। পকেট নয় পেটের দিকে তাকিয়েই মোটামুটি পেট ভরেই খাবার খেলে দ্রুত রুমে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।

সোলাংভ্যালিতে যাত্রা

(২২.০১.২০২০, বুধবার)

সকালে ঘুম থেকে উঠেই রুম থেকে বের হয়ে লবিতে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা সাদা বরফের স্তূপ দেখতে পেলাম। সিমলায় দেখা হয়েছিল তুলোর মতন হালকা রকমের বরফ আর মানালি এসে দেখা হচ্ছে স্তূপ আকৃতির সর্বত্র জুড়ে থাকা বরফ।

সাদা বরফের স্তূপ

ছবি: সাদা বরফের স্তূপ

অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগলাম, আমরাতো মুষলধারে বৃষ্টি, ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টি এসবের সাথে পরিচিত কিন্তু হালকা তুষারপাত, ভারি তুষারপাত এসবের সাথে একেবারেই অপরিচিত।

বরফাবৃত পাহাড়

ছবি: বরফাবৃত পাহাড়

সেইসাথে এসব তুষারপাত আর বরফাবৃত পাহাড় পর্বতও আমাদের কাছে নতুন। স্বাভাবিকভাবেই  ভালো লাগাটাও অন্যরকম ছিল। শুদ্র আর সফেদ বরফাবৃত পাহাড়ের উপর যখন সূর্যের আলো পড়ছিল তখন এক অন্যরকম সৌন্দর্যের অবতাড়না হচ্ছিলো। বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকলাম। আশপাশের বাড়িঘরেও দেখলাম লোকজন বিছানাপত্র ছাদে গরম করতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। এখনকার গন্তব্য হলো সোলাংভ্যালি। সোলাংভ্যালিতে যেতে হলে আলাদা বরফের পোষাক আর গাম বুট ভাড়া করতে হয়। সকালের নাশতা করে একটা দোকান থেকে নিজ নিজ পছন্দ আর মাপ অনুয়ায়ী গামবুট ও বরফের বিশেষ পোষাক পরিধান করি। এটা অনেকটা রেইনকোটের মতন পরিধেয় জামার উপরেই পরিধান করতে হয়। এই পোষাক আর বুট পরার পরে নিজেদের নভোচারি নভোচারি লাগছিলো। এই পিচ্ছিল শক্ত পাহাড়ি রাস্তার কিছুটা পথ গিয়েই মাইক্রো থেমে যায়। এই উঁচু নিচু বরফাবৃতির পাহাড়ি রাস্তায়  মাইক্রো নিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
ফলে সোলাংভ্যালি যাওয়ার জন্য এই রাস্তার উপযোগী বিশেষ শক্তিসম্পন্ন গাড়ি ভাড়া করতে হলো। সেটা নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম সোলাংভ্যালির উদ্দেশ্যে। সোলাংভ্যালির এই যাত্রায় নতুন করে অবাক হওয়ার পালা শুরু হল। দুই পাশে পাহাড় আর পাহাড় সেসব বরফ আর বরফ। রাস্তার পাশে বরফ, উপরে বরফ, নিচে বরফ, বাড়ির ছাদে বরফ, উঠোনে বরফ সর্বত্র কেবল বরফ আর বরফ। এই বরফকেই মাড়িয়ে গাড়ি চলছে।

আবাক আর মুগ্ধ হয়ে দুপাশে তাকিয়ে দেখছি আর পুনরায় মুগ্ধ আর অবাক হচ্ছি। প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পর আমরা সোলংভ্যালিতে পৌঁছলাম। এখানে প্রচুর পর্যটকের সমাগম দেখতে পেলাম।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)

সোলংভ্যালিতে নেমে  অনুভূতিতে  যতটুকু আবাক আর আশ্চর্য হওয়ার সামর্থ্য বাকি ছিল তার সবটুকুই শেষ করে ফেললাম। ডানে বরফ, বামে বরফ, উপরে বরফ, নিচে বরফ,  সামনে বরফ, পিছনে বরফ সর্বত্র শুধু বরফ আর বরফ। বাচ্চাদের মতন লাফালাফি করলাম, দাপাদাপি করলাম, বরফ দিয়ে বরফকেলি করলাম, ঘর বানালাম, সেই ঘরেন মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকলাম, ফটো তোললাম আর কত কি করলাম!!!

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি

সব কিছুতেই আনন্দ, সকল কিছুতেই উচ্ছ্বাস। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম এতো সুন্দর স্থানে আসার তাওফীক দেওয়ার জন্য।

সোলাংভ্যালিতে প্যারাগ্লাইডিং সহ বিভিন্ন ধরণের রাইডিং রয়েছে। যার যার ইচ্ছে আর সামর্থ্য অনুযায়ী সেসব রাইডে চড়ে থাকে। নদীর উপর দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে মোটা দড়ির মাধ্যমে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার রাইডটি পছন্দ করা হলো। সত্যি বলতে কি একটু ভয় ভয় করছিল। তাই দুইজনের পরে আমি শুরু করেছিলাম। যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপত্তা ছিল তবুও যখন শুরু করা হলো তখন কেমন যেন একটা ভয়ের শিহরণ টের পাচ্ছিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করতর লাগলাম। নিচে নদী, বরফের মধ্যখান দিয়ে স্রোতাধারার নদী, রশিতে ঝুলে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছি, চারদিকে বরফ আর বরফ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)নিজের ফোনটি বের করে ভিডিও করছিলাম কিন্তু অনভ্যস্ত হাতে ভিডিওর মান খুব একটা ভালো হয়নি। তবুও তো নিজের স্মৃতি, নিজের কাছেই থাকবে। এসব রাইড শেষ করে আরো কিছুক্ষণ সোলংভ্যালিতে অবস্থান করার পর কেমন করে যে প্রায় ঘন্টা তিনেক অতিবাহিত হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। এবার ফেরার পালা। গাড়ির পার্কিং করা স্থানের দিকে রওয়ানা করলাম। এখানে একটা বিষয় বলে রাখি কোথাও গেলে দিক ভুলে যাওয়া আমার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। এখানেও সেটা ঘটলো, হুট করেই আমি বাকি চারজনকে এই ভীড়ে মধ্যে হারিয়ে ফেলি। হটাত করেই দেখি আমি আর এলিন ছাড়া আর কেউ নেই। এই ভিড়ের মধ্যে দলছুট হয়ে কিছুটা অসহায় অনুভব করলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে গাড়ি যে দিকে ছিল তার বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর বরফে ঢাকা চড়াই বেয়ে অনেকটা উপরে উঠার পরে আস্তে আস্তে লোকজন আর গাড়ির সংখ্যা কমতে দেখে মনে খটকা লাগলো। মনে মনে ভাবলাম  যেখানে গাড়ি পার্কিং করে এসছিলাম  সেখানে তো প্রচুর গাড়ি আর মানুষ ছিল। সেখান থেকে আবার নিচে নামতে লাগলাম, বরফের পিচ্ছিল নিচু রাস্তায় যেকোন মুহূর্তেই স্লিপ কাটতে পারতাম আর এই পাথুরে শক্ত বরফে স্লিপ কেটে পড়া মানে কোমর নিয়ে সোজা হাসপাতালে হাজির হওয়ার সামিল। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে খোঁজা খুঁজির প্রায় ৪৫ মিনিট পরে হারানো গাড়ি আর ভ্রমনসাথীদের খোঁজে পাওয়া গেলো। তাদের অগ্নিশর্ম চেহারা আর তিরস্কারের বানে জর্জরিত হয়ে যতটানা খারাপ লেগেছে তারচেয়ে বেশি আমার ভুলের কারনে তাদেরকে কষ্টে ফেলার বিষয়টি আরো বেশি মর্মপীড়ার কারন হয়েছে। গাড়িতে চড়তেই গাড়ি ফিরতি পথে চলা শুরু করলো। যে পথে সোলাংভ্যালি গিয়েছি সে পথেই ফিরছি। তখন যে দৃশ্য ছিল এখনও তাই। মুগ্ধ নয়নেই দেখছিলাম চারপাশটা। এই বরফের মধ্যেও লোকবসতি আছে। ট্যুরিজমটাই এদের আয়ের অন্যতম মাধ্যম মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকেও হয়তো কেউ কেউ দিল্লি সহ বড় বড় শহরে পড়াশোনা বা অন্য কোন কাজে যায়। ভারতবর্ষের এতো বিশালতা আর এতো এতো বৈচিত্র্য এটা অনায়েসেই বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র হতে পারতো। লোকালয় দেখে মনে হল বরফের সময় কষ্টটা একটু বেশি হলেও বরফ কমের সময় মোটামুটি স্বাছন্দ্যেই এরা চলাফেরা করতে পারে। তাছাড়া স্থানীয় অধিবাসীরা এমন জীবনেই অভ্যস্ত। ৪৫ মিনিট চলার পরে ভাড়া করা গাড়ি থেকে নেমে  মাইক্রোতে চড়ে কাপড় নেওয়া দেকানটিতে আসলাম। নিজ নিজ বরফের পোাষাক আর জুতো  জমা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে মানালি শহরের দিকে রওয়ানা করলাম। দুপুরের খাবারের জন্য মুসলিম হোটেলের খোঁজে গুগল করতেই একটা হোটেলের নাম পেলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত থাকায় দ্রুতই দোকানটিতে যেতে চাইলাম কিন্তু ঠিকানা বুঝতে একটু অসুবিধা হওয়ায় বেশ কিছুটা সময় পার করেই দোকানটি পেলাম। ম্যানুকার্ড দেখে মুরগির বিরিয়ানীকেই সবচেয়ে ভালো বিকল্প মনে হওযায় সেটাই অর্ডার কররাম। শীতের দেশ হওয়াতে একটু সময় ই লাগলে খাবার রেডি করে নিয়ে আসতে, কারন অর্ডার করার পরেই রান্না করে। সে সময়টিতে আমাদেরকে দেওয়া গরম পানি পান করে গল্পগুজব করছিলাম। দোকানটিতে খেতে আসা অধিকাংশ গ্রাহকই ছিলেন মুসলিম। একটা পরিবারকে দেখলাম দোকানে বসেই টিকটক ভিডিও করছে, বুঝতে পারলাম ভারতে টিকটক ভিডিওর ব্যাপক প্রচার আর প্রসার। আমাদের ফেবুর মতনই ভারতের টিকটকের ব্যবহার। খাবার আসলো খেয়ে বিল দিয়ে মার্কেটে গেলাম। মানালি শীত প্রধান অঞ্চল হওয়ায় শীতের জিনিসপত্র ই বেশি ছিল। আব্বার জন্য একটা কটি কিনলাম। তারপর গেলাম দিল্লির বাসের টিকিট কাটার জন্য। কারন আগামীকাল আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে হবে। অনেকগুলো বাস কাউন্টার ঘুরে শেষ পর্যন্ত হিমালয়ান বাস সার্ভিসের টিকেট কাটা হলো। আমাদের বাজেটের তুলনায় একটু বেশি খরচ হয়ে যাওয়ায় পকেটের অবস্থা একটু মন্দই ছিল। আমাদেরকে সফর সঙ্গি বন্ধু সুজনের কাজিন কলকাতায় থাকায় ওর মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ থেকে বিকাশের মাধ্যমে কলকাতায় টাকা আনানো হয়েছে।

( এই টোটাল প্রক্রিয়াটাই অবৈধ, পরে দিল্লি এবং কলকাতায় এসে বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে টাকা নেওয়ার প্রচুর দোকান দেখতে পেয়েছি। বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ থেকে প্রচুর প্রচুর লোকজনের আসা যাওয়ার কারনেই তাদের সেবা দিতে এসব প্রতিষ্ঠান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে)। সে টাকাটা কলকাতা থেকে মানালি আনানোর কোন ব্যবস্থাই পেলাম না। বাস কাউন্টারের লোকেরা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন(ব্যাংকের) সাথে যোগাযোগ করতে বললেন কিন্তু সেখানে গিযেও টাকা আনানোর কোন ব্যবস্থা পেলাম না। আমি একটু আবাকই হলাম, ভারতবর্ষে কি আমাদের রকেট, বিকাশ এসবের মত কোন মোবাইল ব্যকিং ব্যবস্থা নেই? অনেক রাজ্য আর কেন্দ্রের দ্বিস্তর বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে হয়তো করা হয়নি কিংবা হয়তো অন্য কোন সহজ ব্যবস্থা আছে যেটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। টিকেট কেটে একটা মাদ্রাজী দোকান থেকে রাতের খাবার নেওয়া হলো। মুরগির কারি আর নান রুটি পার্সেল করে মানালি শহরের কাজ শেষ করে ড্রাইভারকে নিয়ে হোটেলে চলে আসি। আজই মানালিতে আমাদের শেষ রাত। বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। মধ্য রাতের পরে বিছানায় যাওয়া হলো।

পরের পর্ব: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (৩য় পর্ব)

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

ভ্রমণ কাহিনী

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব)

Published

on

মানালি ভ্রমণ কাহিনী
#পূর্ব_কথা আমার একটা বন্ধু মহল আছে যাদের সবাই ই কমবেশি ভ্রমন পাগল। নানা ব্যস্ততার জন্য একত্রে সব সময় ট্যুর না দেওয়া গেলেও ৭-৯ জনের একটা টিম হয়েই যায়।আর সেই টীমের ৫ হচ্ছে কমন মুখ।প্রতি বছরের ৬-১০ দিন এক বা একাধিকবার আমরা দেশে বা বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যুর দিয়ে থাকি।২০১৮ সালের শেষের দিকে গিয়েছিলাম দার্জিলিং,সান্দাকফু আর ফালুটে।২০১৯ সালের প্রথম দিকে গিযেছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়ে।আর ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ আমাদের রওয়ানা করার কথা ছিল মানালির উদ্দ্যশে।সে মোতাবেক কলকাতা থেকে আমাদের কালকা মেইলের টিকেটও কাটা হয়েছিল কিন্তু ডিসেম্বরের ১২ তারিখে পারিবারিক এক মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ঘটনার জন্য সেটা আর হয়ে উঠেনি।ডিসেম্বরের এই এই যাত্রাটি যখন বাতিল হয়ে গেলো এবং মানালির ট্যুরটিও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হলো তখন জানুযারির মাঝামাঝিতে বন্ধুদের আরেকটি সার্কেলের সাথে সিকিম যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করলাম।আসলে প্লান করাটা সহজ কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন যে কতটুকু কষ্টসাধ্য সেটা ভুক্তভোগী মানুষটি বলতে পারবেন। সিকিম ট্যুরের প্লান নিয়ে আমি শাকিলের অফিসেও গিয়েছি,কথা বলেছি।কিন্তু চাকুরীজীবি শাকিল ছুটি ম্যানেজ করতে পারছিলো না। আর আমার টার্গেট ছিল আমাদের ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক ট্যুরের সময় যে বন্ধটি থাকবে সেই বন্ধেই আমি আমার ট্যুরটি দিবো।শাকিল যখন আমাকে পুরোপুরি আস্থাশীল করতে পারলো না তখন মানালির প্লান করা বন্ধুদেরকেই রাজি করাতে মনোনিবেশ করলাম।মাসুদ আর আইভি নিম রাজি থাকলেও হিমেল সেখানে পুরোপুরিই না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিল।কারন দিন কয়েক পরেই তার বিয়েতে বড় একটা ছুটি নিতে হবে,এতো ছুটি অফিস দিবে কি না সেটা নিয়ে সে সন্দিহান থাকায় নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে।আমি হিমেল আর মাহবুবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকি।একটা পর্যায়ে হিমেল শর্তসাপেক্ষে রাজি হলেও মাহবুব নিজের অফিস থেকে ছুটি নিতে ব্যর্থ হয়।সৌদির এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করা বন্ধু সুজনও নিজের ছুটিকে আরো এক সপ্তাহ বৃদ্ধি করে।আর আইভি নিজের কাজিন এলিনকে নেওয়ায় আমাদের সফরসঙ্গী হয় মোট ৬ জনে। ভারতের ট্রেন সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন যে ভারতের ট্রেনের টিকেট অনেক আগেই করে রাখতে হয়।আমাদের নানা জটিলতার কারনে অনেক আগে তো দূরের কথা মাত্র তিনদিন আগে কলকাতা- দিল্লি,দিল্লি- কালকা আর কালকা- সিমলার রেল টিকেট এবং দিল্লি- কলকাতা ফেরার টিকেট করি।এটা করতে গিয়ে একদিন এদিক সেদিক করারও কোন সুযোগ ছিল না। একটার সাথে আরেকটা সংশ্লিষ্ট ছিল বিধায় একটা পরিবর্তন করলে সবগুলো পরিবর্তন করা লাগছে।কলকাতা – দিল্লির এই জার্নিটা লম্বা, এক বা দুইদিন দেরি করলে ভালো ট্রেনের ভালো সিট পাওয়া যেতো কিন্তু দুইদিন দেরি করলে রবিবার হয়ে যায় যেটা চাকুরীজীবিদের জন্য খুবই কষ্টকর।যাই হোক নানা সমীকরণ, সবার সর্বোচ্চ সুবিধা দেখে ১৮-০১-২০২০ ইং তারিখের সন্ধ্যা ৭ টায় দিল্লিগামী ইউবা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কাটি।১৯ তারিখ ভোরে ট্রেনে দিল্লি থেকে কালকা এবং ১২ টার ট্রেনে কালকা থেকে সিমলার টিকেট করি।ভারতের টিকেট করার পরেই বেনাপোল যাওয়ার ১৭ই জানুয়ারির টিকেট কনফার্ম করি।আবার ফিরতি টিকেট ২৪ তারিখ সন্ধ্যা ৭ টায় দিল্লি থেকে কলকাতার টিকেট করি।এই টিকেটগুলো করতে গিয়ে আমার অসংখ্যবার বিভিন্ন রুট,সময়, তাছাড়া আমরা ৬ জন হওয়ায় এবং তাদেরকে একসাথে সিট দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পেরেশানি পোহাতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত যে কাজগুলো সুন্দরভাবে হয়েছে সেটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমাদের ভ্রমন শুরু হয়েছিল ১৭-০১-২০২০ ইং রোজ শুক্রবার।এবং শেষ হয়েছিল ২৬-০১-২০২০ ইং তারিখ রোজ রবিবার।এই সফরে আমার সঙ্গী হিসেবে যারা ছিল- মাহমুদুল হাসান মাসুদ,হিমেল নাগ,আফরান আইভি,মোঃ সুজন,মোঃ এলিন এবং আসার পথে কলকাতা থেকে আমাদের সাথে সংযুক্ত হয় মোঃ কামরুজ্জামান। তবে মানালির এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বন্ধু হিমেলের ভূমিকা অবশ্যই অগ্রগন্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

যাত্রা হলো শুরু

(১৭.০১.২০২০,শুক্রবার) অনেক জল্পনা কল্পনা আর পরিকল্পনার পরে ১৭ ই জানুয়ারি শুক্রবার আমরা ৬ জন ঢাকা থেকে রওয়ানা করি।শুরু থেকে ৭ জনের পরিকল্পনা থাকলেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং সব সময়ের সফরসঙ্গী মাহবুব শেষ মুহূর্তে অফিসের ছুটির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৬ জনেই ঢাকার কমলাপুর থেকে রওয়ানা করি। আমাদের নির্ধারিত ট্রেন বেনাপোল এক্সপ্রেস রাত ১১ঃ১৫ মিনিটে আসার কথা থাকলেও প্লাটফর্মে আসে ১২ঃ০০ টায় আর কমলাপুর থেকে ছাড়ে ১২ঃ৩০ মিনিটে।ট্রেনটির পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা দেখে নতুনই মনে হয়েছে।বহুদিন পরে বন্ধুদের একত্র হলে যা হয় আর কি আড্ডা আর গল্পগুজবে রাতটি কাটিয়ে দেওয়া হয়।তবে হালকা হালকা সবাইই একটু আধটু ঘুমের চেষ্টা করেছে। সকাল ৯ টায় বেনাপোলে পৌঁছার কথা থাকলেও দেরি করে ছাড়াতে সকাল ১০ টায় বেনাপোলে পৌঁছে। ট্রেন থেকে নামতেই একজন সহায়তাকারী এগিয়ে আসলেন।সবাই তাদেরকে দালাল হিসেবে আখ্যা দিলেও আমি তাদেরকে সহায়তাকারী হিসেবেই আখ্যা দিবো।সিস্টেমের পরিবর্তন না করে কেবল তাদেরকে মন্দ বলাটাই কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।উনি নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন,পাসপোর্ট জমা নিলেন আমরা অফিসে ব্যাগ রেখেই নাশতা করলাম পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষ করে ব্যাগ পাসপোর্ট নিয়ে পোর্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। Manali Tour Guide বাংলাদেশের অংশে তেমন কোন জটিলতা ছাড়াই পার হলাম।ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে অনেকেই বেনাপোলে ভারতীয় অংশে নিজেদের ভালো অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশ অংশে মন্দ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তাই ভারত অংশে একটা ভালো মনোভাব নিয়েই গিয়েছিলাম কিন্তু দুঃখজনক হলেও ভারতীয় অংশের অভিজ্ঞতাটা বেশ তিক্তই হল।তিনশত টাকার বিনিময়ে আমাকে ছাড় দিলেন।এই পোর্টে কাজ করা কর্মকর্তাদের অধিকাংশ ই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের। সারা ভারতবর্ষে পশ্চিম বঙ্গের লোকজন খু্ব একটা প্রভাব না রাখতে পারলেও বাংলাদেশ আর বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের লোকজন ” হ্যাডম” দেখাতে বেশ ভালোই সিদ্ধহস্ত।যাই হোক পোর্ট পেরিয়ে বাংলাদেশী টাকা রুপিতে রূপান্তর করে ভারতের ভূমিতে পদার্পণ করলাম।

ভারতবর্ষে ভ্রমনের সূচনা

(১৮.০১.২০২০,শনিবার) আমাদের এখনকার গন্তব্য যেহেতু হাওড়া সে হিসেবে বনগাঁ হয়ে হাওড়া আসাটাই স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু আমরা একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে নিউমার্কেটগামী বাসে চড়ে বসি,যদিও আমাদের সে প্রশান্তির দেখা আমরা আর পাইনি।পরে যদিও এটা নিয়ে আফসোস করেছি কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে।যশোর রোড ধরে কলকাতা আসার পথে দু পাশের বাড়িঘর দেখে মনে হয়নি সীমান্ত পেরিয়ে ভিনদেশে আছি।অনেকটা বাংলাদেশের গ্রামের মতনই তবে উন্নয়নটা ওখানে তুলনামূলক কমই হয়েছে বলা চলে। Manali Tour Guide বাস একটানা প্রায় ঘন্টা দুয়েক চলার পরে দুপুরে খাওয়ার জন্য একটা হোটেলে যাত্রা বিরতি দেওয়া হলো।ম্যানু ছিল মাটন (খাসি) ডাল আর সবজি। খাসি খাওয়ার সময় হুট করেই সেটা জবেহ করার বিষয়টি মাথায় আসাতে সেটা খাওয়ার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পরি।তবে সবজি,ডাল,চাটনি সহ দুপুরের খাবারটি মন্দ লাগেনি।বাস দিয়ে যাবার পথে খুব সম্ভবত ২৪ পরগণা জেলার কোন একটি স্থানে তিতুমীর কলেজের একটি সাইনবোর্ড চোখে পরলো।এই সেই তিতুমীর যিনি কেবল বাঁশ দিয়েই স্বৈরাচারী ইংরেজদের কামানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।বানিয়েছিলেন বাঁশের কেল্লা।একটা পর্যায়ে ইংরেজ কামানের সামনে টিকতে না পেরে গ্রেফতার হন এবং ফাঁসীর কাষ্ঠে নিজের জীবন দিয়ে শহীদ হন।যদিও আজকের ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শহীদদের আবদান ও তাঁদের কথা চর্চা হয়না বলেই চলে।দীর্ঘ প্রায় ঘন্টা চারেক চলার পরে বাস আমাদেরকে কলকাতা শহরে নামিয়ে দেয়।আমাদেরকে নিউমার্কেট এড়িযায় নামানোর কথা বলেই বাসে চড়ানো হয়েছিল।বাসে উঠানোর সময় কত আদর যত্ন আর নামানোর সময় কোন দায় নেই মমতাজের লোকাল বাস গানটিই মন পড়লো।কোন স্থানে আমাদের নামানো হলো সেটা বুঝতে পারলাম না।একটু সামনেই বাস স্টপেজ থাকায় সেখান থেকে লোকাল বাসে চড়ে হাওড়া স্টেশনে আসি। কলকাতা শহরটিকে কেমন যেন সমৃদ্ধ ই মনে হল।আর সমৃদ্ধ হবেইবা না কেন,বৃটিশরা তো নিজেরদের রাজনৈতিক গোড়া পত্তন এই কলকাতা থেকেই শুরু করেছিল,তাছাড়া বাবু শ্রেণীয় জমিদাররা পূর্ব বঙ্গের প্রজাদের রক্ত আর ঘামকে পুঁজি করেই কলকাতাকে সমৃদ্ধ করেছে।শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে হাওড়া এসে পৌঁছলাম।কলকাতা শহরের হাওড়াগামী এই ভ্রমনটাকে গুলিস্তান থেকে উত্তরাগামী সফরের মতন মনে হয়েছে।

হাওড়ায় এসে হা হয়ে যাওয়া

(১৮.০১.২০২০,শনিবার) হাওড়া আর হাওড়া ব্রিজ সস্পর্কে কলকাতার সাহিত্যিকদের বইয়ে কত পড়েছি কিন্তু কখনো তো আর দেখিনি। ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব)ছবিঃ হাউড়া ব্রিজ হাওড়া স্টেশন সস্পর্কে পড়ার কারনে একটা কল্পনা থাকলেও আজকে এটার বিশালতা আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব) এতো বিশাল স্টেশন।ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কমপ্লেক্স। এটি নির্মিত হয় ১৮৫৪ সালে।যার তৎকালীন নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি।নির্মানের ১০০ বছর পর ১৯৫৪ সালে এটাকে বিদ্যুৎতায়িত করা হয়।এতে মোট ২৩ টি প্লাটফর্ম আছে যার ১-১৪ নং হলো পুরাতন প্লাটফর্ম আর ১৭-২৩ হলো নতুন বা সম্প্রসারিত প্লাটফর্ম।বৃটিশরা নিজেদের শাসনকার্যের স্বার্থেই এই রেল ব্যবস্থাটাকে সম্প্রসারিত করেছিল।ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সেই রেল ব্যবস্থাটাকে আরো আধুনিক ও সম্প্রসারণ করেছে।ফলে বিশাল ভারতবর্ষের একশোকোটির উপরের জনসাধারণের রেলই অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম।ভারতে প্রতিদিন হাজার হাজার রেল বিভিন্ন রুটে চলে থাকে। সন্ধ্যা৭ টার মধ্যে আমাদের ট্রেনটি আসার শিডিউল থাকলেও আসতে ক্ষাণিক বিলম্ব হয়েছে।আমরা জয়েন্ট স্কীণে ট্রেনটি প্লাটফর্মে আসার বিষয়টি নজর রাখছিলাম।একটা সময়ে আমাদের ইউবা এক্সপ্রেস ট্রেনটির ৯ নম্বর প্লাটফর্ম আসার ঘোষণাও শুনতে পেলাম আবার জয়েন্ট স্কীণেও সেটা দেখতে পেলাম।আমরা ৯ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে ছুটলাম এবং সেখানে গিয়ে বিশাল আকৃতির ট্রেনটি দেখতে পেলাম।

ভারতবর্ষের ট্রেনে প্রথম চড়া

ভারতের ট্রেন সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবশ্যই অবগত আছেন যে,সপ্তাহ দুই বা তিনেক আগে টিকেট কাটা ছাড়া নিজের পছন্দ মতন ট্রেন বা সিট কোনটাই পাওয়া একেবারেই অসম্ভব একটা বিষয়। আমরা বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরুর ৪৮ ঘন্টা আগে টিকেট করি ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পছন্দসই টিকেট করা সম্ভব হয়নি।আমাদের রুট আর সময় বিবেচনা করে দিল্লিগামী ইউবা এক্সপ্রেস টি সবচেয়ে উপযোগী মনে হওয়ায় আমরা সেটিতেই টিকেট কনফার্ম করেছিলাম। ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব) আমাদের নির্ধারিত J বগির নির্ধারিত আসনে বসার কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ মিনিট থেকে শুরু হল আমাদের ম্যারাথন ট্রেনের যাত্রা।ইউবা এক্সপ্রেস ১৬ ঘন্টায় দিল্লিতে পৌঁছানোর কথা বললেও পাশে থাকা একজন যাত্রীর কাছ থেকে আরো বেশি সময় লাগার কথা জানলাম।গতদিন থেকে ভ্রমনে থাকা আমাদের ক্লান্ত শরীর না পারছে ঘুমাতে না পারছে বসে থাকতে। ট্রেনটির চেয়ার কোচটি আমাদের দেশীয় চেয়ার কোচের চেয়েও একটু মানহীন মনে হয়েছে আমার কাছে।সারারাত এক ধরনের যুদ্ধ করেই কাটাতে হয়েছে।ভারতবর্ষের প্রথম ট্রেন যাত্রার স্মৃতিটি আমরা ভুলেই যেতেই চাইবো। কলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কি.মি.। পশ্চিমবঙ্গ -ঝড়খন্ড- বিহার-উত্তর প্রদেশ- পার হয়ে ট্রেন চলছে দিল্লির উদ্দেশ্যে।সেই দিল্লি সুলতানি আমলের সুলতানদের দিল্লি। সেই দিল্লি মুঘল আমলের বাদশাহদের দিল্লি। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দিল্লি। সম্রাট শাহজাহানের দিল্লি। জাহাঙ্গীরের দিল্লি। আওরঙ্গজেবের দিল্লি।কুতুব মিনারের দিল্লি।জামে মসজিদের দিল্লি।লাল কেল্লার দিল্লি।কত কিছুই ভাবছিলাম।হায় তাদের উত্তরসূরিরা আজ পরদেশী, বিদেশী আর সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সুবিধাতো দূরের কথা নিজের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে সেখানে বসবাস করাই আজ দুষ্কর হয়ে উঠেছে।কল্পনা থেকে বাস্তবে ফেরত আসলাম।রাতে দুই পাশের দৃশ্য দেখতে না পারলেও সকালে উভয় পাশেই সুজলা সুফলা ফসলের মাঠ দেখতে পেলাম ঘন কুয়াশা, সরিষার ক্ষেত, বাংলাদেশের মতনই মনে হলো অনেকটা।জানিনা কোন প্রদেশ,কোন জেলা,কোন গ্রাম কিন্তু চলন্ত ট্রেন থেকে দুপাশের ফসলের ক্ষেত দেখতে বেশ ভালো লাগলো।আবাদি ভূমির এই ফসলইতো শহরের লোকদের অন্নের ব্যবস্থা করে।অন্নের ব্যবস্থা এই দরিদ্র কৃষকদেরও করে তবে সেটা অন্যভাবে।চলতে চলতে একটা সময়ে হাঁপিয়ে উঠেছি।কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়।তার উপরে আবার নাই ঘুম নাই খাবার দাবার।যদিও ট্রেনে উঠার সময় পাউরুটি,কলা,পানি, বিস্কিট,আপেল এসব নিয়েই উঠেছি তারপরেও দীর্ঘক্ষণের এই জার্নিটা বেশ কষ্টকর ই লাগছিলো। ১৬ ঘন্টার কথা থাকলেও প্রায় ২২ ঘন্টা পরে আমাদের ট্রেন দিল্লির আনন্দ বিহার স্টেশনে এসে পৌঁছলো।দীর্ঘ মেয়াদি ভ্রমনে চেয়ারকোচ থেকে স্লিপারই সবচেয়ে উত্তম বিকল্প বা উপায়।

দিল্লিতে পৌঁছা

(১৯.০১.২০২০,রবিবার) দিল্লিতে যখন নামলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়ে গিয়েছে।দীর্ঘ সময় ট্রেন যাত্রা আর না ঘুমাতে পারায় বেশ কাহিলই লাগছিলো।মাত্র ৮° তাপমাত্রার দিল্লির শীতটা বেশ হাড় কাঁপানোই মনে হচ্ছিলো। আনন্দ বিহার স্টেশনটাকে বেশ বড় আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হলো।ভারতের অধিকাংশ মানুষ যে রেল পথেই চলাচল করে সেটা ওদের স্টেশন আর সুযোগ সুবিধা দেখলেই বুঝা যায়।স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা পরিকল্পনা মাফিক পাহাড়গঞ্জের দিকে যাত্রা করলাম। ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব) পূর্বে কখনো দিল্লি না আসাতে আর ভাড়া সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকাতে আমরা বেশ কিছুক্ষণ দরদাম করে শেষ পর্যন্ত দুটো অটো ঠিক করে পাহাড়গঞ্জের দিকে রওয়ানা করলাম।শহরটাকে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ই মনে হচ্ছিলো এবং ট্রাফিকও বেশ নিয়মশৃঙ্খলিত মনে হলো।প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পর আমরা পাহাড়গঞ্জে এসে নামলাম।যেহেতু আমাদের পূর্ব থেকে কোন হোটেল বুক করা ছিল না তাই একটা শিখ খাবারের দোকানে বসে আমরা দুইজন হোটেল ঠিক করতে গেলাম।হোটেল খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশীদের ওরা খুব একটা ইতিবাচকভাবে দেখছে না এবং হোটেল ভাড়া দিতেও ওদের খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।প্রচণ্ড রকমের হতাশ হলাম।ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু এই মুহূর্তে বলতে গেলে বাংলাদেশ অন্যতম,তাছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ – ভারত সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক পার করছে( যদিও এর সবটুকুই একতরফা), ভারতের পর্যটন খাতের সবচেয়ে বড় গ্রাহক হলো বাংলাদেশের মতন একটি ছোট রাষ্ট্রে ওদের পনেরটি ভিসা সেন্টার দেখলেই বুঝা যায় কি পরিমাণ বাংলাদেশী ওদের দেশে যায়।বিবিসির একটা নিউজে শুনেছিলাম ২০১৯ সালে প্রায় ১৫ লাখ লোক বাংলাদেশী পাসপোর্টে ভারতে ভ্রমন বা চিকিৎসার কাজে গিয়েছেন।ওদের কি দোষ দিবো, দোষ তো আমাদের নিজেদেরই।আমরাই তো ওদের দেশে যাই,ওদের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে নিজেদের ভ্রমণ সত্তাটাকে জাতে তুলি।আমাদের দেশীয় ভ্রমন গ্রুপগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায় মানুষ কী পরিমাণ সিকিম,সিমলা,মানালি,দিল্লি আর মেঘালয়ের প্রতি আসক্ত। আর হুযুগ প্রবণতা তো আমাদের রক্তের মধ্যেই রয়েছে।আমি নিজেও এসব থেকে মুক্ত নই।কষ্ট লাগছে এটা ভেবে যে,এই রাষ্ট্র আমাদেরকে ভিসা দিয়েছে আমরা কাড়ি কাড়ি টাকা এই রাষ্ট্রকে দিয়ে যাচ্ছি তারপরেও হোটেল মালিকদের এই ব্যবহার একটা মানুষিক ধাক্কার মতনই লাগলো। পেটে অনেক ক্ষিদে থাকা সত্বেও মাসুদ আর হিমেল অনেক খোঁজাখুঁজি করে থাকার জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা করলো। হোটেল ঠিক করে খাবারের দোকানে ফিরে আসার পরে ছয়জন একসাথে খাবার খেলাম।বিলটা একটু বেশিই আসলো,তবুও ক্ষিদে পেটে এখানে খাবারের সাথে কোন আপোষ করতে চাইনি।খাবার শেষ করে আমরা হোটেলে আমাদের রুমে গেলাম কিন্তু হোটেলের সংস্কারের কাজ চলায় আমাদের রুমটি ছিল অনেকটাই অগোছালো আর স্যাতস্যাতে,আমরা এতোটাই শারীরিক এবং মানুষিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম যে অন্য কোন হোটেল খোঁজ করার শক্তি পাইনি।বাথরুমের অবস্থা খুবই জঘন্য ছিল,একটা বদনি পর্যন্ত ছিল না,গরম পানির কোন ব্যবস্থাই ছিল না,সাবান আর শ্যাম্পুর টাকা দেওয়া সত্ত্বেও আমরা সেসব পাইনি।অগ্যতা এই হাঁড় কাঁপানো প্রচণ্ড শীতে ঠাণ্ডা পানিতেই আমরা একে একে গোসল করে নিলাম।গোসল করতেই সবারই একটু ক্লান্তি দূর হলো।প্রায় ঘন্টাক্ষাণিক রুমে বিশ্রাম করে আমরা শহর দেখতে বের হলাম।রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিধায় সব স্থানেই লোকজনের আনাগোনা ছিল খুবই কম।একটা ভ্যান নিয়ে আমরা মেট্রোর দিকে রওয়ানা করলাম।ভ্যানের চালক একজন দরিদ্র মুসলিম।উনি মোদি ও তার নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ঝাড়লেন।কিন্তু কীইবা করা যাবে?মানুষের যদি মনুষ্যত্ব লোপ পায় তাহলে তো সে কতকিছুই করতে পারে।এই ভ্যানচালকটিই যেন বুঝিয়ে দিল দিল্লির মুসলিমরা অধিকাংশ ই এমন হতদরিদ্র আর ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার।একটু কষ্টই লাগলো তবে কিছু করার ছিল না।ছুটির দিন বিধায় মেট্রো সেদিন বন্ধ ছিল। সেখানে গান্ধিজীর একটা ভাস্কর্য দেখলাম।একটু হেঁটে রাস্তা পার হয়ে একটা স্টপেজ থেকে বাসে চড়ে ইন্ডিয়া গেইটে গেলাম।দিল্লির এই বাস সার্ভিসটা বেশ গোছানো মনে হলো,নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থামবে,বাসে চড়ার সাথে সাথে টিকেট কাটবে এবং নির্দিষ্ট স্টপেজেই নামিয়ে দিবে ।প্রতিটি বাসেরই নির্দিষ্ট রুট আছে আর নির্দিষ্ট সময় আছে।প্রতিটি যাত্রী ছাউনিতেই রুট আর সময় সম্বলিত বাসের শিডিউল টানানো আছে।২৬ জানুয়ারী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস থাকায় আমরা ইন্ডিয়া গেইটের খুব কাছাকাছি যেতে পারিনি।দূর থেকেই দেখলাম।ইন্ডিয়া গেট ভারতের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এটি দিল্লির অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থানও বটে।প্যারিসের আর্ক দে ত্রিস্ফের আদলে ১৯৩১ সালে নির্মিত এই সৌধটির নকশা করেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস।আগে এর নাম ছিল “অল ইন্ডিয়া ওয়ার মনুমেন্ট”।প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ আফগান যুদ্ধে নিহত ৯০,০০০ ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতিরক্ষার্থে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়।এটি লাল ও সাদা বেলেপাথর ও গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি। আগে পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি এই স্মৃতি সৌধে ছিল। সেই মূর্তিটি অন্যান্য মূর্তির সঙ্গে দিল্লির করোনেশন পার্কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়া গেটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অজ্ঞতা নামা সৈনিকদের সমাধি” হিসেবে পরিচিত “অমর জওয়ান জ্যোতি” স্থাপিত হয়েছে।এই ইন্ডিযা গেইটটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে আর উদ্বোধন করা হয় ১৯৩১ সালে।
INDIA GATE

ছবিঃ ইন্ডিয়া গেইট

ইন্ডিয়া গেইটের দূর থেকেই ছবি তুলে সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে আমরা অটো নিয়ে গেলাম জামে মসজিদ এলাকায়। সেখানে জানা অজানা হরেক রকমের খাবার দাবার দেখতে পেলাম।কত ধরনের খাবার আর সে খাবারের ঘ্রাণ।
ইন্ডিয়া ট্যুর

ছবিঃ স্ট্রিট ফুড

আমাদের ঢাকার চকবাজারের কথা তখন মনে পড়ছিলো।যদিও চকবাজার দিল্লির এই এলাকাটির তুলনায় অনেক ছোট হবে।
ইন্ডিয়া ট্যুর

ছবিঃ স্ট্রিট ফুড

জামে মসজিদ এলাকাটা মুসলিম অধ্যুষিত।মোগল সম্রাট শাহজাহানের উদ্যোগে ১৬৪৪ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে দিল্লির জামে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।এজন্য সেই সময়ে ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ রুপি।পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক টানা একদশক ধরে এই মসজিদ নির্মাণে কাজ করেছে।এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় মসজিদগুলোর অন্যতম।এর চত্বরে প্রায় ২৫ হাজার মুসলিম নামাজ আদায় করতে পারে। আর মসজিদের ভেতরে বসতে পারেন ৮৫ হাজার মুসলমান। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার পরে সম্রাট শাহজাহান শাহী মসজিদের জন্য বুখারা নগরীর(বর্তমান উজবেকিস্তানের একটি শহর) সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারীকে নিয়ে আসেন ইমাম হিসেবে নিয়োগদান করার জন্য।সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারী দিল্লী জামে মসজিদেরর প্রথম ইমাম, তাঁর ইমামতিতে ১৬৫৬ সালের ২৩শে জুলাই প্রথম নামায আদায় করা হয়। সম্রাট শাহজাহান তাকে শাহী ইমাম উপাধী প্রদান করেন এবং ইমামত-এ-উজমার উচ্চ পদে নিয়োগ প্রদান করেন।সেই থেকে দিল্লী জামে মসজিদের ইমাম আবদুল গফুর শাহের বংশধর থেকে নিয়োগ হয়ে আসছে। এই সেই দিল্লি যেটাকে কেন্দ্র বানিয়ে মুসলিমরা সারা ভারত বর্ষকে প্রায় ৭০০ বছর শাসন করেছে।দিল্লি সালতানাত আর মুঘল সালতানাত।এসব শাসকদের সবাই ভারতেকেই নিজেদের মাতৃভূমির ন্যায় আঁকড়ে ধরেছিল। দিল্লির যা কিছু গৌরব তার সবই মুসলমানদের অবদান। আজকের বাস্তবতায় সেই মুসলিমরাই দিল্লি তথা সারা ভারতবর্ষে অচ্ছুৎ। বিজেপির একের পর এক সাম্প্রদায়িক নীতি আর দরিদ্র ভারতীয়দের না বুঝে আস্ফালন ভারতীয় মুসলিমদেরকে দিন দিন কোনঠাসাই করে ফেলছে। অনেকটা সময় দিল্লির জামে মসজিদ এলাকায় কাটিয়ে আমরা দুটি অটো করে পাহাড়গঞ্জে আমাদের হোটেলে ফিরলাম। পরের দিন ভোর ৫ঃ৪৫ মিনিটে ট্রেন থাকায় ম্যানেজারের সহায়তায় রাতেই ট্যাক্সি রেডি করে রেখে ঘুমিয়ে পরলাম।

দিল্লি থেকে কালকা

ভোর ৫ঃ৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন থাকায় মোবাইলে ৩ঃ৪৫ মিনিটেই এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম।পাহাড়গঞ্জ থেকে আামাদের স্টেশনে এস রোহিলা যেতে ৪০ মিনিটের দূরত্ব।তাই সতর্কতা সরূপ একটু আগেই উঠেছি।ব্যাগ গুছিয়ে সবাই হোটেলের চেক আউট করে ট্যাক্সি চড়ে এস রোহিলার দিকে রওয়ানা করলাম। এই ভোরেও দেখলাম দিল্লির এই অংশটি বেশ সচল। সম্ভবত ট্রেনের সূচির জন্য এমন কর্মচঞ্চলতা।দিল্লির হাড় কাঁপানো প্রচণ্ড শীত আমাদেরকে একটু কষ্টই দিচ্ছিলো। এস রোহিলা স্টেশনে এসে আমাদের হিমালয়ের এক্সপ্রেসের নির্ধারিত প্লাটফর্ম জেনে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই সময়ে স্টেশনের গরম কফি খেতে মন্দ লাগেনি। ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব) নির্ধারিত সময়েই ট্রেন আসলো আর আমরা নিজেদের বগিতে এসে আসন গ্রহণ করলাম।ভারতের রেল যোগাযোগ অন্যতম মাধ্যম হওয়ায় রেলের প্রতি ভারত সরকারের যত্নটা বেশ চোখে পরার মতনই। আমার দেশে কেন এমন একটি রেল ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না সেটা নিয়ে আমার অনেক দিনেরই ভাবনা। আমি বুঝিনা আমাদের নীতি নির্ধারকগণ এতো ভারতপ্রেমি অথচ ভারতের এই বিষয়টি কেন অনুসরণ করছেন না।কিছুটা লোকাল ট্রেনের মতনই আস্তে আস্তে হেলে দুলে আমাদের ট্রেনটি এগিয়ে চলছে। যাওয়ার পথে কতশত স্টেশন,কতশত জনপদ পাড়ি দিচ্ছিলো সেসবের নাম মনে রাখতে পারিনি। ইন্ডিয়া ট্যুর চণ্ডিগড় স্টেশনে ট্রেনটি থামার পরে আমরা নেমে চা পান ও ফটোসেশন করেছিলাম।স্টেশনটি অনেক ভালো লেগেছে,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, একেবারে ছবির মতন।একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল,নামটি মনে নেই।চণ্ডীগড়েই বাড়ি,দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।নামার সময় আমাদেরকে শুভকামনা জানিয়ে গেল।ঠাণ্ডার প্রকোপ থাকায় জানালা খুলেও বেশিক্ষণ সেটা খোলা রাখতে পারিনি।আমাদের ট্রেনটি যখন হেলেদুলে কালকা স্টেশনে প্রবেশ করলো তখন ঘড়ির কাঁটায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই। ইন্ডিয়া ট্যুর বৃটিশদের বানানো এই কালকা স্টেশনটি দেখে আমি অভিভূত হলাম।কলকাতা থেকে যখন সিমলায় গ্রীষ্মকালীন রাজধানী স্থানান্তর করা হয় তখন ই এই কালকা স্টেশনটি করা হয়।মূলত কলকাতা থেকে সিমলার নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষার জন্যই কালকা মেইল ও কালকা রেল স্টেশন চালু করা হয়। আমরা কালকা স্টেশনে নেমে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাশতার টেবিলে হাজির হলাম।কালকার তাপমাত্রা দিল্লি থেকে কম হলেও দিল্লির মতন হাড়কাঁপানো ছিল না। দ্রুত নাশতা সেরে হালকা ফটোশেসন করে আামাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত টয় ট্রেনকে নির্ধারিত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।  ইন্ডিয়া ট্যুর আহ টয় ট্রেন  ……….. কত গল্প,কত সাহিত্য, কত সিনেমায় দেখা এই টয় ট্রেন, আজকে চড়ার আগ মুহূর্তে আমরা …….ধীরে ধীরে টয় ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, মনে হচ্ছিলো, “টয় ট্রেন আমাদের অনুভূতি দেখে মনে মনে হাসছিল” 

পরের পর্ব:

প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

Continue Reading

সর্বাধিক পঠিত