ভ্রমণ কাহিনী
ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (৩য় পর্ব)

Published
3 years agoon

মানালির দ্বিতীয় দিন
আগের পর্ব পড়ুন: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (২য় পর্ব)
(২৩.০১.২০২০, বৃহস্পতিবার)
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এখনই চেক আউট করে বেরিয়ে যেতে হবে। ম্যানেজারের সাথে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে নিজ নিজ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে চড়লাম। এবার গন্তব্য মানালি ক্লাব হাউজ। ক্লাব হাউজে যেতে রাস্তার কিছু অংশ খুবই ভয়ংকর। মাইক্রোর মতন কম শক্তিশালী গাড়ি নিয়ে সেখানে যাওয়া টা একটু ঝুঁকিপূর্ণ ই বটে। বেশ কিছুটা সময় আমাদের গাড়িটা ছোট একটা যানজটে আটকে থাকলো। যানজটটা মূলত ঝুকিপূর্ণ বরফাবৃত রাস্তার কারনেই হয়েছে। আশেপাশের লোকজনও দেখলাম সহযোগিতার মনোভাপন্ন।
যানজট ছাড়াতে তাদেরকেও বেশ তৎপর মনে হলো। আসলে এসব গাড়িতে আসা সিংহভাগ লোকই পর্যটক আর যত পর্যটক ততই স্থানীয়ের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ। ক্লাব হাউজের সামনেই গাড়ি পার্ক করে পাশে থাকা একটা খাবারের দোকানে নাস্তার জন্য বসলাম। দোকানটিকে আমাদের দেশের অনেকটা “আল সালাদিয়া ঢাকা”হোটেল সদৃশ বলা যেতে পারে। ছাদ খোলা হোটেলের সামনে দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া বিয়াস নদীর সৌন্দর্য মন্দ লাগলো না।
মনে হয় মানালীর সবটাই এই বিয়াস দ্বারা পরিবেষ্টিত। নাশতা খেয়ে কাউন্টারে টিকেট কেটে ক্লাব হাউজে প্রবেশ করা হলো।

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর
ক্লাব হাউজটি মানালির থেকে ২ কি.মি.বাম দিকে বিয়াস ঘেঁষে অবস্থিত। এটির স্থাপত্যশৈলি বৃটিশের অনুকরন করা হয়েছে। ফলে প্রথম দেখে যে কেউই এটাকে বৃটিশ আমলে তৈরি বলে ভাবতে পারে, আমিও তেমনটিই ভেবেছিলাম, পরবর্তীতে জানা গেল ইনডোর খেলার প্রতি আগ্রহী করতে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিস্ট ডেপোলপমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি করেছে। সম্ভবত বরফে ঢাকা এই প্রদেশটির খেলার মাঠ না থাকার দরুন বিনোদনের কথা বিবেচনা করেই এমনটি করেছেন। তাছাড়া এই ক্লাব হাউজে পর্যটকদেরও কিছু অর্থের বিনিময়ে খেলাধুলা করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমে ঘুরে ঘুরে ক্লাব হাউজের সবটুকু দেখলাম। আমার কাছে মনে হলো এটা নামেই ক্লাব হাউজ, সবটুকুই বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ক্লাব হাউজ ও ক্লাব হাউজের চত্বর
খেলার জায়গা কমই, বেশিরভাগ স্থানই দোকানপাটে ঠাসা। বেশ কিছুটা সময় ঘুরে ঘুরে দেখার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ব্যাডমিন্টন খেলার। চারজন খেলা শুরু করলো, দর্শকসাড়িতে বসে সে খেলাতে মনোনিবেশ করলাম। বেশ হাড্ডাহাড্ডিই হলো লড়াইটা। তাদের বাকি দুজন নামলাম। টিম করা হল আমি আর আইভি আর বিপক্ষ টিমে হিমেল আর এলিন। প্রথম দিকে ওরা টানা পয়েন্ট পেলেও শেষের দিকে আমরাও টানা পয়েন্ট পেতে শুরু করলাম। খেলায় যখন টানটান উত্তেজনা ঠিক তখনই গার্ড এসে আমাদের সময় শেষ বলে জানালেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলায় ইস্তফা দিয়ে রেকেট জমা দিলাম। মাইনাস তাপমাত্রা সত্ত্বেও আমাদের শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়ছিলো। সত্যি বলতে কি খেলাটা মন্দ লাগেনি। ক্লাবের সামনে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। এখানেও দেখলাম পর্যটকদের পয়সা খসানোর জন্য স্থানীয় লোকজন বেশ কতেক পসরা নিয়ে বসছেন। ক্লাব হাউজ শেষ করে এবার রওনা করলাম একটু দূরে হাদিম্বা টেম্পলের দিকে।
বেশ উঁচুতে এই টেম্পলটিতে যেতে হলে গাড়ি ছাড়াও অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। তাছাড়া ভয়ংকর বরফের পিচ্ছিল পথে হোঁটচ খাওয়ার ভয় তো আছেই। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটেই চলতে লাগলাম। এখানে ঘনবসতি একটু বেশি হওয়ায় রাস্তাগুলো বেশ সরু আর বাড়িঘরও একেবারে রাস্তা লাগোয়া। অনেকটাই হিজিবিজি অবস্থা। টেম্পলের সীমানায় এসে অনেকগুলো পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে টেম্পল চত্বরে পৌঁছলাম।
হাদিম্বা টেম্পলটি ১৫৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই টেম্পলের স্থাপত্যশৈলির বিশেষত্ব পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

টেম্পল ও এর আঙ্গিনায় পর্যটকদের ভীড়
চার স্তর বিশিষ্ট প্যাগোডা ছাদ মন্দিরে যোগ করেছে আলাদা বিশেষত্ব। আসলে এটি একটি গুহা মন্দির যা চমৎকারভাবে কাঠের কার্ভিং করা। মন্দিরটি ভীমের স্ত্রী দেবী হাদিম্বার উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। ভীম ছিলেন মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবের একজন।
সিঁড়ির মতন মন্দির চত্বরটাও বেশ পিচ্ছিল ছিল। একটু অসাবধান হলেই ঘটতে পারতো ভয়ংকর কোন দুর্ঘটনা। লোকজন দেখলাম লাইন ধরে পূজো বা প্রণাম করতে মন্দিরে প্রবেশ করছে কেউবা ছবি তুলছে। স্থানীয় অনেক লোকজন পর্যটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন ছোটখাটো কাজকর্ম ও করছে। আমাদের সফর সঙ্গী হিমেলও সিরিয়াল ধরে মন্দির থেকে প্রণাম করে আসলো। বড় বড় অনেক গাছগাছালিতে ঘেরা এই স্থানটিকে একটা আধ্যাতিকতার রূপ দান করেছে। তাছাড়া বরফের মাঝে এসব বড় বড় গাছগাছড়া অন্যরকম সৌন্দর্যেরও অবতারণা করেছে।
বেশ কিছুটা সময় এই মন্দির চত্বরও তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে পার্কিংয়ে থাকা গাড়ির কাছে আসলাম। আমাদের হাতে তখনও বেশ কবছুটা সময় ছিল তাই ড্রাইভার সাহেব শহরের একটু বাহিরে উষ্ণ প্রস্রবনের একটা ঝিরির কাছে নিয়ে গেলেন।
মাইনাস তাপমাত্রার এই মানালিতে উষ্ণ পানির ঝিরি একটু অবাক করার বিষয়ই বটে। হয়তো এর বৈজ্ঞানিক কোন কারনও থাকবে।

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী
বিয়াস নদীর কূল ঘেঁষা এই ঝিরিতে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। বিয়াসের বড় বড় পাথরের উপরে বসে ছবিও তুললাম। খরস্রোতা পাথুরে বিয়াস নদী পাশেই বড় বড় পাহাড় সেই সাথে সবুজ বনাঞ্চল,

গরম পানির ঝিরির পাশে বিয়াস নদী
প্রকৃতির সবটুকুই যেন এখানে একেবারে উজাড় করে দিয়েছে। ফিরতে যদিও ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু সময় তো আর বসে থাকছে না। দ্রুতই মল রোডে ফিরলাম।

মানালি মল রোড
পূর্বের সেই মুসলিম হোটেলেই দুপুরেরখাবার খেলাম। খাবার খেয়ে আমাদের নির্ধারিত মাইক্রো নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা করলাম। বাস স্ট্যান্ডটি শহর থেকে একটু বাহিরে।

মানালি বাস স্টেশন
পর্যটন নির্ভর এই নগরীকে অযথা হাঙ্গামা থেকে রেহাই দিতেই এই ব্যবস্থা। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর ড্রাইভার সাহেব থেকে বিদায় নিলাম। আসলে সব বিদায়ই কষ্টের, ব্যথার।
ড্রাইভার সাহেব সম্পর্কে একটু বলি, উনার নাম জগদীশ, বাড়ি চণ্ডীগড়। সিমলা-মানালি রুটের অধিকাংশ ড্রাইভারের বাড়িই সম্ভবত চণ্ডীগড়। লোকটা খুব কম কথা বলেছেন আর গাড়িটাও মোটামোটি ভালোই চালিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে জানিয়েছেন আমরা সিমলা থেকে মানালীতে থাকার জন্য যে টাকায় প্যাকেজটি নিয়েছি সরাসরি উনার মাধ্যমে সেটি নিলে অন্তত আমাদের ১০০০ হাজার রুপি করে কম লাগতো। সত্য মিথ্যা জানিনা তবে পর্যটন এরিয়াতে থার্ডপার্টি এড়িয়ে সরাসরি মূল পার্টির সাথে কথা বলতে পারলে অনেকটাই সাশ্রয় করা সম্ভব এতে কোন সন্দেহ নেই। ড্রাইভার সাহেব নিজের কার্ড দিয়ে আমাদের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা বাসস্ট্যান্ডে প্রবেশ করলাম।

মানালি বাস স্টেশন
মানালি থেকে দিল্লি
(২৩.০১.২০২০, বৃহস্পতিবার)
বাসস্ট্যান্ডের পরিবেশ খুব একটা ভালো লাগলো না একটু নোংরাই মনে হল, বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে বিয়াস নদীর পাড়টিও বেশ নোংরা আর আবর্জনায় ভর্তি। বড় বড় বাসের ভীড়ে আমরা আমাদের দিল্লিগামি নির্ধারিত বাসটি খুঁজে সেটাতে আসন গ্রহণ করলাম। বাস ছাড়তে তখনও ২০-২৫ মিনিট বাকি। বাসে আমরাই বাংলাদেশি ছিলাম। অনেকেই দেখলাম খাবার নিয়ে উঠছে, বুঝতে পারলাম যাত্রা বিরতিতে এরা বাহিরের খাবার খাবেন না। নির্ধারিত সময় বিকেল ৫ টার সময় ই বাস যাত্রা শুরু করলো। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে বিকেল ৪ঃ৪৫-৫ঃ১৫ মিনিট এর মধ্যে প্রতিদিনই ১০-১৫ টি দিল্লিগামী বাস ছাড়ে। ভারতীয় রেল এখনোও পর্যন্ত এই পাহাড়ি হিমাচলের মানালী পর্যন্ত আসতে পারেনি। কে জানে হয়তো অদূর বা দূর ভবিষ্যতে ভারতীয় রেল এই পাহাড়েও উঠে আসবে। রেল ব্যবস্থাটি ভারতীয়দের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম, সেটা না থাকাতেই এখানে বাসের জমজমাট অবস্থা। এইবার আমার পাশের সিটে বসেছে মাসুদ। যদিও আমাদের ভ্রমনের বেশির ভাগ সময়ই আমার বাসম্যাট হয় হিমেল। আমাদের সামনে স্ত্রী কন্যা সমেত যে ভদ্রলোক বসেছেন উনার কন্যাটি বাস ছাড়ার শুরু থেকেই বমি করা শুরু করেছেন এবং সেটা অনবরত চলছেই। এই বিষয়টি সবার জন্য ই কষ্টের। যদিও পাহাড়ি এসব রাস্তায় এমনটি হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। বাস ছাড়ার পর থেকেই আমারো কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো। আসলে পাহাড়ি রাস্তা, তাছাড়া কয়েকদিনের টানা জার্নি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না হওয়া, বাসের সামনের যাত্রীর অনবরত বমি হওয়া সবকিছু মিলিয়ে সেই খারাপ লাগাটা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলো। চেষ্টটা অনেকটাই সফল হল তবে বেশি সময়ের জন্য না। হটাত করেই কেমন যেন ভ্যাপসা গরম লাগা শুরু হলো, আমি একে একে জুতা খুললাম, মোজা খুললাম, জ্যাকেট খুললাম, হাত মোজা খোললাম তারপরেও কেমন যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে নিচ্ছিলো। পানি পান করে মনোযোগটাকে অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিলোনা। বুঝতে পারলাম যেকোন মুহূর্তে আমিও বমি করে দিতে পারি। চোখ বন্ধ করে এক নাগাড়ে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলাম। আস্তে আস্তে মন্দ লাগাটা কিছুটা কমতে লাগলো। প্রায় ৫ ঘন্টা গাড়ি চলার পরে রাত ১০টার দিকে একটি হোটেলে আমাদের যাত্রা বিরতি দিল। খুব খারাপ লাগা অবস্থা নিয়ে বাস থেকে বের হয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে গেলাম। এই তীব্র ঠাণ্ডায় বেসিনের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানি দিয়েই চোখ মুখ ধৌত করলাম। নাক মুখ আর ঘাড়ে ঠাণ্ডার পানির পরশ পাওয়া পরে একটু ভালো লাগলো। ভ্যাপসা একটা অস্থির গরম লাগা সেটাও কমতে লাগলো। এবার গেলাম খাবার খেতে, সুজন আর এলিনের বেশি খারাপ লাগাতে খাবার না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি, মাসুদ, হিমেল আর আইভি খাবার খাওয়ার জন্য বসলাম। ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার নিলেন। ভাত দেখে আমরা ভাতেরই অর্ডার করলাম কিন্তু সেটার বিল যে এতো হবে কখনোই ভাবতে পারিনি। আমাদের দেশে আমরা ভাতের প্লেট কত টাকা দেই? আমাদের ক্যাম্পাসে ৬ টাকা, বাহিরে না হয় বড়জোর ২০ টাকা, ভারতে সেটা না হয় তিনগুন বেশি হয়ে ৬০ টাকা হবে কিন্তু সেটার দাম যখন ১৫০ রুপি হয় তখন অবাক হওয়ার উপায়ও বাকি থাকে না। ভারত সফরে পুরো অংশেই দেখেছি সালাদ হিসেবে ওরা মুলার একটু স্লাইড দেয় আমরা সেটা ছোঁয়েও দেখতাম না। এখানে সালাদ চাওয়াতে একটা পেঁয়াজের উপরের একটা খোঁসা কয়েকটা খন্ড করে দিয়েছে আর সেটার সাথে যথারীতি কয়েকটা মুলার টুকরো। এটারও বিল ধরেছে ৮০ রুপিয়া। মোট কথা খাবার খেয়ে তৃপ্তি তো পাইনিই যখন বিল শুনলাম ১০৬০ রুপি তখন যেন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মতন অবস্থা। কি আর করা বিল দিয়ে বাসে উঠে এলাম। বুঝতে পারলাম কেন লোকজন বাসে খাবার নিয়ে উঠছিল।
পুনরায় বাস চলতে শুরু করলো। সেই সাথে আমার খারাপ লাগাটাও শুরু হলো। ঘুমও আসছিলো না। আমার সিটম্যাট মাসুদেরও দেখলাম আমার মতনই অবস্থা। পাশে হিমেল আর আইভি ভালোই ঘুমোচ্ছিলো। পিছনে সুজন আর এলিনকে অন্ধকারে দেখা না গেলেও বোধ করি তারাও ঘুমাচ্ছিলো ভালোই। একদিকে ওয়াসরুমের চাপ আর আরেকদিকে এই খারাপ লাগা, কি যে বিশ্রী একটা পরিস্থিতির মধ্যে বসে আছি। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাস চণ্ডীগড়ে এসে পোঁছলো। আমাদের সামনের সিটে থাকা ভদ্রলোক নিজের কন্যা আর স্ত্রী কে নিয়ে নামবেন। এই সুযোগে আমি আর মাসুদ নামলাম। মাসুদ কিছুটা উগড়ে দিলো আর আমিও খোলা স্থানেই সুস্থির হলাম। একটু ভালো লাগার পরে হালকা একটা ঘুমের ভাব আসছিলো কিন্তু সেটাকে ঘুম বলা যাবে না কোনভাবেই। বাম পাশের সিটে হিমেল আর আইভির একাগ্রচিত্তের ঘুম দেখে কিছুটা ইর্ষাই লাগছিলো। সত্যি বলতে কি এমন জার্নিতে ঘুমিয়ে পরাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ, তা নাহলে সমস্যা হতেই পারে। যাই হোক ভোর চারটা বা সাড়ে চারটায় আমাদেরকে দিল্লির কোন একটা স্থানে নামিয়ে দেওয়া হলো। দিল্লি নামতেই বিশ্রী হাঁড় কাঁপানো শীতে কাঁপতে লাগলাম। দিল্লির ঠাণ্ডাটা সত্যিকার অর্থেই বিশ্রী। মানালির বরফের রাজ্যের মাইনাস তাপমাত্রায়ও এতোটা হাঁড় কাপানো ঠাণ্ডা লাগেনি যতটা এখানে লেগেছে।
দিল্লিতে সারাদিন
(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার)
সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে কলকাতার বিমান হওয়ায় সারাদিন দিল্লিতেই থাকতে হবে। হোটেল খোঁজার জন্য অটোতে চড়ে যাত্রা করলাম সেই পাহাড়গঞ্জের দিকে। কয়েক দিন আগের বিশ্রী অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আবার কেন পাহাড়গঞ্জের দিকেই যাত্রা করলাম সেটা আমার বোধগম্য হলো না। একে তো ক্লান্ত তার উপর ঘুম জড়ানো চোখে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করেই তাদের সাথে রওনা করলাম। অটো ড্রাইভার একেকটা হোটেলে নিয়ে যায় আর বাংলাদেশী শুনে নাক কুচকিয়ে ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। কি একটা অবস্থা, এই ভোর বেলাতে আমরা একেকটা হোটেলে যাচ্ছি আর বাংলাদেশি বলে রুম না পেয়ে ফেরত আসছি। খুবই অপমানজনক আর লজ্জাষ্কর পরিস্থিতি। আমার বুঝে আসছিলো না, ভারত আমাদেরকে তাদের দেশের ভিসা দিলো, সব স্থানে যাওয়ার অনুমতি দিলো, আমাদেরকে দিয়ে তাদের লক্ষ কোটি টাকা আয় হলো অথচ আমাদেরকে তারা থাকার জন্য হোটেল ভাড়া দিচ্ছে না?আর আমাদের মন্ত্রীর ভাষায় তো ভারত বাংলাদেশ নাকি এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক পার করছে, যদিও এনআরসি নিয়ে আসামের ৪০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশি বলে ভারতীয় কর্তারা সর্বদাই তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছে, সীমান্ত মানুষ হত্যা করছে, আমাদের পানি নিয়ে যাচ্ছে এমন হাজারো কিছু। তবুও নিছক বাংলাদেশী বলেই আমাদেরকে হোটেল দেওয়া হচ্ছে না। মনটা খুব তিক্ত হয়ে উঠছিলো। অটো ড্রাইভারও আমাদের চেয়ে আরো বেশি তেতে উঠে একের পর এক হেটেলে নিয়ে যাচ্ছেন এবং বারবার আমাদেরকে অভয় দিচ্ছেন। অটো ড্রাইভার আমাদেরকে একটা স্থানে নামিয়ে দিয়ে যায়নি বরং দাযিত্ব নিয়ে কোন একটা হোটেলে উঠিয়ে দিয়েই তারপর গিয়েছেন। এটাকে হয়তো অনেকে অর্থ পাওয়ার একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু আমি এটা অটো ড্রাইভাবের মানবতা বা দায়িত্বশীলতা বলেই ব্যাখ্যা করবো। অনেক ঘুরাঘুরির পরে অত্যন্ত চড়া দামে খুবই নিম্ন মানের একটা হোটেলে আমরা উঠলাম এবং চেকইন করে কোনরকমে ব্যাগপত্র রেখেই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম। ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর পরে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। নাশতা খাওয়ার জন্য দোকান খুঁজতেই কলকাতা বাংলা খাবার, আসমীয় বাংলা খাবার প্রভৃতি দোকানের ভীড়ে দূর থেকে ঢাকা হোটেলের একটি সাইনবোর্ড দেখে এক মুহূর্ত ও দেরি না করে সেটাতেই প্রবেশ করলাম। মালিক হলেন ঢাকা উত্তরার আর কর্মচারি বাহ্মণবাড়িয়ার। কয়েকদিন ধরে ভিনদেশি ভাষা শুনতে শুনতে আর অশুদ্ধ উচ্চরণে বলতে বলতে কানটা একেবারে পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেখানে এই বাংলাদেশী বাংলা ভাষা এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসলো। তৃপ্তিভরে ডালভাজি, ডিম আর পরোটা খেলাম। এমনকি থোড়াও নিলাম। যদিও দিল্লির কোন হোটেলেই থোড়া নেই এমনকি কলকাতায়ও চেয়ে থোড়া পাইনি। নাস্তা খেয়ে এখন জামে মসজিদের চাদনী চক এলাকায় যেতে হবে। সেখানেই শপিং করার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। অনেকটা বাংলাদেশের চকবাজারের মতন। আমাদের সবারই টাকা সেই মানালী থাকতেই শেষ পর্যায়ে ছিল। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু টাকা বাংলাদেশ থেকে কলকাতা পর্যন্ত আনানো গেলেও কলকাতা থেকে মানালি পাঠানো যায়নি। দিল্লির এই এলাকাটিতে দেখলাম রকেট বিকাশের প্রচুর দোকান। চাইলে দেশ থেকে এখানেই সরাসরি টাকা আনানো যেতো যদিও এটা অবৈধ। আমাদের টাকা যেহেতু কলকাতায় এসেছে সেখান থেকে দিল্লি আনানো হলো। কিন্তু কিছু জটিলতায় হাতে আসতে দেরি হচ্ছিলো। আগ্যতা টাকা না নিয়েই চাঁদনি চকের দিকে রওয়ানা করলাম। চাঁদনি চকটি দিল্লি জামে মসজিদ এলাকায়। মসজিদের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম বিকট শব্দে একদল লোক ঢোল, সানাই, বাঁশি বাজিয়ে কি যেন ধর্মীয় রীতি পালন করছে। একেবারে মসজিদের সাথে ই। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সোয়া এগারটা বাজে। আর ৪০ মিনিট পরেই জুমুআর আযান হবে। উল্লেখ্য এই জামে মসজিদ এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত।

দিল্লি জামে মসজিদ
আশপাশের লোকগুলোর মধ্যে এক ধরণের বেদনা দেখতে পেলাম, কেমন যেন একটা অস্বস্তি সবার চোখে মুখে। বুঝতে পারছিলাম লোকগুলোর মধ্যে চাপা বেদনা আছে, হয়তো কিছুটা ক্ষোভও আছে। জানিনা আযানের সময়টিতে সেসব রীতি তারা থামিয়েছিল কিনা। মার্কেটগুলো কেবল খুলছিলো। আমার ইচ্ছে ছিল কেমনে করে বিয়ের শপিং করা হয়, কি কি কেনা হয় সেটা দেখবার, দেখে একটু শিখবার কিন্তু টাকা সংগ্রহ করার জন্য আইভি আর সুজনকে সাথে করে আমাকে হোটেলের পাশে বিকাশের দোকানে যেতে হয়েছিল। সত্যি বলতে কি এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। হিমেল মাসুদ আর এলিন শপিং এ থেকে গেলো আমরা রওয়ানা করলাম টাকা সংগ্রহ করতে। যাবার পথে জামে মসজিদে লোকজনের জুমুআর নামাযে শরীক হতে প্রবেশ করতে দেখলাম। কল্পনায় ভেসে উঠলো আবদুল্লাহ বুখারীর কথা।
১৯৭৩ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করা দিল্লি জামে মসজিদের মরহুম খতীব আবদুল্লাহ বুখারী কলকাতার হাইকোর্টে যখন পবিত্র কোরআন নিষিদ্ধ করার মামলা হয়েছিলো তখন বজ্রকন্ঠে বলে উঠেছিলেন-
“আমি শুধু দিল্লি শাহী জামে মসজিদের ইমাম নই আমি সারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইমাম বলছি, আমরাই ভারতকে আটশত বছর শাসন করেছি, এই ভারতকে আমরাই সাজিয়েছি। যদি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোন বিচারক মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে বাজেয়াপ্ত করার রায় প্রদান করার মত দুঃসাহস দেখায়, আমি ঐ বিচারকের বুকের উপর পা দিয়ে ওর জিহ্বা কেটে ফেলব। “
সেইদিন পুরো ভারত কেঁপে উঠেছিলো ঈমাম সাহেবের ঐকথা শুনে, এবং ভারতের কোন বিচারক আর কোরআন নিষিদ্ধের মত দু:সাহস দেখান নি ..।
ভারতের আজকের প্রেক্ষাপটে এমন একটি কণ্ঠ, এমন একটি ন্যায়ানুগ হুঙ্কার অনেক বেশি প্রয়োজন।
আজকের ভারতে এই শাহী মসজিদকেই ভাঙ্গার হুংকার ছুঁড়ছে সাম্প্রদায়িক সংঘঠন শিবসেনা। জানি না অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় মুসলিমদের কী অবস্থা হবে?
রিকসা করে পুরোনো দিল্লির বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে পাহাড়গঞ্জে আমাদের হোটেলের কাছে পৌঁছলাম। বিকাশের দোকানদারকে খুঁজে পেতে একটু সময় লাগছিলো। প্রয়োজনটা যেহেতু আমাদেরই বেশি ছিল তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায়ই ছিল না। বেশ একটা সময় পরে দোকানদার আসলেন। ভদ্রলোক কলকাতার বাঙ্গালি। তাই বাংলাতেই কথা বললাম। উনি নিজেই বিকাশের এই প্রক্রিয়াটার কথা ব্যাখ্যা করলেন। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে টাকাটা যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সেটা পৌঁছে। যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি উনার কাছে টাকা আসেনি বরং বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লিতে উনার কাছে এসেছে তাই টাকাটা বেশ কয়েকটি জায়গাতে চার্জ দিতে গিয়ে বেশ একটা ভালো ‘এমাউন্ড’ই গচ্চা দিতে হয়েছে। আমরা যখন টাকা হাতে পেয়েছি তখন ঘড়িতে ২ঃ৩০ মিনিট। সন্ধ্যায় আমাদের কলকাতাগামী ফ্লাইট থাকায় এখন আর পুনরায় মার্কেটে যাওয়ার সময় ছিল না। তাছাড়া হিমেলও ততক্ষণে মাসুদকে নিয়ে বিয়ের বাজার শেষ করে ফেলেছে। কি আর করা হোটেলের রুমেই চলে এলাম। খুব বেশি কিছু গোছানোর ছিল না তবুও সবগুছিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। হিমেল, মাসুদ আর এলিন আসার সাথে সাথে ই বের হলাম। সকালের নাশতা খাওয়া ঢাকা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে টেক্সি নিয়ে বিমান বন্দরের রওয়ানা করলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার একটু বয়সী ছিলেন এবং সেইসাথে একটু রসিকও ছিলেন। বিমান বন্দরটি দিল্লি শহর থেকে প্রায় ১৬ কি.মি.বাহিরে।
আমাদের সময় কম ছিল কিন্তু চাচা মিয়ার ট্যাক্সির গতিও কম ছিল। এ যেন সমানে সমানে। তার উপরে সামান্য পথ গিয়ে উনি চাকায় হাওয়া নেওয়ার জন্য ট্যাক্সি থামালেন। কি আর করা, আমাদের উৎকণ্ঠা দেখে উনি অভয় দিলেন এবং সঠিক সময়েই বিমান বন্দরে পৌছানোর নিশ্চিয়তা দিলেন। আমাদের রসিক আইভি তখন বলে উঠলো, ‘চাচা, বিমান মিস করলে কিন্তু আপনার বাসাতেই রাখতে হবে আামাদের’। উনিও বেশ হেসেই এই রসিকতার উত্তর দিলেন। দিল্লির রাস্তাঘাট বেশ চওড়া হওয়ায় গাড়ি প্রচুর থাকলেও ট্রাফিক জ্যামও তেমন একটা পরেনি।
এই দিল্লিতেই ৮০০ বছর মুসলিম শাসনের কেন্দ্রভূমি ছিল। সেসব শাসক বিদেশ থেকে আসলেও ভারতবর্ষকেই নিজেদের স্বদেশ হিসেবে আপন করে নিয়েছিল। বৃটিশদের মতন শাসন করে টাকা বৃটেনে পাচার করেনি। সেন্টার আর পেরেফেরির বিভাজন করেনি। মুসলমানদের ৮০০ বছর শাসনকালে ভারতবর্ষ ই সেন্টার আর পেরিফেরি ছিল। বৃটিশরা এসে পেরিফেরি বানায় বৃটেনকে আর সেন্টার থাকে এই ভারতবর্ষই। যে লোকেরা ভারতবর্ষকেই নিজেদের আপন করে নিয়ে সকল কিছু ভারতবর্ষে ই রাখলো তারাই এখন পরদেশি, বিদেশি আরো কত কি। আর যারা লুটেপুটে সব নিলো তারাই আপন। সুলতানি আমল আর মুঘল আমলের কত স্থাপত্য আজও দিল্লির আলিগলিতে দৃশ্যমান। যদিও সেসব মুছে ফেলতে বিজেপি সরকার বদ্ধপরিকর। আওরঙ্গজেব রোডের নামকরণ হয়েছে এপিজে আবদুল কালাম, তাজমহলকে দাবি করা হচ্ছে তেজো মন্দির সহ আর কত কি। জানি না আর দুয়েক প্রজন্ম পরে মুসলিম শাসন যে ভারতে ৮০০ বছর ছিল সেটা হয়তো কল্পনাই করতে পারবে না। আর নাটক, সিনেমা, সিরিয়ালে যেভাবে মুসলমানদের সন্ত্রাসী, পরদেশি আর টেরোটিস্ট আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তাদের মুসলিম পরিচয় নিয়েই হয়তো ভারতবর্ষে টিকে থাকাটা কষ্টকর হয় যাবে।
যাই হোক গাড়ির হর্ণে ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে ফেরত আসলাম। দূর থেকে ইন্দিরাগান্ধী বিমান বন্দরটি দেখতে পেলাম। বিমানবন্দরের একটু আগেই আমাদের টেক্সি প্রথম দফা চেক হলো। চেকিংয়ে আমাদের সবাইকেই নামতে হলো। কতব্যরত গার্ড আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে একটু সহজ হয়ে মুখে একটা হাসি টানলেন। তাদের দেশ কেমন লাগলো সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। একটু সহজভাবেই চেকিং শেষ করে বিমানবন্দর চত্ত্বরে এসে টেক্সি ছেড়ে দিলাম।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর ও আমার প্রথম বিমানে চড়া
(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার ) লাইনধরে সবাই টিকেট হাতে নিয়ে এক একজন করে প্রবেশ করছে সবার সাথে লাইনে দাঁড়ালাম। পূর্বে কখনো বিমানে চড়া হয়নি ফলে কোন এয়ারপোর্টের ভিতরেও প্রবেশ করা হয়নি। কেমন করে ইমিগ্রেশন হয় সেই বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতাই নেই। তবে নাটক সিনেমাতে এসব দেখার কারনে খুব একটা সমস্যা হয়নি। তাছাড়া আমাদের বন্ধু সুজন সৌদি আরবে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরী করার কারনে স্বাভাবিকভাবেই ইমিগ্রেশনের যাবতীয় বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ছিল। বাকি ৫ জনই এই বিষয়ে তার সহায়তা নিয়েছি। এয়ারএশিয়া এয়ারলাইনের ফ্লাইটটি ছিল সন্ধ্যা ৭:০৫ মিনিটে। বিমান বন্দরে প্রবেশ করি ৪ঃ৩০ মিনিটের কিছু পরে। ভিতরে প্রবেশ করে এয়ারএশিয়ার অনেকগুলো কাউন্টার থেকে একটি কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ালাম। একজন একজন করে যাচ্ছে আর টিকেট চেক করে লাগেজে ট্যাগ লাগাচ্ছে। নিজের পাসপোর্ট রাখার পাসটি ছাড়া বাকি দুটি ব্যাগই লকারে দিয়ে দিলাম। আমার বন্ধুদের কাজ শেষ হয়ে গেলেও আমার কাউন্টারে একটু জটিলতা দেখা দেওয়ার ফলে আমাকে নিয়ে কাউন্টারে থাকা ভদ্রমহিলা অপর একটি কাউন্টার থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আমাকে “ছাড়পত্র “দেন। এবার আরেক দফা এবং চূড়ান্ত চেকিংয়ের পালা।
ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর

পাখির চোখে রাতের দিল্লি
কলকাতায় প্রথম রাত ও ভারতে এযাত্রায় শেষ রাত
(২৪.০১.২০২০, শুক্রবার )
রাতের কলকাতা
কলকাতায় শেষ দিন
(২৫.০১.২০২০, শনিবার ) আজকেই ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হবে। শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে দুপুরের দিকে একটি ট্রেন আছে সেটা যাবে বনগাঁ পর্যন্ত। সে ট্রেনটিই ধরার পরিকল্পনা। সকাল ৮ টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তারপর নিচে নামলাম। কলকাতার হোটেলের লিফটগুলো কেচি গেট সংশ্লিষ্ট। গত ট্যুরে শিলিগুড়িতেও এমনটি দেখেছি। আমাদের বাংলাদেশে এমন লিফটের ব্যবহার কোথাও দেখিনি। মোটামোটি মানের একটা হোটেলে নাস্তার জন্য ঢুকলাম। এখানেও বেশ কজন বাংলাদেশী দেখতে পেলাম। ছোট্ট দোকান আর কাস্টমার বেশি হওয়াতে বেশ ভিড় ছিল। একটু সময় নিয়ে হলেও পরোটা সবজি আর ডিমভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। কলকাতার মার্কেটগুলো তখনও খুলেনি। দুই একটি দোকান বিক্ষিপ্তভাবে খুলেছে কেবল। তাড়া থাকায় এর মধ্যেই টুকটাক কেনাকাটা করতে হচ্ছিলো। গতকাল রাতে ৭ হাজার রুপি হাতে পেয়েছিলাম, এর মধ্যে কিছু বকেয়া পরিশোধ করে ৪ হাজারের মতন ছিল। শপিংয়ের প্রতি বরাবরই অনীহা। তবুও কিছু একটা কিনতেই হবে, কোন পরিকল্পনা ছাড়াই অনেকগুলো চকলেট কিনে ফেললাম, শ্রী লেদারে গিয়ে ভাতিজির জন্য একটা ব্যাগ কিনলাম,
শপিং শেষে শ্রীলেদারের সামনে

কলকাতার হলুদ টেক্সি

বনগাঁ লোকাল ট্রেন

যশোর সীমান্তে পশ্চিমবাংলা অংশের সবুজ প্রকৃতি
বাংলাদেশে প্রবেশ ও আমাদের নিজ নিজ নীড়ে ফিরা
বর্ডার পার হতেই বাসের স্টাফরা মৌমাছির মতন ঘিরে ধরলো। সবাই চাচ্ছে তাদের বাসে যাই এবং সবাই ই ভাড়া কমানোর অফার দিচ্ছে। ধীরস্থির ভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিলাসবহুল সেবা গ্রীনলাইন বাসে যাত্রা করার মনোস্থির করলাম। বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে আর কোন যাত্রী আসবে না সুতরাং দরকষাকষিতে আমরাই ছিলাম সুবিধাজনক অবস্থায়। কাউন্টারে ব্যাগগুলো রেখে ফ্রেস হয়ে খাবার খেতে গেলাম। তার আগে আমি বিকাশ থেকে টাকা তুললাম। আব্বার সাথে কথা বলে নিরাপদে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের বিষয়টি জানালাম সেই সাথে সুস্থ আছি সেটাও বললাম। সকালের নাশতার পরে আর কোন খাবার খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যা বেলায় অন্য কোন খারার না খেয়ে ভাত, ডাল আর ডিমভাজি খেলাম। গরম ভাত হওয়ায় খাবারটা বেশ তৃপ্তিদায়কই হল। খাওয়া শেষে চা পান করে সবাইকে ছোট্ট একটা মিটিং করলাম। সেখানেএই সফরে যদি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে থাকে তাহলে সবাই সবাইকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানালাম। সবাই এতে বেশ স্বতস্ফুর্তভাবেই সহমত পোষণ করলো। খাবার হোটেল থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে গেলাম। ব্যাগগুলো বাসের লকারে তুলে নির্ধারিত আসনে বসলাম। ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও বাস ছেড়েছে ৭ঃ৩০ মিনিটে। রেডিওতে বিবিসির সন্ধ্যার খবর শুনার চেষ্টা করলাম কিন্তু এফএম তরঙ্গ ভালো না থাকার কারনে শুনতে পাচ্ছিলাম না। একটু সামনে আসতেই বিজিবির নিয়মিত চেকাপ। সেটা শেষ করতেই বাস আবার চলা শুরু করলো। আমি মোবাইলে ভূতএফএম ছেড়ে কানে হেডফোনগুজে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। ঘন্টাখানিক বা তারচেয়ে বেশি চলার পর যশোর শহরে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। বাস থেকে নেমে কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করলাম। আবার বাস ছাড়লো, ঘুমের চেষ্টা করলাম। হালকা ঘুম আসলো। ঘুমের মধ্যে টের পেলাম ঘাটে চলে এসেছি। খুব বেশি ভিড় না থাকায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফেরিতে উঠে ঘাট পার হয়েছি। মানিকগঞ্জ যখন পার হচ্ছিলাম তখনই পুরোপুরি চোখ খুলে বাস থেকে নামার মানুষিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাস যখন নবীনগর পার হয়ে প্রান্তিক গেইটে আসলো তখনই বাস থেকে নামলাম। লকার থেকে ব্যাগপত্র নিলাম। নামার আগে আদীব হুজুরের কথা মতন চালক ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম। আমাকে প্রান্তিকে রেখে বাসটি সোজা ঢাকার পথে চলে গেলো। রাত ৪ টা ছুঁইছুঁই, এই সময়ে কোন রিক্সা পাওয়া যাবে না। কাঁধে একটি বিশাল ব্যাগ আর দুই হাতে দুটি হাতব্যাগ নিয়ে হলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার হল একেবারে জাবির শেষ মাথায় গেরুয়া ঢালের একটু আগে। সত্যি বলতে কি এতোক্ষণ ভূত এফএম শুনাতে শরীরটা একটু ছমছম করছিলো। তবুও হাঁটতে থাকলাম। মনে মনে একটা রিক্সার প্রত্যাশা করছিলাম কিন্তু চৌরঙ্গী এসেও কোন রিক্সা না পেয়ে সেটার আশা ছেড়ে দিয়েই টান্সপোর্ট, আলবেরুনি (সম্প্রসারিত ) এর পাশ দিয়ে সালাম বরকত কামালউদ্দীন পার হয়ে বটতলায় এসে দুই একজন মানুষ দেখতে পেলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ আর আরজের মাঝখানে একটি রিক্সা দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা আর নিলাম না, হেঁটেই বাকি পথটুকু ঘামে ভিজে পারি দিয়ে আমার নীড় ৪২৬ নম্বরের সামনে আসলাম। বারন্দার বাতিটি জ্বালিয়ে দরজায় নক করলাম। সোহাগ সাহেব দরজা খোলে দেওয়ার মাধ্যমে শেষ হলো আমার ভারত সফর। সমাপ্তপ্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

আগের পর্ব পড়ুন: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (১ম পর্ব)
টয় ট্রেনে যাত্রা
(২০.০১.২০২০, সোমবার)
টয় ট্রেনে নিজ নিজ আসন নিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই তা চলতে শুরু করলো। আসলে ট্রেন হলেও এতো উপরের পাহাড়ি পথে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ১৮৬৪ সালে বৃটিশ সরকার সিমলাকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করার পরে ১৮৯৮ সালে এই রেল লাইনটির কাজ শুরু হয় এবং ১৯০৩ সালে এসে শেষ হয়। কালকা থেকে সিমলার রেল দূরত্ব হল ৯৬.৫৪ কি.মি এবং এই পথে ১৮টি স্টেশন রয়েছে।
১-০ কি.মি.কালকা
২-৬ কি.মি.টাকসাল
৩-১১ কি.মি.গাম্মান
৪-১৭কি.মি.কটি
৫-২৭ কি.মি.সন্বোয়ারা
৬-৩৩ কি.মি.ধরমপুর
৭-৩৯ কি.মি.কুমারহাট্টি
৮-৪৩ কি.মি.বারোগ
৯-৪৭ কি.মি.সোলান
১০-৫৩ কি.মি.সালোগ্রা
১১-৫৯ কি.মি.কান্দাঘাট
১২-৬৫ কি.মি.কানোহ
১৩-৭৩ কি.মি.কাথলীঘাট
১৪-৭৮ কি.মি.শঘী
১৫-৮৫ কি.মি.তারাদেবি
১৬-৯০ কি.মি.টটু(জতুগ)
১৭-৯৩ কি.মি.সামারহিল
১৮-৯৬ কি.মি.সিমলা
কালকা সিমলা রেলপথে সেতুঃ-
এই রেললাইনে ৮৬৪ টি সেতু আছে যার একটি ১৮.২৯ মিঃ লম্বা স্টিলের সেতু। বাকিগুলো প্রাচীন রোমান স্থাপনা সদৃশ অনেকটা গ্যালারীর মতন দেখতে।

ছবি: সেতু
কান্দাঘাট ও কানোহ স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ৪৯৩ নম্বর সেতুটি “আর্ক গ্যালারী” নামে পরিচিত। পাথরের তৈরি এই সেতুটি তিন স্তর বিশিষ্ট গ্যালারী মতন।
সন্বোয়ারা ও ধরনমপুরের মাঝে অবস্থিত ২২৬ নং সেতুটি পাঁচ স্তরবিশিষ্ট গ্যালারীর মত।
কালকা সিমলা রেলপথের সুরঙ্গ:-
প্রথমদিকে কালকা- সিমলা রেলওয়ে রুটে মোট ১০৭ টি সুরঙ্গ পথ ছিল। ১৯৩০সালে এই ১০৭টি সুড়ঙ্গ পথের ৪টি সুড়ঙ্গ পথ ভেঙে ফেলা হয় এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে আরো একটি (৪৬ নম্বর সুড়ঙ্গটি)ভেঙে ফেলার কারনে বর্তমানে মোট ১০২ টি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে।

ছবিঃ সুরঙ্গ
সবচেয়ে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ হল বারোগে সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গ নিয়ে স্থানীয় লোকের মধ্যে একটা কিংবদন্তী রয়েছে। এ সুড়ঙ্গের জনৈক প্রকৌশলী নিজ খননকৃত সুড়ঙ্গের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন। তিনি সুড়ঙ্গটি তৈরী করতে গিয়ে দুই দিক থেকেই খনন শুরু করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি উভয় দিক থেকে জোড়া লাগাতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার শাস্তিস্বরূপ তাকে ১ টাকা জরিমানা করা হলে তিনি এতটাই অপমানিত হন যে, ব্যর্থতার সে গ্লানি সহ্য করতে না পেরে অসম্পূর্ণ সেই সুড়ঙ্গেই আত্মহত্যা করেন। পরবর্তীতে প্রধান প্রকৌশলী এইচ. এস. হেরলিংটন এই কাজটি ১৯০০-১৯০৩ সালে শেষ করেন। কালকা-সিমলা’র টয়ট্রেন খ্যাত এই রেললাইনটি ২০০৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বৃটিশ ভারতের রাজধানী সিমলা
দুই পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে শেষ বিকেলে সিমলা শহরে এসে পৌঁছা হলো। সিমলা স্টেশনটি শহর থেকে একটু দূরে। ট্রেন থেকে নামতেই হোটেল আর কটেজের এজেন্টরা ঝাঁকে ঝাঁকে টুরিস্ট বগলদাবা করার চেষ্টা করতে লাগলো। কোন এজেন্টের মাধ্যমে হোটেল না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে আসার কারনে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। স্টেশনে হালকা ফটোশেসন করে শহরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
এই সিমলা শহররের নাম করন করা হয়েছে সনাতন ধর্মীয় শ্যামলা দেবির নামানুসারে। ১৮১৭ সালে সিমলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এখানকার আবহাওয়া এবং প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা এখানে হিমালয় রেঞ্জের বনভূমির নিকটে শহরের পত্তন করে। সিমলা মোট ১৯টি পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

ছবি:সিমলা
১৮০৬ সালে নেপালের ভিসমেন থাপা আজকের সিমলার দখল নেন। পরে ১৮১৪-১৮১৬ সালের দুই দফায় যুদ্ধের পর এর দখল চলে যায় ইংরেজদের কর্তৃত্বে। ১৮১৯ সালে লেঃ রোজ এখানে একটি কাঠের কটেজ নির্মাণ করেন। তিন বছর পর প্রথম পাকা দালান গড়ে ওঠে ১৮২২ সালে। ১৮২৫-১৮৩০ সালের দিকে বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রশাসক এবং কর্মচারীরা ছুটি কাটাতে সিমলা আসেন এবং এর আবহাওয়া-প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করেন যার প্রেক্ষিতে ১৮৩০ সালে বৃটিশ রাজ এখানে বসত গড়ার উদ্যোগ নেয়। এই লক্ষ্যে ১৮৩২ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেণ্টিক এবং তৎকালীন মহারাজা রণজিৎ সিং এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৪৪ সালে সিমলার বিখ্যাত চার্চটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
সিমলা পূর্বে দুটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল, ছোট সিমলা এবং মূল সিমলা।
১৮৫০ সালে দুই সিমলার মাঝে সেতু নির্মিত হয়ে সংযোগ স্থাপিত হয়। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিমলার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফিট এবং দৈর্ঘ্যে (পূর্ব-পশ্চিমে)নয় কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সিমলার সবচেয়ে উঁচু স্থান জাখু হিল যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ফিট উপরে যেখানে জাখু মন্দির নামে একটি মন্দির রয়েছে।
সিমলা শহরটি বর্তমানে ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। ১৮৬৪ সালে বৃটিশ আমলে সর্বপ্রথম সিমলাকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করা হয়। ১৮৭১ সাল থেকে সিমলা পাঞ্জাবের রাজধানী ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। বর্তমানে এই প্রদেশে মাত্র ২ লাখ লোক বসবাস করে যা জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় সবচেয়ে কম।

ছবি: রাতের সিমলা
ডানপাশে পাহাড় আর সেখানকার বসতি দেখতে দেখতে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পরে শহরের কাছাকাছি পৌঁছা হল। হাতের বাম পাশে হোটেল ভিক্টোরিয়া নামক হোটেলটির লোকেশন আর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে আমাদের খুবই ভালো লাগলো। আগ্রহী হয়ে কথা বলতে ম্যানেজারের রুমে গেলাম। ম্যানেজার সাহেব আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় শুনে প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন আমার হোটেলে প্রচুর বাংলাদেশি আসে। আপনারা আগে রুম দেখে আসেন যদি পছন্দ হয় তারপর দরদাম করবো। দুইজন রুম দেখে এসে নিজেদের পছন্দেন কথা জানাতেই ভদ্রলোকের সাথে দরদাম শুরু হল। তিনি আমাদের প্লান শুনে একরাত এই হোটেলে থাকা, দুইরাত মানালি হোটেলে থাকা এবং বিভিন্ন স্পটে সার্বক্ষণিক একটা মাইক্রোর সুবিধা সহ একটি প্যাকেজ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ দরদাম করার পরে জনপ্রতি ৩৫০০ রুপিতে ঠিক করা হলো। ৬ জনের দুটি রুম, গিজার ছেড়ে ভালো করে একটি গোসলের পরে খুব আরাম লাগছিলো।

ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি
সত্যি বলতে কি হোটেলের পরিচ্ছন্নতা আর বাহিরের সুন্দর প্রকৃতি এক ধরণের মানুষিক প্রশান্তি দিচ্ছিলো। সবার গোসল আর টুকটাক কাজ শেষ করতে শহর দেখতে বের হলাম। ভিক্টোরিয়া হোটেলটি মূল শহর থেকে সামান্য দূরে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি আর ভাবছি বৃটিশরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের শাসন আর শোষণের স্বার্থে কতকিছুই না করে গেছে। এই সেই সিমলা শহর যেখানে বৃটিশদের সাথে ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মিটিং হয়েছে, বৃটিশদের সাথে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মিটিং হয়েছে, পাকিস্তান-ভারতের মিটিং হয়েছে, বৃটিশরা ভারত ছাড়ার আগে সিমলায় থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথি পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। কে জানে হয়তো সেসব নথিতে বৃটিশদের শত শত কুকীর্তি আর ভন্ডামির কথা লিপিবদ্ধ ছিল। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের “ভারত স্বাধীন হল” বইটিতে সিমলায় বৃটিশদের সাথে কংগ্রেসের মিটিংয়ের বর্ননা আছে। তাছাড়া ভারতীয় বড় বড় রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য এই সিমলা শহরে আসতেন। হোটেলের ম্যানেজার কাস্মীরি ভদ্রলোক জনাব মইন সাহেবই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর, কেউ থুতু ফেলছে না, বাহিরে ধূমপান করছে না মানে ধূমপান করা নিষিদ্ধ। পশ্চিমা কোন শহর আমি দেখিনি এখানে কেমন যেন একটা পশ্চিমা শহরের অনুভূতি আসলো। যদিও সেসব দেশে কখনোই যাওয়া হয়নি। একে একে বিখ্যাত গির্জা, ইন্দিরাগান্ধীর
ভাস্কর্য, জিরোপয়েন্ট, সেনানিবাস সহ গোটা শহরটিই দেখা হলো। জিরো পয়েন্ট থেকেই বৃহৎ হনুমানের ভাস্কর্যটি দেখা যায়। বৃটিশদের সময় সিমলাই ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের সেনা সদর দফতর।
রাতের খাবারের জন্য মইন সাহেব খাবারের একটা দোকানে নিয়ে গেলেন। নান রুটি আর মুরগির কারি করা একটা খাবার, নামটি ভুলে গেলেও খাবারের স্বাদটি এখনোও মুখে লেগে আছে। ভারতে প্রবেশের পরে এই প্রথম কোন খাবার খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হলো। খাবারের পর সিমলা জিরো পয়েন্টে মইন সাহেবর গল্প শোনলাম। কাস্মীরে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন এবং তাদের স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের কথাও বললেন। মাইনাস তাপমাত্রায় বাহিরে প্রচন্ড বাতাস থাকার কারনে খুব ঠাণ্ডা লাগছিলো। কিছু সময় পরে ঢালু বেয়ে নামতে নামতে হোটেলে ফিরে আসলাম। কয়েক দিনের ক্লান্তি সেই সাথে ঘুমানোর সুন্দর পরিবেশ আর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। একটু পরেই জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টির মত তুষারপাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে থোকায় থোকায় তুলা পড়ছে। জানালার পাশে আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছি। সোডিয়াম বাতির আলোয় তুষারপাত আরো সুন্দর লাগছিলো। একটু পরে আমরা হোটেলের লবিতে গিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা আর শীতকে উপেক্ষা করেই ঝটপট বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আসলাম। রাত প্রায় ১২ টার পরে আমরা বিছানায় গেলাম।
সিমলা থেকে মানালী
(২১.০১.২০২০, মঙ্গলবার)
কয়েকদিনের ভ্রমন আর ক্লান্তির কারনে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরিই হল। ঘুম থেকে উঠেই দেখি পুব দিকে সারা পাহাড়ে সাদা তুষারে ছেয়ে আছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য।
আমরা বাংলাদেশীরা তুষার, তুষারপাত এসব সিনেমা আর গল্পই পড়েছি। বাস্তবিক আমাদের দেখার সুযোগ কমই। এমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখে হা হয়ে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অপরূপ দৃশ্য দেখলেও খুব দ্রুত মানালির দিকে রওয়ানা করার তাড়া ছিল। তাই ফ্রেশ হয়ে দ্রুতই হোটেলের চেক আউট করা হলো। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির ড্রাইভার রাজেশ সাহেবের মাইক্রোতে উঠে বসলাম। সিমলা শহরের পাহাড়কে বামপাশে রেখে মাইক্রো মানালি অভিমুখে যাত্রা করলো।
সিমলা থেকে মানালির দূরত্ব ২৪৫ কি.মি.। কিন্তু পাহাড়ি পথ আর বিভিন্ন স্পট দেখে দেখে মানালি পৌঁছতে প্রায় ৮-১০ ঘন্টা লেগে যায়। সেজন্য ই ড্রাইভার সাহেব আমাদের আরো আগে রওনা করা দরকার ছিল বলে মত প্রকাশ করলেন। সিমলা শহরের একটু বাহিরে এসে একটা ধাবায়(খাবারের দোকান)নাশতা খাওয়ার জন্য বিরতি নেওয়া হলো। গাড়ি থেকে নামতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার একটা তীর আমাদের শরীরকে বিদ্ধ করলো। অথচ সবাই ভারি ভারি একাধিক শীতবস্ত্র পরিহিত। কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে বসে ম্যানু থেকে খাবারের অর্ডার করা হলো। সত্যি বলতে কি খাবার আর দামের সমন্বয় হচ্ছিলো না, আর ভারতে এসে খাবার নিয়ে আপনি কখনোই সন্তুষ্ট হবেন না। প্রায় ২০ মিনিট পরে খাবার আসলো, খেতে আরো ২০ মিনিট। বিল মিটিয়ে পুনরায় গাড়িতে চড়ে যাত্রা করতে করতে একঘন্টা শেষ। ক্ষাণিক চলতেই বুঝতে পারলাম পাহাড়ি এই রাস্তাতেই খাবার না খেয়েই যাত্রা করা উচিত ছিল কিংবা খাবার খেয়ে বেশ কিছুটা সময় বিশ্রামের পর যাত্রা করা দরকার ছিল। মোট মোচড় দিয়ে সবারই কমবেশি বমির ভাব হচ্ছিলো।
বলতে না বলতেই একজনের বমি হয়ে গেলো। আর ভ্রমনে এই বমির বিষয়টা কি পরিমাণ বিরক্তিকর সেটা ভুক্তভোগি না হলে বুঝতে পারা যায় না। আর বমিটা একটা সংক্রামক ব্যধি। একজন শুরু কররে অন্যজন সংক্রমিত হবেই। যাই হোক গাড়ি থামিয়ে তাকে ঠিক করে পুনরায় যাত্রা শুরু হলো। কিছুদূর যেতেই আরেকজন বমি করলো । আবার গাড়ি থামানো হল। পাশে একটা ধমীর্য় স্থাপনা ছিল সেখানকার কল থেকে পানি নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গাড়ি পরিষ্কার করে পুনরায় যাত্রা শুরু হল। ড্রাইভার সাহেব মনে হয় এসবে অভ্যস্ত। উনি বেশ পেশাদারিত্বের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছিলেন। আমি তখন মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম, কোনদিন এমনটি হয়নি যদি আজ হয়ে যায় তাহলে তো এতোদিনের রেকর্ড ভেস্তে যাবে। শেষ পর্যন্ত রেকর্ড অক্ষুন্নই থেকেছে। তবে পাহড়ি রাস্তায় এমনটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। হালকা হালকা বিরতিতে গাড়ি চলছিলো। একটু পরে রাস্তার পাশের দোকান থেকে লেবুর শরবত, কমলা এসব খাওয়া ও ওয়াশরুম থেকে আসার পর মোটামোটি সবারই মধ্যেই একটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছিলো। এর পরে আর কেউ বমি করেনি। মোটামোটি সহনীয় গতিতেই আমাদের গাড়ি চলছিলো। গাড়িতে পানজাবি সঙ্গীত আর বাহিরে প্রকৃতির সৌন্দর্য।
আমরা চলছি আর প্রকৃতি দেখছি, কতশত অজানা জনপদ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়িটি মানালির দিকে ছুটছে। পাহাড়ি রাস্তা আর পাশে নদী থাকায় ভ্রমনটা বেশ চিত্তাকর্ষক ই লাগছিলো।
সিমলা থেকে মানালি যাবার পথে বেশ কয়েকটি বড় ছোট সিমেন্টের কারখানা পরে। ডাললা ঘাট নামক স্থানে ভারতের বিখ্যাত আম্বুজা সিমেন্ট কারখানা অবস্থিত। কতশত লড়ি আর ট্রাকের সারি দেখলাম। এসব বাহনে করেই আম্বুজা সিমেন্ট সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে যাবে। আরেকটু সামনে বারোমানা নামক স্থানে acc নামক আরেকটি সিমেন্ট কারখানা। সেখানেও সারিবদ্ধ কতশত ট্রাক আর লরি। আসলে সারা ভারতবর্ষে এতো ভৌগলিক, কৃষ্টি আর স্বাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অখণ্ড থাকার অনেকগুলো কারনের মধ্যে ব্যবসায়িক দিকটিও অন্যতম একটি কারন। কেননা এতো বিশাল বাজার সারা ইউরোপ মিলিয়েও নেই। তাই ভারতকে অখন্ড রাখার পিছনে ব্যবসায়ীদের অর্থ খরচেরও একটা বিষয় রয়েছে। কোথাও পাহাড়ি রাস্তা আর কোথাওবা সমতল কিন্তু সর্বত্রই প্রকৃতি এতো সুন্দর করে সাজানো আর গুজানো কেবল তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। পাহাড়ের পাশে একটি পাথুরে নদী রয়েছে স্থানীয় ভাষায় এটার নাম শতেন্দ্রু নদী। পানি অল্প হলেও স্রোত রয়েছে অন্যান্য পাহাড়ি নদীর মতনই। আরেকটু সামনে গিয়ে সুন্দরনগর। এই সুন্দরনগরেই একটি লেক রয়েছে, মানালি যাওয়ার পথে অনেকেই এখানে একটু থামেন। আমরাও সেটা মিস করেনি। ওয়াচ টাওয়ার থেকে লেকটিকে আরো অপরূপ লাগছিলো। সত্যি বলতে কি, সিমলা থেকে মানালির সবটুকু পথই সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যে ভরপুর। দরকার শুধু দেখার মতন চোখ আর অনুধাবন করার মন, তাহলেই হয়তো সুন্দরের নিত্য নতুন শাখার সাথে পরিচয় ঘটে যাবে। সুন্দরনগর থেকে ২৫ কি.মি. পরেই হল মান্ডি শহর। এই মান্ডি থেকেই বিখ্যাত বিয়াস নদীর শুরু। এই বিয়াস নদী এখান থেকে মানালি পর্যন্ত সঙ্গ দিবে। মান্ডি শহর থেকে একটু সামনে গেলেই পান্দ ডেম। এই পান্দ ডেমের মাধ্যমেই ভারত সরকার বিয়াস নদীর জলকে নিয়ন্ত্রণ করে জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এই ডেমের একটু সামনে একটা চায়ের দোকানে গাড়ি রেখে চা পান করলাম। কিছুক্ষণ বসে থেকে পান্দডেম আর বিয়াস নদীর নীলাভ পানির সৌন্দর্য দেখলাম।

ছবি: বিয়াস নদী
অন্যান্য পাহাড়ির অঞ্চলের মতন এখনকার অদিবাসীরাও সম্ভবত নারী প্রধান। দোকানদার ও তার সহকারী উভয়ই নারী। যারা নারীকে ঘরের বাহিরে এসে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করাকেই আধুনিকতার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেন তাদের দৃষ্টিতে হয়তো সকল পাহাড়ীয়রাই আধুনিক। মান্ডির পরেই শুরু হয় কুল্লু। কুল্লু থেকে মানালি এই অংশটুকু খুবই ভয়ংকর আবার সেই সাথে সুন্দরও বটে। পাহাড়ের নিচ দিযে খাঁজ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বর্ষার সময় প্রায়শই এই স্থানটিতে পাহাড় ধস নামে ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড় ধস বন্ধ করতে ভারত সরকারের চলমান ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ চোখে পরলো। ভারতীয় সরকার এই পর্যটন খাতে ব্যাপক অর্থ খরচ করছে। ওদের পরিকল্পনাও আছে সেই সাথে সেটার কম দুর্নীতিতে বাস্তবায়ন ও আছে। আমাদের হয় পরিকল্পনা আছে বাস্তবায়ন নেই, অথবা বাস্তবায়ন আছে সঠিক পরিকল্পনা নেই, তাই তো ফ্লাওভার করার পরে মনে পড়ে প্ল্যানে ভুল, রেললাইন বসানোর পরে মনে পরে এটা ভুল হয়েছে খুলে আবার নতুন করে বসাতে হবে, আর দুর্নীতির কথা আর নাইবা বললাম। চীনে এক কি.মি. রাস্তা করতে সেখানে ১০ টাকা খরচ হয় আমাদের দেশে সেটা চারগুনে ৪০ টাকা খরচ লাগে। এই জন্য ই হয়তো স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপ ছিল সারা পৃথিবী পায় সম্পদের খনি আর আমি পাই চোরের খনি। একটু স্লো গতিতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। সামনেই একটা টানেল দেখতে পেলাম একেবারে পাহাড়ের মধ্যেখান দিয়ে। ২.৮ কিমি দৈর্ঘ্যের এই টানেলটির নাম হল উট টানেল। টানেল পার হওয়ার পরে বিয়াস নদীর পাগলকরা সৌন্দর্য দেখে আমি একেবারেই মোহিত হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি গত কয়েকদিনের ক্লান্তি, আজকের সেই সকাল থেকে টানা জার্নি সবকিছুই যেন নিমেষে ই হাওয়া হয়ে গেল। এতো বিশাল ভারতবর্ষের পরতে পরতে সৌন্দর্যের এতো খনি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের মাঝখানে নীলাভ স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের উপরে ছোট বড় গাছের সাড়ি। একেবারে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। জায়গাটার প্রতি আমার এমন মনোভাবের জন্যই হয়তো সেটাকে আরো ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া গেলো। সামনের একটা বেইলী ব্রিজে হালকা যানজট থাকায় গাড়ি থেমে গেলো, নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তখনই গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেলাম। ঝটপট কয়েকটি ফটো তুলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। সত্যি ই ভারতবর্ষে যে প্রচুর পর্যটক আসে সেটার কারনও আছে। ওদের সৌন্দর্য আছে সেটা রক্ষা করার সরকারি বেসরকারী চেষ্টাও আছে সেই সাথে ওদের মধ্যে সচেতনতাও আছে। আমাদের দেশে না আছে সরকারি প্রচেষ্টা না আছে সচেতনা। তাই তো প্রায়ই দেখা যায় চন্দনাথ পাহাড়ের উপরের বিরিয়ানির প্যাকেট, গুলিয়াখালি বিচে শত শত পলিথিন আর প্যাকেট, টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ভাসমান সারি সারি এলকোহলের বোতল। বাংলাদেশের পর্যটকগন ফেসবুকে ছবির দেওয়ার টুরিস্ট। হৃদয়ে ধারণ করার টুরিস্ট নয়। সৌন্দর্য বোধ আমাদের অন্তরেই হয়তো নেই। তবে খুব ধীরে হলেও একটা পরিবর্তন আসছে। সেটাই আশাব্যঞ্জক।
বিয়াস নদীর অপর পাড়ের পাহাড়টি হিমালয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চাল। আর কিছুদূর যেতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। রাস্তা অনেক চওড়া আর মসৃণ হওয়াতে এই অন্ধকারেও গাড়ি চালাতে কোন সমস্যা ই হচ্ছিলো না। একটু পরেই হাতের বাম দিকে পাহাড়ের উপরে কুল্লু শহরটি দেখতে পেলাম। পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর আর সেসব ঘরের আলোকে দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার জোনাক জ্বলার মতন মনে হচ্ছিলো। কুল্লু শহরে থেকে মানালি যেতে ৪০-৫৫ মিনিটের মতন লাগে। শপিংয়ের জন্য কুল্লু শহরের এক প্রান্তে থাকা একটা শালের দোকানের কাছে বিরতি দেওয়া হল। সন্ধ্যার সাথে সাথেই মনে হয় এখানকার দোকানপাট সব বন্ধ করে ফেলা হয়, আমরা যেতেই দেখলাম দোকান বন্ধের আয়োজন শুরু হয়েছে তবে আমাদের কারনেই কিছুক্ষণ দেরি করলো। আমাদের সফরসঙ্গীরা খুব শপিং করলো, সবাই ই বাসায় নিজ নিজ আপনজন আর প্রিয়জনদের সাথে অডিও ভিডিও কলে কথা বলে কাপড় চোপড় পছন্দ করছিলো, আমি ঘুরে ঘুরে সেসব দেখছিলাম। সত্যি বলতে কি শপিং এর প্রতি আমার কখনোই আকর্ষণ ছিলো না আর এটা আমার ভালোও লাগে না। আমার পরিচিত জনেরা বিয়ের পরে আমার দুরাবস্থার কথা ভেবে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মেয়েরা নাকি শপিংয়ে খুব আগ্রহী থাকেন, কে জানে হয়তো তখন আমিও আগ্রহী হবো কিংবা আমার বউও আমারই মতন শপিংয়ে অনাগ্রহী হবে। যাই হোক সবার শপিং দেখে মায়ের কথা মনে পরে গেলো, মা থাকতে কোনদিনও মায়ের জন্য কিছু কিনে নিযে যাইনি আর এখন তো মা নেই ই!!!!
বেশ সুন্দর মাফলার দেখে সেটা কিনতে চেয়েছিলাম কিন্তু সত্যি বলতে কি সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করতে পারিনি। আমার কিছুটা বিমর্ষ চেহেরা দেখেই মাসুদ মায়ের স্মরণের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। মাসুদ আমাকে সেটি বলেও দিয়েছিল। আসলে ভালোবাসার মানুষজনেরা হয়তো এমনি করেই হৃদয়ের কথাটি টের পেয়ে যায়।
সেলসম্যান মেয়েটির সাথে আমাদের আইভি দেখলাম খুব খাতির জমিয়ে ফেলেছে আসলে কে কাকে পরাস্ত করলো সেটা না বুঝতে পারলেও উভয়ের হাসি দেখে বুঝলাম উভয় পক্ষই খুশি। হিমেল দেখলাম হবু বউয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে জামা পছন্দ করলো। এলিন, সুজনও বাসায় কার কার সাথে যেন কথা বলছিলো। আমাকে ছাড়া বাকি পাঁচজনই শপিং করলো। শপিং শেষে এখানে চা আর হালকা নাশতা করে পুনরায় গাড়িতে চড়ে মানালির পথ ধরলাম। এখন আর বড়জোর একঘন্টা, তারপরেই হাজির হবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানালি শহরে। গাড়ি চলছে আর আমরাও শেষ সময়ে একেবারে অধৈর্য হয়ে পরছিলাম। মানালির কাছাকাছি আসতেই আকাশ থেকে তুলার পেজের মতন বরফ পড়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ড্রাইভার সাহেব একটু চিন্তিত হয়ে দ্রুত হোটেলে পৌঁছতে চাচ্ছিলেন। যদিও মল রোডে রাতের খাবার খেয়ে তারপর হোটেলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ওনার কথা শুনে বুঝলাম আমাদের দ্রুতই হোটেলে যাওয়া উচিত। কারন তুষারপাত বৃদ্ধি পেলে গাড়ি যেকোন সময়ই রাস্তায় আটকে যেতে পারে। একথা শুনে একটু শঙ্কিত ই হলাম। বিদেশি বহু মুভিতে রাস্তায় বরফের কারনে সাড়ি সাড়ি গাড়িকে আটক অবস্থায় দেখেছি। একটু পর সব শঙ্কা কাটিয়ে ড্রাইভার সাহেব হোটেলে সামনেই নামিয়ে দিলেন। হোটেলে উঠে দুটি রুমে নিজ নিজ ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হলাম। যখন মানালি শহরে ঢুকছিলাম তখনকার তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪-৫। রুমে আসার পরে সেটা মাইনাস ৭-৮ দেখতে পেলাম।
এই মানালি শহরটি ভারতের উত্তর হিমাচল প্রদেশের কুল্লু জেলার বিয়াস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনীর মনুর নাম অনুসারে মানালী নামকরণ করা হয়েছে। মানালি শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০৫০মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। মানালিতে আসা যাওয়ার রাস্তাটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মানালির মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার হাজার। এদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জন পুরুষ আর ৩৫ জন মহিলা। সাক্ষরতার হার শতকরা ৭৪.৫।
হালকা ফ্রেশ হয়ে হোটেলের নিচে খাবার খেতে যাই। দাম একটু বেশি হলেও এই শীতে গরম খাবার খেতে পারাটা কম সৌভাগ্যের বিষয় না। একটা বিষয়ে বুঝতে পারলাম ভারতে এসে ভাত খাওয়াটা অনেক বেশি বিলাসিতা। পাহাড়ি মানালিতেও সেটার ব্যত্যয় হয়নি। পকেট নয় পেটের দিকে তাকিয়েই মোটামুটি পেট ভরেই খাবার খেলে দ্রুত রুমে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।
সোলাংভ্যালিতে যাত্রা
(২২.০১.২০২০, বুধবার)
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রুম থেকে বের হয়ে লবিতে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা সাদা বরফের স্তূপ দেখতে পেলাম। সিমলায় দেখা হয়েছিল তুলোর মতন হালকা রকমের বরফ আর মানালি এসে দেখা হচ্ছে স্তূপ আকৃতির সর্বত্র জুড়ে থাকা বরফ।

ছবি: সাদা বরফের স্তূপ
অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগলাম, আমরাতো মুষলধারে বৃষ্টি, ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টি এসবের সাথে পরিচিত কিন্তু হালকা তুষারপাত, ভারি তুষারপাত এসবের সাথে একেবারেই অপরিচিত।

ছবি: বরফাবৃত পাহাড়
সেইসাথে এসব তুষারপাত আর বরফাবৃত পাহাড় পর্বতও আমাদের কাছে নতুন। স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগাটাও অন্যরকম ছিল। শুদ্র আর সফেদ বরফাবৃত পাহাড়ের উপর যখন সূর্যের আলো পড়ছিল তখন এক অন্যরকম সৌন্দর্যের অবতাড়না হচ্ছিলো। বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকলাম। আশপাশের বাড়িঘরেও দেখলাম লোকজন বিছানাপত্র ছাদে গরম করতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। এখনকার গন্তব্য হলো সোলাংভ্যালি। সোলাংভ্যালিতে যেতে হলে আলাদা বরফের পোষাক আর গাম বুট ভাড়া করতে হয়। সকালের নাশতা করে একটা দোকান থেকে নিজ নিজ পছন্দ আর মাপ অনুয়ায়ী গামবুট ও বরফের বিশেষ পোষাক পরিধান করি। এটা অনেকটা রেইনকোটের মতন পরিধেয় জামার উপরেই পরিধান করতে হয়। এই পোষাক আর বুট পরার পরে নিজেদের নভোচারি নভোচারি লাগছিলো। এই পিচ্ছিল শক্ত পাহাড়ি রাস্তার কিছুটা পথ গিয়েই মাইক্রো থেমে যায়। এই উঁচু নিচু বরফাবৃতির পাহাড়ি রাস্তায় মাইক্রো নিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
ফলে সোলাংভ্যালি যাওয়ার জন্য এই রাস্তার উপযোগী বিশেষ শক্তিসম্পন্ন গাড়ি ভাড়া করতে হলো। সেটা নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম সোলাংভ্যালির উদ্দেশ্যে। সোলাংভ্যালির এই যাত্রায় নতুন করে অবাক হওয়ার পালা শুরু হল। দুই পাশে পাহাড় আর পাহাড় সেসব বরফ আর বরফ। রাস্তার পাশে বরফ, উপরে বরফ, নিচে বরফ, বাড়ির ছাদে বরফ, উঠোনে বরফ সর্বত্র কেবল বরফ আর বরফ। এই বরফকেই মাড়িয়ে গাড়ি চলছে।
আবাক আর মুগ্ধ হয়ে দুপাশে তাকিয়ে দেখছি আর পুনরায় মুগ্ধ আর অবাক হচ্ছি। প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পর আমরা সোলংভ্যালিতে পৌঁছলাম। এখানে প্রচুর পর্যটকের সমাগম দেখতে পেলাম।
সোলংভ্যালিতে নেমে অনুভূতিতে যতটুকু আবাক আর আশ্চর্য হওয়ার সামর্থ্য বাকি ছিল তার সবটুকুই শেষ করে ফেললাম। ডানে বরফ, বামে বরফ, উপরে বরফ, নিচে বরফ, সামনে বরফ, পিছনে বরফ সর্বত্র শুধু বরফ আর বরফ। বাচ্চাদের মতন লাফালাফি করলাম, দাপাদাপি করলাম, বরফ দিয়ে বরফকেলি করলাম, ঘর বানালাম, সেই ঘরেন মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকলাম, ফটো তোললাম আর কত কি করলাম!!!
সব কিছুতেই আনন্দ, সকল কিছুতেই উচ্ছ্বাস। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম এতো সুন্দর স্থানে আসার তাওফীক দেওয়ার জন্য।
সোলাংভ্যালিতে প্যারাগ্লাইডিং সহ বিভিন্ন ধরণের রাইডিং রয়েছে। যার যার ইচ্ছে আর সামর্থ্য অনুযায়ী সেসব রাইডে চড়ে থাকে। নদীর উপর দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে মোটা দড়ির মাধ্যমে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার রাইডটি পছন্দ করা হলো। সত্যি বলতে কি একটু ভয় ভয় করছিল। তাই দুইজনের পরে আমি শুরু করেছিলাম। যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপত্তা ছিল তবুও যখন শুরু করা হলো তখন কেমন যেন একটা ভয়ের শিহরণ টের পাচ্ছিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করতর লাগলাম। নিচে নদী, বরফের মধ্যখান দিয়ে স্রোতাধারার নদী, রশিতে ঝুলে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছি, চারদিকে বরফ আর বরফ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো।
নিজের ফোনটি বের করে ভিডিও করছিলাম কিন্তু অনভ্যস্ত হাতে ভিডিওর মান খুব একটা ভালো হয়নি। তবুও তো নিজের স্মৃতি, নিজের কাছেই থাকবে। এসব রাইড শেষ করে আরো কিছুক্ষণ সোলংভ্যালিতে অবস্থান করার পর কেমন করে যে প্রায় ঘন্টা তিনেক অতিবাহিত হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। এবার ফেরার পালা। গাড়ির পার্কিং করা স্থানের দিকে রওয়ানা করলাম। এখানে একটা বিষয় বলে রাখি কোথাও গেলে দিক ভুলে যাওয়া আমার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। এখানেও সেটা ঘটলো, হুট করেই আমি বাকি চারজনকে এই ভীড়ে মধ্যে হারিয়ে ফেলি। হটাত করেই দেখি আমি আর এলিন ছাড়া আর কেউ নেই। এই ভিড়ের মধ্যে দলছুট হয়ে কিছুটা অসহায় অনুভব করলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে গাড়ি যে দিকে ছিল তার বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর বরফে ঢাকা চড়াই বেয়ে অনেকটা উপরে উঠার পরে আস্তে আস্তে লোকজন আর গাড়ির সংখ্যা কমতে দেখে মনে খটকা লাগলো। মনে মনে ভাবলাম যেখানে গাড়ি পার্কিং করে এসছিলাম সেখানে তো প্রচুর গাড়ি আর মানুষ ছিল। সেখান থেকে আবার নিচে নামতে লাগলাম, বরফের পিচ্ছিল নিচু রাস্তায় যেকোন মুহূর্তেই স্লিপ কাটতে পারতাম আর এই পাথুরে শক্ত বরফে স্লিপ কেটে পড়া মানে কোমর নিয়ে সোজা হাসপাতালে হাজির হওয়ার সামিল। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে খোঁজা খুঁজির প্রায় ৪৫ মিনিট পরে হারানো গাড়ি আর ভ্রমনসাথীদের খোঁজে পাওয়া গেলো। তাদের অগ্নিশর্ম চেহারা আর তিরস্কারের বানে জর্জরিত হয়ে যতটানা খারাপ লেগেছে তারচেয়ে বেশি আমার ভুলের কারনে তাদেরকে কষ্টে ফেলার বিষয়টি আরো বেশি মর্মপীড়ার কারন হয়েছে। গাড়িতে চড়তেই গাড়ি ফিরতি পথে চলা শুরু করলো। যে পথে সোলাংভ্যালি গিয়েছি সে পথেই ফিরছি। তখন যে দৃশ্য ছিল এখনও তাই। মুগ্ধ নয়নেই দেখছিলাম চারপাশটা। এই বরফের মধ্যেও লোকবসতি আছে। ট্যুরিজমটাই এদের আয়ের অন্যতম মাধ্যম মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকেও হয়তো কেউ কেউ দিল্লি সহ বড় বড় শহরে পড়াশোনা বা অন্য কোন কাজে যায়। ভারতবর্ষের এতো বিশালতা আর এতো এতো বৈচিত্র্য এটা অনায়েসেই বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র হতে পারতো। লোকালয় দেখে মনে হল বরফের সময় কষ্টটা একটু বেশি হলেও বরফ কমের সময় মোটামুটি স্বাছন্দ্যেই এরা চলাফেরা করতে পারে। তাছাড়া স্থানীয় অধিবাসীরা এমন জীবনেই অভ্যস্ত। ৪৫ মিনিট চলার পরে ভাড়া করা গাড়ি থেকে নেমে মাইক্রোতে চড়ে কাপড় নেওয়া দেকানটিতে আসলাম। নিজ নিজ বরফের পোাষাক আর জুতো জমা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে মানালি শহরের দিকে রওয়ানা করলাম। দুপুরের খাবারের জন্য মুসলিম হোটেলের খোঁজে গুগল করতেই একটা হোটেলের নাম পেলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত থাকায় দ্রুতই দোকানটিতে যেতে চাইলাম কিন্তু ঠিকানা বুঝতে একটু অসুবিধা হওয়ায় বেশ কিছুটা সময় পার করেই দোকানটি পেলাম। ম্যানুকার্ড দেখে মুরগির বিরিয়ানীকেই সবচেয়ে ভালো বিকল্প মনে হওযায় সেটাই অর্ডার কররাম। শীতের দেশ হওয়াতে একটু সময় ই লাগলে খাবার রেডি করে নিয়ে আসতে, কারন অর্ডার করার পরেই রান্না করে। সে সময়টিতে আমাদেরকে দেওয়া গরম পানি পান করে গল্পগুজব করছিলাম। দোকানটিতে খেতে আসা অধিকাংশ গ্রাহকই ছিলেন মুসলিম। একটা পরিবারকে দেখলাম দোকানে বসেই টিকটক ভিডিও করছে, বুঝতে পারলাম ভারতে টিকটক ভিডিওর ব্যাপক প্রচার আর প্রসার। আমাদের ফেবুর মতনই ভারতের টিকটকের ব্যবহার। খাবার আসলো খেয়ে বিল দিয়ে মার্কেটে গেলাম। মানালি শীত প্রধান অঞ্চল হওয়ায় শীতের জিনিসপত্র ই বেশি ছিল। আব্বার জন্য একটা কটি কিনলাম। তারপর গেলাম দিল্লির বাসের টিকিট কাটার জন্য। কারন আগামীকাল আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে হবে। অনেকগুলো বাস কাউন্টার ঘুরে শেষ পর্যন্ত হিমালয়ান বাস সার্ভিসের টিকেট কাটা হলো। আমাদের বাজেটের তুলনায় একটু বেশি খরচ হয়ে যাওয়ায় পকেটের অবস্থা একটু মন্দই ছিল। আমাদেরকে সফর সঙ্গি বন্ধু সুজনের কাজিন কলকাতায় থাকায় ওর মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ থেকে বিকাশের মাধ্যমে কলকাতায় টাকা আনানো হয়েছে।
( এই টোটাল প্রক্রিয়াটাই অবৈধ, পরে দিল্লি এবং কলকাতায় এসে বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে টাকা নেওয়ার প্রচুর দোকান দেখতে পেয়েছি। বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ থেকে প্রচুর প্রচুর লোকজনের আসা যাওয়ার কারনেই তাদের সেবা দিতে এসব প্রতিষ্ঠান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে)। সে টাকাটা কলকাতা থেকে মানালি আনানোর কোন ব্যবস্থাই পেলাম না। বাস কাউন্টারের লোকেরা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন(ব্যাংকের) সাথে যোগাযোগ করতে বললেন কিন্তু সেখানে গিযেও টাকা আনানোর কোন ব্যবস্থা পেলাম না। আমি একটু আবাকই হলাম, ভারতবর্ষে কি আমাদের রকেট, বিকাশ এসবের মত কোন মোবাইল ব্যকিং ব্যবস্থা নেই? অনেক রাজ্য আর কেন্দ্রের দ্বিস্তর বিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে হয়তো করা হয়নি কিংবা হয়তো অন্য কোন সহজ ব্যবস্থা আছে যেটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। টিকেট কেটে একটা মাদ্রাজী দোকান থেকে রাতের খাবার নেওয়া হলো। মুরগির কারি আর নান রুটি পার্সেল করে মানালি শহরের কাজ শেষ করে ড্রাইভারকে নিয়ে হোটেলে চলে আসি। আজই মানালিতে আমাদের শেষ রাত। বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। মধ্য রাতের পরে বিছানায় যাওয়া হলো।
পরের পর্ব: ভারত ভ্রমণঃ মানালির ডায়েরি (৩য় পর্ব)
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।

যাত্রা হলো শুরু
(১৭.০১.২০২০,শুক্রবার) অনেক জল্পনা কল্পনা আর পরিকল্পনার পরে ১৭ ই জানুয়ারি শুক্রবার আমরা ৬ জন ঢাকা থেকে রওয়ানা করি।শুরু থেকে ৭ জনের পরিকল্পনা থাকলেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং সব সময়ের সফরসঙ্গী মাহবুব শেষ মুহূর্তে অফিসের ছুটির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৬ জনেই ঢাকার কমলাপুর থেকে রওয়ানা করি। আমাদের নির্ধারিত ট্রেন বেনাপোল এক্সপ্রেস রাত ১১ঃ১৫ মিনিটে আসার কথা থাকলেও প্লাটফর্মে আসে ১২ঃ০০ টায় আর কমলাপুর থেকে ছাড়ে ১২ঃ৩০ মিনিটে।ট্রেনটির পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা দেখে নতুনই মনে হয়েছে।বহুদিন পরে বন্ধুদের একত্র হলে যা হয় আর কি আড্ডা আর গল্পগুজবে রাতটি কাটিয়ে দেওয়া হয়।তবে হালকা হালকা সবাইই একটু আধটু ঘুমের চেষ্টা করেছে। সকাল ৯ টায় বেনাপোলে পৌঁছার কথা থাকলেও দেরি করে ছাড়াতে সকাল ১০ টায় বেনাপোলে পৌঁছে। ট্রেন থেকে নামতেই একজন সহায়তাকারী এগিয়ে আসলেন।সবাই তাদেরকে দালাল হিসেবে আখ্যা দিলেও আমি তাদেরকে সহায়তাকারী হিসেবেই আখ্যা দিবো।সিস্টেমের পরিবর্তন না করে কেবল তাদেরকে মন্দ বলাটাই কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।উনি নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন,পাসপোর্ট জমা নিলেন আমরা অফিসে ব্যাগ রেখেই নাশতা করলাম পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষ করে ব্যাগ পাসপোর্ট নিয়ে পোর্টের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ভারতবর্ষে ভ্রমনের সূচনা
(১৮.০১.২০২০,শনিবার) আমাদের এখনকার গন্তব্য যেহেতু হাওড়া সে হিসেবে বনগাঁ হয়ে হাওড়া আসাটাই স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু আমরা একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে নিউমার্কেটগামী বাসে চড়ে বসি,যদিও আমাদের সে প্রশান্তির দেখা আমরা আর পাইনি।পরে যদিও এটা নিয়ে আফসোস করেছি কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে।যশোর রোড ধরে কলকাতা আসার পথে দু পাশের বাড়িঘর দেখে মনে হয়নি সীমান্ত পেরিয়ে ভিনদেশে আছি।অনেকটা বাংলাদেশের গ্রামের মতনই তবে উন্নয়নটা ওখানে তুলনামূলক কমই হয়েছে বলা চলে।
হাওড়ায় এসে হা হয়ে যাওয়া
(১৮.০১.২০২০,শনিবার) হাওড়া আর হাওড়া ব্রিজ সস্পর্কে কলকাতার সাহিত্যিকদের বইয়ে কত পড়েছি কিন্তু কখনো তো আর দেখিনি।

ভারতবর্ষের ট্রেনে প্রথম চড়া
ভারতের ট্রেন সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবশ্যই অবগত আছেন যে,সপ্তাহ দুই বা তিনেক আগে টিকেট কাটা ছাড়া নিজের পছন্দ মতন ট্রেন বা সিট কোনটাই পাওয়া একেবারেই অসম্ভব একটা বিষয়। আমরা বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরুর ৪৮ ঘন্টা আগে টিকেট করি ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পছন্দসই টিকেট করা সম্ভব হয়নি।আমাদের রুট আর সময় বিবেচনা করে দিল্লিগামী ইউবা এক্সপ্রেস টি সবচেয়ে উপযোগী মনে হওয়ায় আমরা সেটিতেই টিকেট কনফার্ম করেছিলাম।
দিল্লিতে পৌঁছা
(১৯.০১.২০২০,রবিবার) দিল্লিতে যখন নামলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়ে গিয়েছে।দীর্ঘ সময় ট্রেন যাত্রা আর না ঘুমাতে পারায় বেশ কাহিলই লাগছিলো।মাত্র ৮° তাপমাত্রার দিল্লির শীতটা বেশ হাড় কাঁপানোই মনে হচ্ছিলো। আনন্দ বিহার স্টেশনটাকে বেশ বড় আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হলো।ভারতের অধিকাংশ মানুষ যে রেল পথেই চলাচল করে সেটা ওদের স্টেশন আর সুযোগ সুবিধা দেখলেই বুঝা যায়।স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা পরিকল্পনা মাফিক পাহাড়গঞ্জের দিকে যাত্রা করলাম।

ছবিঃ ইন্ডিয়া গেইট

ছবিঃ স্ট্রিট ফুড

ছবিঃ স্ট্রিট ফুড
দিল্লি থেকে কালকা
ভোর ৫ঃ৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন থাকায় মোবাইলে ৩ঃ৪৫ মিনিটেই এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম।পাহাড়গঞ্জ থেকে আামাদের স্টেশনে এস রোহিলা যেতে ৪০ মিনিটের দূরত্ব।তাই সতর্কতা সরূপ একটু আগেই উঠেছি।ব্যাগ গুছিয়ে সবাই হোটেলের চেক আউট করে ট্যাক্সি চড়ে এস রোহিলার দিকে রওয়ানা করলাম। এই ভোরেও দেখলাম দিল্লির এই অংশটি বেশ সচল। সম্ভবত ট্রেনের সূচির জন্য এমন কর্মচঞ্চলতা।দিল্লির হাড় কাঁপানো প্রচণ্ড শীত আমাদেরকে একটু কষ্টই দিচ্ছিলো। এস রোহিলা স্টেশনে এসে আমাদের হিমালয়ের এক্সপ্রেসের নির্ধারিত প্লাটফর্ম জেনে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই সময়ে স্টেশনের গরম কফি খেতে মন্দ লাগেনি।



প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।
সর্বাধিক পঠিত
-
ইতিহাস4 years ago
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎশক্তিদের ভূমিকা
-
অন্যান্য3 years ago
উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়ন
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
দ্রোহ -প্রেম ও যৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস (পর্ব ০১)
-
শিল্প-সাহিত্য3 years ago
শব্দশ্রমিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
-
বাংলাদেশ4 years ago
বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
-
শিল্প-সাহিত্য4 years ago
প্রকৃতি,প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা
-
ইতিহাস3 years ago
সম্রাট শাহজাহানঃ সৌন্দর্য্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে